সাম্প্রতিক বাংলাকবিতার অন্নময় ভুবন

 

 

সাম্প্রতিক বাংলাকবিতার অন্নময় ভুবন

যশোধরা রায়চৌধুরী

 

একটা লেখা হয়ে উঠছে এবার

জমানো আমার পাখি পুড়ে গিয়ে সিদ্ধ হয় নুনে
হৃৎকমলিনী তাতে জুড়ে দেয় বিভিন্ন সবুজ
আমার হৃৎপিণ্ড এসে পড়ে যায় বিষাদ উনুনে …( কুন্তল মুখোপাধ্যায়) 

 

গল্প করছিলাম সংগীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগে। ঐ যে, ঔপন্যাসিকা নন যিনি ‘দুই বিঘে জমি” ও না, না, থুড়ি, শুধু বিঘে দুই-এর সম্পাদিকা। যশোদি একটা লেখা দিও। কী নিয়ে লিখব ভাই। বরং কবিতা লেখার প্রসেস নিইয়ে একটা মুক্ত গদ্য দিই? আসলে তোমাদের কাগজে এত ভাল ভাল বিষয়ে এত ভাল ভাল লেখা হয়ে গিয়েছে, কবিতা বিষয়ে নতুন বিষয় ভেবে ওঠাটাই ত একটা বিশাল কাজ, তাই না?

 

সংগীতা শুনবেই না।  না , আমরা ত কবিতাবিষয়ক বিশ্লেষণধর্মী লেখাই  ছাপি। কবিতাবিষয়ক কিছু একটা ভাব।

 

কিছুদিন আগে , মনে পড়ল, গল্প করছিলাম মথ পত্রিকার সম্পাদক, প্রিয় অনুজ  কুন্তল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। বাংলা কবিতার ভেতর কেমন করে জানি বহুদিন ধরেই রয়ে গেছে অন্নের কথা, রান্নার কথা, খাবারের কথা,  খাওয়াদাওয়ার কথা। 

 

 সেই যে ছোট্টবেলা থেকে শুনে আসছি  বাঙালির প্রিয় ব্যসন রান্না আর খাওয়া… অন্নব্যঞ্জনে মনপ্রাণ সমর্পিত রাখার কথা। রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাঁধা  মেয়েবেলা র কথা শুধু নয়, খাবারে পুরুষ নারীর বন্ধনটিও জব্বর , কেননা, “বাসনার সেরা বাস রসনায়”। 

অন্নের পার্লান্সে কথা বলে বাঙালি। অন্ন মেপে দেখে বহির্বিশ্বকে।  অন্ন দেখে দেবে ঘি, পাত্র দেখে দেবে ঝি.. এরকম অসংখ্য প্রবাদ প্রবচন ঘিরে আছে আমাদের বাঙালিদের অন্নচিন্তা-অবসেশনকে। সবচেয়ে বড় , কবিতা আর অন্নকে জুড়ে দেওয়া সংস্কৃত প্রবচন বোধ হয়, আজো বাঙালির মুখে মুখে ফেরে : অন্নচিন্তা চমৎকারা কাতরে কবিতা কুতঃ।

 

ভাত বা অন্নের সঙ্গে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মান্ডের ধারণা ভেতো বাঙালির  জুড়ে আছে। বাঙালির স্বাধীনতা ও দেশভাগ উত্তর অস্তিত্বে ত আরো বেশি করে ভাত নিয়ে একটি ভয় বা অনিশ্চিতি নিরাপত্তাহীনতার ধারণা লুকিয়ে আছে। অন্নের সঙ্গে আমাদের বঙ্গজনের  অতি জটিল এক সম্পর্ক। এক শাক্ত এক বৈষ্ণব সম্পর্ক। এক সুড়ঙ্গলালিত এক হাট খোলা সম্পর্ক। 

 

অন্ন ব্রহ্ম

 

বড় চেনা কথা অন্ন ব্রহ্ম। ফিরে যদি চলে যাই “ব্যাদের যুগে”। সেসময়ের কয়নেজ। শব্দযুগলের ভেতরে পরতে পরতে রয়ে যায় অস্তিত্বের নানা সত্য, প্রখ্যাত পন্ডিত সুকুমারী ভট্টাচার্য  বেদ উপনিষদের পাতায় পাতায় পড়ে, ক্ষুধা আর অন্ন নিয়ে কী বলেন দেখি। 

 

“বৃহদারণ্যক উপনিষদে শুনি, ‘প্রথমে এখানে (এই বিশ্বভুবনে) কিছুই ছিল না, এ সব মৃত্যু দিয়ে আবৃত ছিল। ক্ষুধা দিয়ে, ক্ষুধাই মৃত্যু-নৈবেহ কিঞ্চনাগ্র আসীস্মৃত্যু নৈবেদমাবৃতামাসীৎ। অশনায়য়াহশনায়া হি মৃত্যুঃ ‘ (২:২:১)। এ কথা ব্ৰাহ্মণসাহিত্যে বহুবার শুনেছি, এখন উপনিষদেও শোনা যাচ্ছে। অবশ্য বৃহদারণ্যক উপনিষদ তো সরাসরি শতপথব্রাহ্মণেরই শেষাংশ। ব্রাহ্মণসাহিত্যই যেন বিবর্তিত হয়েছে উপনিষদে, কাজেই এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। সেই প্রসঙ্গে আগের মতোই শোনা যায়, ‘অন্ন থেকে বীর্য–অন্নাদ্বীর্যম।’ (প্রশ্ন উপ, ৬:৪) এ যেন ব্ৰাহ্মণসাহিত্যেরই অনুবৃত্তি, চেনা কথার পুনরুচ্চারণ। ছান্দোগ্য বলে, ‘যে কুলে (বৃহৎ যৌথ পরিবারে) এ আত্মা বৈশ্বানর (অগ্নি)-কে উপাসনা করা হয়, সেখানে (লোকে) অন্ন আহার করে, শ্ৰী’র দেখা পায়, তার ব্রহ্মদীপ্তি আসে–অত্ত্যন্নং পশ্যতি শ্ৰিয়ং ভবত্যস্য ব্রহ্মবৰ্চসম। কুলে য এতমেবাত্মানং বৈশ্বানরমুপাস্তে।’ (ছা/উ ৫:১২:২; ৫:১৩:২; ৫:১৪:২; ৫:১৫:২) এই ধরনের কথাই শুনি অন্যত্র: ‘মহ হল অন্ন। অন্নের দ্বারাই সকল প্ৰাণ মহিমান্বিত হয়–মহ ইত্যন্নম। অন্নেন বাব সর্বে প্ৰাণা মহীয়স্তে।’ (তৈত্তিরীয় উপ. ১:৫৩) হঠাৎ শুনলে কেমন অবাক লাগে, উপনিষদের যুগে–যখন আধ্যাত্মিকতাই জয়যুক্ত, যখন ব্রহ্মাই পরম সত্যতখন নেহাৎ তুচ্ছ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় বস্তু অন্নকে এই গৌরব দেওয়া হচ্ছে: ‘অন্নের দ্বারা সকল প্রাণ মহিমান্বিত হয়।’ যতদিন গেছে ততই মানুষ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর ভাবে বুঝতে পেরেছে উচ্চ কোটির দার্শনিক চিন্তা গৌরবের বস্তু হলেও সে চিন্তার আধার যে শরীরটা, তাকে বাঁচিয়ে রাখে অন্নই, কাজেই চিন্তার মহিমা অন্নের ওপরে একান্ত ভাবেই নির্ভরশীল, এ অন্ন মহ, মহৎ, এর মধ্যে নিহিত প্ৰাণের মহিমা। অন্নেই এই সমস্ত প্রাণী নিহিত–অন্নে হীমানি সর্বনি ভুতানি বিষ্টানি।’ (বৃ/আ/উ ৫:১১:১)। সমস্ত প্রাণীর আধারভূত অন্ন, অন্ন বিনা প্রাণীরা জীবন ধারণ করতে পারে না, আর জীবনই যদি বিপন্ন হয় ত উচ্চ চিন্তা তো নিরবলম্ব হয়ে পড়ে। কাজেই এদের মুক্তদৃষ্টিতে অন্নের তত্ত্বটি খাটি ভাবেই ধরা দিয়েছিল। অন্য রকম চিন্তাও ছিল, কিন্তু এই ধরনের নির্মোহ দৃষ্টিও ছিল। …

ছান্দোগ্য উপনিষদে, আচার্য শিষ্যকে বলছেন ‘হে সৌম্য, মন হল অন্নময়–অন্নময়ং হি সৌম্য মনঃ ‘ (ছা/উ ৬:৫:৪)।অন্ন মহৎ, প্ৰাণি-মাত্রকেই জীবনধারণের জন্য অন্নের উপর ভরসা করতে হয়, কারণ অন্ন বিনা প্রাণরক্ষাই হয় না। তাই এদের বলতে হয় যে, ব্রহ্মা-আত্মা-ঐক্য কে যে অবধারণ করবে। অর্থাৎ জানবে সেই মন হল অন্নময়। এবং অন্নের এই মহিমার স্বীকৃতি নানা ভাষায়; আর এর স্বীকারের পিছনে আছে তার দুষ্প্রাপ্যতা। অন্ন সহজলভ্য হলে তার এত মহিমা কীর্তন থাকত না। বৃহদারণ্যক উপনিষদ খুব খোলাখুলি ভাবে বলেছে, অন্ন বিনা প্ৰাণ শুকিয়ে যায়—শুষ্যতি বৈ প্রাণ ঋতেহন্নাৎ।’ (বৃ/আ/উ ৫:১২:১) অন্নের মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘অন্ন বলের চেয়ে অধিক… অন্নকে যে ব্রহ্মা বলে উপাসনা করে সে অন্নবান, পানীয়বান লোকে প্রতিষ্ঠিত হয়–অন্নং বাব বলাণ্ডুয়ঃ… যোহন্নং ব্রহ্মেত্যুপাস্তেহান্নাবতো বৈাস লোকান পানবাতোৎভিসিন্ধ্যাত।’ (ছা/উ ৭:৯:১) এখানে প্রণিধান করবার মতো কথাটা হল, ‘অন্নকে যে ব্রহ্মা বলে উপাসনা করে।’ উপনিষদে মাঝে মাঝেই অনেক বস্তুকে ব্রহ্মা বলা হয়েছে, যেমন প্রাণ, মন, ইত্যাদি। এগুলি দার্শনিক তত্ত্বের উপাদান, ব্রহ্মের কল্পনা থেকে দূরে নয়। কিন্তু অন্ন? সে যে নেহাতই স্থূল বস্তুজগতের দৈনন্দিন প্রয়োজনের সাদামাটা বস্তু। ধর্ম দর্শন, ব্রহ্মাতত্ত্ব থেকে বহু যোজন দূরে তার অবস্থান। সেই অন্নকে ব্রহ্মজ্ঞানে উপাসনা করার কথা বলা হল।”

 

( অন্ন ব্রহ্ম, বেদে ক্ষুধা প্রসঙ্গ, সুকুমারী ভট্টাচার্য) 

 

সেই একই পাঠ বেঁকিয়ে চুরিয়ে দিতে পেরেছেন  ষাট দশকে এক ঘোষিত বামপন্থী কবি। যিনি নিশ্চিতভাবে পাঠবস্তু হিসেবে পড়েছিলেন হিন্দুর তথাকথিত ধর্মগ্রন্থ উপনিষদ, তৈত্তীরিয় উপনিষদের সেই উক্তি, ‘আমি অন্ন, আমি অন্ন, আমি অন্ন; আমি অন্নভোজী, আমি অন্নভোজী, আমি অন্নভোজী ( অহমন্নমহমন্নমহমন্নম। অহমন্নাদোহহমস্নাদোহহমান্নাদঃ।’ (তৈ/উ৩:১০:৬) অথবা এই কথা , যে অন্ন থেকেই প্রাণীরা জাত হয়, অন্ন দিয়েই জাত প্রাণীরা বেঁচে থাকে। অন্নে প্রবিষ্ট হয়ে প্রাণীরা লীন হয়ে যায়। 

সেই পাঠকে যুগোপযোগী করে নিয়ে, দুর্ভিক্ষ-উত্তর বাংলার জোতদার রাজনীতিক কালোবাজারিদের জন্য বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখলেন, 

“অন্ন আলো, অন্ন জ্যোতি, সর্বধর্মসার।

অন্ন আদি, অন্ন অন্ত, অন্নই ওঙ্কার। 

সে অন্নে যে বিষ দেয়, কিংবা তাকে কাড়ে,

ধ্বংস করো, ধ্বংস করো, ধ্বংস করো তারে।”

 

চিরদিনকার  কবিতাতেই ক্ষুধা আর মানুষের কথা বলে চলেনে কবি। কখনো ভঙ্গিটি অবচেতনের ভেতরে ঢেউ তোলা। “হা অন্ন, জো অন্ন” কবিতাটিতে,  দেবারতি মিত্র ভিখিরিদের ভিক্ষার কথা বলেন তিনি এভাবেইঃ

“পাহাড়ের নীচে ভিখিরিরা সারাদিন ভিক্ষে করে/ রান্নার কাঠকুটো কুড়িয়ে ফিরে এল। / তাদের মন কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলল না। / তাদের বুক ফাঁকা, পেটে আগুন,/ প্রাণ কেঁদে উঠল – ভাত, ভাত।“ ( হা অন্ন, জো অন্ন, দেবারতি মিত্র, মুজবৎ পাহাড়ে হাওয়া দিয়েছে) 

 

নব্বইপরবর্তী খাদ্যপানীয়জগতের উঁকি

 

আমাদের এ আলোচনা তবু ঘুরুক ফিরুক সাম্প্রতিক কালের বাতায়নে। কেননা আমাদের এই সময়ের তরুণদের লেখালেখিই আজ আলোচ্য। এক বা একাধিক কোণ থেকে আলো ফেললেও আমরা দেখছি বাঙলা কবিতার আজকের বাচনেও খাবার আছে। খাদ্যের রকমফের ঘটেছে। চিরাচরিত খাদ্যপানীয়ের পাশে এসে বসেছে ফাস্ট ফুড, বা স্ট্রিট ফুড, দুধের পাশে বসেছে মদ,  কফির দোকান এসে মাথা গলিয়েছে ছোট্ট চা- দোকানে চা আর লেড়ো বিস্কুটের পাশে।  

 

১৯৯০ থেকে ২০০০ আমরা জানি এই দুই দশকে বাংলা কবিতা্র ভাষা নানাভাবে পুনরাবিষ্কৃত হয়েছে,  নানাভাবে নতুন দিক নির্দেশ করেছে। এই নতুনত্বের একটা বড় অংশ মিশে আছে দৈনন্দিন ও বদলে যাওয়া জীবনযাপনের কথা হুবহু কথ্যভঙ্গিতে তুলে আনার দিকে। 

 

এই বিশেষ অভিমুখের একট বিশেষ অংশ, বাংলা কবিতায় খাওয়াদাওয়া, খাদ্য বস্তু, ফাস্ট ফুড, রান্নাবান্নার রেফারেন্স। কখনো সরাসরি কখনো বা প্রতীকে উপমায় ব্যঞ্জনায়, অন্নব্যঞ্জন, খাদ্য খাবার এসেছে কবিতায়। এসেছে বললে ভুল হবে, একটা ধার পেয়েছে, একরকমের মান্যতা পেয়েছে। কেননা আজকের কবিতা প্রতিদিনের যাপনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে নালেঝোলে কব্জি ডুবিয়ে আসক্ত-আলিঙ্গনাবদ্ধ। 

 

তোর পিঠের তিলগুলো দিয়ে নতুন রেসিপি বানিয়েছি। আজকে আমার সাথে লাঞ্চ

কর। আমাদের গন্ধ মিলেমিশে ভরে আছে ডাইনিং রুম । তোর হাতের নিচের দিকটা

খেতে খেতে মনে হয় বাঁ পা-টা একটু টেস্ট করি । নোনতা বুড়ো আঙুলের মাথাটা

জিভে নিই। ছ’ ঘন্টা ম্যারিনেট করা তুই গলে যাস আমার মুখের মধ্যে । ডানদিকের

বুকে এসে কিছুক্ষণ দম নিই । আর ওটা? ওটা রেখে দিই সবার শেষে খাব বলে । 

 

(স্বাগতা দাশগুপ্ত ,আ লা কার্টে)

 

এ লেখায় আছে ঔদ্ধত্য আর গ্লোবালাইজড বাঙালির  নিজস্ব মুদ্রা। একই ঔদ্ধত্য নিয়ে ,

বল্লরী সেন অনায়াসে লিখতে পারেন, দেহদানের ফি, দু পেয়ালা ধূমায়িত কফি। বা , অন্য আখরে, বিষাদের তামাশা আর ভালবাসার অক্ষমতাকে হুবহু  তুলে আনতে পারেন খাবারের অনুষঙ্গে, 

 

ধনিয়াখালির বাঁজা মেয়ে, কাপড়ের কমলা পাড়ে

কতবার সে তার কৈশোর মুছে ফেলেছে

গৃহে তার ১৮ বছরের পুত্র

প্রতিরাতে

একই খাটে শুয়ে

মাংসের কোয়াগুলো ফেলে দেবে বলে

ফ্রিজ থেকে বার করে, ভুলে যাওয়া কৌটোয় তার

যোনি খুলে রাখা আছে ২২ বছর…কদমের থেঁতলানো

পিন্ডের ওপর মায়া হয়। মনে হয় এই বুঝি ডাকলো কেউ

কেউ যেন বুক ফাটিয়ে কেঁদে বারণ করছে

আসলে কেউ নয়।

পর পর সমস্ত সংখ্যা প্রতারক। একে একে সব্বাই আমারি

গায়ের পরে ভাত উগলে দেয়। বিগতজনমের অন্ন তরকারি,

নৈহার ফেরত মেয়ে যেমন কান্নার ভেতরে ছুড়ে দেয়

টুকরো করা হরলিক্স বিস্কুট, চাদমালা হরফের পাশে।

( বৃষ্টিবাহী ফেরি, বল্লরী সেন ) 

 

অথবা , 

মনে-রাখা রোদ্দুর এখন বারখলোমিউ-এর ছাতিম

পাতায়

—তুই একা সব পোড়ানো মাছের ছালটুকু বসে

খেয়ে নিলি?

—একটাই খাবার প্যালেট, রঙ লাগছে দানায়

দানায়, মাছের ঘিলুর মতো অসমাপ্ত আকাশ

একটু করে সূর্যকে টেনে রাখতে চাইছে

—তোর গলা ওই বুঝি শুনলাম। বুঝি ভিড়ের

মধ্যে তোর ঘ্রাণ। জলে তোর নিস্তরঙ্গতা, কেবল

আসে আর চলে যায়

—ফর্কের পিনে তোকে কাঁটা ফুটিয়ে ছুঁয়ে দেবে

ছেলেবেলা, তখন আমরা ২২ বছর পর রুমাল

চুরির খেলা খেলবো

—তুই কেবল হাঁটুতে বল নিয়ে লোফালুফি করবি

আর হুস্ করে কফির মতো আমি উড়ে যাচ্ছি

পাহাড় রঙের একটা তুষারপাতে।

এখন এটাই আমাদের শীত শীত খেলা।

( বল্লরী সেন, সুরের শৌহর) 

 

সাঁওতাল পুরুষের মত বন্য তোমার রূপ/একমাত্র তোমার পাশেই নিজেকে মনে হয় তপ্তকাঞ্চন/…

বড় জোর রাতের ভদ্র গৃহস্থ রান্নায় আনব/মহুয়ায় ম্যারিনেট করা বনমোরগের স্বাদ।

 

                      ( রূপলাগি, পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়, শালপাতাটা ফেলার আগে)

ম্যারিনেট, মাইক্রোওয়েভ, কফিশপে বিধুর হয়ে ওঠে নব্বই-দুহাজারি বেলাগুলি। নিজেও লেখার মধ্যে এনেছিলাম ডালহৌসির চাউমিন গন্ধ, এনেছিলাম রোলের দোকান, নব্বইয়ের নতুন ভাষার ঝোঁকে, রোজকার যাপন বলার ঝোঁকে।  নব্বই পরবর্তী কবিরা, দুহাজার পরবর্তী কবিরা, হয় খুব উচ্চকিত ভাবে দ্যাখনদারি নিয়ে খাবার খাদ্যকে উদযাপন করেছেন, বাহারি আলো , কফিশপের গন্ধকে বরণ করেছেন মুক্ত অর্থনীতির খোলাবাজারে নেমে, নয়ত নস্টালজিয়া বিধুর মৃত্যুচেতনার দিকে মুখটি সযত্নে ফিরিয়ে নিয়ে ভারি নতমুখে নিচু কন্ঠস্বরে যাপন করেছেন খাবার ও মানবজীবনের অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক সংলগ্নতাই। বহু আগে নব্বইয়ের দুটো ধারা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেছিলাম একই অঙ্গে ইন্ডিয়া ও ভারতের কথা। আজও সেইরকম করেই দেখতে ইচ্ছে হয় , অথবা মিলেমিশে যেতে দেখি এই সময়ের কবিতায় ভারত ও ইন্ডিয়াকে। আলাদা করা যায়না। 

 

ঐ আলোঝলমল ফুড কোর্টের পাশে পাশে, নিবিড় নির্জনভাবে খাবারকে দেখা,  খাদ্যবস্তুর সঙ্গে মৃত্যু ও ধারাবাহিকতা চেতনার একটি নমুনা তাই এইরকম ও পাচ্ছি :

 

