অসামান্য প্রেমের গল্পঃ অরিন্দম ঘোষ ( ১৯৪১-২০১২)

arindam and jaya

পূর্ব কথাঃ
আমার মামা অরিন্দম ঘোষ (১৯৪১-২০১১) দু হাজার এগারোর ১৩ এপ্রিল আমাদের ছেড়ে চলে যান। তার কিছুদিন আগেই ইমেল করে এই লেখাটি আমাকে ও আরো কিছু বন্ধুদের পাঠান। নিজে অভ্র ডাউনলোড করে নিউ জার্সিতে বসে লেখাটি লিখেছিলেন, ক্যান্সারের ভয়াল আক্রমণের ভেতরেই। কেন? নিজের প্রেমের গল্পটি লিপিবদ্ধ করে যাবেন বলে…সেই গল্প একটা রিয়েল লাভ স্টোরি। আপনাদের জন্য। এক বিন্দু এডিট না করেই দিলাম। যশোধরা রায়চৌধুরী।

 

 

 

দেবী  দর্শন

আমার  লেখার  ব্যাকগ্রাউন্ড :

অনেক  দিনের,  একটা  মনের  ভেতর  চেপে  রাখা  ইচ্ছে,  এত  দিনে  মনে  হয়  পূর্ণ  হ’তে  যাচ্ছে ।  আমার  এই  ইচ্ছেটি  কোনো  জটিল  ইচ্ছে  নয়,  অতি  সহজ  সরল  ইচ্ছে, আমার  জীবনের  একটি  বিশেষ  ঘটনা,  একটি  বিশেষ  অভিজ্ঞতার  ঘটনা,  নাঃ  ঠিক  ক’রে  বলতে  ‌গেলে,  “একটি  বিশেষ  আনন্দের  অভিজ্ঞতার  ঘটনা”  সকলকে  জানানো ।  এরকম  একটা  ঘটনা  যা  আমার  জীবনকে  আনন্দে  ভরিয়ে  দিল,  তা  আমি  ছাড়া  আর  সকলের  অজানা  থাকবে  এ  ভাবলেই  মনটা  খারাপ  হ’য়ে  যায় ।   আমার  জীবন  খুব  যে  “অসুখের”  ছিল  তা  নয়,  দেখতে  গেলে  মোটামুটি  সুখেরই  ছিল,  কিন্তু  এই  ঘটনাটি  আমার  জীবনে  এক  আনন্দধারার  সূত্রপাত  করল  যে  ধারা  এখনো  বর্ত্তমান ।  যারা  কখনো  ভালবেসেছেন  কাউকে  বা  যারা  এখন  ভালবাসায়  হাবুডুবু  খাচ্ছেন  বা  যারা  নানাবিধ  কর্তব্যের  তাড়নায়  ভালবাসার  বিলাসিতায়  কখনো  মন  দেয়ার  সময়  পাননি,  তাদের  সকলের  সঙ্গে  যদি  আমার  এই  বিশেষ  আনন্দের অভিজ্ঞতার  কথা  ভাগ  ক’রে  নিতে  পারি  তাহ’লে  আমার  আনন্দটা  সম্পূর্ণ  হয় ।    কোনো  আনন্দের  দিনে  বান্ধুবান্ধবকে  নিয়ে  পার্টি  করার  মতো  আরকি !  দুটি  বাধা  ছিল  এতদিন আমার এ  কাজ  ক’রতে, একটি  আমার  হাতের  লেখা  আর  দ্বিতীয়টি  আমার  লেখার  হাত ।  আমার  স্কুলের  বাঙ্গলার  মাস্টার  মশাই  বলেছিলেন  তোমার  হাতের  লেখা  আর  লেখার  হাত  দুটোরই  এক  অবস্থা,  কোনোটাই  পাতে  দেয়া  যায়  না ।  আমার  এক  বন্ধু  আমার  এই  দুঃখের  কথা  শুনে  আমাকে  জানাল,  “দ্বিতীয়  বাধাটি  আজকাল  আর  কোনো  বাধাই  নয়,  ‘পাতে’  দেয়া  রেওয়াজ  এখন  উঠে  গেছে  এখন  ‘বুফের’  যুগ,  তোমার  জিনিষ  তুমি  সাজিয়ে  দেবে,  যার  নেবার  ইচ্ছে  সে  নেবে,  ইচ্ছে  নাহ’লে  নেবে না,  পাতে  দিয়ে  পাত  নষ্ট  করার  ব্যাপার  নেই ,  শুধু  জিনিষটা  যেন  ভাল  দেখতে  হয়  সেটা   খেয়াল  রাখতে  হবে ।  মানে  তোমার  ‘হাতের  লেখার’  একটা  বন্দোবস্ত  ক’রতে হবে ।”  বন্ধুবর  চ’লে  যাওয়ার  পর  আমি  যখন  আমার  হাতের  লেখা  নিয়ে  চিন্তায়  মশগুল  তখন  যাকে  বলে  একটি  অলৌকিক  ঘটনা  ঘটলো ।  হটাৎ  অভ্রকে  দেখলাম  আমার  জানালায়  উঁকি  দিচ্ছে ।  আমি  অভ্রর  নাম  শুনলেও ঠিক  চিনতাম  না  ওকে ।  আপনাদের  অনেকের  সঙ্গে  অভ্রর  নিশ্চই  পরিচয়  আছে ।  ওর  দিকে  তাকাতেই  ও  আমার  মনের  কথা  বুঝে  গেল,  জানালার  ওদিক  থেকেই আমাকে  একটি  চাবির  ডালি  উপহার  দিয়ে  বল্‌ল, “এই  চাবির  ডালিটি  আপনি  নাবিয়ে  নিন,  আপনার  হাতের  লেখার  বন্ধন  থেকে  এই  চাবির  ডালি  আপনাকে  উন্মুক্ত  করবে ।”    সত্যি  এ যেন  একেবারে  যাদু  ভরা  চাবির  ডালি,  আমার মতো  আগের   যুগের  মানুষেরও  কোনো  অসুবিধে  হ’ল  না,   নিজের   হাতে  লেখার আর  কোনো  ব্যাপারই  রইল  না  ।  রইল  খালি  অভ্রের  জন্য  আমার  অনেক  আশীর্বাদ ।

আমার  আর  লেখায়  কোনো  বাধা  নেই,  এখন  আমি  নিশ্চিন্তে  লিখতে  পারি ।  আপনারাও  নিশ্চিন্তে  পড়া  আরম্ভ  করতে  পারেন,  আমার  এ  লেখা  অতি  ছোট,  কারণ  যে  ঘটনার  কথা  লিখতে  যাচ্ছি  সেটি  পুরো  এক  দিনেরও  ঘটনা  নয়,  চোদ্দ  থেকে  ষোল  ঘণ্টার  হবে ।  একদিন  বিকেল  সন্ধ্যের  সন্ধিক্ষণ  মানে  ধরুন  বিকেল  চারটে-পাঁচটার  থেকে  পর  দিন  সকাল  সাতটা  কি  আট্‌টা  পর্যন্ত  হবে ।  আমার  এক  বন্ধুর  সঙ্গে  গড়িয়াহাট  রোডের  এক  বাস  স্টপে  নেবে  সেই  মেয়েটির  সঙ্গে  দেখা  হওয়ার  থেকে  পর  দিন  দেবী  দর্শন  অবধি  আমার এই ঘটনা ।  তাহ’লে  নির্ভয়ে  আরম্ভ  করলাম – – –

