হারিয়ে যাওয়া ভাষা

শীত পড়তেই গ্রামবাংলায় শুরু “বড়ি” দেওয়ার পালা – বার্তাবাহী

যশোধরা রায়চৌধুরী

একটা স্বপ্ন দেখে প্রায়ই ঘুম ভাঙে আমার। একটা চ্যাপ্টা চৌকো উঠোন। উঠোনে অনেক রোদ্দুর। রোদ্দুরে পাট পাট করে একদিকে মেলে দেওয়া বিছানাবালিশ। ভাদ্রের রোদ্দুরে শুকোচ্ছে। রোদ্দুরের রং কাঁচা হলুদের মত। অনেক বৃষ্টি হয়ে যাবার পর বাঙ্গালায় এমন রোদ্দুর বিকশিত হয়। 

এই স্বপ্নটা হয়ত বাঙালির যৌথ স্বপ্ন। উঠোনের অন্য দিকে বিছানো আছে সাদা কাপড়ের ওপর আচার ও বড়ি । আমসত্ত্ব। হাতে করে পাকা আম আর গুড় ঘুটে সেই তরলকে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে সূর্যকিরনের মহিমার তলায়। তাইতে তৈরি হচ্ছে আমসত্ত্ব। বেতের জালি বাচাটাই বা কুলো ধামা ইত্যাদির ওপর। ফলত শুকনোর পর সেই পাতলা কালচে অসামান্য স্বাদের আমসত্ত্বের এক পিঠে খাঁজকাটা কাটা দাগ, প্যাটার্ন তৈরি হয়েছে। ছিঁড়ে ছিঁড়ে সেই আমসত্ত্ব খেতে হয়। চুরি করে খেতে বেশি মজা। 

বাঙালি এখনো স্বপ্ন দেখে সেইসব কাচের বয়ামে রাখা পাতলা সাদা থান কেটে মুখ ঢেকে বাঁধা আমতেলের। স্বপ্নে দেখে। আচার খায় এম টি আরের, আর ভাবে মায়ের বা ঠাম্মার বা দিদার তৈরি আচারের কথা। 

আমার স্বপ্নের এই উঠোনটা কোথাও নেই , ছিল না। এ শুধু অল্প করে গল্পে পড়া। রাণী চন্দের “আমার মায়ের বাপের বাড়ি” গল্পে পড়া। আমার দিদার , মায়ের স্মৃতিচারণে শোনা। আমার দিদার বাড়িতে উঠোন ছিল না ছাত ছিল, তবে দিদুর সে ছাতে উঠে যাওয়া সম্ভব ছিল না বিশেষ। ষাটোর্ধ দিদুকে পেয়েছি তবু এই কাল্পনিক উঠোনের কেন্দ্রে। 

আসলে স্মৃতি ত ভাষাবিশ্বও। দিদুর কথা থেকে সেই বিশাল সুন্দর কাল্পনিক পরিবারের কথা আমার প্রজন্মে চুঁইয়ে এসেছে। 

দিদুর গল্পে সদ্য বিবাহিত দিদুকে ঢাকার ডাক্তারের পরিবার থেকে বরিশালে আসতে হয়। আর আত্মীয়ারা যখন ঘিরে ধরে ঘোমটা সরিয়ে নব্যবধূর নাক চোখ ইত্যাদি পরীক্ষা করছেন, গায়ের রং পরনের কাপড়ের কোণ পাকিয়ে তা দিয়ে রগড়ে দেখছেন আসল না পমেটম মাখা, অথবা শাড়ির খোল ধরে পরখ করছেন অথবা ডাক্তার মানে বড়লোক বাবা কত গয়না দিয়েছেন তা দেখছেন, তখন ধনিকন্যাকে এক বিদগ্ধ পিসশাশুড়ি বলে ওঠেন, শোন মনু, এইহানে লুসিপুরি জোটবে না, মুরিসিড়াই খাইতে অইব। অর্থাৎ বাপের বাড়িতে যত খুশি লুচি পুরি খেয়ে এসেছ বটে, এখানে সেসব পাবে না। মুড়ি আর চিঁড়েই খেতে হবে। 