“পিতৃতর্পণের দিনে পূর্বপুরুষেরা ছাই খুঁজতে আসেন

বসতবাড়িতে, কর্মক্ষেত্রে, চেনা চা দোকানে…তিনি দেখছেনঃ তাঁর লাগানো

তুলসিগাছটা আর নেই – যে আরামকেদারায়

বসে রোদ্দুর মাখতেন, সেটা বারান্দার এক কোণে

বর্গী আক্রমণ হয়ে গেছে…। … সেই হাওয়ায় তিনি ফিরে যান…

বাড়ির নতুন বউ স্বপ্নে দেখে বাবা এসেছেন।

চা খাচ্ছেন, সঙ্গে এক জামবাটি মুড়ি-চানাচুর…”( ‘মহালয়া’ , রাজদীপ রায়, জন্মান্ধের আলো)

 

মগ্ন এক পারিবারিক নস্টালজিয়া বিধুরতা আমাদের ছেয়ে ফেলে, তুচ্ছ হয়ে ওঠে অসামান্য। 

অন্য এক কবির অন্য কবিতায় আসে মশলাবাগানের গন্ধ। 

“সবাই তো জানে আমি আর ঈশ্বর খুব মিশুক নই

তেজপাতার বস্তা থেকে ঘ্রাণ নেই তেজপাতা ও অবয়বের

অসমাপ্ত এস এম এস করি, মোবাইল হারাই ছায়াপথে

কথা বলতে গিয়ে বারবার হোঁচট খাই “( তেমন মিশুক নই, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, জলবিষুব জংশন)

 

ছোট্ট চা দোকান

ছেলেরা চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয় , মেয়েরা চা বানিয়ে দেয় ছেলেদের। এমন এক অলিখিত জেন্ডার ঘটিত, লিঙ্গবৈষম্যের অদৃশ্য মানসিক প্রি অকুপেশনের বেড়াজাল আছে হয়ত বা। তবু চায়ে পে চর্চা থামে না আমাদের। ইংরেজরা বছর দেড়শো আগে বাঙালিকে চা ধরিয়েছিল… আর চায়ের চাষ করিয়েছিল বঙ্গভূমির দার্জিলিং প্রদেশে… তারপর থেকে চা নিয়ে কত না মজা , খেলা , কবিতা, আনন্দ, ছড়াকাটা, ব্যঙ্গবিদ্রূপ ও আমাদের। আমাদের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে চায়ের ওতোপ্রোত সম্পর্ক এনে ফেলা হল কীভাবে তা নিয়ে মূল্যবান কাজ করেছেন শ্রী গৌতম ভদ্র। আমাদের দেখা শুধু সামান্য এ চা বিবরণী কীভাবে আলতো ছায়াপাত করেছে আআদের সাম্প্রতিক  সমসাময়িক কবিতায়। 

 

“শীতকাল চলে এল/ গড়াল বিকেল/ এঁটো কাপ ডিশ ধুরে ধুরে দেখি/ জল শুকিয়ে আসছে কেটলির/ নিভু নিভু আঁচ… বেকারি বিস্কুট থাক/ চানাচুর কেক/ থাক সিগারেট…”

 

এ কবিতা চা দোকান চালানোর কবিতা। নারী না পুরুষ কন্ঠ বলছে এ কথা? ধাঁধা থেকে যায়। শেষকালে ধাঁধা কাটে হয়ত বা। “আচমকা ঢুকে পড়ো যদি/ আর বৃষ্টি নামে/ঝড় ওঠে কালবৈশাখীর/ সংগে প্রেমিকাও থাকে যদি/ উনুনে পড়বে আঁচ/ চায়ে দেব আদা ও এলাচ/যদি মনে ধরে/ ছোট্ট এই চায়ের দোকান/ তোমাদের/ গোলাপ… গোলাপ…”

 

এ কবিতা লিখেছেন তিলোত্তমা বসু, বইয়ের নাম ছোট্ট চা দোকান। এর পরে পড়ব আর একটি কবিতা, নাম “চা”। 

 

রবিবারের বিকেলগুলো বেশ শ্লথভাবে কেটে যায়। এমনই এক সাধারণ রবিবার। সন্ধে পাঁচটা নাগাদ নিয়ম মত মধ্য গ্রামে “চা নাও”বলে ডাক দিয়ে তিতি-রমা সরে যায় অন্য কাজে। টেবিলের সামনে গিয়ে দেখি দুটি কাপে চা রয়েছে। একটি ধূমায়িত অন্যটি নয়। বুঝি ধূমায়িত কাপটি চার, অন্যটি আমার। কারণ ঠান্ডা চা-ই আমার পছন্দ। 

 

চিনি ছাড়া, দুধ ছাড়া, চালু ও স্পেশাল বহুবিধ চা পাশাপাশি অনেক দেখেছি সর্বত্র। কিন্তু একই সঙ্গে বানাও দুকাপ চায়ের একটি ধূমায়িত অন্যটি ঠান্ডা হওয়া সম্ভব কীভাবে?

 

রান্নার এই সূক্ষ্মতম ব্যবহারিক দিকটি প্রতিদিন নজর এড়িয়ে যায়, কারণ আমার নজর সবসময় সুবিধা গ্রহণের দিকে ঝুঁকে থাকে। তবু কোনো এক শান্ত শ্লথ দিনে দৃষ্টিবান হয়ে উঠি। দেখি গৃহকর্ম নিপুণতা – বিশুদ্ধ নিপুণতাকে ছাড়িয়ে চলে যায় কোনো এক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিভেদ দর্শনের দিকে।  ( চা, প্রদীপ সিং হ, পরমার্থ ও লোকাল থানা)

 

ইফ চা কামস, ক্যান বিস্কুট বি ফার বিহাইন্ড? চা আর বিস্কুটের সখ্য ত সর্বজনবিদিত। বিশেষত লেড়ো বিস্কুট। 

 

“আমরা ক্লান্ত হয়ে লোকাল ট্রেনের সিটে/ পাশাপাশি বসি/ মানুষের শব্দহীনতা নিয়ে আলোচনা করি/ চায়ে লেড়ো বিস্কুট ডুবিয়ে খেতে খেতে বুঝি/ আমাদের একটাই পৃথিবী। ( ৯, অনির্বাণ কর, ঈশরের মেসযাপন ) 

 

একরকমের ভালবাসা ও “চা খাওয়ানো” যে সমার্থক, তা আমরা অদিতি বসু রায়ের কবিতা থেকে জানি। 

“বাগানে মোড়া পেতে বসে শব্দছক মেলাতে পারিনি বলে,/ প্রতিবেশীর বিয়েতে নিমন্ত্রণ হয়নি।/ সুতির শাড়িতে ফলস পরাই না বলে, ভাত পুড়ে গেছে।/ ফেরত খুচরো না গোনায় পাড়ার পাগল চা খাইয়েছিল একবার। “ ( পিন নম্বরহীন কলকাতা, অদিতি বসুরায়, পালটাচ্ছে ইউজার নেম) 

 

ফাস্ট ফুড জিন্দেগি

 

নয়ের দশক থেকে ফাস্ট ফুড হল আমাদের নিজস্ব কথনবিশ্বের অংশ । পথে চলতে চলতে দেখা শোনা শোঁকা ও খাওয়া প্রতিটি দুরন্ত খাবার আমাদের কবিতার ভেতরে গুঁড়ি মেরে ঢুকেছে। আমার নিজের লেখা লেখিতে এসেছিল টং টং আওয়াজ করে যাওয়া দোসার গাড়ি অথবা রোল চাউমিনের কর্নার দোকান… আজো তাদের অপ্রতিরোধ্য আগমন। 

 

অরিন্দম রায় লিখছেন, 

 

সমস্ত শহর আমি চুরি করে রেখে দেবো নিজের ভেতরে/ যেভাবে ধোসার পেটে লুকনো তরকারি থাকে/ দক্ষিণ ভারত থেকে/ নিছক বেদনা কিছু মিশে যায় সম্বরের ঘ্রাণে। / গ্রাহক যা বোঝে না/ শুধু রাঁধুনিই জানে ( ধোসা, অরিন্দম রায়, নির্বাচিত শূন্য)

 

এ কবিতার ভেতর আছে মন খারাপের ঘ্রাণ, সঙ্গে ভিন প্রদেশের সংস্কৃতিকে আপন করা বাঙালির অভিজ্ঞান। 

 

অথবা অভিজিৎ বেরা লিখছেন, 

 

“ওদিকে হিন্দিগান, এদিকে কুকুর। মাঝখানে বিকেলের ধোসাওয়ালা ঘন্টি বাজাচ্ছে। … আয়াদের সঙ্গে বাচ্চারা ঘরে ফিরলে হিন্দিগান বন্ধ হবে…হোমওয়ার্কের সামনে ঢুলতে ঢুলতে বাচ্চাগুলো দেখবে/ ক্লাসের মিস ধোসা বানাচ্ছে,/ ওরা তার মধ্যে টপাটপ ঢুকে পড়ছে। / এর থেকে ভাল পালানোর জায়গা আর হয়না। “( পালানোর জায়গা, অভিজিৎ বেরা , গডজিলার নিজস্ব ইতিহাস) 

 

ডিম্ভাত , ডিম্ভাত!!!

ডিম-পাঁউরুটির মত জীবনে, তুমি এলে

একটি হলুদ রঙের কলা…

নিটোল আকার দেখে, বিশ্বাস করো,

ভারি খিদে পায়… ( ডিম পাউঁরুটির কবিতা, রাজশ্রী চক্রবর্তী ,  )

 

এমন দিন পড়ল, বাংলার রাজনীতির পুরো এলাকাটাই দখল করে নিল ডিম্ভাত অথবা ডিম+ভাত। কোন এক ময়দানে কোন এক ব্রিগেডের সভায় যোগদানকারীদের ডিমভাতের প্রলোভন দেখানোর নামই রাজনীতি, এমন এক ডিসকোর্স টাটকা তাজা হয়ে উঠে এসেছে এ ভুবনে। অন্যদিকে মিডডে মিলে শিশুরা এক পেট ভাত পাচ্ছে কিন্তু একটা ডিম পাচ্ছে কিনা তা নিয়ে তরজা উঠছে চরমে।   ভাবতে আশ্চর্য লাগে, এসব ঘটছে আমাদেরই তথাকথিত বিশ্বায়িত সময়ে।

ডিম নামক বিষয়টি হয়ত বা আমাদের , যারা ৬০ দশকের সন্তান, তাদের জীবনে ছিল গুরুত্বপূর্ণ, কেননা হ্যাচারিগুলির রমরমার তখনই শুরু। আমাদের শৈশবে কারো বাড়িতে সৌজন্য সফরে গেলে, চা মিষ্টির পাশে যদি একটা ডিমভাজা জুটত তা ছিল মহার্ঘ। পিকনিকে অবশ্য খাদ্য ছিল ডিমসেদ্ধ আর কলা দিয়ে কাঁচা পাউরুটি। এসব ছাপিয়ে তারপর দৈনন্দিন জীবনের পরতে পরতে ডিম অনুপ্রবেশ করল। এমনকি পথখাদ্য হিসেবে সবচেয়ে সুলভ হল ডিম। তারের খাঁচার মত গোল ঝুড়িতে তাই ডিমসেদ্ধ অলংকার হয়েছে, রাস্তায় উনুন পেতে ডিম পাউরুটি বিক্রির সুলভতা পাওয়া গেছে। অনেক অজস্র ডিম ভাজার গন্ধ আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে আকুল করেছে।   তাই কি, আমাদের সময়ের কবিদের কবিতায় ডিম , ডিম, ডিম আর ডিম? 

লাল লঙ্কার মিশেল দেওয়া ডিমের  ঝোলের খোঁজ/ খিদের মুখে ভাতের পাতে যেমন/           তোমায় তেমন খুঁজেছি রোজ রোজ। …ডিমের মত স্বাদু এবং পুষ্টিকর ছেলে/সোনালি চুল রূপোর মেয়ে পেলে/দারুণ দিনে বুঝো/ঘাম, তেল আর আঁচের গন্ধ খুঁজো । ( রূপকথার পরে, পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়, জাদুদেবতার জন্য) 

               অথবা

“ডিম ভেঙে প্যানের উপর ছড়িয়ে দিতেই, তুমি পৃথিবীর গোলাকার নিয়ে শুরু করলে খেলা। তাতে ছড়িয়ে দিলে পেয়াঁজের কুচি। ভূখন্ড মূলত ক্ষমতায় চিহ্নিত, তাই, নুন ও সামান্য গোলমরিচের গুঁড়ো ছাড়া খাবার অযোগ্য। 

প্লেটে, কাঁটাচামচের পাশে টম্যাটো ও চিলি সস ঢেলে , পরিবেশনের আগে রাষ্ট্রসংঘের ঢংয়ে এই যে হাসলে;

মনে হল, অতিথির প্রতি

ভারতীয় সংস্কারের কথা। 

( আপ্যায়ন, পল্লব ভট্টাচার্য, নিঃশব্দের নীচে) 

 

কামনা বাসনার সঙ্গে অতএব মিলেমিশে যাবে ডিমটোস্ট। 

 

ততক্ষণে আমি প্লেটনিক যুদ্ধে হেরে গেছি, কথা বলেছি/ সূপ ঢেলে দিয়েছিল তারপরি রোয়িং রোয়িং/ দক্ষিণ থেকে চলে গেছি প্রায় হিন্দ সিনেমা পর্যন্ত/ আর দীর্ঘ ছায়া আমাদের ঐ অর্থোডক্স চার্চ/ বন্ধ সিনাগগ অবধি গিয়ে পড়েছে/ তেল কালি ঢালা অর্ধেক বন্ধ ট্রাম লাইনের পাশে/ লোহাগুদামের পাশে চামেলি ফিল্ম লেট ক্যাপিটালিজম/ চা ডিমটোস্ট সোনি শোরুম শ্রী শ্রী চন্ডীর পাশে/ আমাকে নগ্ন কর প্রকাশনা সংস্থার একটু আগে। ( ডিজায়ার, ঈপ্সিতা হালদা, কা আ)

 

ডিম পর্ব শেষ করতে হয় এই অনবদ্য কবিতাটি দিয়ে। অভিজিৎ ঘোষের লেখা। 

আজ ডবল আনন্দ।/ মা রাঁধছে হাঁসের ডিমের ঝোল/ সাথে পোস্তর বড়া, / আমরা সবাই অবাক চোখে মাকে দেখছি / যেন প্রথমবার…/ডিমের ঝোল ফুটছে টগবগিয়ে, / যেন নিঝুম রাতে হাজার খুরের শব্দ/ ঝোল নেমে কড়াইয়ে পড়েছে পোস্ত,/ ফটফটিয়ে শব্দ/ আমাদের জোড়া জোড়া চোখ/গিলে খাচ্ছে মাকে – আর মাকে মনে হচ্ছে দশভূজা…/এক হাত সামলাচ্ছে ডিমের ঝোল/ অন্য হাত পোস্তর বড়া,/ কোনোটায় গরম ভাত,/ বাকি হাতেরা আটকে রাখছে/ আমাদের, ঘরের কোণে/ আজ মহালয়া/ দেবীপক্ষের শুরু।  ( আজ মহালয়া, অভিজিৎ ঘোষ, অলীক বাড়ির খোঁজে) 

 

মাংস  মনোরম

সকল ফুলের কাছে এতো মোহময় মনে যাবার পরেও/ মানুষেরা কিন্তু মাংসরন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। /বর্ণাবলেপনগুলি কাছে গেলে অর্থহীন, অতি স্থূল ব’লে মনে হয়। ( বিনয় মজুমদার)

বিনয় মজুমদার চিরনমস্য আর বেদবাক্য প্রতিম তাঁর সামান্যীকরণ বা জেনারালাইজেশনগুলি । তা থেকেই ডেরিভেটিভের মত নেমে এসেছে পরবর্তীতে আমাদের প্রজন্মের হাতে মাংস-ভজনার সমস্ত ঝালমশলা যেন। রবিবারের  মাংস রান্নার ঘ্রাণ মিশ্রিত, প্রেশার কুকারের সিটিমুখরিত বেলা বারোটা মধ্যবিত্তের স্বর্গ ছিল বহুকাল, মাংস খাওয়া আমাদের সারা সপ্তাহের বেঁচে থাকায়ে খুলেছড়িয়ে মিশে যাবার আগে। নস্টালজিয়া তবু পিছু ছাড়েনা, মফস্বলি বিয়েবাড়ির  নস্টালজিয়া যেমন উঠে এসেছে এই লেখায়ঃ

“চেনা লোকেদের বিবাহ যেমন, অঘ্রাণের শেষে মফঃস্বলে / ফিরে যেতে হত। যশোর রোডের ধারে সন্ধ্যে নেমে এলে/ আমরা খেতে বসতাম। কেটারিংয়ের নিবু আলোয়/ থাল থেকে ধোঁয়া উথত, চাক চাক রসাল মাংস/ দিয়ে যেত ওরা।…অমনি মৃত্যুচিন্তা ভয় তাঁর বুঝি দাঁড়ানোর কথা ওই পারে। কেননা মরাপশুদের অস্তিত্বে ভরা বিষণ্ণ জলপাই / কাদার দাগ, সরলতাভরা এ সংকেত আর কী বা! / ওসব দর্শনচিন্তা দূর ঘেঁসে যেত। বরং  ছেঁদো নিমন্তন্নের প্রতি/ আগ্রহ ছিল ঢের। চিবানো অসম্ভব বুঝে গিলতাম এক তাল চর্বি “ ( পলায়ন, ঈপ্সিতা হালদার, কা আ) 

“খিদে আনো, মালকিন, নিরামিষ ভাতে/ দু-হাতা ছড়িয়ে দাও মাংসের ঝোল” (  নিরামিষ, দেবব্রত কর বিশ্বাস, শ্রীগোপাল মল্লিক লেন) 

“চড়ুইভাতির কথা, মাংসের তলাটা ধরে যাওয়া/ ঝাল, উহু, জল! জল! একচোখে বলা হল হাসি/ ভালোমানুষের মতো মুখ করে সমস্ত দুপুর/ দলছুট, আমরাই বরাবর হারিয়ে গিয়েছি” ( এপিটাফ, তৃষ্ণা বসাক, গোপন ট্যাটু) 

 

“চৈত্রশেষের বাতাস ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল / বলো বস্‌ , কাল মাংস হচ্ছে তো তাহলে? দই? খুব ভোরে স্নান? / তেলচিটে গেঞ্জি আর জাঙিয়ার ওপোর গলিয়ে নেবে আদ্দির পাঞ্জাবি? / বিকেলে আশ্রম যাবে? কাব্যলোক? রবীন্দ্রসঙ্গীত?/ ফেরার পথে কি ছুঁয়ে যাবে লক্ষ্মী বস্ত্রালয়? শ্রীহরি ভাণ্ডার? “ ( সংক্রান্তি, প্রবুদ্ধসুন্দর কর, নৈশশিস) 

 

 দার্শনিক ভুবন = অন্নভুবন

জীবনমরণের প্রতীক হয়ে ওঠে রান্নার হাঁড়ি আজকের কবিতায় , এ আমরা বারংবার দেখেছি। খাদ্যের চিত্রকল্প বহুদূর চলে যায় অনায়াসে। 

“অন্ধের উনুনে বসানো হয়েছে, কড়াই/ ফুটছে সংকেত, পুড়ছে কার কব্জির/ শিরা উপশিরা/ নিজেকেই রেঁধে বেড়ে খেতে হয়/ প্রতিদিন খাওয়ার সময়/ অর্ধপরিচিত ভিক্ষুকরা/ তার পাত খাবলায়” ( তিন,  সুকল্প চট্টোপাধ্যায়, নিরর্থ) 

আসলে গোটা ব্রহ্মান্ড এক বৃহৎ রান্নাঘর হয়ে উঠছে এসব লেখায়ঃ

“আমি সাধারণত মায়ের রান্নাঘরের দিকে মুখও বাড়াইনা/আজ একটু কৌতূহলে উঁকি দিয়ে দেখি নানা রকমের/বয়ামে বোতলে মশলাপাতি, তেজপাতা, পাঁচ ফোড়নের সাথে//কোনোটাতে জ্যেঠু, কোনোটায় পিসি, আবার কোনোটায় দাদু বা ঠাম্মা! … ( মা দিবস, ঋক অমৃত, কলেজ স্ট্রিটের চ্যাপলিন) 

“শ্রাদ্ধবাড়ি এমন একটা জায়গা যেখানে প্রত্যেকের বর্তমান ও ভবিষ্যতের একসঙ্গে নেমন্তন্ন থাকে। শ্রাদ্ধে গেলে দেখা যায়, মানুষ প্রথমে খুব কাঁদে। তারপর আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যে জল দেয়। তারও পরে খেতে বসে বলে, “দাদা, এখানে আরেকটা লুচি দিন না”। এদিকে যিনি মারা গেছেন , তিনি একটা ঘরের কোনা বেছে নেন। শরীরে তাঁর রজনীগন্ধার  পারফিউম। তাঁকেও দেওয়া হয় লুচি, ধোকার ডালনা এইসব । লুচি এককালে তাঁরও প্রিয় ছিল। এখন লজ্জায় চাইতে পারেন না আর…” ( শ্রাদ্ধ, পৃথ্বী বসু, খইয়ের ভেতরে ওড়ে শোক)

এইসব জন্ম ও মৃত্যুর কথকতা যেন অশেষ। মৃত্যুকে পোষ্য করে তোলার এই অনবদ্য কবিতাটি পড়া যাক। 

“হাঁটুর সমান মৃত্যু সারাদিন পায়ে পায়ে ঘোরে/ সে যদি না থাকে তার ছায়া/ থাকে দূরে-কাছে/ ল্যাজ নাড়ে, বুভুক্ষু তাকায়/ ঝকঝকে স্টিলের থালায়/ ঝুঁকে পড়ে/ কাছে ডাকি তাকে/ সে আমার বিষণ্ণতা চেটে চেটে খায়।” ( পোষ্য, হিমালয় জানা, ভূতের শহর থেকে)