 

 

 

 

আমার  ব্যাক্‌গ্রাউন্ড :

মধ্য  কোলকাতার  ছোট্টো  একটি  পাড়া ।  বারো  চোদ্দ  ফুট  চওড়া  একটি  গলি,  বড়ো  জোর একশো  ফুট  ঢুকে  এসেছে  বড়ো  রাস্তা  থেকে,  আর  গলির  শেষে  আছে  একটি  খোলা  জায়গা,  চল্লিশ  বাই  পঞ্চাশ  ফুট  হবে ।  এই  গলি  আর  খোলা  জায়গাটিকে  ঘিরে  রয়েছে  বেশ  কিছু  দোতলা  আর  তিনতলা বাড়ী,  তার মধ্যে একটি  হ’ল পুরোনো  আমোলের  বিশাল  ফ্ল্যাট  বাড়ী ।  এ পাড়ায়  ঢোকা বা বেরোবার  রাস্তা  খালি  ঐ একটি  গলি ।  তাই  এ  পাড়ায়  বেপাড়ার  ছেলেমেয়ে  বা  লোকজন  খুব  একটা  কেউ  ঢোকে  না ।   সব বাড়ীর  বাসিন্দারা  মিলে  মিশে  থাকে,  যেনো  একটি  বড়ো  ফ্যামিলি ।

এই  পাড়াতেই  আমার  জন্ম  আর  এই  পাড়াতেই  কেটেছে  আমার  জীবনের  প্রথম  তিরিশটা  বছর  ।  অনেক  আনন্দ  পেয়েছি  অতি  তুচ্ছ  কারণে  আবার  অনেক  দুখঃও  পেয়েছি             অতি  তুচ্ছ  ব্যাপারে,  সেই  সব  বয়েসের  কথা  ভাবতে  বেশ  লাগে,  তালেগোলে  বেশ  সুখেই  কেটেছে  ঐ  দিনগুলি ।

আমার  স্কুল  হেটে  যেতে  সময়  লাগতো  বড়ো  জোর  দশ  মিনিট ।  নীচু  ক্লাসে  যখন  পড়ি  তখন  আমার  জগৎ  ছিল  স্কুল  আর  ঐ  পাড়া ।  তবে  স্কুলে  গিয়ে  পড়ার  চেয়ে  পাড়ার  বন্ধুদের  সঙ্গে  খেলাটাই  আমার  কাছে  বেশী  আকর্ষণীয়  ছিল ।  প্রধান  খেলার  যায়গা  ছিল  পাড়ার মাঝখানের  খোলা  যায়গাটি  আর  ফ্ল্যাট  বাড়ীর  ছাত ।  ডান্ডাগুলি,  মারবেল,  লাট্টু,  আর  ইটের  উইকেট  ক’রে  ক্রিকেট  খেলা  হ’ত  নীচে,  গাদী  আর  হাডুডু  খেলা  হ’ত  ফ্ল্যাট  বাড়ীর  ছাতে ।  তখন  পাড়ায়  আমার  বয়সী  সব  ছেলে মেয়েই  আমার  বন্ধু  ছিল ।  খেলাধূলো  সবই  হ’ত  সবাই  মিলে ।

আস্তে  আস্তে  সবাই  উচু  ক্লাসে  উঠতে  লাগলাম ।  এক  সময়  খেয়াল  হ’ল  ছেলেদের  আর  মেয়েদের  দুটি  দল  হ’য়ে  গেছে,  নিজেদের অগোচরে,  কোনো  রাগারাগি  বা  ঝগড়াঝাটি  ছাড়াই ।  মেয়েদের  দেখতাম  নিজেদের  মধ্যেই  গল্প  করতে  ব্যস্ত,  আমরা  ছেলেরা  ওখানে  গিয়ে  পরলেই  কথা বন্ধ  খানিক ক্ষণের  জন্য ।  আমরা  ছেলেরাও  যেন  তখন  নিজেদের  মধ্যে  কথা  বলতেই  বেশি  আগ্রহী  হ’য়ে  পরলাম ।  কথার কি অভাব ?  লুকিয়ে  দেখে  আসা  কোনো  সিনেমা  বা  বিশেষ  কোনো  বই  নিয়ে  কথা ।  কোন্‌  হিরোইন্‌কে  কার  বেশি  ভাল  লাগে,  কোন্‌  পাড়ার  কোন্‌  মেয়েটি  বেশি  সুন্দর  দেখতে  সেই  নিয়ে কথা ।  নিজেদের  সব  নতুন  নতুন  জীবনের  অভিজ্ঞতা  নিয়ে  কথা ।

এছাড়া  অনেক  সিরিয়াস্‌  কথাও  হ’ত  মাঝে  মাঝে  আমরা যখন  স্কুলের  একেবারে  ওপরের  ক্লাসে  পড়ি ।  এই  যেমন  সংস্কারের কথা ।  ধর্মীয়,  সামাজিক,  আর  কিছু  গ্রাম্য  সংস্কার,  যার  বিধিনিষেধ  আমাদের  স্বাধীনতায়  যেন  বাড়ো  বেশি  হস্তক্ষেপ  করছিল  তখন ।  মনের  ভেতর  যেন  সংস্কারের  সব  উচু  উচু  দেয়াল  তৈরী  হ’য়ে  ছিল ।  আমার  প্রায়েই  মনে  হ’ত  এই  দেয়াল  গুলো  ভাঙ্গতে  হবে ।  সব  ছেলেই  যে  আমার  সঙ্গে  একমত  ছিল  তা  নয় ।  তবে  ক’একজন  সঙ্গী  পেয়েছিলাম  যারা  আমার  সঙ্গে  ঐ দেয়াল  ভাঙ্গায়  উৎসাহী  ছিল ।  মাঝে মধ্যে  বেরিয়েও  পড়েছি  ঐ  দেয়াল  ভাঙতে ।  বেরোবার  আগে  কত  দিনের  তোড়জোড়  আর  ভাঙার  পর  সেকি  উত্তেজনা !  তার  রেশ  চলেছে  অনেক  দিন  ধ’রে ।  স্কুলের  জীবনে  খুব  বেশি  দেয়াল  ভাঙা  হ’য়ে  ওঠে  নি,  বাকী  গুলো  ভাঙতে  ভাঙতে  কলেজ  জীবনের  মাঝামাঝি  পৌছে  গিয়েছিলাম ।

আমাদের  সময়  স্কুলের  কোর্স  ছিল  দশ  বছরের,  তারপর  দু  বছর  সকলেরই  জেনারেল কলেজে  যেতে  হ’ত,  তারপর  যার  যেরকম  ইচ্ছে  জেনারেল  কলেজে  থাকতে  পারত  বা  প্রফেশনাল  কলেজে  যেতে  পারতো ।  আমি  দ্বিতীয়  দলে  ছিলাম ।