দিদুদের গল্পে থাকত খাটের তলায় জমানো রাশি রাশি নারকেলের কথা। রাশি রাশি আমের কথাও। যে ঋতুর যে ফসল, যে ফল, সেসব এসে জড়ো হত, জমা হত খাটের নিচে। কাঁঠাল খাবার পর জড়ো হত কাঁঠালের বীজ বা আঁটি। আর তা নিয়ে তোইরি হত জমজমাট গল্প। কাঁঠালের আঁটি প্রথমে শুকিয়ে তারপর উনুনের নিচের ছাইয়ের মধ্যে মরা আঁচে ভাজা ভাজা করে, অথবা শুকনো কড়াতে টেলে বা খোলা ভাজা করা হত। তারপর সেগুলো হয়ে যেত যখন তখন খাওয়ার জিনিস। 

আমাদের আজকের ভাষায় স্ন্যাকস। 

দিদুর গল্পে আছে এইসব ও। ওদের যৌথ স্মৃতির বিষয়ীভূত যা যা। বাচ্চা ছেলে, জেঠিমার কাছে এসে কাঁঠালের আঁটি চেয়েছে খেতে। জেঠিমা ব্যস্ত , বলেছে জ্যেঠার কাছে চাইতে। বাচ্চা বলেছে, জ্যাঠা শালায় ত দিল না। জ্যেঠিমা ক্ষিপ্ত। বলেন, জ্যাঠাকে শালা বলিস? যা প্রণাম কর গিয়ে। প্রণাম করা হল সে ভাষায় “হোগা উপুত করে হ্যাবা দেওয়া”।  হে অর্বাচীন পাঠক, এখানে হোগা পশ্চাদ্দেশ এবং হ্যাবা সেবা বা প্রণাম। 

“জেডিমা লো জেডিমা মোগে এউগ্যা কাডালের আডি দে 

চা গিয়া তোর জ্যাডাড্ডে হে হালায় ত দিলে না

জ্যাডারে কও হালা

হোগা উপুত কইরা হ্যাবা দে হ্যাবা দে”

এটা পড়ার সময় জ গুলো সব z  উচ্চারণ হবে। 

দিদুদের ভাষাবিশ্বটাও লোপাট হয়েছে তাদের বসবাস, তাদের ব্যবহারিক অভ্যাসের মত। তাই, ভাদ্রমাসে বৃষ্টি থেমে একটা দিন যখন শুকনো হয়, রোদ্দুর হয়ে ওঠে, যখন টেনে টেনে ভাল শাড়ি, সব বিছানা বালিস ওই কাল্পনিক উঠোনটায় এনে ফেলতে হয় , রোদ্দুর খাওয়াতে হয়, তখন বলতে হয়, “ওরে আজ বেশ খরা করেছে। সব রোদে দে রে। ” বা “খরা হইসে দেইখ্যা,  সব টাইন্যা বাইর করলাম, এখন দ্যাখো কী আজাইরা কান্ড, আবার মেঘ কইর‍্যা আইল!

এখন মনে হয় আমাদের এসব ভাষা হারানো দিদুর তৈরিপুরনো জমাট বাঁঢা উলের জামা দিয়ে বানানো শতরঞ্চিটা হারিয়ে ফেলার থেকে বেশি দুঃখের। দিদুর প্রিয় কথাগুলোর একটা ছিল লান্ডিভাস্যি। কোনকিছু ঘেঁটেঘুঁটে ফেলা , গুবলেট করে ফেলাকে বললত লান্ডিভাস্যি করে ফেলা। এই গত পরশু শব্দটা আমার কাছে ফিরে এল বাংলাদেশের এক জনপ্রিয় ফুড চ্যানেলের বক্তার ভাষায়। পোলাওটা ফ্রাইং প্যান ধরে ধরে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে মশলার সঙ্গে মেশাতে হবে, সেই কথাটা বোঝাতে গিয়ে বক্তা বললেন , আপনারা আবার হোটেলের শেফের মত কইর‍্যা এইটা মিশাইতে গিয়া বেশি ঝাঁকাইয়া লান্ডিভাস্যি কইর‍্যা ফেলবেন না য্যান। 

শব্দটা শুনে মাথার মধ্যে ঝনঝনিয়ে ফিরে আসে সেইসব দিদু দিন। খাটের ওপর বসে নির্দেশ দিয়ে দিয়ে দিদু সবাইকে দিয়ে কাজ করাতে পারতেন। ফরসা, নরম , থলথলে তার বাহু, আমি সেই নরম হাত ময়দার মত চটকাতাম। পুজো হবে ঘরে, সরস্বতী বা লক্ষ্মীপুজো, ঘর ধোয়া দেওয়া হত, মুছে আসন পাতা হত, বড় বড় পাথর কাঠের বারকোশ আর তামার পরাত নামান হত। পুরনো চটে যাওয়া, জরি কালো হয়ে যাওয়া বেনারসি শাড়ি বের করে টাঙিয়ে দেওয়া হত ব্যাকগ্রাউন্ডে। তারপর ছোট ঝাপসা হয়ে আসা ক্যালেন্ডার থেকে কেটে বের করা দেবী চিত্রের পট রাখা হত। 