আরেকটি আশ্চর্য কবিতায় পড়ি মৃত্যু অনুষঙগের এক ধান থেকে প্রস্তুত বস্তু খইয়ের মাহাত্ম্যকথন। আবিষ্কার করি বৈষ্ণব কবিতার এক নব রূপ। এই সময়ের কথনে। 

 

“মায়ের দুধের এই দেহ/ এই দেহে/ আমার ঠাকুরের অবগাহন/ হৃদিপদ্মাসনে তাঁর ঠাঁই/ প্রহার -সুন্দর খই/ দুধের বাটিতে ভিজিয়ে/ আমার পূজন / তাঁর নিত্যখাদ্যরূপ/ তাঁর জাগরণভূমি” ( খই হয়দ, গৌতম দাস, আশ্চর্য চাদর)

এক খাদ্যজগতের ক্ষুধাপ্রবণতার ভেতরে অনন্ত সম্ভাবনা থেকে যায়, কবি তাকে শুধু খুঁড়ে তোলেন। এক গা অশরীরী শিরশিরে স্বপ্নসম্ভব কল্পনা জগৎ উঠে আসে এ কবিতায় :

বাসনকোসনের শব্দ শুনে উঠে বসি। সারা ঘর খাবারের গন্ধে ভরে আছে

এতখানি স্পষ্ট নয় যে কাউকে দেখাব…

ডাইনিং টেবিল ঘিরে জটলা করছে দু চারটে মানুষ। ভোরবেলা

ভাঁড়ারের দিকে ছুটে যাই। দু চামচ গুঁড়ো দুধ, একখাবলা চাল, 

দু – চারটে আলু যেন কম কম লাগে।  ( সাবকনশাস, শ্যামসুন্দর মুখোপাধ্যায়, হলুদ দাগের বাইরে পথচারী ) 

একেবারেই অন্যভাবে ভুবনকে দেখেন বিশ্বজিৎ রায়, যখন বিপ্লব আর সংসারকে এক লাইনে এনে ফেলেন তিনি। 

বিশ্বাস করুন কোনো বিপ্লব কখনো করিনি। রোজ সকালে উঠে দুধ গরম করি, ছেলের টিফিন গুছোই, চা করি। তখন ওর মা ঘুম থেকে উঠে রুটিন গুছোয়, পাশের ঘর থেকে নিয়ে আসে ইশকুলের জামা কাপড়। নিয়মিত বাজার করা আমার অভ্যেস— মাছ চিনি, কিনতেও পারি, হাতে বেগুন নিয়ে লোফালুফি করে বলে দিতে পারি কচি না বুড়ো, পোকা আছে কি নেই। বাবা শিখিয়েছিল। মা দূরে থাকে— সপ্তাহান্তে যাওয়ার চেষ্টা করি। বাবা বাজার ফেলে চলে যাওয়ার পর মায়ের যে একা লাগে জানি। তবে বাড়ি ফেলে এসে মা থাকতেই চায় না আমার এখানে, ন-মাসে ছ-মাসে আসে। লালচে টম্যাটো রান্নায় দিতে মা খুব ভালোবাসে, আমি নিয়মিত কিনি। পেনশন তুলি, ফলের সময় নিয়ে আসি ফল। এইসব নিত্য ছা-পোষা কাজে আমার বেশ ঘাম হয়, রান্না করে শার্টের আঁচলে হলুদ মুছতে বিশ্বাস করুন জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের থেকে বেশি সুখ পাই। কড়ায় যখন ফালা ফালা করে কাটা আলু আর পটলের পাশে ফুলে ওঠে বড়ি তখন মায়া এসে জমে আমার ভেতরে। ঠাকুর সাজাতে পারি, জানি কীভাবে আলুর খোসা দিয়ে রাঁধা যায় আশ্চর্য ঝাল। বুঝি কীভাবে চালানো যায় কম পয়সায় সংসার, পিঁপড়েরা মুখে করে কখন বয়ে আনে ডিম, কখন ডেকে ওঠে গায়ে গায়ে লেগে থাকা টিকটিকি। এইসব দৃশ্যের মধ্যে থাকি, শুধু কখনো কখনো কতগুলো শব্দ এসে ডাক দিয়ে যায়। রাত নিভে গেলে বাসি চাঁদ পড়ে থাকে ভোরের শিয়রে। শব্দেরা এলে শুধু মনে মনে বয়ে যাই— রাঁধছি, শার্টের আঁচলে মুছছি হাত, আর শব্দের পিছু পিছু বাড়ি ছাড়ছে মন। একে আর যাই হোক বিপ্লব বলে না, গেরস্থালির ভূত বলা যেতে পারে।” ( গেরস্থালির ভূত, বিশ্বজিৎ রায়, গেরস্থালির গদ্য) 

 মধ্যবিত্ত বাঙালির স্বপ্ন আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে, সবটাই ভাত আর রান্নাঘরের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে কজন পারেন, যাঁরা পারেন তাঁদের সূক্ষ্মসংবেদী মননকে আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, অর্ধনারীশ্বর এক বিশ্বের প্রতিভূ। 

“স্বপ্ন বললে এটুকুই – গরম ভাতের সঙ্গে ডাল আর কাগজি লেবুর গন্ধ মনে পড়ে যায়” ( ২৭, অরিন্দম রায় , রোজনামচা) 

 নির্মাল্য মুখোপাধ্যায় এক কবি, যিনি তাঁর একটি সিরিজ কবিতার নামকরণই করেছেন, “লীলা মজুমদারের রান্নার বই থেকে”।

যার শুরুর কবিতায় আছে, “পার্বণী রান্নাকথা বাঙালির ঘরে/ মনোসুখে গৃহিনীরা ব্রতয়ারী পড়ে”  । তারপর একে একে আসে নানা কবিতা। শ্রীভোগ, ডাল আর নটেশাক, মিটলোফ, মার্মালেড, এলোঝেলো কুচোগজা, লাউচিংড়ি বাংলাদেশের। প্রতিটি কবিতাই উল্লেখ্য , এক এক লেখায় উঠে আসে বাঙালি ও রান্নার এক এক পদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা অনুষঙ্গ, কাহিনি, গল্পগাথা। 

লাউচিংড়ির গল্পে পিসিমা , গোপালভাঁড়, এলোঝেলোতে প্রাইমারি ইশকুল, হেড মাস্টার মশাই, আবার মিটলোফ মার্মালেডে উদুখল, কলম্বো বন্দর, সারেং এর নোটবুক , সাগরের জলের নুন আর লেবুর মার্মালেড। ডাল আর নটেশাক কবিতায় আসে বাসস্টপ,  মাধবী হোটেল আসে, আসে দুর্গা গণেশ। 

 

নির্মাল্য আরো এক কবিতায় লেখেন শুভবিবাহের খাতার কথা। আদ্যন্ত নস্টালজিয়ায় চোবানো সেই লেখায় আছে বিয়েবাড়ির খাওয়া দাওয়ার বর্ণনা। কলাপাতা,  আরম্ভে মাটির গেলাসে জল, নুন আর লেবু, রাধাবল্লভী আর কুমড়োর ছক্কার কথা আছে। 

 

                         

 

 

নারীকবিতায় রান্নাঘর আর ফ্রিজ আর ভাতের পাত

  নারীর কবিতায় রান্নাঘর রান্নাবান্না এসেছে অবিরল স্বচ্ছন্দগতিতে, যেটা স্বাভাবিক ত বটেই আমাদের সামাজিক কাঠামোয়। আটের দশকের চৈতালী চট্টোপাধ্যায় সুতপা সেনগুপ্ত সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়দের কবিতায় নারীজগতের প্রতিনিধিত্ব করেছে আঁশবটি উনুন নুন আগুন ও মাছ। কিন্তু পরবর্তীতে এই রান্নাঘরের প্রতীক আরো বিস্তৃত এবং লক্ষণীয় হয়েছে।

তুমি আমার প্রথম পাতের নিমবেগুনের তিক্ত স্মৃতি হওনি ভাগ্যিস !

হওনি মধ্যিখানের পাঁচমেশালি  নিরামিষ-আমিষের সাত-সতেরো ।

মনেই নেই অতরকম পদের অতরকম স্বাদ । শেষ পাতের দই-মিষ্টি

ভেবেও তো তোমাকে খুঁজিনি ।

#

আজ তোমার কাছে এসেছি সব অভিজ্ঞতা পার হয়ে ।

তুমি আমার সব-ভোলানো মুখশুদ্ধি হবে ?

                (মুখশুদ্ধি, পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়, শালপাতাটা ফেলার আগে)

  প্রথমে ফ্রিজ থেকে বের করা তারপর/স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পৌঁছনোর জন্য/নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা-/এরপর গ্যাস পুড়িয়ে গরম করলেই ব্যস ,/বাসি খাবার নিমেষে টাটকা ।/ভ্যাপসা আবহাওয়ায় পচিয়ে ফেলার চেয়ে/বাসি সম্পর্ক কিছুদিনের জন্য/ফ্রিজের শৈত্যে ফেলে রাখা ভালো ।  (বাসি খাবার অথবা,পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়,যতসব অলক্ষ্মীপনা)

 একটা গোটা বই রান্নাঘর নিয়ে, লিখে ফেলেছেন ২০০০ পরবর্তীর এক মেয়ে কবি তুষ্টি ভট্টাচার্য , বইয়ের নাম কুইজিন। প্রতীকে আর উপমায় রান্নাঘর হয়ে উঠেছে একটি মেয়েজীবনকে নানাভাবে দেখার আয়না। তুলনাগুলি সমর্থ হয়ে উঠেছে । রেসিপির ঢং এনেছে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনাকর এক ধর্ষিত, খন্ডিত, উৎপীড়িত মেয়েজীবনের কাহিনিকে। কয়েকটি নমুনা পেশ করা গেল।     

উপুড় করে রাখা কড়াকে নারীর নিতম্বের মত লাগে/নারীবাদী কড়া চিৎ হয়/উনুনে চাপে ( কড়া, তুষ্টি ভট্টাচার্য, কুইজিন) 

রুটি করার পরে চাটুটা তখনও গরম ছিল/এ চাটুতে হাত দিলে ফোস্কা পড়ে না/জল ঢেলে দিলে ছ্যাঁক করে শব্দও ওঠে না/ এবার ওই চাটু মাজবে গোপালের মা/ছাই পাওয়া যায় না বলে/টব থেকে একমুঠো মাটি আর সাবান দিয়ে/রগড়ে রগড়ে তুলে ফেলবে আটা পোড়ার দাগ/ঝকঝকে সাফ হয়ে চাটু উঠে যাবে বাসনের তাকে/রাতে রুটি করার সময়ে/ওকে আবার নামানো হবে তাক থেকে (চাটু,তুষ্টি ভট্টাচার্য, কুইজিন)

 

 “আমার খিচুড়ির সুবাস তখন/বৃষ্টি নামাচ্ছে।” (  খিচুড়ি , তুষ্টি ভট্টাচার্য, কুইজিন)

পটলের গা থেকে চেঁছে নিচ্ছ সবুজ/যে ধার থেকে ধারালো হল ছুরি/তার কোন সবুজ ছিল না।/অন্তঃসারশূন্য বীচি বাদ গিয়ে হাঁ হাঁ করা পেট/অপেক্ষায়-/পুর তৈরির মধ্যে কোন রহস্য নেই/যেমন আছে পেটের মধ্যে লুকিয়ে থাকায়…(  দোলমা , তুষ্টি ভট্টাচার্য, কুইজিন)

চৌকো করে কেটে রাখা ভেটকির টুকরোকে/ভিনিগারে ভিজিয়ে রাখতে হয়/মাছের থেকে আঁশটে গন্ধ আলাদা করে নেওয়াই দস্তুর/আর তখনই কেটে ফেলতে হয় মাপমত কলাপাতা/নারকোল-সরষের মাখামাখির মধ্যে ফেলে দিও কিছু লঙ্কার ঝাল /কলাপাতায় সযত্নে মুড়ে নেওয়ার আগে তেলের কথা ভুল না!…মাইক্রোওয়েভের চালাক বাক্সে মিনিট দশেক রেখে দিলে বুঝবে/পুড়ে যাওয়া সবসময়ে দৃশ্যমান হবে, এমন কোন কথা নেই! (ভেটকির পাতুরি, তুষ্টি ভট্টাচার্য, কুইজিন)

 চকচকে চামড়ায় আরও একটু তেল মাখানো হল/ধারালো ছুরির ডগা দিয়ে/নিতম্বের উঁচু হয়ে থাকা মাংস পিন্ড খুবলে নিয়ে/যৌনাঙ্গ বরাবর লম্বালম্বি চিরে দিলাম দেহটা/ভেতরের তুলতুলে মাংসে গুঁজে দিলাম রসুনের কোয়া/এরপর আগুনের লকলকে শিখায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পোড়ানো।/চামড়া পোড়া গন্ধে ঘর ভরে যাচ্ছে –/কুঁকড়ে ছোট হয়ে আসছে বডি –/আমার খুব গান পাচ্ছে -/আহা বড় জ্বালাপোড়া! জলে ডুবে যদি একটু ……/   খুঁটে খুঁটে তুলে ফেললাম পোড়া চামড়ার ছাল/নুন, লঙ্কা আর ঝাঁঝালো তেলের মলম দিয়ে/ভেতরের তুলতুলে মাংসটা চটকে মেখে/ওপরে ছড়িয়ে দিলাম সবুজ সরস টাটকা ধনেপাতা…লুব্ধক বেগুন ধর্ষিত হওয়ার জন্যই জন্মায় –/এ কথা জেনে যাওয়ার পরে আমার কোন পাপবোধ নেই। ( ধর্ষণ , তুষ্টি ভট্টাচার্য, কুইজিন)

 এ তালিকা দীর্ঘ। এ লেখা অনন্ত। আরো  অনেক উদাহরণ বাইরে রয়ে গেল। তবু, মূল প্রবণতাটুকু যেন ধরা গেল মনে হয়। এটুকুই … তারপর ত পাঠকের নিজস্ব সফর শুরু। 

 

 

flat lay photography of vegetable salad on plate
Photo by Ella Olsson on Pexels.com

 

বাঙালিনীর রান্নাঘরের বিবর্তন

শুভশ্রী পত্রিকায় প্রকাশিত, ২০২০

 

 

বাঙালিনীর রান্নাঘরের বিবর্তন

যশোধরা রায়চৌধুরী

 

If you can organize your kitchen, you can organize your life. Louis Parrish 

 

শুরু করা যাক নেহাতই এক ভ্রমণ উশকানি দিয়ে। আপনি যদি কখনো যান নিউ মেক্সিকো নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ পশ্চিমের এক  রাজ্যে। সেটা রেড ইন্ডিয়ানদের দেশ । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে র ইতিহাস জানা থাকলে নিশ্চয়ি এটাও জানা যে অসংখ্য প্রজাতির অ্যাবরিজিনাল রেড ইন্ডিয়ানদের অগুনতি

anise aroma art bazaar
Photo by Pixabay on Pexels.com

মানুষকে মারতে মারতে,  উপজাতিদের নিজস্ব চিহ্ন মুছতে মুছতে তৈরি হয়েছিল আমেরিকার বিশাল উপনিবেশ। ২০০ বছরের সে ইতিহাস ছিল মোছার ইতিহাস। আজ আবার খুঁড়ে তোলার নতুন অধ্যায়। আজ সেই সব রেড ইন্ডিয়ানদের সংস্কৃতি অনেক মানুষের অধ্যয়নের বিষয়। সংস্কৃতি সংরক্ষণের চেষ্টা অব্যাহত, সে  জন্য সান্টা ফে , এক প্রাচীন শহরে আছে একাধিক যাদুঘর। সে যাদুঘরে দাঁড়িয়ে একটা অংশ দেখে আশ্চর্য হবেন হয়ত। অথবা আদৌ আশ্চর্য হবেননা, কারণ এ ত আমাদের চেনা সংস্কৃতি। সে অংশে রাখা আছে বাসন কোসন, আর দেওয়ালে লেখা আছে রেড ইন্ডিয়ানদের এক প্রজাতি নাভাহো ইন্ডিয়ানদের একটি কথা। কোন বাড়িতে কত সুখ তা তার রান্নাঘর দেখে বোঝা যায়। এই রান্নাঘরেই বোনা হয় পরিবারের সব সদস্যের মধযে ভালবাসার সুতো।  যে কোন গৃহের কেন্দ্রে থাকে রান্নাঘর, সেখানে তৈরি হয় গরম খাবার আর মানুষ ক্রমশ তার পরিবারকে ভালবাসতে শেখে। যে বাড়ির রান্নাঘর যত জমজমাট, সে বাড়ি তত সুখের আলয়। ইংরেজিতে একটা কথাই আছে, the home is where the hearth is… আর, সুখ হল ছোট্ট বাড়ি, যার রান্নাঘরটি বৃহৎ। বলেছিলেন আলফ্রেড হিচকক।(Happiness is a small house, with a big kitchen.)

 

অথচ ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, বাঙালিনীর দুর্দশার কারণ হল তার সারাবাড়ির মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সবচেয়ে ছোট সবচেয়ে ধোঁয়াধুলো ভরা অন্ধকার কোণের ঘরটিই তার রান্নাঘর। এবং এই রান্নাঘরে “আটকে” গিয়েই বাঙালিনির পরাধীনতা আরো বেশি বেশি করে আন্ডারলাইনড হয়েছে চিরটাকাল। আশৈশবের এই ধারণার পাশাপাশি বৃহৎ ও জনসমাকুল বড় পরিবারগুলির রান্নাঘরের , ও রান্না মহলের বিস্তৃতি ও আকার আমাকে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে, কবে আটকে গেল বাঙালিনী ছোট্ট আর অবহেলিত রান্নাঘরে? আনন্দের বদলে যেখানে দুঃখ অসুখ আর অস্বস্তি গজিয়ে উঠতে শুরু করল? আর আমরা, নবযুগের স্বাধীনতা কামী বাঙালিনীরা কি সেই পাক শালার ভোগের পাক থেকে বেরিয়ে আসতে পারলাম আদৌ আমাদের অসংখ্য গ্যাজেট সমাকুল নয়া জমানার রান্নাঘরগুলোতে। অনেক নতুন ফ্ল্যাট বাড়িতে যেগুলি ক্রমশ ওপেন কিচেন বলে অভিহিত হচ্ছে? 

 

বাঙালিনীর রান্নাঘরের বিবর্তন দেখব বলে এই লেখার অবতারণা। এ মহাসমুদ্র থেকে এক দুটি নুড়ি পাথর তুলে নেব শুধু। বাঙালিনীকে আমি দেখব আমার দিদিমার প্রজন্ম, আমার মায়ের প্রজন্ম ও আমার প্রজন্মের প্রেক্ষিতেই।  তার ভেতরেই ধরা পড়বে যা কিছু ধরা পড়ার। 

 

 

রাজস্থান বেড়াতে গিয়েছিলাম। যোধপুর জয়সলমীরের এ কোণে ও কোণে গোঁজা আছে বড় বড় প্রাচীণ হাভেলি । সেসব হাভেলির পুরাতাত্বিক খোপেখাপে, সিঁড়িতে, কুলুঙ্গিতে অতীত ধরা থাকে। মায়াময় জাফরিকাটা জানালা ও ছাতের কোণে লেখা থাকে কত না যুগের প্রণয় অথবা আভিজাত্যের ইতিহাস। কিন্তু সবচেয়ে অবাক করা হয় সেসব হাভেলির একটা ছোট্ট ঘর। রসুইঘর। সেখানে আজকের “ক্ষুদ্র পরিবার সুখী পরিবার” এর ট্যুরিস্ট দের জন্য শোভা বর্ধন করে আছে সুবিশাল সব হাঁড়ি কড়াই,  লালচে তামার ঘড়া, কুচকুচে কালো লোহার বিশাল পাত্রগুলি। এক একটা পাত্রে মানুষ সমান রান্না করা যায়। উনানের জন্য খাঁজযুক্ত এক বিশাল ঘর, চুলহা জ্বালাবার পরিপাটি বন্দোবস্তটির পাশাপাশি, প্রায় আধ মানুষ সমান উদুখল ও মজুদ। এসব দেখলে গা শিরশির করে। এবং এক সুবিশাল পরিবার-আত্মীয়স্বজন-লতায়পাতায় ঘেরা আশ্রিতমন্ডলী-কর্মচারীর গোটা সমাজের খাওয়া কীভাবে জুটত এই রান্নাঘরগুলো থেকে তার আন্দাজ পেয়ে আরো বেশি করে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

 

সমপরিমাণ উত্তেজনা হয়েছে জোড়াসাঁকোর রান্নাঘরের সরঞ্জামগুলি দেখে, দেখেছি নিচু নিচু জাপানি কায়দার টেবিল এনে , প্রাচীন সেই মাটিতে পাত পেড়ে আসন পেতে খাওয়ার চিরাচরিত আচারকে কীভাবে খানিক বিবর্তনের কায়দায় এগিয়ে নিয়ে গেলেন এই ঠাকুর পরিবারটি, জীবনের প্রতিক্ষেত্রে আলোকপ্রাপ্তির পথ যাঁদের কেটে বের করবার অবদান অনস্বীকার্য।  

 

রবীন্দ্রনাথের শৈশব স্মৃতি জীবনস্মৃতি বলছে চাকরবাকর পরিবেষ্টিত বড় হয়ে ওঠার কথা। বাঙালিনী ওই ধরণের বড় পরিবারে রান্নাঘরের কাছাকাছি থাকলেও, রান্নাঘরের অধিকারটি ছিল ঠাকুরের হাতে, অসংখ্য দাসদাসীর মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা হয়ে। সেসব বড় পরিবারের রান্নাঘর ম্যানেজমেন্ট এ গৃহিণীদের ভূমিকা ত ছিলই, নইলে চিত্রা দেব অসাধারণ এক “ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল” লিখতে পারতেন কি? পূর্নিমা ঠাকুরের ‘ঠাকুরবাড়ির রান্না” বইটিও স্মৃতিধার্য। অন্যা অনেকের কলমেও আগ্রহোদ্দীপক ঠাকুরবাড়ির রান্না নিয়েও অগণিত চমৎকার লেখা থেকে আন্দাজ করা যায় নতুন ধরণের এক্সপেরিমেন্টাল রান্নাবান্নায় অগ্রণী ছিলেন মেয়েরা। 