 

 

ঘটনার  ব্যাক্‌গ্রাউন্ড :

কলেজে  যখন  প্রথম  ঢুকলাম   নিজেকে  বেশ  বড়  মনে  হওয়া  আরম্ভ  হ’ল  তার  কারণ  বোধহয়  স্কুলের  সময়ের  চেয়ে  ঘোরাফেরার  আর  স্বাধীনতার  গন্ডী  বেড়ে  যাওয়া ।  স্কুলের  শেষের  দিক  থেকেই  মেয়েদের  প্রতি  বেশ একটা  ইন্টারেস্ট্‌  গ্রো  করা  শুরু  হ’য়েছিল,  মানে  বল্‌তে  পারেন  তখন  থেকেই  মনে  একটু  প্রেম-প্রেম  ভাবের  উদয়  হ’য়েছিল ।  আশ্চর্যের  ব্যাপার  পাড়ার  কোনো  মেয়ে  বন্ধু  আর  তখন  মনে  যায়গা  পেল  না ।  এর  দুটি  কারণ  হ’তে  পাড়ে,  এক  ছোটবেলা  থেকে  একসঙ্গে  খেলাধুলো  ক’রে  ভাই  বোনের  সম্পর্ক  হ’য়ে  গিয়েছিল  অথবা  ওরা  “গেঁও  যোগী  ভিখ্‌  পায়না”র  দলে  পড়ে  গিয়েছিল ।  তাই   কলেজে  ঢুকে  খুব  উৎসাহ  পেতাম  যখন  এদিকে  ওদিকে  নতুন  নতুন মেয়েদের  সঙ্গে  আলাপ  হওয়া  শুরু  হ’ল  ।  সবই  কলেজে  পড়া  মেয়ে,  কিছু  নিজেদের  কলেজের  আর  কিছু  অন্য  কলেজের ।  এখানে  ওখানে  তাদের  সঙ্গে  দেখা  ক’রে  দল  বেধে  আড্ডা  দিয়ে  আর  পড়াশুনোর  ব্যাপারটা  ধামাচাপা  দিয়ে,  দিন গুলো  বেশ  ভালোই  কাট্‌ছিল  ।

কলেজে  বেশ  ক’এক  দিন  হ’য়ে  গেছে,  মোটামুটি  অভ্যস্ত  হ’য়ে  গেছি  কলেজ  জীবনের  সঙ্গে,  এরকম  সময়  একদিন  এক  বন্ধুকে  নিয়ে  আমার  বেরোবার  কথা ।  তাকে  ডাক্‌তে  গেছি  তার  বাড়ী,  বিকেলের  দিকে ।   গিয়ে  শুনলাম  সে  বাড়ী  নেই ।  বন্ধুর  মা  আমাকে  জানালেন  যে  বন্ধু  একটু  পড়েই  এসে  পরবে  আর  বন্ধু  ব’লে  গেছে  আমি  যেন  একটু  অপেক্ষা  ক’রি ।  বন্ধুর  মা  যখন  আমার  সঙ্গে  কথা  বলছিলেন  একটি  ছোট্ট  মেয়ে  পাশে  এসে  দাড়িয়ে  ছিল ।  মুখের  আদল  দেখে  বুঝলাম  মেয়েটি  আমার  বন্ধুরই  ছোটো  বোন ।  মা  মেয়েটিকে  ব’ল্‌লেন,  “দাদার  বন্ধুকে  ঘরে  নিয়ে  বসাও  আমি  এখনই  আস্‌ছি” ।  মেয়েটি  আমাকে  ভেতরে  বসার  ঘরে  নিয়ে  গিয়ে  বসালো  আর  নিজে  আমার  সামনের  চেয়ারে  বোস্‌লো ।  আমি  খেয়াল  ক’রে  ছিলাম  যে  মেয়েটি  বন্ধুদের  সঙ্গে  খেলা  ছেড়ে  মার  পাশে  এসে  দাড়িয়ে    ছিল,  তাই  আমি  ব’ল্‌লাম,  “তুমি  ব’স্‌লে  যে ?  তুমি  খেলতে  যাবে  না ?”  উত্তর  পেলাম, “না,  মা  না  আসা  অবধি  আমি  আপনাকে  কম্পানি  দেবো” ।  উত্তর  শুনে আমি  ‘থ’, খানিকক্ষণ  মেয়েটিকে  শুধু  দেখলাম ।  দেখে  ম’নে  হ’ল  বড়ো  জোর  ক্লাস  সিক্সএ  পড়ে ।  ঐ  বয়সী  এত  সপ্রতিভ  মেয়ে  আমি  কখনো  দেখেছি  ব’লে  মনে  পড়ে  না ।  গভীর  চোখ,  মিষ্টি  মুখ,  সহজ  সরল  ভাব,  আমার  খুব  ভালো  লাগলো ।  আমি  ব’ল্‌লাম, “তোমার  বন্ধুরা  অপেক্ষা  কর্‌ছে ।  আমাকে  ক’একটা  কাগজ  বা  পত্রিকা  দিয়ে,  ওদের  সঙ্গে  খেল্‌তে  যাও,  আমি  তোমার  মাকে  ব’লে  দেবো  যে  আমিই  তোমাকে  যেতে  ব’লেছি” ।  মেয়েটি  যেন  হাঁফ  ছেড়ে  বাঁচল,  চেয়ার  থেকে  উঠে,  দু তিনটি  পত্রিকা  আমার  হাতে  দিয়ে,  একটু  মিষ্টি  হেসে  ঘড়  থেকে  বেড়িয়ে  গেল ।  বন্ধুর  মা  যথা  সময়ে  এলেন  চা  জলখাবার  নিয়ে,  আমার  বন্ধুও  ফিরে  এল  প্রায়  একই  সময় ।  তার  একটু  পড়ে  আমি  বেড়িয়ে  পরলাম  বন্ধুকে  নিয়ে ।

আপনারা  আবার  ভেবে  নেবেন  না  যে  আমি  সেদিনই  মেয়েটির  প্রেমে  পড়ে  যাই ।  অতো  ছোট্ট  একটি  মেয়ের  সঙ্গে  প্রেম  করার  তখন  কোন  প্রশ্নই  উঠে  না ।  তবে  এটা  ঠিক  যে  অনেক  সময়ই  এই  মেয়েটির  মিষ্টি  মুখটি  আমার  মনে  ভেসে  উঠেছে  তখন ।