মা চালের গুঁড়ো গোলা বা কথ্যভাষায় পিটুলি গোলা দিয়ে আল্পনা দিচ্ছে, ফুলছড়া, লতাপাতা, কলকা। আল্পনাটা একটা জ্যান্ত বস্তুর মত, জীবন্ত লতাগাছের মত গড়াতে গড়াতে ফর্ম নিচ্ছে, শেপ তোইরি হচ্ছে। নিখুঁত সিমেট্রি বা প্রতিসাম্য নেই সে আল্পনায়। গাছের ডালের মত ছড়াচ্ছে । গোল হয়ে আবার এদিকে ওদিকে আঁকড়া বা শুঁড় বের করে আনছে। সেই আল্পনা যতদূর যায় ততদূর পাতা হয় থালায় থালায় কাটা ফল মূল, গোটা পঞ্চফল, মিষ্টির পাত্র, থালা, পরাতে ধানদুব্বো, কোশাকুশিতে গঙ্গাজল…লক্ষ্মীপুজোয় বাতাবি লেবু মাখা, রান্না করা লুচি মোহনভোগ, দই খই, বাতাসা, চিনির মঠ। 

কোনকিছু লান্ডিভাস্যি হয়না দিদুর পৃথিবীতে। সব চক্রাকারে সুসমঞ্জস সুষমায় থাকে। 

বাঙাল শব্দ বা কথা আজো অনেক স্মৃতি টেনে আনে। ঘর দোর নোংরা করে রাখলে মা বলতেন গু গু কইর‍্যা রাখস। 

এ দেশিদের হেগো শব্দের প্রতি প্রীতি সর্বজন বিদিত। নোংরা করে রাখা ঘরকে হেগোডাঙা বলা হয় পশ্চিম বঙ্গের ভাষায়। হাওড়ার মানুষ, বলেন, হরি বল মন রসনা, খেজুর গাছে পোঁদ ঘোষো না, ঘষতে ঘষতে পড়বে রক্ত, তবেই জানব হরিভক্ত। ও বাংলায় হোগা প্রচলিত আর এ বাংলায় পোঁদ। কোনটাই বিশেষ সু উচ্চ ও সুসামাজিক মান্য ভাষা নয়। এমন কথা শব্দ, কত কথা তবু, হারাচ্ছে আমাদের ভাব ভাষা কথনবিশ্ব থেকে। 

দিদুর বাড়ির আরেক গল্প মনে পড়ল। এক দল আত্মীয় দূর পরবাস থেকে বেড়াতে এসেছিলেন সে বাড়িতে। আত্মীয় বা জ্ঞাতি, কিন্তু ততটা উচ্চবিত্ত নন, হয়ত অভ্যাসে ততটা পরিশীলিত নন। হয়ত নোংরা তারা। মাথায় উকুন বা গায়ে খোসপাঁচড়াও থাকতে পারে, হয়ত ছারপোকাও দু একটা। 

তা বেশ কিছুদিন বাড়িতে থেকে তাঁরা যখন চলে গেলেন শেয়ালদায় ট্রেন ধরতে,  প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দিদা বিশাল উনুনে বিরাট ডেকচিতে সোডার জল ফুটিয়ে তাঁদের ব্যবহৃত যাবতীয় বিছানার চাদর বালিশের খোল, লেপের ওয়াড় সব ভিজিয়ে দিতে নির্দেশ দিলেন। আর বাকি বিছানাগুলো টেনে টেনে ছাতে নিয়ে রোদে দেওয়া হল। 

ঘন্টাখানেক এসব কর্মযজ্ঞ চলছে , ইতিমধ্যে সেই তাঁরা ফিরে এলেন। শেয়ালদায় গিয়ে বসে থাকার পর জানা গিয়েছে তাঁদের ট্রেন বাতিল। আবার পরদিনের সেই ট্রেনে চাপতে হবে। 

ফিরেই তাঁরা হাঁ। এত এত বিছানার চাদর কাচা হচ্ছে, সোডা সাবান ফোটানোর গন্ধ চারদিকে, আর রোদে পড়ে আছে ন্যাড়া ন্যাড়া সব তোষক বালিশ!