 

বাঙালিয়ানা ওয়েবসাইট থেকে জানছি, দ্বারকানাথ যে আভিজাত্যের নিশান উড়িয়েছিলেন, তাতে অনুমান করা মোটেই অসঙ্গত নয় যে, সেকালের বনেদি বড়লোকবাড়ির মত ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরেও চাকরবাকর-দাসদাসীর রমরমা ছিল। বাড়ির গৃহিণীরা মূলত কর্ত্রী ছিলেন, কর্মী নয়। এই অনুমান অংশত ঠিক। দেবেন্দ্রনাথের অনুশাসন নাকি এর মধ্যে কিছু বদল এনেছিল। ঠাকুরবাড়ির যে মেয়ে প্রথম বেথুন স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, সেই সৌদামিনী, মহর্ষির বড় মেয়ে, বাবার নির্দেশে দীর্ঘদিন হেঁশেলের ভার নিয়েছিলেন। যতই অর্থানুকূল্য থাক না কেন, বেহিসেবি আলস্যবিলাসে যেন কেউ অভ্যস্ত না হয়ে পড়ে, সেই তাগিদে এমন সিদ্ধান্ত নেন মহর্ষি। অপব্যয় রোধ তো এর বিশেষ কারণ বটেই, এছাড়া মেয়েদের গার্হস্থ্যধর্মের উপযুক্ত বিকাশ ও প্রসার এর প্রধান কারণ। শরৎকুমারী, বর্ণকুমারী তো রন্ধনপটু ছিলেনই, তবে প্রত্যেক মেয়েকেই নাকি প্রতিদিন অন্তত একটি করে তরকারি রাঁধতে হত। রসুই আর ভাঁড়ারের কর্তৃত্ব যে দায়িত্ববোধের জন্ম দেয়, তার যথাযোগ্য প্রকাশ ঘটানোই দেবেন্দ্রনাথের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল।

 

কবি স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর রান্না ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহলে খুব জনপ্রিয় ছিল। তার হাতের রান্না খেতে সবাই খুব পছন্দ করতেন, বিশেষত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি নাকি টকের সঙ্গে ঝাল মিশিয়ে বেশ নতুন পদ তৈরি করতেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও নাকি মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে বসে “বৈজ্ঞানিক প্রণালীর আহার” রাঁধার পরিকল্পনা করতেন। রাঁধতেন কবিজায়া। নির্দেশ দিতেন কবি। কখনো কখনো এসব খাদ্য অখাদ্যও হত নাকি। জানিয়েছেন খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় তাঁর কবি কথায়। রাণী চন্দ-র গুরুদেব বইতেও পাই কবির রান্না নিয়ে , খাওয়া নিয়ে নানা রকম বাতিকের কথা। 

 

 কবি ভ্রাতা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজ মেয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর “আমিষ ও নিরামিষ রান্না” দুই খন্ডের বই। সে দুটি  ত ভর্তি নতুন নতুন পদের বিবরণে। যা পড়া এক অন্য ধরণের ভ্রমণ। এই প্রজ্ঞাসুন্দরীই নাকি, রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশতম জন্মদিনে তাঁকে “ কবিসম্বর্ধনা বরফি “ রেঁধে খাইয়েছিলেন। 

বাংলা খাবারের মেনুকার্ডের জন্মও প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর হাতে, নাম দিয়েছিলেন “ক্রমণী”। 

 

কিন্তু রবি ঠাকুরের পরিবারকে সব বিষয়ে টান দেওয়া অপ্রয়োজনীয়। বাঙালির ফার্স্ট ফ্যামিলিটিকে সর্ব ব্যাপারে টেনে আনলে বাস্তব চিত্র থেকে সরে যাব আমরা। কেননা কলকাতায় ওইরকম ধনী পরিবার আর কটি? অনেকাংশে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্রের  হেঁশেল ও উনুনের কথাই আসল ধর্তব্য। মেয়েদের সঙ্গে উনুনের জটিল ও বাধ্যতামূলক আন্তঃসম্পর্কের মধ্যে দিয়ে কলকাতায় বাঙালিনিদের যার যার নিজস্ব রান্নাঘরের রাজনীতিটি গড়ে উঠেছে। এক দখলদারিত্ব, মমত্ববোধ আর অন্যদিকে প্রবল ভাবে পরিশ্রান্ত হবার চির আয়োজন বাঙালিনীর রান্নাঘর। “খাওয়ার পরে রাঁধা আর রাঁধার পরে খাওয়া”র চক্র থেকে যাদের মুক্তি নেই কোন। ছিল না অন্তত। রবীন্দ্রনাথ নিজেই এ লাইন লিখে দৈনন্দিন জীবনে মেয়েদের রান্নাচক্রে আটকে থাকা যেমন করে বুঝিয়েছেন, তাঁর নানা গল্পেও সে কথার সমর্থন আছে, আর আছে শরৎ সাহিত্যে , বিভূতিভূষণের লেখাতেও। 

 

স্ত্রীর পত্রে যখন মৃণাল লেখে, মনে অছে, ইংরেজ ডাক্তার এসে আমদের অন্দর দেখে আশ্চর্য্য হয়েছিল এবং আঁতুড়ঘর দেখে বিরক্ত হয়ে বকাবকি করেছিল। সদরে তোমাদের একটু বাগান আছে। ঘরে সাজসজ্জা আসবাবের অভাব নেই, আর,অন্দরটা যেন পশমের কাজের উলটো পিঠ; সেদিকে কোনো লজ্জা নেই, শ্রী নেই , সজ্জা নেই। সেদিকে আলো মিট্‌মিট্‌ করে জ্বলে; হাওয়া চোরের মতো প্রবেশ করে; উঠোনের আবর্জনা নড়তে চায় না; দেওয়ালের এবং মেজের সমস্ত কলঙ্ক অক্ষয় হয়ে বিরাজ করে। কিন্তু, ডাক্তার একটা ভুল করেছিল, সে ভেবেছিল, এটা বুঝি আমাদের অহোরাত্র দুঃখ দেয়। ঠিক উলটো অনাদর জিনিসটা ছাইয়ের মতো,সে ছাই আগুনকে হয়তো ভিতরে ভিতরে জমিয়ে রাখে কিন্তু বাইরে থেকে তার তাপটাকে বুঝতে দেয় না। আত্মসন্মান যখন কমে যায় তখন অনাদরকে তো অন্যায্য বলে মনে হয় না। সেইজন্যে তার বেদনা নেই। তাই তো মেয়েমানুষ দুঃখ বোধ করতেই লজ্জা পায়। আমি তাই বলি, মেয়েমানুষকে দুঃখ পেতেই হবে, এইটে যদি তোমাদের ব্যবস্থা হয়, তা হলে যতদূর সম্ভব তাকে অনাদরে রেখে দেওয়াই ভালো; আদরে দুঃখে ব্যাথাটা কেবল বেড়ে ওঠে।

 

রান্নাঘরগুলিও , বাঙালি মধ্যবিত্তের ঘরে যে “পশমের কাজের উল্টোপিঠ” এ কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নেওয়া যায় , আমাদের পূর্বনারীরা অন্তত এ বিষয়ে অন্যথা বলবেন না। আমার স্মৃতিতে দিদিমার বাড়ির সবচেয়ে আনন্দময় স্মৃতি খাওয়াদাওয়ার। সকাল থেকে রাত এক নিরবচ্ছিন্ন খাদ্যমেলা লেগে থাকা সে বাড়িতেও রান্নাঘরটি ছিল কালো কুচকুচে। কাঠের বা কয়লার উনুনে রান্না হয়ে তেল মশলা ময়লা সবটাই পাঁচ বছর বাদে বাদে “এলা” রং করানো ছাতটিতে উঠে গিয়ে সেঁটে যেত। 

 

এই একই বৈপরিত্যের বিবরণ কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অন্য লেখাতেও। উদ্ধৃত করি যোগাযোগের মধুসূদনের বাড়ির বিবরণটি, কুমুদিনী যে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিল। 

 

বাইরের মহলে সর্বত্রই মার্বলের মেজে, তার উপরে বিলিতি কার্পেট, দেয়ালে চিত্রিত কাগজ মারা এবং তাতে ঝুলছে নানারকমের ছবি– কোনোটা এনগ্রেভিং, কোনোটা ওলিয়োগ্রাফ, কোনোটা অয়েলপেন্টিং– তার বিষয় হচ্ছে, হরিণকে তাড়া করেছে শিকারী কুকুর, কিম্বা ডার্বির ঘোড়দৌড় জিতেছে এমন-সব বিখ্যাত ঘোড়া, বিদেশী ল্যাণ্ডস্কেপ, কিম্বা স্নানরত নগ্নদেহ নারী। তা ছাড়া দেয়ালে কোথাও বা চীনে বাসন, মোরাদাবাদি পিতলের থালা, জাপানি পাখা, তিব্বতি চামর ইত্যাদি যতপ্রকার অসংগত পদার্থের অস্থানে অযথা সমাবেশ। এই-সমস্ত গৃহসজ্জা পছন্দকরা, কেনা এবং সাজানোর ভার মধুসূদনের ইংরেজ অ্যাসিস্টান্টের উপর। এ ছাড়া মকমলে বা রেশমে মোড়া চৌকি-সোফার অরণ্য। কাঁচের আলমারিতে জমকালো-বাঁধানো ইংরেজি বই, ঝাড়ন-হস্ত বেহারা ছাড়া কোনো মানুষ তার উপর হস্তক্ষেপ করে না– টিপাইয়ে আছে অ্যালবাম, তার কোনোটাতে ঘরের লোকের ছবি, কোনোটাতে বিদেশিনী অ্যাক্‌ট্রেসদের।

 

অন্তঃপুরে একতলার ঘরগুলো অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে, ধোঁয়ায় ঝুলে কালো। উঠোনে আবর্জনা– সেখানে জলের কল, বাসন মাজা কাপড় কাচা চলছেই, যখন ব্যবহার নেই তখনো কল প্রায় খোলাই থাকে। উপরের বারান্দা থেকে মেয়েদের ভিজে কাপড় ঝুলছে, আর দাঁড়ের কাকাতুয়ার উচ্ছিষ্ট ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে উঠোনে। বারান্দার দেয়ালের যেখানে-সেখানে পানের পিকের দাগ ও নানাপ্রকার মলিনতার অক্ষয় স্মৃতিচিহ্ন। উঠোনের পশ্চিম দিকের রোয়াকের পশ্চাতে রান্নাঘর, সেখান থেকে রান্নার গন্ধ ও কয়লার ধোঁয়া উপরের ঘরে সর্বত্রই প্রসার লাভ করে। রান্নাঘরের বাইরে প্রাচীরবদ্ধ অল্প একটু জমি আছে, তারই এক কোণে পোড়া কয়লা, চুলোর ছাই, ভাঙা গামলা, ছিন্ন ধামা, জীর্ণ ঝাঁঝরি রাশীকৃত; অপর প্রান্তে গুটিদুয়েক গাই ও বাছুর বাঁধা, তাদের খড় ও গোবর জমছে, এবং সমস্ত প্রাচীর ঘুঁটের চক্রে আচ্ছন্ন। এক ধারে একটিমাত্র নিমগাছ, তার গুঁড়িতে গোরু বেঁধে বেঁধে বাকল গেছে উঠে, আর ক্রমাগত ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে তার পাতা কেড়ে নিয়ে গাছটাকে জেরবার করে দিয়েছে। অন্তঃপুরে এই একটুমাত্র জমি, বাকি সমস্ত জমি বাইরের দিকে। সেটা লতামণ্ডপে, বিচিত্র ফুলের কেয়ারিতে, ছাঁটা ঘাসের মাঠে, খোয়া ও সুরকি-দেওয়া রাস্তায়, পাথরের মূর্তি ও লোহার বেঞ্চিতে সুসজ্জিত।

 

বাহির আর অন্দরমহলের কী প্রচন্ড বৈপরিত্য । চোখ জ্বলে যেতে থাকে এই বৈপরিত্যে। কিন্তু একে নির্দ্বিধায়, বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করে এসেছে মেয়েরা যুগের পর যুগ। 

 

পথের পাঁচালিতে সর্বজয়ার রান্নাবাটির চিত্র, অপরাজিততে কাশীতে ধনীগৃহের রান্নাঘরে রান্নার কাজ পাওয়া সর্বজয়ার নিতান্ত করুণ অবস্থা, দারিদ্র্য, অসহায়তা ও অসুস্থতার কাহিনিও স্মর্তব্য এখানে। আরো পরে, কবিতা সিং হের নানা লেখাতে ফুটে উঠেছে এই বৈপরিত্য, ডাবল স্ট্যান্ডার্ড, এই  সব আশ্চর্য অবদমন আর অবহেলা উপেক্ষা। 

 

আসবেন অনিবার্যভাবেই আশাপূর্ণা দেবীও এই আলোচনায়। আলু কোটা, মাছ বাছা এইসবের আটপৌরে ঘরোয়া বর্ণনার ভেতর দিয়ে যিনি অনিবার্যভাবে তুলে আনবেন রান্নাঘরের রাজনীতিকে, নারীর সঙ্গে নারীর লড়ে যাওয়ার ইতিহাসকে, সমাজে পিতৃতন্ত্রের প্রতিভূ হয়ে শাশুড়ি বা পিশশাশুড়িদের অবস্থানকে, যার সঙ্গে নিয়ত সংঘাতে যেতে যেতে ক্ষতবিক্ষত হবে পরের প্রজন্মের বউমারা। এই সংঘাত মনস্তাত্বিক , রাজনৈতিক , সামাজিক। অনেক ক্ষেত্রেই যে সব রোগলক্ষণ দিয়ে এই সংঘাতকে বোঝান হবে তা হল রান্নাঘরের খুঁটিনাটি। এখানেই তার শক্তি আর ক্ষমতা। ছোটর ভেতর দিয়ে অনেক বড় কে বুঝিয়ে দিতে পারে সে। 

 

৩। গ্রামীণ জীবন আর শহরজীবন

 

কোথায় যেন, মনে হচ্ছে এই লেখাটি লিখতে লিখতেই, আমি ধরতে পারছি একটা প্যারাডাইম শিফট। একটা জল বিভাজিকা। মা যা হইয়াছিলেন থেকে মা যা হইয়াছেন এর মত। বাঙালি মেয়ে আর রান্নাঘরের সম্পর্কের যেন দুটি ধাপ। কোথায় যেন একটা রেখা । যার আগে সব নিশ্চয়তই মুগ্ধতার , সর্বসুন্দর ছিল না। কিন্তু পরের পর্ব বড় বেদনার। নঙর্থক। 

 

 অবনতিটি কি তবে  ঘটে গিয়েছে গ্রামীণ জীবন থেকে শহর জীবনে আসতে আসতে। শিল্পবিপ্লব, নগর পত্তন, নগরায়নের বিষ বাষ্প, ইংরেজ শাসনের পাকে পাকে জড়ানো কৃত্রিমতার হিসেব  – এই উপাদানগুলি, বলা ভাল ফ্যাক্টরগুলি এসে ধীরে ধীরে পালটে দিল সবাইকে জড়িয়ে নিয়ে গ্রামের মেয়ের বাঁচা, যেখানে কাজগুলিও ছিল ভাগ বাঁটোয়ারা করা। বহু নারীর এক যৌথ কৃত্য। 

 

রাণী চন্দের “আমার মা’র বাপের বাড়ি” বইটি যদি দেখি ( বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ১৯৭৭), ছত্রে ছত্রে দেখব কত না আনন্দ রন্ধনের পাকে পাকে। 

 

সরস্বতী পূজার কথা বলতে গিয়ে বলছেন রাণী, “ আজ ঘরে ঘরে জোড়া ইলিশ আসে। মামীরা জোড়া ইলিশের কপালে সিঁদুর পরিয়ে উলুধ্বনি দিয়ে বাজার থেকে আনা মাছ ঘরে তোলেন। কচি, বাচ্চা মাছ। আজকের দিনের মাছ ভাজতে নেই, সাঁতলাতে নেই। ‘একছাইয়া’ করে কেটে ফোটানো হলুদজলে মাছ ছেড়ে পাতলা ঝোল রাঁধতে হয় এই ইলিশের। “ এইভাবেই লেখেন তিনি অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে কাসুন্দি করার পদ্ধতি। সরষে ধোয়া, ঢেঁকিতে কোটা, শুদ্ধ পবিত্রভাবে কাসুন্দি তৈরির বৃত্তান্তে লেগে থাকে উৎসব, আনন্দ। মালিন্য থাকে না কোন। আমসত্ত্বের দিনে উঠোন ছেয়ে আমসত্বের ছাঁচ পড়ার গল্প লেখেন রাণী। নানা রকম পাথরের ছাঁচ। পাটি চাটাই চিকনাই, কাসারি রেকাবি বগি থালাগুলিও আমসত্ত্বের জন্য ব্যবহার করার কথা বলেন তিনি। মায়ের শৌখিন কাজ, আর দিদিমার ঢালা কাজ । এই ভাষা গুলির ব্যবহার বলে দেয় রান্না-বান্না এক যৌথ যাপনের অঙ্গ, সে এক অনেক বড় সমাজধর্ম। 

 

এখানে রান্নাঘর কোন ছোট ঘর না। তা নদীর পাড়, উঠোন, ধান ভাণার জায়গা, ধানের মরাই, সর্বত্র ব্যাপ্ত। সেখানে উনুন সূর্য দেব, উনুন সময়, উনুন এমনকি গ্রীষ্মবর্ষাশরৎশীত বসন্ত। 

 

রাণী চন্দ বলছেন, শনির পূজা, নারায়ণ সেবা, হরির লুট, বারব্রত – সব কিছুরই ভিড়ই উঠোনে। রাণী চন্দের দিদা, অন্নপূর্ণার অন্য এক রূপ যেন। নিরিমিষ রান্নাঘরের সামনে বর্ষার জল থেকে শোল মাছের বাচ্চা গামছায় ধরার গল্প থেকে, মুড়ি মুড়কি নারকেল নাড়ুর তৈরির গল্প, সবটাতেই এই অন্নপূর্ণার ভান্ডার পূর্ণ থাকে তাই। 

 

রান্নাঘরের এই সাবেক আনন্দময় বৃত্তান্ত কি অনেকটাই ভেঙে ভেঙে গেল না, শহরে এসে? তবু তার স্বাদটি লেগে থাকল লীলা মজুমদারের ‘রান্নার বই’ তে ( আনন্দ, ১৯৭৯)। যে বইয়ের ভূমিকায়  তিনি লেখেন, রান্নাঘরের বাঁদী শব্দটির বিপরীতে রান্নাঘরের রাণীদের দাপটের কথা।আবার তিনিই লেখেন, মধ্যবিত্ত পরিবারে রান্না হয়ে কয়লার উনুনে। “নোংরা হয়, ধোঁয়া হয়, বাসন বেজায় পোড়ে, রাঁধুনীর মুখে বেজায় আঁচ লাগে এবং প্রচুর তাপ নষ্ট হয়, অর্থাৎ একশো বছর আগের অসুবিধাগুলো এখনো দিব্যি প্রকট। “

 

এর পর তিনি নানা রকম ধোঁয়াশূন্য চুল্লির কথা তোলেন। স্টোভ , যা কেরোসিনে চলে, তার কথাও বলেন। 

 

এভাবেই ক্রমশ আমরা প্রবেশ করছি আমাদের সময়ে। মা মাসিদের যুগ থেকে গ্যাসে রান্না করার চল হল। এখন ত সর্বজনের কাছে লভ্য করতে প্রধানমন্ত্রীর যোজনাই রয়েছে। 

 

কবিতা সিং হ তাঁর ‘ক্ষমা’ নামের এক গল্পে হুবহু তুলে আনেন এক বিশাল যৌথ পরিবারে নববধূ হয়ে আসা এক শিক্ষিতা কর্মরতা মেয়ের কথা। বেমানান বউ। যৌথ পরিবারের মহাপরাক্রান্ত শ্বশুর। শাশুড়িকে মারেন ধরেন। অত্যাচার করেন। কেউ কিছু বলে না।  শাশুড়ি দাওয়ায় বসে কুটনো কোটেন।

 

 এখানেও পাব রবি ঠাকুরের স্ত্রীর পত্রের যেন এক সমর্থন।  এ বাস্তবতা কলকাতার বহু বহু বছরের মধ্যবিত্ত সংসারের। 

“লতার নাকে সেই ড্যাম্পের গন্ধ এখনও লেগে আছে। যেন এখনও সেই গন্ধ পাচ্ছে। যে গন্ধ পচনের উপমা। নষ্ট গন্ধ। শেষ হয়ে যাওয়ার গন্ধ। সেই নড়বড়ে প্রাচীন বাড়িটা তার মনের মধ্যে এখনো দুঃস্বপ্নের মতো বসে আছে। নীচের তলায় কতগুলো অন্ধকার ঘর। দিনের বেলায় সেখানে তেলচিটে ন্যাড়া বালব জ্বালতে হয়। ভাঁড়ার ঘর, পুজোর ঘর, রান্নাঘর, ঠাকুর চাকরদের ঘর। “