কিছুদিনের  মধ্যে  এই  মেয়েটির  বাড়ীর  সকলের  সঙ্গেই  আমার  পরিচয়  হ’য়ে  গেল,  পড়ে  বেশ  ঘনিষ্টই  হ’য়ে  গিয়েছিলাম  ওই  বাড়ীর  সঙ্গে ।  কলেজের  দিনগুলি  আর  বছরগুলি  হৈহৈ  করে  কেটে  হাচ্ছিল ।  দেখ্‌তে  দেখ্‌তে  জেনারেল  কলেজ  ছেড়ে  প্রফেশনাল  কলেজে  গেলাম,  তাও  প্রায়  শেষ  হ’য়ে  গেল ।  ওদিকে  মেয়েটিও  আর সেই  নিচু  ক্লাসে  নেই,  স্কুলের  ওপর  দিকের  ক্লাসে  উঠে  এসেছে ।  আমার  দ্বিতীয়  কলেজটি   কোলকাতার  একটু  বাইরে  হওয়ায়  কোলকাতায়  ঘুরে  বেড়ান  এমনিই একটু  কম  হ’চ্ছিল,  তায়  কলেজের  শেষের  দিকে  বই  খাতা  একটু  বেশী  খুলতে  হ’ত  ব’লে  কোলকাতা  আসা  আরও  কমে   গিয়েছিল ।  জিনিষটা  দাড়িয়েছিল  যে  ন’মাসে  ছ’মাসে  একআধ্‌বার  দেখা  হয়েছে  আমার  আর  মেয়েটির ।

 

যত  কমই  দেখা  হোক  আমি  বেশ  বুঝতে  পারছিলাম  যে  দিনে  দিনে  মেয়েটির  প্রতি  আমার  আকর্ষণ  বেড়ে  যাচ্ছে ।  আপাত  দৃষ্টিতে  আমাদের  সম্পর্কের  কোন  পরিবর্ত্তন  হয়  নি,  যথা  পূর্বম্‌  তথা  পরম্‌ ।  মেয়েটির  ব্যবহার  সর্ব্বদাই  স্বভাবতঃ  সংযত ।  মেয়েটির  প্রতি  আমার  ব্যবহার  যেন  কখনও  ক্যাসুয়্যালের  বাইরে  না  যায়  সে  সম্বন্ধে  আমি  খুবই  সচেতন  থাকতাম ।  মেয়েটির  ব্যবহার  যতই  সংযত  হোক,  মনের  ভেতর  আমি  জানতাম  যে  মেয়েটি  আমার  সান্নিধ্য  পছন্দই  করে ।  ইতিমধ্যে  একটি  দুটি  মেয়ের  আমি  যে  বেশ  প্রিয়  হ’য়ে  উঠেছি  তা  বুঝতে  পারতাম,  তাদেরও  আমার  বেশ  ভালই  লাগত,  তাদের  সঙ্গে  হাসি  ঠাট্টা  ক’রে  সময়  কাটাতেও  বেশ  লাগত,  কিন্তু  সেইসব  সম্পর্ক  বেশী  দূর  এগয়  নি ।  কিছুর  একটা  অভাব  ছিল,  তাই  একটু  গিয়েই  মিলিয়ে  গেছে ।  এই  সব  সম্পর্ক  মিলিয়ে  যাওয়ার  কারণ  আমি  জানতাম,  জানতাম  কিসের  অভাব,  অভাব  হ’চ্ছে  আকর্ষণের,  জানতাম  যে  ওই  আকর্ষণ  আমার  আছে  খালি  ওই  একটি  মেয়ের  প্রতি ।

ভাবছেন,  আমার  যদি  মেয়েটিকে  এত  ভাল  লাগত  আর  আমি  যদি  জানতাম  মেয়েটিও  আমাকে  অপছন্দ  কর্‌ত  না,  তাহ’লে  আর  বাধা  কি  রইল, আমি  তো  এগোলেই  পারতাম ।  বাধা  ছিল,  বড়ো  বড়ো  দুটি  বাধা ।  দুটিই  হ’ল  সেই  দেয়াল,  সেই  সংস্কারের  দেয়াল ।  গ্রাম্য,  সামাজিক,  ধর্মীয়,  যত  রকম  সংস্কারের  দেয়াল  ছিল  মনের  মধ্যে,  সব  ভেঙ্গে  ফেলেছিলাম  ততোদিনে,  কিন্তু  খেয়াল  করিনি  যে  কবে  নিজেই  মনের  মধ্যে  দুটি  নতুন  দেয়াল  তৈরি  করেছি,  কেউ  সে  দেয়ালগুলি  আমার  ওপর  চাপিয়ে  দেয়  নি ।  এ  দেয়ালগুলি  নিয়ে  কখন  কারুর  সঙ্গে  আলোচনাও  হ’য়  নি  আমার ।  তাহ’লে  আপনাদের  কাছে  আজ  বলি ।  এক নম্বর  দেয়াল, – “কোন  স্কুলের  মেয়ের  সঙ্গে  প্রেম  করা  নিষিদ্ধ” ।  আমার  তখন  একটা  ধারণা  ছিল  যে,  মেয়েদের  ব্যক্তিত্ব  ঠিক  গড়ে  ওঠে  না  স্কুলে  পড়ার  সময় ।  কি  ক’রে  জানিনা   আমার  এ  ধারণা  জন্মে  ছিল  যে,  নীচু  ক্লাসের  মেয়েদের  সঙ্গে  ভাব  ক’রতে  লাগে  দুটি  লজেন্স,  আর  উঁচু  ক্লাসের  মেয়েদের  জন্য   লাগে  দুটি  ক্যাড্‌বেরী ।  আগেই  আমি  ব’লে  রাখি  আপনাদের,  আমার  কিন্তু  এ  ধারণা  এখন  আর  নেই ।  আমার  পরিচিত  বেশ  কিছু  সুখী  পরিবার  আছেন  যাদের  ভালবাসা  শুরু  ঐ  স্কুল  থেকেই ।  তাই  কেউ  দয়া  ক’রে  আর  আমার  ওপর  রাগ  রাখবেন  না,  ছোট  বেলার  ঐ  ধারণার  জন্য ।  দ্বিতীয়  নম্বর  দেয়াল, – “বন্ধুর  বোনের  সঙ্গে  প্রেম  করা  নিষিদ্ধ” ।  এ  ব্যপারে  আমার  ধারণা  খুব  পরিস্কার  ছিল ।  আমার  ধারণা  ছিল,  (সত্যি  ব’লতে  কি  সে  ধারণা  এখনও  আমার  মন  থেকে  পুরো  যায়  নি),  যাদের  কেউ  জোটে  না,  তারাই  বন্ধুত্বের  সুযোগ  নিয়ে,  বাড়ীতে  ঢুকে  বাড়ীর  মেয়েদের  সঙ্গে  “ছুক্‌-ছুক্‌”  করে  প্রেম  করে ।  আমি  নিজেকে  ঐ  দলের  ব’লে  কখন  মনে  করিনি  তাই  এই  দেয়ালের  সৃষ্টি ।

 

 

 

সেই  ঘটনা – চোদ্দ  থেকে  ষোল  ঘণ্টার  ঘটনা :