বাড়িতে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। অদ্ভুত লজ্জাকর পরিস্থিতি একেবারে!

এসব হল বাঙালির ইদানীং -কার “ভাইরাস ভীতির” বহু আগের কথা। যখন বাঙালি রাস্তা থেকে এসেই রাস্তার কাপড় ছেড়ে ফেলত। সবাই সাবান কাচত বাইরে থেকে আনা কাপড় চোপড় ছেড়ে। আর হাত পা ধুত এক ঘন্টা ধরে ঘরে ঢোকবার আগে। ব্যাকটেরিয়ার নাম না শুনলেও, কলেরা ওলাউঠো প্লেগ আর জাপানি ইনফুলুয়েঞ্জা ম্যালোরির জ্বর এসবের ভয়ে কাতর বাঙালি। ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়। নোঙরা ও গু গু হয়ে যাবার ভয়। 

এই সেদিন পরশপাথর ছবিতে দেখলাম সন্ধেবেলা বৃষ্টি ভিজে আসা পরেশবাবু ওরফে তুলসী চক্কোত্তিকে বলছেন তাঁর গিন্নি, শুনছি কোথা থেকে একটা জাপানি ইনফুলুয়েঞ্জা এসেছে, অবেলায় ভিজে এলে? এখন যদি জ্বরজারি হয়?

এই সব পুরনো কথা এখন বড় উষ্ণতা আনে, ওম আসে জীবনের বিশাল এক পর্বের।

খ্যারেকুটে আগুন দিয়া পেত্নি বইসে আলগুসাইয়া

আমাদের মাতামহী , প্রমাতামহী, তাঁদের সমস্ত রকমের আত্মীয়াদের ভেতরে পরস্পরের বিষয়ে কূটকচালি করে, এ ওর নামে কুকথা বলে, লাগানিভাঙানি দিয়ে মহাকান্ড বাঁধাতেন। আর এই যে নানা জনকে নানা রকম কথা বলে অন্যদের মধ্যে নিপুণভাবে ঝগড়া লাগিয়ে দিতে পারা, এই গুণটি যাদের থাকে, তাদের সম্বন্ধেই ওই উক্তিটি করা হয়ে থাকে। খ্যারেকুটে মানে কাঠকুটো বা খড়কুটোয় আগুন দিয়ে, পেত্নী আলগোছে আরাম করে বসে থাকে আর আগুনের শোভা দেখে। অন্যদের নারদ নারদ বলে যুদ্ধ লাগানোর যে কোন পরিস্থিতিতেই এ কথা  যে প্রযোজ্য, তা আশাকরি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। 

চীৎকার আর কাতরোক্তির মধ্যখানে যে আর্ত রব, তাকে বাঙাল রা বলতেন , কুওইর পাড়া। কেউ জোরে কেঁদে উঠলে, বলাই বাহুল্য সে মেয়ে, চীৎকার করে ঝগড়া করলে বা ডাকাডাকি করলে, মায়েরা অবলীলাক্রমে বলতেন , কুওইর পাড়তাসস ক্যান?

এইসব গল্প লতায়পাতায় আমাদের কাছে চলে এসেছে। আমার কাছে এসেছে। আজ আর এসব কথা বাতাসে ভাসে না। তবু ভাবখানা অসীম ও অনন্তে, চিরন্তন ভাববিশ্বে ঝুলে আছে। 

যেমন আমাদের আরেক বন্ধুর দিদার কথাগুলি মন থেকে যায়না।  বাগবাজারের সেই দিদা প্রতিদিন সকালে রাশি রাশি মুড়ি আর আলুর চপ দিয়ে জলখাবার করতেন। একদিন হঠাৎ অনুভব করলেন আলুর চপে স্বাদ পাচ্ছেন না সেভাবে। বয়সের সঙ্গে ক্রমশ জিভের তার চলে গেছে। 

দিদা বলে ওঠেন,  আলুর বড়াটা ঘুইঁট্টা ঘুইঁট্টা লাগে যে। 

ঘুঁটের মত স্বাদ হীন হয়ে যায় যখন আলুর চপ, জীবন যখন শুকায়ে যায়, সেই মধ্যবয়সে উপনীত , পঞ্চাশোর্ধ আমিও অনুভব করেছি, অধিকাংশ খাদ্যে স্বাদ নেই তেমন। শুধু খাদ্য কেন, এই সব জীবিত বিষয়েই আকর্ষণ কমে যাচ্ছে কি ? জীবন কি সত্যিই ঘুঁইট্টা ঘুইঁট্টা লাগে না আজকাল?