 সিঁড়ির তলার অন্ধকার  একটি ঘরকে চুনকাম করে নিজের মত করে  থাকতে শুরু করে বরণ-করে-না-আনা বউটি। কারণ ছেলে নিজের মতে বিয়ে করেছে। তারপর একদিন বউটি নিজের ছোট কেরোসিন স্টোভ এনে চা বানানোর আয়োজন টুকু করে ফেলে। মানে একটা চার দেওয়ালের মধ্যে যেন স্বাধীনতার স্বাদ। নিজের রান্নাঘর হল না। অন্তত ক্লান্তি অপনোদনের চা টুকু ত হল। 

 

কিন্তু  এই সাম্যাবস্থা ক্ষণিকের। স্বামী দেবকুমারের সঙ্গে লতার ঝগড়া বাড়তে থাকে। দেবকুমারের মা তার বাবার কাছে জো হুজুর। লতা নয় কেন। দেবকুমারের দাবী বাড়ে। লতা বোঝে দেবকুমারের ভেতরেও আছে তার বাবারই রক্ত। পুরুষত্বের দাবি।  সে হঠাত শোনে, তার ক্যাবলা নিরীহ শাশুড়ি তার স্বামীকে ভাত ডাল বেড়ে দিতে দিতে বলছে, “একদিন বেধড়ক মার দে, তাহলেই দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে…”

 

 তারপর লতা সে ঘরে ঢুকে আসে। স্বামীকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। তারপর কি হল দেখে নেওয়া যাক কবিতা সিং হের কলম থেকে। 

 

দেবকুমার তার পিছনে ছুটে গিয়ে উঠোনের মাঝখানে ফেলে তাকে প্রচন্ড মারল। শাশুড়ি নীচের উঠোনে দাঁড়িয়ে, আর দেওর ননদ ওপরে বারান্দায় দাঁরিয়ে সব দেখল। … কিন্তু কিছু বলল না। 

 

সে এক অদ্ভুত দিন।  লতা তার ঘরে ফিরে গিয়ে… ঘরের কোণে যে কেরোসিনের বড় ক্যানটা রাখা ছিল সেটা নিয়ে সারা ঘরে ছিটিয়ে দিল। তারপর দেহসলাই এর বাক্সটা হাতে করে দাঁড়াল। কি ভয়ংকর জ্বালা। আগে সে ভাবত বাঙালি ঘরের বউ রা আগুনে পুড়ে মরে কেন? আসলে এতদিনে বুঝতে পারল ওই পোড়ার জ্বালা তাদের জ্বলএন্র প্রতীক। 

 

এভাবেই বিংশ শতকের বাঙালিনি রান্নাঘরের পলিটিক্স স্থাপিত হয়। একদিকে শোষণ বঞ্চনা। অন্যদিকে টিন টিন কেরোসিনের ধোঁয়া ও আগুনের মধ্য দিয়ে প্রতীক তৈরি হয়। রান্নাঘরের বাঁদীর। 

 

৪।পরিবেশ বান্ধব রান্নাঘরের গল্প

 

আমার শৈশব দেখেছে আমার দিদিমাকে। যিনি রাণী চন্দের সমসাময়িক প্রজন্ম। আর দেখেছে মাকে। কবিতা সিং হের প্রজন্ম। চিনে নিয়েছে অন্নপূর্ণাকে দিদিমার মধ্যে।  আর নীরবে ক্ষয়ে যাওয়া পরিশ্রমে নুয়ে যাওয়া এক একাকী পথিককে মায়ের মধ্যে। তবু। দুজনেই শিখিয়ে গিয়েছেন রান্নাঘরের ভেতরে আছে অনেক পাঠ। আজকের পরিবেশ নিয়ে সচেতনতার যুগে এ পাঠগুলো বার বার ফিরে দেখার। 

 

ও বাংলা থেকে চলে আসা বাঙালরা ১৯৪৭ এর পর থেকে পাতে এক কুচি ভাত , আধখানা লঙ্কা ফেলেন নি। লেবু বা সজনে ডাঁটা বা আমের আঁটি শেষতম ছিবড়ে না হওয়া অব্দি ফেলেননি।

আমাদের ছোটবেলা জুড়ে মা , মাসি, পিশি, দিদা, মায়ের পিশিমা, সবার রান্নাঘরগুলোও এক একটা রিসাইক্লিং এর আস্ত কারখানা ছিল। রান্নার আগে কত না প্রস্তুতি। সেই সব অপার্থিব স্বাদের আলুর খোসার ছেঁচকি বা পটলের খোসার ছেঁচকিগুলো কে ভুলবে? অথবা লাউয়ের খোসার জিরিজিরি ভাজা, যাতে একটু আলু আর কুমড়ো পড়লে তা নিজেই হয়ে ওঠে একটি পদ? ভাত বাসি হলে জলে ডুবিয়ে পান্তা যেমন, তরকারি বাসি হলে সে তরকারি গরম করার তরিকাও কত রকমের। তেল গরম করে একটা শুকনো লঙ্কা ফেলে ছ্যাঁকছোঁক করলেই একদম ফ্রেশ। মাংসের ঝোল অবশ্য যত বাসি আর যতবার ফোটানো, ততই মজে অপূর্ব স্বাদ, ওটা রান্নাঘরের বেদবাইবেলেই লেখা। আর হ্যাঁ, কে ভুলতে পারে, একটু পুরনো একটু টকে যাওয়া মুশুরডালকে জল মেরে মেরে টক ডাল বানানোর রীতি। সঙ্গে তেঁতুল শুকনো লঙ্কার শুদ্ধিকরণ। আঁট হয়ে আসা সেই ডাল দিয়ে একথালা ভাত হাপুশহুপুশ করে খেয়ে নেওয়া যেত।

রসগোল্লা ঘরে এলে, মিষ্টি খাওয়া শেষ হলে রসটা চাটনিতে যেত, আর হাঁড়িটি গাছ পোঁতার জন্য বারান্দায় যেত । কাঁচা আম উঠলেই আচার হত। পাকা আম বেশি পাকলেই গুড় দিয়ে গুলে ঘ্যাঁট পাকিয়ে আমসত্ত্ব দেওয়া হত, চাঁচারির ওপর তেল মাখিয়ে প্রচুর রোদ্দুর, কাজেই সোলার এনার্জির সদ্‌ব্যবহার। চাঁচারির চালনির ছক কাটাকাটা দাগ পড়ে যেত আমসত্ত্বগুলোতে। কালো হয়ে আসা,  ছোটমুখওয়ালা টিনের ডালডা কৌটোয় সে আমসত্ত্ব তোলার আগেই যে অর্ধেক হাপিশ হয়ে যাচ্ছে সেটা অবশ্য ধর্তব্যের মধ্যেই ধরা হত না। আমসত্ত্ব আর আচার চুরির বৈধতা ছেলেপিলেগণকে দেওয়া ছিল। যা কিছু প্রভূত উৎপাদিত হত এবং পাওয়া যেত, তাই কিছু না কিছুভাবে সংরক্ষণ হত তো। শুকিয়ে, গুটিয়ে, নেড়ে চেড়ে, নানাভাবে রক্ষা করার নামই নাকি গৃহিণীপনা। কস্মিনকালেও এর সঙ্গে কৃপণতার কোন যোগ আছে নাকি?

ফেলে দেওয়ার কোন সিন ছিল না আমার মায়ের রান্নাঘরেওবাসি পাউঁরুটির তরকারি আমি এখনো বানাই, একটু পুরনো না হলে , একটু শুকিয়ে না উঠলে ওই টুকরো করে কাটা রুটিগুলোর ভাজাভাজা ভাবটা খোলতাই হয়না। শুনেছি ঠিক এইভাবে মারাঠিরা আটার রুটি , মানে যাকে ওঁরা বলেন পোলি, তার সবজি বানানো হয়। বাড়তি , ঝড়তি পড়তি যে কোন খাবার দিয়ে অসম্ভব ভাল ভাল স্ন্যাক্স তৈরি এক সর্বভারতীয় কৃতি।

অ্যান্সিলিয়ারি বাকি যা যা উদ্‌বৃত্ত হত রান্নাঘর থেকে, তা অবধারিতভাবে যেত বেড়াল বা পাখিদের খাদ্য হিসেবে। শেষ পর্যায় গাছেদের। মাকে দেখতাম মনোযোগ দিয়ে একটা বালতিতে জমিয়ে, ডাল ধোয়া জল চাল ধোয়া জল গাছের গোড়ায় দিতে। শুনেছি, আমার এক বান্ধবীর মা রান্নাঘরের পেছনের জমিতে এত রকমের সবজির জল, সবজিগুলোর বীজশুদ্ধ ফেলতেন যে সেখানে এক রীতিমত বীজতলা হয়ে, নানা সব্জির গাছ গজিয়ে উঠেছিল।

অল্প লইয়া থাকি তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়। এই গানটাও ঐ সব মা-দিদারা গাইত খুব। কিন্তু তা বলে কোন দীনতা ছিল না তো ঐ অন্নপূর্ণা প্যাটার্নের মহিলাদের মধ্যে? বাড়িতে দীয়তাং ভুজ্যতাং চলছে, চলছেই। কত লোকের পাত পড়ছে , যার মধ্যে অনেকেই অনাত্মীয়, পরিচিতমাত্র, গ্রামসম্পর্কের ভাইপো বা ভাইঝি। আর কী কী সব অদ্ভুত নাম হত বাঙালদের এই মামা মাসি কাকা ভাইবোনদের। বুজুন লালু ভুতো ভ্যাদন মনা বংকা।

সেই সব ভাইবোন ভাশুর দেওর সার দিয়ে বসে পড়লে, কারুর পাতে একটা গোটা ডিম তো অন্যদের আধখানা ডিম। মামাদের কাছে গল্প শুনতাম , বয়সে বেশি বড় নয় এমন এক কাকা, তাদের পাত থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিতেন ডিম  বলতেন,  বুঝিস না, আমার ডিমটা লাগে, শরীরটা বাড়ছে না? বাড়ন্ত গড়ন। পুরো টেনিদার গল্প।

সত্যিই তো ডিম কম পড়তই সংসারে। তাই তো, দিদার ঐ সুতো দিয়ে কেটেকুটে মাঝে মাঝেই ডিমসেদ্ধ ভাগবাঁটোয়ারা। তার পরের স্টেজে, ডিমক’টা দিয়ে অমলেট করে সেই অমলেটই কেটে কেটে ঝোলে ফেলে দেওয়া। পাতলা বা গরগরে টমেটো পেয়াঁজ রসুনের ঝোল, তার মধ্যে ভাসমান অমলেটের টুকরো। আহা। এর পরের সেটেজ, আরো যখন টানাটানি, দশজনকে তিনটে ডিম দিয়ে ঝোল করে দিতে হবে , তখন তো ডিম ফেটিয়ে তার মধ্যে ময়দা বা ব্যসন , পেঁয়াজকুচি দিয়ে গোল গোল বড়া ভেজে ঝোলে দেওয়া।

সবটাই ছিল অল্প লইয়া ম্যানেজ করার ছক।

নাঃ কোন কৃপণতা ছিল না। বরং আজকের যুগের কোন ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিট্যুটে , এ নিয়ে একটা লেকচারে ডাকা যেত দিদাকে। সর্বক্ষণ হাসিমুখে, পজিটিভ থেকে, অল্প সামর্থ্যের মধ্যে যাকিছু পাওয়া যায়, সবকিছুকে অপটিমাল লেভেল অব্দি ব্যবহার করে নিতে পারার ক্ষমতা, আমাদের নেই।

ছোট্টবেলায় শরৎ চাটুজ্জের মেজদা পড়তাম আমরা ইস্কুলের বাংলা বইতে। সেটায় মনে আছে, বহুরূপীর বাঘসজ্জার একটা দড়ির লেজ নিয়ে শেষ মন্তব্য, পিশিমার? রেখে দাও, ওটা কাজে লাগবে।

ওই এক লাইন নিয়ে অনেক টীকা টিপ্পনী লিখেছি ইশকুলে। কিন্তু তার বেশি, আমাদের মাতৃতন্ত্রের মুখে ওই কথাটা শুনেছি উচ্চারিত হতে। সবকিছুই ছিল  রেখে দাও, কাজে লাগবের দলে। এখন ফেলার কালচার এসে আমাদের গ্রাস করেছে। অল্প অল্প করে ভাত ডাল বানিয়ে ফ্রিজে রেখে রেখে খাওয়া। তাই বাসি পচা নেই। জামাকাপড় তো গন্ডায় গন্ডায় কেনা হয়, কাজেই ফেলে না দিলে আলমারিতে জায়গা কোথায়? ইউজ অ্যান্ড থ্রো-র যুগে, আমাদের জীবদ্দশায় দেখে ফেলেছি যে সংরক্ষণের ঘোর অভ্যাসগুলি, সেগুলোই বেশ কল্পকথা। 

 

ঠাকুমা, দিদু আর মায়ের ছিল শিশিবোতল জমানোর বাধ্যতা। কে জানে, ওরা আর সব গৃহিণীদের মতই, নাকি একটু অদ্ভুতই! কেন যেন আমাদের বাড়ির লোকেরা, কিছুতেই ফেলতে পারত না কিচ্ছু। একের পর এক জ্যাম জেলির বোতল আসত বাড়িতে, পরে, কাগজ-কাবাড়িওয়ালার কাছে দেওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। “কাজে লেগে যাবে” সব। এমনকি যারা মিষ্টির দোকানের রসগোল্লার হাঁড়িটি বাড়িতে এলেও,  রসগোল্লা খাবার পর রসটা চাটনির জন্য তুলে রাখে, এবং হাঁড়িটা বারান্দায় তুলসি চারা পোঁতার জন্য, জ্যান্ত শিশিবোতল তারা আর কী করেই বা কোন প্রাণে ফেলে দেয়?

হ্যাঁ, আমার ঠাকুমা যখন নিজেই টমেটো সস বানাতেন, তখন, বা আচার বিলি বন্দোবস্ত করতেন, তখন সেই সব শিশিবোতলের ডাক পড়ত। মিটসেফ নামে একটা জিনিশ থাকত সব বাড়িতে। কালচে, তেলচিটে, বাদামি থেকে কালো হয়ে যাওয়া জালে ঘেরা একটা আলমারি। ভেতরে অনেক দূর অব্দি অন্ধকারে সার সার দাঁড়িয়ে থাকত সব আচারের শিশি ও বয়াম। বয়ামে আচার বানানোর পর, মেয়েরা বাপের বাড়ি এলে তারা শ্বশুরবাড়ি ফেরার সময়ে সেই ছোট ছোট হরলিক্সের শিশিতে করে দু তিন রকম আচার যাবে না তো কী? ছেলে মেয়েরা দূরে হোস্টেলে পড়তে গেলে, তাদের সঙ্গে তিলের বা নারকেলের নাড়ু, মুড়কি, মোয়া এসব বানিয়ে বানিয়ে,  বোতলে ছাড়া আর কিসে করেই বা দেওয়া হবে। মনে নেই, অপুকে সর্বজয়া তার পড়তে যাবার সময়ে ট্রাঙ্কে কী কী বাঁধাছাঁদা করে দিয়েছিল?

ঠিক একইরকম ভাবে, গ্রীষ্মের সব ফল ফলাদি আচার হয়ে বোতলে ঠাঁই পাবে, আর শীতেরগুলিও। এমনকি, যে সব সরু মুখ টমেটো সসের বোতল আসবে বাড়িতে, সেগুলিও ধোয়া হয়ে গেলে, তার ভেতরে ভরা হবে অনেক টমেটো নুন আদা রসুন দিয়ে সেদ্ধ করে, ঠান্ডা করে, কাঁই আলাদা করে, ছেঁকে আবার বড় পাত্রে অল্প আঁচে ভিনিগার, চিনি, সব মিশিয়ে,  ঘন করে তোলা ঘরোয়া টমেটো সস। সেই সসের স্বাদ বড় কোম্পানির সসের থেকে অনেক বেশি ভাল, সে বলাই বাহুল্য। ঠাকুমা প্রতি শীতেই আমাদের জন্য নামে নামে এমন বেশ কিছু বোতল রেখে দিতেন।

এই ভাবেই বাড়িতে সার দিয়ে সাজানো ধোয়া বোতলগুলি, রান্নাঘরের কোণায় সযত্নে সাজানো থাকত। থাকত ভাঁড়ারঘরের পেছন দিকে। ভরা বোতলেরাও থাকত। গ্রীষ্মের ছুটির দীর্ঘ দুপুরে চুরি করে খাবার জন্য। লীলা মজুমদারের গল্পে যে আচার ভেবে ভুল করে কে যেন একটা মরা আরশোলাও তুলে এনেছিল। ভাঁড়ার এত অন্ধকার!

শিশি বোতলের গল্প বলতে শুরু করলেই মনে এসে যাবেন সুকুমার রায়।

মিশিপাখা শিখিপাখা আকাশের কানে কানে

শিশিবোতল ছিপিঢাকা সরু সরু গানে গানে 

নেড়া এই গানটা খুব নরমসুরে গেয়েছিল, আমাদেরও মনে থেকে গেছে যুগ যুগ। “হিজিবিজ্‌বিজ্‌ বলল, ‘হ্যাঁ, গানটা ভারি শক্ত ।’

ছাগল বলল, ‘শক্ত আবার কোথায় ? ঐ শিশি বোতলের জায়গাটা একটু শক্ত ঠেকল, তাছাড়া তো শক্ত কিছু পেলাম না ।’ …

এসব বোতলের গল্প পলিপ্যাকের যুগে এসে কি হারিয়ে বা ফুরিয়ে যাবে? কাচের বোতল ক্রমশ বেমিল হতে হতে ডোডোপাখি হয়ে গেছে। হরলিক্স কোম্পানিই কাচের বোতল বন্ধ করে পেট বোতল করেছে বহুদিন। শুনি, অনেক পরিবেশ সচেতন মানুষ আবার নতুন করে কাচের বোতল ব্যবহারের ডাক দিচ্ছেন আজকাল। প্ল্যাস্টিক বর্জনের কর্মসূচি নিচ্ছে নানা দেশ-রাজ্য-মিউনিসিপালিটি যখন, এ কথা ভাবাই যেতে পারে।

কিছু ফেলতে না পারা দিদা-ঠাকুমাদের পুরনো ছেঁড়া শাড়ির ন্যাকড়ার জায়গায় টিশ্যুপেপার আর বোতলের জায়গায় পলিপ্যাকের থলথলে শরীরগুলো, ক্রমশ ‘সুবিধেজনক’ আর ‘ইউজ অ্যান্ড থ্রো’ –মায়াহীনতায় গ্রাস করে নিচ্ছে আমাদের। যেভাবে লোপাট হয়ে যাচ্ছে দিদিমা ঠাকুমারা আর পিশতুতো মামাতো মাসতুতোরাও!

এই সময়ে দাঁড়িয়ে, আমাদের অনেক পুরনো দিনের ছাতগুলো বড্ড মায়ার হাতছানি দেয়। কাপড়ের ঢাকনি পরানো সার সার বোতল তেল –আম-কুল-তেঁতুল –লেবু নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে স্মৃতির ওপারে। মন কেমন করে ওঠে।

 

 

৫। বিশ্বজোড়া রান্নাঘর

 

শেষ করি আবার এক বিদেশের গল্প দিয়েই। ইরানের মেয়ে, থাকেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন সামিন নোসরত। বইয়ের পাশাপাশি আছে তাঁর টিভি সিরিয়াল, সমনামী। আছে নিজস্ব ব্লগ ও। বইটির নাম salt fat acid heat .,,,নুন তেল টক তাপ… এই চার জিনিসের সমন্বয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে সামিন খুঁজে ফিরেছেন রান্নার ম্যাজিক, যাদু, রহস্য। কিন্তু শেষ মেশ তিনি ফিরে এসেছেন নিজের রান্নাঘরেই। আর বলেছেন, বাড়িতে আত্মীয়দের ডাকলে তাঁদের কেও স্যালাডের পাতা কুটতে বা অলিভ অয়েলে মশলা মিশিয়ে সস তৈরি করতে কীভাবে উৎসাহিত করেন তিনি। কেন করেন? কারণ রান্না যে কোন কষ্টকর ক্লান্তিকর বিরক্তিকর প্রক্রিয়া না তা বোঝাতে চান। ফ্রেশ ইনগ্রেডিয়েন্ট, মানে তাজা সবজি তাজা মাছ মাংস তাজা মশলা শাক এইসব দিয়ে যে রান্না, তাকে ভুলতে বসেছে পাশ্চাত্যের মানুষ। 

 

আমারো এটাই প্রতিপাদ্য। সামিন নোসরতের  রান্নার বই পড়ে, তাঁর শো দেখে ভেতরের প্রতিটি তন্ত্রীতে টান পড়ল। মনে পড়ল রাণী চন্দের ‘আমার মার বাপের বাড়ি’র পাতাগুলোই আবার। মনে পড়ল আমার দিদিমাকে, আবার।

মেয়েদের সংগে রান্নাঘরে র সম্পর্ক বহুদিনের কিন্তু গ্রামীণ, প্রিকলোনিয়াল সময়ে তা ছিল সহজ, জৈবিক, স্পষ্ট। এবং অনবদমিত। শোষণ মুক্ত। মেয়েরা নয় শুধু, গোটা পরিবার ঘিরে থাকত উনুনকে। a home is where the hearth is.