জুলাইয়ের  শেষের  দিক ।  আমাদের  ফাইনাল  পরীক্ষা  হ’য়ে  গিয়ে  রেসাল্টও  বেরিয়ে  গিয়েছে ।  কাজের  ব্যপারে  এদিক  ওদিক  কিছু  চিঠি  পাঠানো  আর  এখানে  ওখানে  কিছু  যায়গায়  দেখা  করা  ছাড়া  আর  কোন  কাজ  নেই  খুব  একটা ।    বন্ধুদের  সঙ্গে  আড্ডা  মেরেই  কাটছিল  বাকী  সময়টা ।  জুলাই  মাস  হ’লেও  বৃষ্টির  প্রভাবে  গরমটা  বেশী  ছিল  না  তখন ।  এরকম  একদিন   গড়িয়াহাটের  এক  চক্রে  আড্ডা  মারতে  গিয়েছিলাম ।  সেখান  থেকে  আমি  আর  এক  বন্ধু  বেড়িয়ে  পড়েছিলাম  আরেক  বন্ধুর  খোঁজে ।  একটি  বাসে  উঠে  পরলাম,  গড়িয়াহাট  রোড  ধ’রে  একটু  গিয়ে  বাস  থেকে  নামলেই  বন্ধুর  বাড়ী ।  তখন  ঠিক  সন্ধ্যে  হবো  হবো  করছে  বা  হ’য়েছে ।  বলতে  পারা  যায়  বিকেল  সন্ধ্যের  সন্ধিক্ষণ ।  কলকাতার  রাস্তার  লাইট্‌  গুল  সব  আস্তে  আস্তে  জ্বলে  উঠ্‌ছে,  অথচ  দিনের  আলোর  একটু  ম্লান  রেশও  আছে ।  এমন  সময়  আমাদের  বাস  এসে  দাড়াল  আমাদের  নির্দিষ্ট  বাসস্টপে ।  আমরা  বাস  থেকে  নামলাম ।  বাসের  জন্য  ফুটপাথে  অপেক্ষমান  ক’এক  জন  আমাদের  ছেড়ে আসা বাসে  উঠে  গেলেন,  বাকিরা  দাড়িয়ে  রইলেন  অন্য  বাসের  অপেক্ষায় ।  আমরা  ফুটপাথের  দিকে  এগোতে  লাগ্‌লাম,  আমি  বোধহয়  একটু  অন্যমনস্ক  ছিলাম,  সামনে  কারা  দাড়িয়ে  আছে  তাদের  খুব  একটা  খেয়াল  করিনি । আমার  বন্ধু  যেন  তখন  আমাকে   কি  একটা  বলে  যাচ্ছিল  পাশ  থেকে  সে  কথাও  আমি  খেয়াল  করিনি ।  ফুটপাথে  এক  পা  রেখে  সাম্‌নে  তাকাতেই আমার  সব  ইন্দ্রিয়  যেন খানিক্ষণের  জন্য  বন্ধ ।  আমার  সামনে  তখন   খালি  একটি মুখ ।  আঁধ অন্ধকারের  মধ্যে  জ্বলজ্বল  করছে  খালি  একটি মুখ ।  এই  মুখটি  আর  কারো  নয়  সেই  মেয়েটির ! ফুটপাথের  শেষে  একটি  দেয়ালের  সামনে  দাঁড়িয়ে আমারি  দিকে  তাকিয়ে মৃদু  হাসি  মুখে  হাত  নারছে । কতক্ষণ  চুপ  ক’রে  তাকিয়ে  ছিলাম  মনে  নেই্‌,  কিন্তু মনে  আছে  টান-টান  ক’রে  পেছোনে  আঁচরানো  চুলে  একটি  ছোট্টো  বিনুনি  কাঁধের পাশ  দিয়ে  সামনে  চ’লে  এসেছে,  মনে  আছে  একটি  সাদা  ব্লাউস  আর  চওড়া  পাড়ের  সাদা  সাড়ী (সম্ভবত  তাড়াতাড়ির  সময়  মার  এই  সাড়ীটিই  সামনে ছিল ),  পড়া সোজা  হ’য়ে  দাঁড়ানো  চেহারাটি,  মনে  আছে  হাতের  সেই  ছোট  ব্যাগটি,  আর পায়ের  সেই  ডাব্‌ল  স্ট্র্যাপ্‌  চটি  জোড়া,  আর  মনে  আছে  সেই  মৃদু  মিষ্টি  হাসিটি  যা  বাকী  সব  কিছুকে  ম্লান  ক’রে  দেয়,  যার  স্মৃতিতে  আমি  এখনো  বিহ্বল  হয়ে  যাই ।

কাঁধে  বন্ধুর হাতের  ঝাকুনিতে  আমার  সম্বিত  ফিরে এলো,  বন্ধু  বল্‌ছে  শুন্‌লাম, “কিরে  তোর  কি  হ’ল,  চুপ  ক’রে  আছিস  কেনো,  কখন  থেকে  বলছি  ঐ  মেয়েটি  তোকে  দেখে  হাত  নাড়ছে,  আর  তুই  চুপ  ক’রে  দাড়িয়ে  আছিস !” আমি  আর  কথা  না  বাড়িয়ে  সামনে  এগোনো শুরু  করলাম  ।  দেখলাম  মেয়েটিও  আমার  দিকে  এগিয়ে  আসছে । সামনা সামনি  পৌছুতে  পৌছুতে  আমি  আমাকে সামলে  নিয়েছি, সব  কিছু  আবার  ‘আন্ডার  কন্ট্রোল’, ‘বিহ্বলতা’  কি  জিনিষ  আমার  আর  জানা  নেই ।

আমারা  দুজনই  দুজকে  এখানে  এসময়ে  দেখে  একটু  আশ্চর্য কারণ,  এটা  কারুরই  পাড়া  নয় ।  আমাদের কথাবার্তা  হ’ল  মোটামুটি  এরকম :

আমি – ” আরেঃ, তুমি  এখানে এই  সময় ?”

মেয়েটি – ” আমি এসেছি আমাদের  কলেজের  পাড়া  দেখতে,  বন্ধুর  সঙ্গে ।”

আমি –  “তোমার কলেজ ?  তুমি অল্‌রেডি  কলেজে  ভর্তি হ’য়ে  গিয়েছ ?  ওহোঃ  আমি তো ভুলেই  গিয়েছিলাম  যে  এবার  তোমার  হায়ার সেকেন্ডারি  দেবার  কথা ছিল ।”

মেয়েটি –  “তা  আপনিতো  অনেক  দিন  আমাদের বাড়ী  আসেননি,  তাই  নিশ্চই  ম’নে  নেই ।  আমার  কিন্তু  ম’নে  আছে  যে  আপনার  এবার  ফাইনাল  পরীক্ষা  ছিল ।”

আমি –  “ফেলে  দিলেতো   তুমি  আমায়  লজ্জায়ে !  সত্যি  অনেক  দিন  যাওয়া  হয়নি  তোমাদের  সঙ্গে  দেখা  কর্‌তে ।  আমার  ফাইনাল  পরীক্ষাটাও  কিন্তু  সত্যিই  না  যাওয়ার  একটা  কারণ ।  ক’দিনের  মধ্যেই  তোমাদের  বাড়ী  যাব ।  মাসীমা,  মেশোমশাই  সব  কেমন  আছেন ?”