আধুনিকতা, শিল্প বিপ্লব পরবর্তী অবস্থায় এটা পালটে গেল। ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক অবস্থায়, টান পড়ল খাদ্য বস্তুতে। আর মেয়েরা হলেন রান্নাঘরে র বাঁদী। রান্নাঘর হল অন্ধকার ছাইপাঁশ এর গাদার পাশের এক বন্দিশালার নাম। 

মেয়েদের অনবদমিত মুক্ত স্বাধীন ভাবতে ভাবতেই দেখলাম, রান্নার শিল্পগুণ হারিয়ে গেছে। রান্না হয়ে গেছে এক দিনগত পাপক্ষয়।  এক দু প্রজন্মে সবাই রান্নাকে এক অভিশাপ মনে করতে লাগলাম। যৌথ পরিবারগুলো আদিতে ছিল যৌথ কর্মশালা। শহরের প্রেক্ষিতে সেটা হয়ে গেল পৈশাচিক , নারকীয়। দায়হীন , ঘষ্টে চলা অভ্যাস। মনে করে দেখুন তপন সিং হের সেই “গল্প হলেও সত্যি” ছবি। পঞ্চাশ দশকে তৈরি ছবি । রান্নাঘর, তার সামনের উঠোন, তার উল্টোদিকের দালানে বসে সবার খাওয়া দাওয়া। এই যৌথ পরিবারে সুখ শান্তি নেই। আছে ঝগড়া, কর্মবিভাগ নিয়ে ক্ষোভ। নোংরা পিছল দালান। কেউ তা পরিষ্কার করার কথা কোনদিন ভাবেইনি। এই হল ঔপনিবেশিক রান্নাঘর। রবীন্দ্রনাথ যে ছাইগাদার কথা লিখলেন, তপন সিং হের ছবিতে ফুটে উঠল তার আরোও ২৫ -৩০ বছর পরের ছবি। স্বাধীনতা উত্তর কলকাতার তীব্র সংকট ময় দিনকালের ছবি। সেখানে রান্নাঘরই মাইক্রো কসম। ছোট আকারে আমাদের বিশ্বভুবন। কেউ দায়িত্ব নেবে না । সবাই একে অপরকে দুষবে। 

 

আরো পরে আসবে স্বাধীনতা। আপাত দৃষ্টিতে। পোস্ট কলোনিয়াল বা উত্তর ঔপনিবেশিক জমানায় আমরা মুক্ত হলাম। যৌথ পরিবার ভেঙে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি হল। জা ননদ শাশুড়ি গিয়ে মিক্সি আর মাইক্রোওয়েভ এল। আমাদের বাড়িতে ঢুকল রাশি রাশি গ্যাজেট। তৃষ্ণা বসাক তাঁর ‘প্রযুক্তি ও নারী’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন রান্নাঘরে হামানদিস্তা বা শিল নোড়ার বদলে মিক্সি ঢুকে পরিশ্রম লাঘব করল হয়ত, কিন্তু মেয়েদের দূরত্ব বাড়াল একে অপরের সঙ্গে। দূরত্ব বাড়ল রান্নার উপকরণের সঙ্গে। এখন মিক্সি টিকে ধুয়ে তুলে রাখতে প্রচুর সময় লাগে। পরিচ্ছন্ন রাখতে হয় প্রতিটি যন্ত্রকে। জীবনযাপন একাকিত্ব ময়, অনেক নারী মিলে মিশে গল্প করতে করতে রান্নার পরিসর চলে গিয়েছে। ক্রমশ কর্মরত , ঘরে বাইরে শোষিত মেয়েদের জীবন আরো চাপের হয়ে যাচ্ছে। 

 

 মেয়েরাও পুরুষদের সমান হল, তাতে ক্ষতি এই হল যে মার্কিন বাত্তি ওয়ালা মেয়েরা সারা সপ্তাহ প্রোটিন বার আর রেডিমেড প্রোটিন শেক খেয়ে কাটায়। দিনান্তে ক্লান্ত দেহে মাইক্রোওয়েভে পিৎসা গরম করে খায়। ভাল খেতে না পাওয়া, তাজা খাবার না পাওয়া,  সেটাও কম দাসত্ব না। তাজা সব্জি, তাজা স্যালাড খেতে হলে যে পরিমাণ পরিশ্রম তাতে দিতে হয়, তা আনন্দহীন হয়ে গিয়েছে। “সময় নেই” এর ভূত তাদের তাড়া করেছে। তাই বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। খাবারের স্বাদই শুধু কমেনি, জীবনের সাধ ও কমেছে। 

পুরুষরা আদি যুগ থেকে রান্নাঘরে যেত না বলে মহিলাদের ও আর রান্নাঘরে না যাওয়াটাকে আমরা স্বাধীনতা মানলাম। উল্টোটা হওয়া উচিত ছিল, পুরুষ নারী উভয়ের মিলিতভাবে রান্না করা চালু হওয়া উচিত ছিল। সেটা ত হল না। দার্শনিক লেখক অরিন্দম চক্রবর্তীর “স্নেহগেহবন্ধুত্ব” প্রবন্ধেও এই কথাই আছে। স্নেহ বা গৃহের টান কমছে। সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে গিয়ে তাই গৃহ ভেঙ্গে যাচ্ছে। মেয়েদের দেওয়া সেবা, যত্ন, স্নেহ, এগুলোর অবমূল্যায়ণ শুরু কবে? যেদিন থেকে বাঁধা মাইনের চাকরিতে ছেলেদের বাইরে যাওয়া, প্রতিটি ঘন্টাকে সু-উপায়ী বা প্রডাক্টিভ করে তোলার প্রয়োজনীয়তা মাথার মধ্যে গেঁথে দিলেন ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসক। ঘড়ি ধরে কাজ করে ট্যাঁকে মাইনের টাকা যে আনছে সেই শুধু সমাজে কর্মী। বাকিরা এলেবেলে আলতু ফালতু। তাই সেবা, যত্ন, গৃহ শ্রম ক্রমশ মূল্যহীন। যেমন মূল্যহীন সংসারের সেই সব পুরুষেরা যাঁরা গান গাইতেন ছবি আঁকতেন, পাড়ায় ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন, এর জুতো সারাতেন ওর বাজারটা করে দিতে যেতেন, শ্মশানবন্ধু হতেন। কুমড়ো কাটা বট ঠাকুর হতেন। কলোনিয়াল ভাষায় তাই হল ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান। এই হিসেবে দেখলে লিওনার্দো দাভিঞ্চির মত শিল্পীও আজকের সমাজে এলেবেলে গণ্য হতেন। 

 

পোস্ট কলোনিয়াল সময়ে রান্নাঘর মেয়ে পুরুষ সবার জীবন থেকেই উঠে গেল। পড়ে রইল রেস্তোরাঁ, টেক অ্যায়ে, রেডি টু ইট, প্যাকেজড ফুড, রান্নার লোক প্রমুখের তোইরি রান্না। অ্যালিয়েনেশন ঘটল টোটালি। রান্নার প্রক্রিয়ায় যে আনন্দ আছে, এটা যে সবাই মিলে ভাগ করে নিয়ে করার মত জিনিস, খেতে যতটা ভাল লাগে, রান্না করতেও ততটাই ভাল লাগা উচিত, এসব কথা  পাশ্চাত্যকে আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন সামিন নোসরতের মত অনেকে। আমাদের কবে ভ্রমমুক্তি ঘটবে কে জানে। 

 

মায়ের কর্তব্য ভিন্ন কিছু নাই

molina

সে একজন মা। একজন কারুর স্ত্রী, একজন কারুর মেয়ে, একজন কারুর বোন। এবং মা। এইসব পরিচয় তৈরি হয় সমাজে। তারপর সারাজীবন সেই ছাপ্পা গুলো নিয়ে চলতেই হয়। সেটাই দস্তুর।

হ্যাঁ মাতৃত্বের আনন্দ আছেই । আনন্দটুকুকে এতটুকুও খাটো করছিনা। অনন্ত সুখের পিন্ড আছে সন্তানে। কিন্তু তারপরেও থাকে অনেক প্রশ্ন, অনেক কথা।

প্রথম যেদিন সে মাতৃত্বের রণডংকা বাজতে শুনেছিল, সেদিন ছিল তুমুল দুর্যোগের দিন। বিবাহিত জীবনের মোটে আট কি ন মাসের মাথায় সেই দিন।

তার আগে সে তার বরকে, যৌন সঙ্গমের সময়েও , নানা বিধিনিষেধের মধ্যে রেখে, নিজের গর্ভাধান আটকানোর চেষ্টা করেছে। তার বরও কিছু কম শিক্ষিত পরিশীলিত নয়। সে নিজেও চাইত না বিয়ের পরের রাত্তিরেই বউকে প্রেগনেন্ট করার মত “নীচকর্ম” করতে। যেটা তার অনেক বন্ধু করেছে, এবং আড়ালে খিঁকখিঁক হেসেছে তারা , এরা সব ফার্স্ট নাইট কেস।

শিক্ষিত স্বামী হবার নাতে, স্ত্রীর সঙ্গে বসে ক্যালেন্ডার দেখে সংসর্গ ঠিক করেছে। দু হাজারের দম্পতি তারা।

বহু স্ত্রীর এই সৌভাগ্য হয়না সে জানে। সে দিক থেকে তার কোন আপশোস অভিযোগ নেই স্বামীর প্রতি।

সেটা অন্য গল্প, যে তথাপি অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়া থাকে, এবং ঘটিলে তাহা “ঈশ্বরের দান” হিসাবে মানিয়া লইতে হয়।

অ্যাক্সিডেন্ট ঘটল এবং পিরিওড মিস হল। সে দেখল, মুহূর্তে পৃথিবীর রঙ পালটে পাটকিলে, ধোঁয়াটে এবং অসম্ভব ক্লান্তিকর হয়ে গেল তার কাছে। গুরুভার হয়ে উঠল জীবন।

কিন্তু সে তো তার নিজের কাছে। অফিসে একটা নতুন অ্যাসাইনমেন্ট। সেটাতে দক্ষতা দেখাতে পারবে না , ভেবে বসের কাছে কুঁকড়ে যাওয়া। শরীরের নানা আশ্চর্য নতুনত্বের ঝড় , তাকে বহন করার জন্য দক্ষতা অর্জন। সব ছিল কার্যক্রমে। প্রথম তিনমাসের অসম্ভব গা গুলনো এবং আর যা যা হয়ে থাকে।  সকালে ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘর থেকে আসা এমনকি সাদা পটল আলুর ছেঁচকির সেই সম্বর দেবার গন্ধেও অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসতে থাকছিল তার।

এইসব পেরিয়ে সে দেখল, পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যার পুরাতন, আদিম, প্রাচীনতম খেলা শুরু। শ্বশুর এবং শাশুড়ি আনন্দে আটখানা। অন্য সবকিছু গোপনীয়তার চাদরে ঢাকা থাকলেও, সন্তানসম্ভাবনা একধরণের প্রোমোশন।

ভয়ানক পরিশীলিত এবং বাঙালি ভদ্রলোকের এপিটোম তার শ্বশুরমশাই হঠাৎ বসবার ঘরে সবার সামনে আবেগ থরথর কন্ঠে প্রায় আবৃত্তির ঢঙে বলে ফেললেন, প্রথমে সে তুমি ছিলে কন্যা। তারপর স্ত্রী হলে। এখন হবে মা। নারীত্বের সম্পূর্ণতাই তো মাতৃত্বে। তোমার পদোন্নতি হল। জীবনের সর্বোচ্চ ধাপে উঠে গেলে তুমি।

তার শাশুড়ি কেমন ভয়ানক গুরুত্ব দিতে শুরু করলেন তাঁকে। প্রায় যা পুলিশি খবরদারির মত দেখায়!

একমাত্র আনন্দ জন্মেছিল তিনমাসের মাথায় প্রথম সোনোগ্রাফির দিনে, অপরিচিত এক নতুন ধুকপুকুনির শব্দ ডাক্তার যখন শোনালেন, আর সোনোগ্রাফির স্ক্রিন তার দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন কী ভীষণ দৌড়চ্ছে আপনার বাচ্চা জলের ভেতর। মাছের মত ঘাই মারছিল একটি ছায়া। সেই ছায়াকেই ভালবাসল সে। মুখহীন এক শিশু।

সন্তানটির আসার আগে, সকলের ফুর্তি আর পুলক তাকে খুবই বিচলিত করলেও, সে মেনে নিল মাসে একবার করে ডাক্তার দেখিয়ে আসা।

তারপর, মেনে নিল সবার তার ওপরে নানা খবরদারি। এটা করবে না ওটা ধরবে না। এভাবে শোবে না, ওখানে বসবে না। কিচ্ছু বাইরের খাবে না।

ফুচকা চুরমুর চিকেন রোল আদি দীর্ঘ কয়েক মাসের জন্য বন্ধ হল।

তারপর সেই মহা মুহূর্ত। সে ঢুকে গেল ভীত চকিত এক স্ফীতোদর শরীর নিয়ে, নার্সিং হোমের গর্তে। সেই রাতেই তার যৌনকেশ ব্লেড দিয়ে শেভ করতে করতে বয়স্কা নার্স বললেন অমোঘ বাণীঃ মেয়েদের এই এক জ্বালা। যতই পড়ো আর যতই বড় চাকরি কর, এর থেকে নিস্তার নেই।

সাতদিনের নার্সিং হোম বসবাসে সে দেখে শুনে বুঝে ফেলল সন্তানজন্ম নিয়ে আয়াদের উল্লাস, নতুন শাড়ি পাওয়ার আশ্বাস। চোখে মুখে অশ্লীল ভঙ্গি করে কত না রসিকতা, সন্তানজন্মের গূঢ় তত্ত্ব নিয়ে। দাদার এবার একতলায় ঢোকা বন্ধ, দোতলায় নতুন ভাড়াটে এসেছে। হি হি।

স্বামী তো অদ্ভুত আচরণ করছে, সে দেখল।  অপারেশনের দিন দেখতে এল,  তারপর কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে , অন্যমনস্ক হয়ে, কেমন যেন উদাসীন, বাড়ি চলে গেল, একটু মিষ্টি কথাও না বলে। গলা আটকে এল কান্নায় , মেয়েটির। বাচ্চাটা আমাদের দুজনের তো। তাহলে কেন আমাকেই শুধু থাকতে হবে ঠান্ডা সাদা এই নার্সিং হোমটায়। আর তুমি ভিতু আত্মীয়ের মত, অসুস্থা গিন্নিকে দেখে কাষ্ঠ হাসি হেসে চলে যাবে, তারপর পরদিন বলবে, সারা সন্ধে ছেলে বন্ধুরা তোমাকে ঘিরে রেখেছিল মালের আড্ডায় , কেননা, বাচ্চা হলেই গিন্নির প্রেম চলে যাবে, সব অ্যাটেনশন কেন্দ্রীভূত হবে বাচ্চার দিকে, তাই একলা হয়ে যাবে স্বামী, এই ভয়ে সে পারছিল না একা একা সন্ধেটা কাটাতে।

অপারেশনের দিনের সেই ধক করে নাকে আসা ক্লোরোফর্মের গন্ধ আর তার আগের মুহূর্ত অব্দি ডাক্তারদের হাসাহাসি, অ্যানেস্থেটিস্টের নানা টুকরো কথা, এ বাবা, পেশেন্ট অ্যাতো ফ্যাকাশে কেন, ব্লাড কাউন্ট দেখি তো!  আর গোটা ব্যাপারটার প্রবল শীত-করা প্রাইভেসিহীন নিশ্ছিদ্র নৈর্ব্যক্তিক একটা পরিবেশে দম আটকে এসেছিল তার। উলঙ্গ সে এক বিটকেল পিঠখোলা হাস্পাতাল সবুজ মোটা কাপড়ের জামার তলায়। এই বোধ এসেছিল। তলপেট উন্মুক্ত করে তাকে কেটেকুটে বাচ্চাকে বার করবে পুরুষ ডাক্তার, অন্তত আজকের জন্য স্বামীর চেয়ে সে বেশি প্রিভিলেজড, ভাবতে গিয়ে অসংখ্য গোল গোল জোরালো আলোর বৃত্ত দেখতে দেখতে সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।

জ্ঞান ফিরেছিল চাপ চাপ অনির্দেশ্য ব্যথায়। অবশ হয়ে আছে সারাটা তলপেট অঞ্চল। কিছু জানে না। অথচ প্রচন্ড ব্যথা। চোখ খুলতে একটা ন্যাকড়ার পুটলি এনে তাকে দেখানো হয়েছিল। এই তো বাচ্চা, ছেলে হয়েছে, ছেলে।

বর এসে হাত ধরেছিল বিবর্ণ মুখে।

আবার কেবিনে ঢুকে ঘুম, ঘুম, ওষুধের ভেতর।

পরদিন থেকে ক্ষতচিহ্ন, ব্লিডিং, শিশুকে দুধ খাওয়ানোর নতুনত্ব, নার্সের বকুনি, আয়ার ধমক।

সবকিছুর মধ্যে ছোট একটা নতুন মাংসদলার ধুকপুক, ভয় আর আনন্দের জোট বাঁধা অদ্ভুত এক ফিলিং।

এই ডেটাবেসের প্রান্তে ছিল আবার বাড়ি ফিরে আসা। বালতি বা কোণ ভারি জিনিশ না তুলতে পারা ইত্যাদি ইত্যাদি, প্রায় দু মাস।

একটু ইনফেকশন, ব্লিডিং বন্ধ না হওয়ায় অনেকটা ওষুধ পালটানো, ভয় ডর। ক্যাথিটার লাগিয়ে রাখার পর যন্ত্রণা আর চুলকুনি তার যোনিদ্বারে। এই অস্বস্তিগুলি তো কিছুই নয়। তারপর যা আরম্ভ হল তা জীবনের নতুন দিক।

নার্সিং হোমেই শাশুড়ি গিয়ে নাতির মুখদর্শন করে, বউমাকে দেখে ফিকফিক করে হেসে বললেন, এবার দেখব কেমন অফিস গিয়ে ছটা সাড়ে ছটা অব্দি অফিস কর, চারটে বাজলেই বাড়ি ফিরে আসতে শুরু করবে ত! বাচ্চার টান, বাবা, হুঁ হুঁ!

কন্টিনুয়াস সারভেইলেন্সে বন্দিদশায় থাকা শুরু হল। শিশুটির জন্য আয়া আছে। তবু সে বই পড়ে শিখে নিয়ে তাকে স্নান করাতে চেষ্টা করত, জামা পরাত, হাগু পরিষ্কার করে দিত। হিসির কাঁথা পাল্টাত। কিন্তু যারা কিছুই করত না , সেই সব বাড়ির লোকেরা তার আশেপাশে ঘুরত। মা ছিল না বলে মায়ের বাড়িতে গিয়ে থাকা হয়নি তার। শ্বশুরবাড়ির লোকের পুলিসগিরি তার সহ্য হত না। সে যে বাচ্চা বিষয়ে কিছুই জানেনা, এটা নতুন মা-কে চোখে আঙুল দিয়ে বলার মধ্যে এক অদ্ভুত সুখ আছে সকলের, সে বুঝতে পারে।

বাচ্চা কাঁদলে অভিযোগের আঙুল উঠত, কাঁদছে কেন? খাওয়াচ্ছ না ঠিক করে?

খাওয়াতে গেলে বলা হত, মাথাটার তলায় হাত দাও ঠিক করে। পশ্চার ঠিক হয়নি।

শুইয়ে রাখলে শাশুড়ি এসে নাতির মুখচন্দ্রমা নিরীক্ষণ করতে করতেই ইম্যাজিনারি পিঁপড়ে খুঁজে পেতেন, অথবা ঠিক করে কাঁথা দিয়ে ঢাকা হয়নি ওকে, বলে তাকে এক প্রস্থ জ্ঞান দিয়ে যেতেন।

শিশু ছ মাস  হতে হতে অলটারনেটিভ খাবার দেওয়া শুরু। সেই সময়ে বোতল ঠিক ঠাক পনেরো মিনিট ধরে  না ফোটানোর অপকারিতা আর বুকের দুধ অনেকক্ষণ ধরে খাওয়ানোর উপকারিতা নিয়ে লেকচার শোনানো হত তাকে। কে না এসে জ্ঞান দিয়ে যেত। কে না এসে বক্তব্য রাখত। যেখানে পৃথিবীতে যত মহিলা আছে যারা কখনো না কখনো বাচ্চা রেখেছে বা পেটে ধরেছে, তাদের বক্তব্য রাখার অধিকার জন্মে যায় কীভাবে যেন। আর নতুন মায়ের কাজ সবার কাছ থেকে তাদের নিজস্ব টিপস শুনে যাওয়া। জমা করা। ডেটাবেসে। শুধু শ্বশুর শাশুড়ি নয়, বাবা, কাকা, পিশি, পিশে, মাসি শাশুড়ি , কে নয় এই জ্ঞানদাতাদের দলে। এমনকি আয়া, বাড়ির ঘরমোছার লোক। এমনকি রাস্তার অপরিচিত মহিলা। ডাক্তারখানার হেল্পার।

ঠিক করে ধরুন। ধরা ঠিক না আপনার।

বাব্বা, ছেলেটাকে সামনে দিয়ে জামা পরিয়েছে দ্যাখো, হি হি , পেছনটা পুরো বেরিয়ে আছে…

কেন দাঁত উঠল না এখনো? আমার নাতনির তো ক—বে…

কেন শিশু কথা বলতে শিখল না আজো? আমার ছেলে তো কত আগে…

একবছর হয়ে গেছে বাচ্চাটার? এ মা, হাঁটতে পারে না? আমাদের টা তো এরই মধ্যে…

বাড়ির নানা পলিটিক্স তার এতদিনে গা সওয়া হয়ে গিয়েছে, বাচ্চার দৌলতে।

তার নিজের বাড়ি ছিল না কোন, বাপের বাড়ির লোক মানে তার মামিমা কাকিমারা এসে মুখ দেখে গেল শিশুর, ব্যাস তাদের কর্তব্য শেষ।

শ্বশুরবাড়ি তার সর্বেসর্বা হল। এর আগে, বিবাহের অব্যবহিত পরে, নিজে যখন তার বরের সঙ্গে দরজা বন্ধ করে থাকত, প্রাইভেসির দৌলতে, তখন মনে হত এঁরা যথেষ্টই লিবারাল এবং শিক্ষিত। কিন্তু সে ইতিপূর্বে যা যা দেখেনি, এখন শিশু সন্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো নাটকের মত অভিনীত হতে শুরু করল।

তার জগত হয়ে গেল সচ্ছিদ্র, অন্যদের কথাবার্তা কাজ কর্ম এসে পৌঁছতে শুরু করল শিশুর হাত ধরে।

তখনই শুরু তার সহস্র হাতের পাশাপাশি সহস্র কানের জন্মের। সে শুনতে পায়, পাশের ঘরে আলোচনা চলছে তার শিশুর বাড়বৃদ্ধি নিয়ে, এবং তার উপরে তার মায়ের ভূমিকা নিয়ে।

সে দেখতে পায় , শিশুকে ঘিরেই বর্ণনা হয়, বিশেষত পুরুষ শিশু , প্রথম বংশরক্ষক। ছেলে কই, ছেলের মায়ের সঙ্গে বেরোচ্ছে। এরকম কথা শুনতে শুনতে সে স্তম্ভিত হয়ে টের পায়, তার নিজের একটি নাম ছিল , বেশ বড় নাম, বরবর্ণিনী রায় চট্টোপাধ্যায় গোছের ( চট্টোপাধ্যায়টি তার স্বামীর অবদান অবশ্যই) … সেটি বেবাক বেমালুম হাপিশ হয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ তার বিবরণ হয়ে যাচ্ছে “ছেলের মা” বা ‘পুটুশের মা’ বা ‘বিংগোর মা’।

আদি অকৃত্রিম সামাজিক প্রক্রিয়ায় কাজের লোকেদের জগতে যেভাবে পুঁটির মা বা ক্ষেন্তির মা জন্ম নেয় সেভাবেই হচ্ছে। বাড়িতে আসা লোক বলছে, বাড়ির কাজের লোক বলছে, এমনকি তার বাড়ির লোক, মানে শ্বশুর শাশুড়িও বলছেন, এমনকি তার বর ও বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলার সময় বলছে!

ইতিমধ্যে সে তার নিজের চাকরির জন্য বদলি হল অন্য প্রদেশে, ছোট এক শহরে। নিজের ব্যক্তিজীবনে সে একজন সরকারি চাকুরে। উইথ অল ইন্ডিয়া ট্রান্সফার লায়াবিলিটি । কথাটা লোকেরা ধীরে ধীরে হৃদয়ংগম করতে পারছে এখন, বিয়ের পর পর জোর গলায় ত আর বলা যায় না, কালই আমি দিল্লি বম্বে পোস্টিং নেব! সে সত্যের অভিঘাত ওদের সহ্য হত না বলেই বলা যায়না। কিন্তু স্লো লি ওদের মাথায় ঢুকল সেটাও। তখন প্রতিভাত হল, ম্যাটারটি বৌমার ইচ্ছাধীন, সে চাইলেই কেঁদে ককিয়ে তার হেডকোয়ার্টারস কে বলে বদলি ঠেকাতে পারে। কিন্তু করছেনা, তার মানে, “আমাদের সঙ্গে থাকতে চাইছে না”।

অ্যাজ ইফ তার ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন দাম দিত তার হেডুরা। উলটে তারা ওকে পাঁচ বছর কলকাতায় থাকার পর বাইরে ঠেলবেই, এটা নিশ্চিত। তবে সেটা হলেই সে এ যাত্রা  এই কনটিনুয়াস সার্ভেলেন্স থেকে বেঁচে যাবে, এটা ভাবতেই নিজেকে বেশ অসভ্য আর সস্তা লাগছিল তার। মীন লাগছিল। মীনগণ হীন হয়ে রহে সরোবরে টাইপের।

তখনই কানে আসে বরের এক পিশি আর তার শাশুড়ির কথোপকথন :

শোন বৌদি, বৌমার তো বদলির চাকরি, তা সে যেখানে খুশি যায় যাক। বাচ্চাটাকে কিন্তু তুমি ছেড়ো না। বৌ ত পরের ঘরের মেয়ে, ছেলেটা তো তোমাদের। যাকে বলে বংশের বাতি। ওকে এখানেই কোন ইশকুলে ভর্তি করে রেখে যেতে বল। আমাদের ছেলে আমরা ছাড়ব কেন? মা যাক না গিয়ে যেখানে প্রাণ চায়?

আসলে সন্তান একটি প্রপার্টি। যেরকম স্ত্রী ও একটা প্রপার্টি, তবে কিনা আজকালকার দিন, দু পাত ইংরিজি পড়ে চাকরি করে সব বউগুলো নিজেদের ভেবে ফেলেছে মহা মাতব্বর, সে আর কী করা যাবে।

সন্তানটি তো বাবার পদবি ধারণ করে, মায়ের নয়! কাজেই তার ওপর একটা দখল থাকেই শ্বশুরবাড়ির।

এ ছাড়াও কথা আছে। বউ যেখানে যাবে, সেখানে বাচ্চাকে দেখবে কে? বউ তো সারাদিন অফিসে থাকবে। “আমাদের বাড়ির বাচ্চা”-র দেখভাল করবে মাইনে করা কাজের লোক? তা তো হতে পারে না। এমনিই তো চাকরি করা বৌয়ের হাতের অবহেলা আর উদাসীনতায় ছেলেটা রোগা হয়ে গেল।

সুতরাং সে যখন বদলি হয়ে ভুবনেশ্বর গেল, তার ছেলের দেখভাল করার কথা তুলে শাশুড়ি এবং শ্বশুর অলটারনেটিভলি যেতে লাগলেন সেখানে। একেবারে থাকতে লাগলেন। নজরবন্দী দশা ঘুচল না। ছেলেও বড়লোকের অওলাতের মত আহ্লাদে, আতুপুতু হল। একেবারেই সে যেভাবে তাকে মানুষ করবে ভেবেছিল সেভাবে “নিজের কাজ নিজে কর “ টাইপ সেলফ রিলায়েন্ট করে মানুষ করা গেল না।

ছেলে ক্রিকেট খেলতে শিখল, ছবি আঁকতে শিখল কিন্তু গান গাইতে শিখল না। তাকে নানারকম খেলনা কিনে দেবে ভেবেও দেখল, পুরুষোচিত র‍্যাট ট্যাট ট্যাট বন্দুক আর আর্মির ছাপ ছোপ মারা হেলিকপ্টার দেওয়া হচ্ছে তাকে, উপহারে। দেখল, বাড়ির কোন জিনিশ ভাঙ্গলে চুরলে তাকে বাহবা দিয়ে বলা হচ্ছে, মারো, মারো, তোমারই তো সব। এগুলো কিন্তু সব তোমার , বাবু, এই ফ্রিজ, এই টিভি। গেলে তোমার যাবে।

তাকে শেখান হচ্ছে অধিকার, আবার সেই প্রপার্টি রিলেশন্স।

শ্বশুর শাশুড়িরা একজন গিয়ে তিন চারমাস গিয়ে থেকে আসতেন, তারপর যেতেন অন্যজন। বিষয়টাকে বাধা দিতে সে চায়না, হাজার হোক তাঁদের নিজেদের সংসার ফেলে রেখে তো তাঁরাও অনেকটা আত্মত্যাগ করছেন, তার পেটে থেকে পড়া সন্তানকে দেখার জন্যই। তা ছাড়া শুষ্ক, দায়সারা আয়া বা বাচ্চাধরার লোকের তুলনায়, একজন দাদু বা ঠাম্মার সঙ্গ পাওয়া , এটাও ত কত না জরুরি শিশুর জীবনে, সেটা তো সে স্বীকারই করে। তার নিজের মা-ও তো নেই।

মধ্যে মধ্যে তার বর আসত ছুটিতে। সে কটা দিন হীরকদ্যুতিময় ব দ্বীপের মত হাসি খেলা গানে কাটত, তারপর আবার  ডার্ক এজ। সে কটা দিন ঠারে ঠোরে বয়স্কদের দাপট ও “আত্মত্যাগের মহিমা”র গল্প শুনতে হত। তাঁরা উঠতে বসতে  শহর হিসেবে কলকাতার তুলনায় ভুবনেশ্বরের নিকৃষ্টতা জাহির করতেন, কেননা শহরটাকে বৌমার পোস্টিং এর ফলে ‘নিতে হচ্ছে’। বেড়াতে এলে অন্যরকম হত।

ততদিনে শিশু থপ থপ করে হাঁটছে, চলছে, ছড়া বলছে, ভাত খেতে খেতে কার্টুন নেটওয়ার্ক দেখছে, ঠাকুমার সঙ্গেই ছড়ার বই বা ছবির বই শেষ করছে আর দাদু থাকাকালীন বাংলা অক্ষর পরিচয়ও হচ্ছে তার… খবরের কাগজ দেখে দেখে।

আসলের থেকে সুদ মিষ্টি, একথাও ওঁরা বলে থাকেন, অন্তত শ্বশুরমশাই। শাশুড়ি সদাই পাঁচের মত মুখ করে থাকেন, কারণ একটি আদিবাসী রমণীকে সে তার ভুবনেশ্বর হাউজহোল্ডের রান্নার দায়িত্বে রেখেছিল, আর সে কিছুই রাঁধতে পারেনা শাশুড়ির মনমত। সে এক শ্বাসরোধী পরিস্থিতি। রান্নার লোক আর শাশুড়ি সারাদিন ঝগড়া করে মুখ ভার করে বসে থাকত, আর তাকে সন্ধ্যাবেলা এসে সেই ঝগড়া মেটাতে হত, অথবা আসামাত্র আদিবাসী মেয়েটি এসে ফিরিস্তি দিতে থাকত, বাড়িতে কী কী নেই।

বাজারে যাওয়া বা কাউকে বাজারে পাঠানোর দায়িত্বটা ছিল তার, কারণ, ওই যে, আগেই বলা হয়েছে, ভুবনেশ্বরে আসার জন্য দায়ীটা কে, শুনি?

রোজ, রোজ সেই আলু নেহি হ্যায়, মুড়ি নেহি হ্যায়, দুধ খতম হো গিয়া হ্যায় শুনতে শুনতে বাড়ি ফিরেই সে আবার বাজারে যেত। ইতিমিধ্যে তার বাড়িতে বাচ্চার মা-র ভূমিকায় একটা ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। কারণ ইতিহাস বইয়ের পাতায় মুহুর্মূহু লিখিত হয়েই চলেছে, যে সে একজন নন রেসিডেন্ট মা। সে বাচ্চাকে খাওয়ায় না ঘুম পাড়ায় না, হাগায় না ছোঁচায় না।

এক শীতের রাত্তিরে, ছেলেকে ছুঁচিয়ে দিতে বাথরুম যায় সে, পটিতে বসা ছেলের সঙ্গে ছড়া বলতে বলতে তাকে মহৎ কর্ম করতে সাহায্য করে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ,  সে, ওভারহিয়ার করে ( হিন্দি বা বাংলা সিনেমায় যা সচরাচর ঘটে থাকে , এবং নায়িকাদের এই ওভারহিয়ারের ফলে অনেক কাপ ডিশ সরবতের গেলাস ভেঙে থাকে), তার শাশুড়ি ছুটে গিয়ে কাজের মহিলাকে জিগ্যেস করছেন, ভাবী কোথায় রে? বাচ্চাকে বাথরুম থেকে পরিষ্কার করে নিয়ে গেছে?

হাঁ।

কী দিয়ে পরিষ্কার করল? ঠান্ডা জল দিয়ে?

( বাচ্চার হাগানো ছোঁচানোর জন্য গরম জল রাখা থাকত গিজারে, এবং একটি বালতিতে)

নেহি, গরম পানি সে।

তুই নিজে দেখেছিস, গরম জল দিয়েই করেছে তো?

 

এগুলো কোন বিচ্ছিন্ন কথোপকথন না, এগুলো সন্তান জন্মানোর পরবর্তী তার গোটা জীবনের এক একটি স্নিক পিক মাত্র। আসলে কনটিনুয়াস সারভেইলেন্স ব্যাপারটির সঙ্গে যারা পরিচিত না তারা এর মর্ম বুঝবেন না।

ব্যাপারটি হল, এটা একটা ডিকটমির জগত। হয় তুমি ভাল মা নয় তুমি ভাল চাকুরে। এখনো প্রাক্তন নামে ছবি হয় বাংলায়। যাতে ভাল বউ বনাম ভাল চাকুরে নিয়ে আলোচনা চলে। সেই একই ডিকটমিবশে, ভাল মা হতে হলে ভাল চাকুরে হওয়া যাবে না। আর একটা ওভার হিয়ার অথবা, থালা গেলাস ফেলে দেওয়ার মত শুনতে পাওয়া ডায়ালগ তার শাশুড়ির, বউ যদি কেরাণি হত তাহলেই ভাল হত , অফিসার হয়েই হয়েছে মুশকিল, একটা দিনও সাড়ে ছটা সাড়ে সাতটার আগে ফিরতে পারে না।

সে যেহেতু অফিসার, এবং অফিসে দরকার হলে শনিবার যেতে হয়, দরকারে অদরকারে দিল্লি ছুটতে হয়, ট্যুরে যেতে হয়,  দু বছরের বাচ্চাকে রেখে চার মাসের জন্য আমেরিকায় একটা অফিশিয়াল ট্রেনিং এও গেছে সে ( সত্যি কী করে পারে এরা, অ্যাঁ!!! এত কেরিয়ারিস্ট! ) … সে তো খারাপ মা হবেই। তাকে হতেই হবে এমন মা যে বাচ্চাকে খাওয়াতে পারে না, যে বাচ্চাকে ঠান্ডা জলে ছোঁচায়, ছেঁড়া জামা পরায়, একটাও কাজ পরিষ্কার করে করতে পারেনা। স্নানের টাবে বাচ্চা ফেলে চলে যায়, বাচ্চা ডুবে মরে যায়, এমন সব ভয়ঙ্কর হরার স্টোরি তো আছেই পৃথিবীতে… তাদের ডোমেনে এখন ওরকম সব গল্পরা ঘোরাঘুরি করে রাতবিরেতের রক্ত পিশাচের মত।

সেই শুধু বুঝতে পারে না, বাচ্চার কোন ক্ষতি হচ্ছে, সে তো বেশ ছড়া বলছে, খেলছে  , বেড়ে টেড়ে উঠছে… কিন্তু শ্বশুর শাশুড়ি তো হাহুতাশ করেই চলছেন ভেতরে ভেতরে, যে বাচ্চাটা ঠিকঠাক মানুষ হল না। মাকে পেলনা।

এতটাই এসব করছেন যে ছেলে যখন ষোল বছরের, সে একদিন সত্যজিত রায়ের মহানগর দেখে চমকে উঠবে, ওই সিনটায়, যেখানে  মা চাকরি করতে যাচ্ছে , বাচ্চার জ্বরের দিনেও। মাধবী ফিরে এসে দেখছে সারাবাড়ি থমথমে, আর  বাচ্চা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে, আর অনুতপ্ত মাধবীকে তার শাশুড়ি বলছে, ছেলে তো সারাদিন বলে গেল,   মা খারাপ, মা পাজি, মা খালি অফিসে যায়। প্রত্যুত্তরে মাধবী ছেলের হাতে গুঁজে দিচ্ছে উপহার, যা আসলে, মেনস্ট্রিমের মতে, চাকুরে মায়ের দেওয়া ঘুষ। নিজের না-থাকার বিকল্পে দেওয়া পারিতোষিক।

তার ছেলে , এখন বড়, তার চোখ দপ করে জ্বলে উঠল ছবির ওই অংশটা দেখে, মায়ের দিকে তাকাল এমন চোখে, যে মা বুঝল, ওই ডায়ালগটা কত্তো চেনা চেনা লেগেছে তার। মা ছেলে দুজনেই তারপর হো হো করে হেসে ফেলল।

ইন্দ্রা নুয়ি নাকি রাত্তির অব্দি অফিস করে দেরিতে একবার বাড়ি ফিরে দেখেছিল বাড়িতে দুধ নেই, তার নিজের মা বলেছিল, বাড়িতে দুধ নেই, আনতে হবে। ইন্দ্রা বলেছিল আমার বর ত অনেক আগেই এসে গেছে মা, ওকে কেন বলনি? মা বলেছিল বেচারি খেটেখুটে এসেছে, ক্লান্ত।

মেয়েদের চাকরি করা মানে খেটেখুটে ক্লান্ত হয়ে এসেও তোমাকে চূড়ান্ত পারফর্মেন্স –এ বাজার হাট সব করে দেখাতে হবে, তুমি দুধ ময়দা চাল ডাল সবকিছুর কেমন খেয়াল রেখেছ। আর এসব অবলীলাক্রমে করার পরও, আসল হল একটা অপরাধী অপরাধী মুখ করে থাকা। একটা শহিদ শহিদ স্টাইল করে থাকা।  যদি তোমার মুখে এতটুকুও অপরাধবোধ না ফোটে ( যেমন আমাদের গল্পের এই সে-র মুখে কোনদিনই ফুটত না) তাহলে ধরে নেওয়া হবে তুমি খারাপ গৃহিণী ও খারাপ মা।

 

ছেলে বড় হতে থাকে এরপর। পর পর যা যা মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারে ঘটার সবই ঘটতে থাকে , যথা এরপর স্কুলিং নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হল। তালিকা তৈরি হল। লাইন লাগানোর জন্য অনুপ্রাণিত হল স্বামীটি।

স্কুলে যেতে গিয়ে শিশু কাঁদল না। সেটাও বিস্ময়ের। কেন কাঁদল না? শিশু স্কুলে কিছু শিখছিল কিনা, তা নিয়েও সংশয় ছিল। প্রশ্ন ধরা হত ওকে, বাইসাইকেলে কটা আই বলতো? গাজর দেখিয়ে জেঠিমা জিগ্যেস করত, এটা কি কালার শিশু? রেড বলেছিল বলে আ আ ছি ছি শুরু হল, সেকি,  ওকে অরেঞ্জ কালারটা চেনাও নি?

সবকিছুর শেষেও, ভাল মা হয়ে উঠতে পারল কি, সে? খুব সন্দেহ আছে তাতে।

শিশুর ক্লাস টু। একদিন অফিস থেকে ফিরে এসে সে দেখল শাশুড়ির মুখ হাঁড়ি। শিশুর ক্লাস টিচার ওর খাতায় লাল কালি দিয়ে লিখে দিয়েছেন, হোম ওয়ার্ক নট ডান।

শাশুড়ি ঝাঁঝিয়ে উঠে সেকে জবাবদিহি চাইলেনঃ  হোমওয়ার্কটা  করল কিনা এটাও দেখতে পারো না?

ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ, মিশেল ফুকো নাকি লিখেছিল। একজন মা শুধু বায়োলজিকালি মা হয়ে ওঠেনা। পেট থেকে পড়লেই বাচ্চা পয়দা করা যায়না। মা হওয়া শিখে উঠতে হয়। কঠোর তপস্যা চাই।

আজকের দিনের মায়েদের কত না চাপ। তাকে সর্বংসহা ও সর্বকর্মা হতে হবে। কে যেন গোটা একটা বইই লিখে দিয়েছে, আমার মা সব জানে। তাই তাকে সেই বইটা কিনে পড়ে ফেলতে হবে ও শিশুর সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।

টিভির বিজ্ঞাপনে যেরকম দেখায়, মা কখনো বকবে না অধৈর্য হবে না বিরক্ত হবে না। নিজের সুখের কথা ভাববে না। সারাদিন ছেলের মুখে জলের গেলাস খাবারের থালা এবং কুলকুচি হয়ে গেলে গামছা তুলে দেবে। জামা বার করে রাখবে, পরিয়ে দেবে। জুতো পরিয়ে দেবে। স্কুলে র থেকে এলে গ্লুকন ডি গুলে দেবে। পরীক্ষায় ভাল করলে কিটক্যাট কিনে দেবে।

মা কখনো নিজের কাজ করবে না, বাড়িতে যতক্ষণ থাকবে ছেলের সঙ্গে খেলবে কথা বলবে, ছেলের পড়া দেখবে। অফিসে গেলে তো আরো বেশি অপরাধী হয়ে মাকে ফিরে আসতে হবে, আরো দ্বিগুণ উৎসাহে ছেলের সেবাযত্ন করতে হবে, সে সময়টা সে ছিল না সেই সময়টার অভাব পুষিয়ে দিতে হবে।

মাতৃত্ব কত আনকন্ডিশনাল তা নিয়ে অনেক ভাল ভাল কথা পড়া যাবে, বলা হবে অনেক সুন্দর কবিতা গান আর বাণী, মা হল সবার ওপরে।

এইভাবে , কন্ডিশনড হতে হতে, সে দেখেছে, সে এক রোবট মা এখন।

সারাদিন অফিস করে বাড়িতে ঢুকেই চুড়িদার কামিজের ওপর থেকে চুন্নিটা নামিয়ে রেখে সে রান্নাঘরে ঢুকে  ছেলের দাবি অনুসারে কোনদিন চাউমিন কোণদিন পাস্তা কোনদিন ভাত নেড়ে বিরিয়ানি করে দেবে। অনায়াসে তারপর  ছেলের হোমওয়ারক দেখবে, অনায়াসে তার প্রয়োজন হলে বেরিয়ে কিনে এনে দেবে সেলোফেন পেপার অথবা ফেভিকল, কলম পেন্সিল বা রুলটানা খাতা। যখন যেটা দরকার।

রাত এগারোটায় ঘুমে ঢুলে পড়তে পড়তেও, ছেলের দাঁত মাজা জামা পালটানো সুপারভাইজ করবে, বিছানা পাতবে।

স্বামী করে না এসব? না তা নয়। স্বামী অনেক কিছুই করেছে, করে হালকা করেছে গুরুভার সন্তানপালনের দায়। সে জুতো পরিয়ে দিয়ে চুল আঁচড়ে দিয়ে শার্ট পরিয়ে দিয়ে নিয়ে গেছে শিশুকে টিউশনে। কিন্তু জুতোটা কিনে এনেছে মা, চিরুনি হারিয়ে গেলে কথা শুনতে হয়েছে মাকে, শার্টের বোতাম না থাকলে মার সামনে ছুঁড়ে ফেলে বলা হয়েছে, দেখে রাখতে পারো না, আদ্ধেক শার্টের বোতাম নেই?