মেয়েটি –  “সবাই  ভালো  আছেন,  আপনি  যখন  আসবেন  কথা  হ’বে ।”

আমি –  “তা  কলেজের  পাড়া  তো  দে‌খ্‌লে,  এখন  বাড়ী  ঠিক্‌ঠাক্‌  পৌছুতে  পাড়বে  ?”

মেয়েটি –  “আচ্ছা  আপ্‌নি  কি  আমাকে  এখনো  সেই  ক্লাস্‌  সিক্সে  পড়া  স্কুলের  মেয়েটিই  ভাবেন ?  আমরা  ঠিক  বাড়ী  পৌছে যাব,  কোনো চিন্তা  ক’রবেন  না ।”

আমার  বন্ধু  ও মেয়েটির বন্ধু  সকলের সঙ্গে  আলাপ  পরিচয়  হ’তে  হ’তেই, মেয়েটির  বাড়ীর  রুটের  বাস  এসে গেল,  একটু  হেসে,  “আজ  তা  হ’লে  আসি”,  ব’লে  বন্ধুর  সঙ্গে  বাসে  উঠে  চ’লে  গেলো  সে ।  আমরাও  আমাদের  গন্তব্য স্থলের  দিকে  পা  বাড়ালাম ।

সেদিন  আমার  আড্ডাচক্রে  বিশেষ  মন  লাগল  না,  কোথায়  যেন  একটা  তার  ঠিক  সুরে  বাঁধা  ছিল  না । অন্য  দিনের চেয়ে  একটু  তাড়াতাড়িই  উঠে  পরলাম আড্ডা  ছেড়ে । গড়িয়াহাট  থেকে  একটা  ডাব্‌ল  ডেকার  বাসে  চেপে  বাড়ীর  দিকে  রওণা  হ’লাম ।  এখানে  ব’লে  রাখি, তখনকার  মানে  সিক্সটিসের  কোলকাতার  স্টেট্‌  বাস  গুলোর  কিন্তু  এখনকার  মতো  অবস্থা  হয়নি,  ডাব্‌ল  ডেকার  গুলো  তো  রীতি মতো  লণ্ডনের  ডাব্‌ল  ডেকারের  সঙ্গে  কম্পিট্‌  ক’রতে  পারত  পরিচ্ছন্যতায় । রাত  ন’টায়  ভীড়ও  ক’মে  আস্ত  কোলকাতার  বাস  ট্রামে । এ রকম  একটি  বাসে  উঠে  পরলাম  আমি ।  বাস  প্রায়  খালি,  দো তলায়  চার পাঁচ  জনের  বেশী  যাত্রী  নেই ।  আমি  একদম  সামনের  একটি  সীটে  গিয়ে  বস্‌লাম ।  ওপড়ের  সব  জান্‌লা  গুলো  খোলা ।  রাস্তায়  গাড়ী  তখন কমে  এস্‌ছে,  আমাদের  বাস  ড্রাইভার  সাহেবও  চান্‌স  পেয়ে  খুব  আনন্দে  স্পিড্‌  দিলেন  বাড়িয়ে ।  সাম্‌নের  খোলা  জান্‌লা  দিয়ে  হুহু  ক’রে  হাওয়া ঢু্‌কতে লাগ্‌লো ।  আমার  মনও  সেই  হাওয়ার  সঙ্গে  তাল  রেখে  চলতে  লাগলো সেই  গতিতে ।  বার বার  মনে  হ’তে  লাগ্‌লো  “স্কুলে  পড়া  সংস্কারের  দেয়ালের  বাধা”  এখন  আর  নেই ।  কিন্তু  অন্যটি ?  সেতো  এখনও  চীনের  প্রাচীরের  মত  দণ্ডায়মান । পাপ  পুণ্য নিয়ে  আমার খুব  একটা  চিন্তা  ভাবনা  ছিল  না  কোনো  দিনই,  কিন্তু  তখন  যেন  ঐ  চিন্তাই  আমার  শরীরে  জ্বালা  ধরিয়ে  দিল । পাপ  কাকে  ব’লে  সেটা  যেন  এত  দিনে আমার  মনে প্রথম প্রবেশাধিকার  পেল । বিনা  কারণে  কারুর  জীবন  নষ্ট  করা  যে  ভীষণ  পাপ, সেটা বুঝতে  আর  সময়  লাগ্‌লো  না ।  আমি  থাক্‌তে,  আমার  এক  “ফালতু মন  গড়া”  সংস্কারের  জন্য, এই  ফুলের  মত  মেয়েটির  জীবন  যদি  নষ্ট  হয়ে  যায়  তা  হ’লে  তার  প্রায়সচিত্ত  করতে হবে  সেই  আমাকেই ।  বাস  চল্‌ছে  তখন  এঁকে  বেঁকে  অনেক  কায়দা  ক’রে,  কিন্তু  আমার  মন  চল্‌তে  লাগল  শুধু এক  বিশেষ লক্ষের  দিকে,  সেই  “চীনের  প্রাচীরের”  দিকে,  সেই  মনের  শেষ  দেয়াল  ধংসের  দিকে  । বেশী  সময়  যায়  নি,  বাসটি  তখন পার্ক  সার্কাস  ঘুড়ে  সবে  সি-আই-টি  রোডে  ঢুক্‌ছে,  তখন  হ’ল  সেই  হক্‌  চকিয়ে  দেয়া  ঘটনা ।  সারা  পৃথিবী  যেন  কাঁপতে  শুরু  করল,  চারিদিকে  শব্দের  ঝন্‌  ঝনা,  সব   কিছু  যেন  লণ্ডভণ্ড ।  আমার  মনের  “চীনের  প্রাচীর”,  মানে  আমার সেই  শেষ  সংস্কারের  দেয়াল  আজ  এই  ভাবেই  শেষ  হচ্ছে  আমার  মনের কাছে ।

উদ্‌গ্রীব  হয়ে  সামনে  তাকালাম  সেই  দেয়ালের  ভগ্নাবশেষ  দেখার  জন্য, দেখলাম  একটি উঁচু  দেয়াল,  কিন্তু  তার  সঙ্গে  আমার  সেই  মনের  দেয়ালের  কোন  মিল  নেই,  একেবারেই  কোলকাতার  রাস্তার  পাশের  ছা-পোশা  দেয়াল,  বেঁকে  যাওয়া  কিছু  ল্যাম্প  পোস্ট  আর  কিছু  ভাঙ্গা  গাছের  ডাল ।  হঠাৎ  যেন পৃথিবী  স্থির,  কোথাও  কিছু  চল্‌ছে  না,  সব স্তব্ধ ।  তবে  এটা  কোলকাতার  শহর,  স্তব্ধ  হয়ে  বেশীক্ষণ  থাক্‌তে  পাড়ে না,  প্রথমে  একটা গুঞ্জণ শুরু  হ’ল  নীচের  দিক  থেকে,  তারপর সেটা  বেশ  হৈ-চৈ এর  আকার  ধারণ  করল ।  আমিও  আর  সকলের  সঙ্গে  নীচে  নেবে  এলাম আস্তে  আস্তে ।  বোঝা  গেল  আমার  মনের  দেয়াল  ভাঙ্গার  সঙ্গে  এই  আচম্‌কা  ঘটনার  কোনো  সম্পর্ক  নেই ।  একটি  দুর্ঘটনা  বাঁচাতে  গিয়ে  বাসটি  ফু্‌ট্‌পাথে  উঠে  আসে,  ক’টি  ল্যাম্প  পোস্ট  আর  একটি  বড়  গাছ  ছাড়া  রাস্তায়  দাড়ান  কিছুরই  বেশী  ক্ষতি  হয়  নি । তবে বাসের  জান্‌লার  কাঁচ  ভেঙ্গে  ছিল অনেক,  তারই  ছিল সেই  ‘ঝন্‌ ঝনা’ ।  আমাদের  বাসের  চালক,  কোন  যাত্রীর  বা  কোন  পথচারীর  সেরকম কোন  আঘাত  লাগেনি  দেখে,  আর  আমাদের  বাসের  এখন  এখান  থেকে  বেরোবার  কোন  উপায়  নেই  দেখে, আমি  গুটি  গুটি  আর  একটি  বাসে  চেপে  বাড়ীর  দিকে  চল্‌লাম ।

বলাই  বাহুল্য, বাড়ী  ফির্‌তে  একটু  দেরি  হ’য়ে  গেল ।  বাড়ীর  রীতি  অনুযাই  ততক্ষনে  সবাই  খেতে  ব’সে  গেছে ।  আমার  দেরী  ক’রে  আসার  কারণ  হিসেবে  বাসের  ফুট্‌পাথে  ওঠার  ঘটনাটা  বোলে  আমিও খেতে  ব’সে  গেলাম ।  আমার  গল্প  শুনে  মনে  হোলো  ছোড়্‌দি  আর  আমার  ছোট  ভাইয়ের  মুখে  মুচ্‌কি  হাসি  খেলে  গেল ।  কিন্তু   খাওয়ার  শেষে  হঠাৎ  ছোড়্‌দি  আমাকে  বোল্‌ছেন, “নাঃ,  আজ   সত্যিই  কিছু  একটা  ঘোটেছে  মনে  হয়,  তুই  একেবারেই  অন্যমনস্ক ” ।  “তা  সত্যিই  একটা  ঘটনা  ঘটেছে,  সব  তোমাকে  পড়ে  বোল্‌বো”,  বোলে  শোবার  ঘরের  দিকে এগোলাম ।  রাতে  সেদিন  আর  কিছুতেই  ঘুম  এলো  না, খালি  এ পাশ  আর  ও পাশ ।  মাঝে  ক’একবার  ছাদে  চলে  গেলাম,  যদি  বাইরের  হাওয়াতে  মনটা  একটু  ঠান্ডা হয় ।  কিন্তু  সে  রকম  কিছু  হোলো  না,  বরং  এক সময়  দেখলাম  পূর্ব  দিকের  আকাশে আলোর  আভাশ,  মানে  রাত  প্রায়ে  ফুটো  হয়ে  এস্‌ছে ।  নীচের  তলায়  খুট্‌ খা্‌ট  আওয়াজ,  কাজের  লোকেরা  উনুন  জ্বালিয়ে  তাদের  চা এর  বন্দবস্ত  কোর্‌ছে ।  আমি  নীচে চ’লে  গেলাম  ওদের  সঙ্গে  চা  পানে  যোগ  দিতে ।  এত  ভোরে  আমাকে  দেখে  ওরা  সবাই  খুব  হ’তবাক্‌,  ঐ  সময়টা  আমার  মাঝরাত হ’বার  কথা ।  এক কাপ  চা  হাতে নিয়ে  আবার  ছাদে  চ’লে  গেলাম ।  চা এর  কাপ  হাতে  ক’রেও  বেশ  ক’একবার  ছাদে  এ দিক  ও দিক  ক’রলাম  কিন্তু মন  শান্ত  হ’লো  না ।  বিক্ষিপ্ত  মনকে  শান্ত  ক’রতে হ’লে  মন্দিরে  যেতে  হয়  শুনেছি ।  আমার  তখন আর  বিশেষ চিন্তা  করার  ক্ষমতা  ছিল  না,  ঠিক  করলাম  মন্দিরেই  যাব,  কাছেই  এক  দেবী  মন্দির  আছে,  ঐ  খানেই  হবে  আমার  শেষ  চেষ্টা ।  বেড়িয়ে  পরলাম  মন্দিরের  উদ্দেশ্যে ।  ঘটনা  শুরু  হোএছে এক  “দিন  আর  রাতের সন্ধিক্ষণে”,   পড়ের  “রাত  আর  দিনের  সন্ধিক্ষণ” এসে  গেছে,  আর  অপেক্ষা  করা  যায়  না ।

নিজের  জন্য  মন্দিরে  যাওয়া  এই  আমার  প্রথম ! মন্দিরে  গিয়ে যখন পৌছুলাম  দিনের  আলো  আরো  একটু  বেড়েছে । মন্দির  দেখলাম  অনেক  উঁচুতে,  সামনে  সোপান  শ্রেণী, মন্দিরের  দরজা  বন্ধ ।  দেখলাম  আমার  থেকে  আগে  আসা  কিছু  ভক্ত  বিভিন্ন  ধাপে  দাঁড়িয়ে  মন্দিরের দিকে  তাকিয়ে  অপেক্ষা  কোরছে ।  পাশেই  হাত পা  ধোবার  জন্য জল  রাখা  আছে ।  আমি  হাত পা  ধুয়ে,  ঐ সোপান  শ্রেণীর প্রথম  ধাপে  পা  রেখে  মন্দিরের  দিকে  তাকিয়ে  দাড়ালাম ।  দেখলাম  আমার  থেকে  আগে  আসা  ভক্তরা সব  আমার  দিকে  ফিরে  তাকিয়েছে ।  আমি  ওপোরে  ওঠা  শুরু  করলাম ।  ক’এক  ধাপ  ওঠার  পর  দেখলাম  এক  অদ্ভুত  জিনিষ,  ঐ  ভক্তরা  গড়িয়ে  গড়িয়ে  আমার  দু পাশ  দিয়ে  পড়ে  যাচ্ছে ।  তাদের  চোখের  সে  কি  দৃষ্টি  আমার  প্রতি,  রাগ, দ্বেষ, হিংসা,  বলা  চলে  জীঘাংসা,  এরা  আগেকার  আমলের  মুনি  হ’লে  আমি  বোধ হয়  ভষ্মিভূত  হয়ে  যেতাম ।  কিন্তু সে  রকম  কিছু  না হয়ে  মন  আমার  তখন  আনন্দে  ভোরে  গেল  ঐ  দৃষ্টি  দেখে ।  একে  বলে  অহমিকার  আনন্দ,  আমি  তখন  অহমিকার  ঢেউএর  ওপোর  সার্ফ  ক’রে  বেড়োই তাই  এই  আনন্দ ।

আমি  ওপরে  গিয়ে মন্দিরের  দর্‌জার  সামনে  দাড়ালাম,  বন্ধ  দরজায়  হাত  রাখতেই, দরজা  খুলে  গেল ।  ভেতরে  দেখলাম  কোন  পূজারী  নেই,  খালি  বেদীর  ওপর  একটি  দেবী  মূর্তি ।  দুই  হাত  জড়ো  করে  আমি  মূর্তির  সামনে  দাড়ালাম । ভাল  ক’রে  দেখলাম  দেবী  মূর্তিকে ।  যে  এই  মূর্তিকে   রূপ  দিয়েছে  সেই  কারিগরের  সত্যিই ক্ষমতা  আছে । চোখের  কি  গভীর  দৃষ্টি,  ফোলা  ঠোঁটে  সেকি  সুন্দর  হাসির  রেখা,  মনে  হোলো  যেন  দেবী  আমাকে  দেখেই  হাসছেন ।  এবার  ঘটল  আমার  জীবনের  সবচেয়ে  “চমৎকার”  ঘটনা,  বেদীর  থেকে  দেবীমূর্তি  নেবে  আমার  সামনে  এসে  দাঁড়ালেন ।  আমার  জড়ো করা  হাতে  হাত  রেখে  বললেন, “তোমার  অপেক্ষাতেই  ছিলাম,  এত  দেরি  করলে  যে ?”  আমি  স্তম্ভিত ! সম্বিত  যখন  ফিরে  পেলাম  তখনো  দেখি  দেবীমূর্তি  হাসি  মুখে  আমার  দিকে তাকিয়ে  আছেন ।  আমি  বললাম,  “আগে  এলে  যে  অন্য  ভক্তদের  দলে  আমিও  বিলীন  হয়ে  যেতাম ।

দেবীমূর্তি  আমাকে  আলিঙ্গনপাশে  আবদ্ধ  ক’রলেন ।

 

আগের  লেখারচারপাঁচ  মাস  রে

আমার  ‘দেবী দর্শন’  রম্য রচনা  লেখা  শেষ  ক’রেছিলাম  চার-পাঁচ  মাস  আগে,  তখন  মনে  হয়েছিল  আর  কিছু  আমার  লেখার  নেই ,  আমার   ‘দেবী দর্শন’-এর  ওখানেই  শেষ ।  কিন্তু  ক’দিনের  মধ্যেই  আমার  জীবনে  এমন  একটি  ঘটনা  ঘট্‌ল,  মানে আগের  লেখা  শেষ  হবার  ক’দিনের  মধ্যেই,  এই  চার-পাঁচ  মাসের  মধ্যেই,   এমন  একটি  ঘটনা  যে  বুঝলাম  আমার  আসল  ‘দেবী দর্শন’  সেই  কমবয়েসের  দর্শনেই  শেষ  হয়  নি  ।

হঠাৎ  জানা  গেলো  আমার  সঙ্গে  জড়িয়ে  গেছে  এক  দুরারগ্যরোগ,  এর  কাছ থেকে  ছাড়া  পাওয়া  কঠিন  । একেবারে  সেই  ‘কাল হরতি নিমেষাৎ সর্বম’-এর  উদাহরন  আমার  নিজের  জীবনে  এসে  পড়ল  ।  আমার  অহমিকার  সাগরে  সার্ফ  করার  দিন  চলে  গেল,  জীবনকে  দেখার   দৃষ্টি  পালটে  গেল  ।  এ  রোগ  থেকে  একেবারে  ছাড়া  পাওয়া  যায়না  তা  নয়,  তবে  তা  করতে  লাগে  অনেক  চিকিৎসা,  অনেক  মনের  জোর,  শুভাকাংখীদের  অনেক শুভকামনা,  আর  লাগে  প্রচুর,  প্রচুর  শুশ্রূষা  ।  প্রথমটির  ভার  পড়ল  আধুনিক  হাস্‌পাতালে,  দ্বিতীয়টি  আমার  নিজের  মনে,  তৃতীয়টি ?,  –  আমার  শুভকামনা  করার  যে  এত  জন  আছে  আমার  আগে  জানা  ছিল  না,  আর  শেষেরটির  ভার  তুলে  নিল  সেই  মেয়েটি,  সেই  রাস্তায়  দেখা  হওয়ার  প্রায়  সাতচল্লিশ  বছর  পড়ে  ।  এ  শুশ্রূষা  যে  কি  জিনিশ  সে  যারা  এর  মধ্যে  দিয়ে  গেছেন  তারাই  খালি  জানেন  ।  সকাল,  দুপূর,  বিকেল,  সন্ধ্যে,  রাত, – দিনের  কোন  সময়  বাকী  থাকেনা  একটু  বিশ্রামের  জন্য  ।  এ  শুশ্রূষা  করার  সময়  মুখে  কোনো  কষ্টের  ছাপ  পড়লে  চলবে  না,  রোগী  যেন  বুঝতে  না  পাড়ে  শুশ্রূষাকারির  কোনো  শারীরিক  অসুবিধের  কথা,  মনের  ভেতরের  কোনো  আশংকার  কথা  ।   সে  যেন  বোঝে  এটুকু  কাজ  করা  কিছুই  নয়,  আর  ভয়,  ভয়ের  কি  আছে  ক’দিনেই  সব  ঠিক  হয়ে  যাবে  ।  অনেক  দিন  হ’ল  আমি  সেই  মুখ  দেখে  যাচ্ছি  ।  সেই  বিশ্রান্ত  চোখের  দৃষ্টির  ওপর  খুসীর  প্রলেপ,  ঠোঁটে  জোর  ক’রে  আনা  স্মিত  হাসির  রেখা  ।  সেই  সাতচল্লিশ  বছর  আগের  ত্বকের  লালিত্য  এখন  নেই  কিন্তু  আছে  সাতচল্লিশ  বছরের  এক্সপিরিয়েন্সের  ছাপ,  আছে  আমাদের  এত  বছরের  অনেক  আনন্দের,  অনেক  দুঃখের  ছাপ  ।  আমার  মনের,  আমার  শরীরের  সব  গ্লানি  ধুয়েমুছে  দূর  ক’রে  দিয়ে  যখন  ও  আমার  সামনে  এসে  বসে,   ওর  এই  শান্ত,  শ্রান্ত  মুখ  নিয়ে,  তখন  এই  মুখ  দেখে,  আগে  দেখা  সব  কিছুই  এখন বুঝি  তুচ্ছ,  সেই  আমার  তখনকার  দেবীদর্শনও  ।  এখন   আমার  চোখ  বন্ধ  ক’রে  যখন  মনের  ভেতরে  তাকাই,  জ্বলজ্বল  করে  ওঠে  আবার  সেই  মুখ,  খালি  এখন  আর  দেখি  না  সেই  সাতচল্লিশ    বছর  আগের  কচি  মুখ,  এখন  দেখি  সেই  মেয়েটিরই  এখনকার  শান্ত,  শ্রান্ত  মুখ,  এখন  বুঝি  এই  আসল  দেবী,  এখনি  হচ্ছে  আমার  আসল  দেবী দর্শন     

 

(শেষ)

3 thoughts on “অসামান্য প্রেমের গল্পঃ অরিন্দম ঘোষ ( ১৯৪১-২০১২)

Leave a comment