আসলে , একটাই তফাত থেকেছে। স্বামী যা যা করেছে, সেগুলো স্বামী স্বেচ্ছায় করেছে। ওর করার কথা ছিল না বাধ্যতা ছিল না তাও করেছে।

বাই ডিফল্ট ওগুলো সব মায়ের করার কথা ছিল। স্বামী করে, তাকে ধন্য করেছে, হেল্প করেছে। স্বামীর কাজ করাটা স্বামীর ক্রেডিট। আর স্ত্রীর না করাটা, স্ত্রীর গাফিলতি। ত্রুটি। তাকে চিরজীবন অপরাধী হয়ে থাকতে হয় এই তথ্যের জন্য, যে, সে যখন অফিসে থাকত তখন তার সন্তানকে শাশুড়ি দেখত, আয়া দেখত, অনেক সময় আগে ফিরে এসে স্বামীও দেখত।

অন্যেরা যে যা অবদান রেখেছে শিশুর জীবনে, কোনটাই বাই ডিফল্ট ছিল না। সেগুলো অবদান ছিল। আর সে যা করেছে? একজন মায়ের তো তা করারই কথা। সেজন্যে আলাদা করে কোন থ্যাঙ্কস প্রাপ্য আছে নাকি আবার? ওটাকে কোন কাজ বলতেই নারাজ তো, সমাজ। ওগুলো তো তার কর্তব্য।

পেট থেকে পড়েছে কার, বাচ্চাটা, শুনি?

করবে না মানে?

শিশু একদিন বড় হয়ে যাবে, শিগগিরি একদিন সে নিজের জীবন খুঁজে নেবে। তারপর অচিরেই নিজের জীবন সঙ্গিনীও।

তখন , সেই জীবন সঙ্গিনীও , সে কি চাইবে, করুক সব কাজ বাই ডিফল্ট?

 

এরপর বিদ্বজ্জনরা প্রশ্ন তুলবেন, আমাদের গল্পের মেয়েটি এত ন্যাকা কেন? তার এত এত অসুবিধের কথা সে এতদিন মুখ ফুটে বলেনি কেন? সে কেন শ্বশুরবাড়ির সংস্রব ত্যাগ করেনি। ভুবনেশ্বর থেকে টিকিট কেটে শ্বশুর শাশুড়িকে পত্রপাঠ বিদেয় করে দেয়নি এবং পরবর্তী জীবনে কেবলমাত্র আয়া বা কাজের লোকের হাতেই ছেলেকে মানুষ করেনি?

সে কেন নিজের এই বিশ্রি অসম সম্পর্কটা ভেঙে ফেলেনি?

সে যেহেতু বিবাহিত জীবনে আছে, প্রশ্ন উঠবে,  সে কেন আপোশ করেছে এত ? সে তো চাকরি করত, ইন ফ্যাক্ট নিজের বরের চেয়ে বেশি মাইনের চাকরিও ( যেটা নাকি আবার খুলে দেবে আরো এক বিশাল আলোচনার দরজা, এ নিয়ে বেশি মুখ না খোলাই ভাল)… তাহলে সে ছেড়ে চলে যায়নি কেন?

এত প্রেম, বাব্বা! বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। নিশ্চই অন্য ধান্ধা ছিল , অন্য কোন হিসাব কিতাব, অন্য কোন হিডেন অ্যাজেন্ডা!

হ্যাঁ তার বরও তো বলেছে তাকে, আসলে তুমি অপরচুনিস্ট একটা, মারাত্মক চালু মাল, ম্যানেজ মাস্টার। নিজের ছেলেকে আমার বাবা মাকে দিয়ে বড় করিয়ে নিলে কনভিনিয়েন্টলি, পয়সা দিলেও এরকম আয়া তো পেতে না, এত নির্ভরশীল, শুভাকাঙ্ক্ষী। এখন তো লিখবেই, আমার বাবা মা কত খারাপ।  তোমার হাতে কলম আছে তো!

সে আসলে অপরচুনিস্ট। সে চায়নি তার নিজের এই সব টুকরো টাকরা অপমান  (যা সে বিশ্বাস করে এই সমাজ পরিবর্তন না হলে কোনদিন পরিবর্তিত হবে না এবং এই সমাজে থাকা অধিকাংশ মেয়েকে এসবের মধ্যে দিয়েই যেতে হয় ) গায়ে মাখতে। তবুও ডেটাবেস হিসেবে এগুলো তার মাথার মধ্যে রেজিস্টারড হয়েছে, থেকে গেছে, সে ভুলতে পারেনি, বা ৯০ শতাংশ ভুলে গেলেও ১০ শতাংশই তার মনে “থেকে গেছে”।

সে আসলে অপরচুনিস্ট, সে চেয়েছে তার ছেলে মানুষ হোক একটা আপাত স্বাভাবিক পরিসরে, পরিবারে, দাদু ঠাকুমার সঙ্গে।

তার মা ছিল না, বাবা অন্য বিয়ে করেছিল,  প্রথম জীবনে ঠাকুমার আদরে আর পরে ঠাকুমা মারা গেলে, কাকিমাদের হাত তোলা ও লাথি ঝ্যাঁটা খেয়ে সে নিজে মানুষ হয়েছিল। হয়ত সেজন্যেই, ব্রোকেন ফ্যামিলিতে বড় হওয়ার চাপ সে তার সন্তানকে দিতে চায়নি। সে জানে একা থাকার মহিমা, সে জানে কষ্ট কাকে বলে, সে জানে নিজের চাকরি তার নিজের অর্জন, মামা কাকাদের গালে পিঠে হাত বুলিয়ে দেওয়া পুরস্কার নয়, তাই নিজের চাকরি নিয়ে সে অন্যদের কাছে ফাটাতে চায়নি, ফুটানি মারতে চায়নি। নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সযত্নে আলাদাও রেখেছে আবার স্বামীর থেকে।

এগুলো তার আপোশ বইকি। যারা নিজেদের র‍্যাডিকাল বলে তাদের জীবনের যে প্রতিমুহূর্তে পেরেক ফোটা চাপ, সমাজ যা প্রতিনিয়ত দিতে থাকে , তার থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে সে চেয়েছে কারণ তার শৈশব আদৌ খুব একটা সুন্দর ছিল না। অন্তত যৌবন সুন্দর হোক সে চেয়েছিল।

আর এই আপোশের ফলে সে পেয়েওছে অনেকটা। সে পেয়েছে মন দিয়ে চাকরি করা এবং নিজের লেখালেখি করার পরিসর। আফটার অল সারাজীবন শুধু বিবিধ পুরুষের সঙ্গে এবং সেই পুরুষতন্ত্রের এজেন্ট নারী ( তার কাকিমারা, তার শাশুড়ি প্রমুখ) দের সঙ্গে লড়াই করে সময় নষ্ট না করে তাদের উপেক্ষা ও করুণা করতেই সে বেশি পছন্দ করেছে।

এই আপোশের পথ অনেকের নয়। অনেকেই ঝগড়া করে, প্রতিবাদ করে, বেরিয়ে যায় সংসার থেকে। হয়ত সে পারেনি এসব। কিন্তু পারেনি বলেই তার এই এই শোনাগুলো, ডেটাবেসের এই এই চড় থাপ্পড়গুলো, মিথ্যে হয়ে যায়না। সে কিন্তু টাকা দিয়ে অনেক কিছু কিনতে পারে। কিন্তু বহুকিছু কিনতে পারাটাই তো তার সবচেয়ে বড় ডিসকোয়ালিফিকেশন, কারণ তার শাশুড়ি তো সারাজীবন চাকরি করেন নি, আর এখনো ছেলেরা না খেলে খেতে বসেন না। রাত বারোটা একটা বাজলেও তবু না। এই সব না খাওয়া আর জেগে থাকা দিয়ে তো তিনি মাতৃত্বের পরীক্ষায় বৌমার থেকে বেশি নম্বর পেয়েছেন বলেই জানেন। তাই তো তাঁর কনফিডেন্স এর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যায়না। মহিলাকে করুণা করতেও তাই আজকাল তার করুণা হয়।

বুদ্ধিজীবী ও র‍্যাডিকালরা এখনো বলে সে নাকি থ্রি এস, মানে সসসস্বামী সসসন্তান সসসসসংসার নিয়ে দিব্যি আছে।

চাকুরে মেয়েরা, অন্তত তার মহিলা কলিগেরা, অন্তত এটা বলে না, এটুকুই যা এক রিলিফ!

krittibas smaroke songkolito, 2003

আমি তো নব্বইয়ের, কৃত্তিবাসের কে?
যশোধরা রায়চৌধুরী

সত্যি কথাটা হল, শুনতে যতই বেখাপ্পা লাগুক, ‘ইহাই রূঢ় বাস্তব, ইহাই জীবনের ট্র্যাজেডি। উনিশশো নব্বইয়ের কবিদের সঙ্গে “কৃত্তিবাসের” আদৌ কোন সম্বন্ধ থাকার কথা ছিল না। কৃত্তিবাস-এর যখন জন্ম, নব্বইয়ের অধিকাংশ কেন, প্রায় কোনো কবিরই তখন জন্ম হয়নি। নব্বইয়ের কবিরা যখন জন্মেছেন, কৃত্তিবাসের তখন শৈশব পেরিয়ে কৌশোর। আমার কাছে কৃত্তিবাসের কবিদের স্ট্যাটাস পুরোদস্তুর খুল্লতাতগোত্রীয়, একথা বললেও একবিন্দু মিথ্যে বলা হয়না।
আসলে পুরনো কৃত্তিবাসের নবজন্ম না হলে উনিশশ নব্বইয়ের কবিদের কাছে এর কোনও বিশেষ অর্থই থাকত না। ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা, নস্ট্যালজিয়া –প্রিয় বাঙালির আর এক রোম্যান্টিক স্মৃতিমাত্র রয়ে যেত কৃত্তিবাস। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামক স্বপ্নের পুরুষের হাত ধরে, মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করা চার পাঁচ অনাদি পুরুষ বা চিরন্তন অ্যাংরি ইয়াং ম্যান শক্তি-শরৎ-তারাপদ-সমরেন্দ্র-দীপকদের হাত ধরে।
একথা অস্বীকার করে লাভ নেই যে “কৃত্তিবাসে”র এই নতুন জন্মের ফলে নব্বইয়ের কবিরা বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছেন। উপকারটা কখনো –সখনো বেশ বস্তুতান্ত্রিকই হয়েছে। আবার উল্টোদিকে, নব্বইয়ের কবিদের তেজি কাঁধে ভর রেখে এই যে কৃত্তিবাসের আবার সক্রিয় হয়ে ওঠা, হৈ হৈ করে চলা – এতে আমাদের লেখালেখির জন্য প্রশস্ত এক জায়গাই শুধু তৈরি হল না, একদয়া যাঁদের দিকে তাকাতে ঘাড় টনটন করে উঠত এমন সব বাঘা বাঘা স্টলওয়ার্ট কবির সঙ্গে কাঁধ ঘষাঘষির স্বপ্ন ইচ্ছাপূরণেরও সুযোগ ঘটেছে।
তবে এরও বহু আগে, আমার প্রজন্মের ছেলেমেয়দের কালেকটিভ আনকনশাসের ভেতরে, অন্ধ অবচেতনের ভেতরে, কৃত্তিবাসের আনাগোনা। সেই কবি কবিতা সিং হের ‘শ্রবণী’, মঙ্গলবার সন্ধ্যার রেডিওতে, সেই এফ এম বিহীন রেডিওতে। কবিতাপাঠ, গল্পপাঠ। সেই রেডিওর কল্যাণেই শোনা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অসম্ভব কন্ঠ, তার উদাত্ত পাঠ, সেইসব টানটোন, সুর, যা থীক আপামার বাঙালি কবি কবিতা পড়তে শিখলেন যেন। শুরুটা বোধ হয় ওখান থেকেই, তখনো যাঁদের চোখে দেখিনি তাঁদের গলা শুনেছি… এই গোছের একটা শিহরণ। অনেকগুলো গমগমে গলা, অনেকগুলো গমগমে নাম।
তারপর ছাপার অক্ষর। কাকার বাড়িতে ( কবি মানস রায়চৌধুরী ( ১৯৩৫-১৯৯৬) , একদা যিনি কৃত্তিবাসের গোষ্ঠীর সঙ্গে ছিলেন যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ) ইতস্তত ছড়ানো থাকত নানা কবিতার পত্রপত্রিকা। তার মধ্যে ‘কৃত্তিবাস’ও থাকত। সেই ঐতিহাসিক, বড় সাইজের কৃত্তিবাস। নিউজপ্রিন্টে ছাপা। বুভুক্ষুর মতো ছাপার অক্ষরের খোঁজে পড়তাম, না বুঝলেও পড়তাম, বুঝতে পারতাম যে সামান্য কতিপয় শব্দ, মাথার ভিতরে গেঁথে যেত তারা , ঢুকে যেত ওই অন্ধ অবচেতনেই বোধ হয়। সে সব শব্দ বাংলাভাষায় না রচিত হলে, হয়ও আমারও কোনওদিন কবিতা লেখা হত না।
এর পর শুরু হল কবিতার বই পড়া, আমাদের নিজেদের। আমি আর দিদি। দিদি বড় বলে ওই শুরু করে। ল্যাজে ল্যাজে আমি। কবিতার বই আবিষ্কারও ছিল তার মধ্যে। বাড়িতেই , পুরনো বইয়ের তাক থীক, আমার স্বর্গত বাআব্র সং গ্রহের বইগুলি দিয়ে, পড়া শুরু হল।
তন্ন তন্ন করে পড়া হল গুপ্ত ধনের মতো। পারিবারিক রত্নকোষের মত, বাবার কেনা জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা, সিগনেট প্রেসের, হলুদের ওপর শ্যাওলা সবুজ ফার্নের ছবি ওয়ালা। তারপরেই যে আবিষ্কারটা ঘটল সেটা কৃত্তিবাসের সঙ্গে কিছুটা যুক্ত। দুটো বই। একটার নাম “প্রেমের কবিতা” । সুকুমার ঘোষ ও রাণা বসু সম্পাদিত । পাতায় পাতায় চারু খানের ছবি। বইটার আকৃতি সাড়ে চার বাই সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি। ওপরে বাহারি আর্ট পেপারের জ্যাকেট। খুদে, চমৎকার গেট আপের, উপহারযোগ্য এক বই। এই বইয়ে প্রেমের কবিতাগুলি খুব যে আধুইক ছিল তা বলা যায়না। কবিদের রেঞ্জ-এর শুরু রবীন্দ্রনাথে, শেষ অরবিন্দ গুহতে। ১৯৬২ তে প্রকাশিত এই বইয়ের ভিতরে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘প্রেম’ কবিতাটি পড়ে শিহরিত হই। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘প্রিয়তমাসু’ এবং ‘প্রধান আঁধারে’ পড়ে মুখস্ত করে ফেলি। একটা কালো ডায়েরিতে তখন প্রিয় কবিতাপংক্তি টুকে টুকে রাখতাম। সেখানে টুকে রাখি। ফাউন্টেন পেনের প্রুশিয়ান নীল বা রয়্যাল ব্লু কালিতে।
এই সব কবিতা পড়েই জীবনে প্রথম বুঝতে পারি প্রেমের কবিতা বস্তুটি কী। যেকোনো বাঙালি ছেলেমেয়ের মতই, প্রেমে পড়ার বহু আগেই, প্রেম কী তার এক অস্বচ্ছ ধারণা করে নিই এই কবিতাগুলি থেকে। অবশ্য মনে আছে সমর সেন-এর কবিতাটি জঘন্য লেগেছিল। ভীষণ তির্যক। ‘মেয়েটি বল্ল নতুন বন্ধুকে/ যা কিছু রটায় রটাক নিন্দুকে/ক্লান্ত মাথা রাখুন আমার উরুতে’ কবিতাটির অসামান্যতা বোঝার বয়স তখনো আমার হয়নি। বড্ড কড়া তখন এ আমার পক্ষে।
এই মিষ্টি বইটির সঙ্গে সঙ্গে আর একটি অপূর্ব বই পড়ি তখন। ওই বইয়ের যেখানে শেষ, এই বইয়ের সেখানে শুরু। প্রকাশ সাল কোথাও পাইনি। সম্পাদক শান্তি লাহিড়, দাম চার টাকা। ‘বাংলা কবিতা’ নাম, প্রকাশনার নাম ‘সাহিত্য’ । প্রোডাকশন দুর্দান্ত। জন্মসাল ধরে ধরে কবিদের সাজানো ছিল। কেবল পঞ্চাশের দশকের কবিরাই ছিলেন এই বইতে। জ্যাকেটে বলা হয়েছিল – “বাংলা কবিতার পঞ্চম দশক পুরধিকারের পুনরর্জনের পুনরুজ্জীবনের মাহেন্দ্র মুহূর্ত, প্রাচুর্যে প্রবলতায় সামর্থ্যে ও প্রত্যয়ে স্পন্দমান। আলোকের অভ্রশীর্ষ থকে অন্ধকারের পাতালগর্ভ পর্যন্ত তার দুই করতলের প্রসার, অহংকার ও আত্মহনন তার দুই গন্ডে আচিত্রিত। …যে সব কবিরা অনেকে মিলে সং হত কিংবা যাঁরা প্রত্যেকে আলাদা বিচ্যুত দ্বীপের মতো আত্মবলীন তাঁদের সবাইকে এই সংকলনে এই সর্বপ্রথম একত্রিত করা হল।“
এই বইটিতে ১৯২৮ এর জাতক অরবিন্দ গুহ থেকে শুরু করে ১৯৪০-এর জাতিকা কেতকী কুশারী অব্দি ছিলেন। এই অসামান্য সংকলনটি, আমার ১৯৭০ দশকে যাপিত সদ্য কৈশোরের কবিতার পাঠ অভিজ্ঞতার এক প্রধান, গুরুত্বপূর্ণ ও প্রগাঢ় ইনপুট। এই বইতেই প্রথম পড়ি ‘হঠাৎ নীরার জন্য’ , যা বাঙালি প্রেমিকদের বাইবেল। পড়ি শঙ্খ ঘোষের ‘এখন আরো অপরিচয় এখন আরো ভালো/ যা কিছু যায় দুপুরে যায় উড়ে’। পড়েছি তন্ময় দত্ত-র ‘শিল্পী’ : কাঁধেতে ফুলের ছাতা শিল্পী চলে একা পথ দিয়ে’, পড়েছি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘চতুরঙ্গে’ “ খুব বেশিদিন বাঁচব না আমি বাঁচতে চাই না”। এর থেকে বেশি কপি করার মত, অনুকরণের মধ্যে দিয়ে সর্বাত্মক পূজনের যোগ্য, আর কীই বা ছিল, একজন হাংলা বাংলা , ইস্কুলে ইতিহাসে আর অংকে মুহুর্মুহু ঢ্যাঁড়া খাওয়া ক্লাস সেভেন –এইটের মেয়ের পক্ষে?
এর পরের ইনপুট নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর “উলঙ্গ রাজা” বা শান্তনু দাশের ‘কাফের’-এর সঙ্গে কেনা, আমার দিদির বইমেলা থেকে সংগৃহীত তারাপদ রায়ের ‘নীল দিগন্তে এখন ম্যাজিক’। যাতে একটা কবিতা ছিল “ কৃত্তিবাস ১৮ বছর, কৃত্তিবাস রায় ৬ বছর”। ‘তুমি আমার উনিশশো আটান্ন, আমার থার্ড ক্লাস ডিগ্রি,/ আমার পাজামার উপরে ফুল প্যান্ট, আমার পাগলামি/ চৈত্রমাসের রাত-দুপুরে আমার ভরা যৌবন…’ এখানে পেয়েছিলাম আরো এক কৃত্তিবাসের ইশারা। কৃত্তিবাস রায়। যে আরো চার বছর বাদে, প্রেসিডেন্সিতে আমার সহপাঠী হবে।
আমাদের ছোটবেলার উনিশশো ষাট-সত্তর, কলেজ গমনের উনিশশো আশির দশক জুড়ে, রাজনৈতিক টালমাটাল, প্রযুক্তির অমোঘ নীরব গুঁড়ি মেরে প্রবেশ, এই সবের ফাঁক – ফোঁকর দিয়েই, ক্রমাগত চুইয়ে এসেছে কবিতার জগৎ। আর সেই জগতে কৃত্তিবাসী কবিরা, মূলত পঞ্চাশের কবিরাই , ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম বইমেলা যাওয়ার স্মৃতিগুলো , ক্লাস এইট নাইনের আমার সেই চোখদুটো যে সব ছবি মনক্যামেরায় ধরে নিয়েছিল, সেগুলো এখনো তাজা। সেই সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সমরেশ বসু শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে ভিড়ের মধ্যে থেকে কৌতূহলী আমি দেখেছি, ময়দানের মেলায় ঢোল বাজিয়ে নাচানাচি করতে, দেখেছি অটোগ্রাফ দিতে, দেখেছি স্টলের সামনে চেয়ার পেতে বসে আড্ডা দিতে। শুরুর দিকের বইমেলার মাঠের গন্দ আর নতুন বইয়ের গন্ধ, তারই সঙ্গে মিশে ছিলেন কবিতার হিরোরা, আইকনরা। তৃষ্ণার্ত স্পঞ্জের মত শুষে নিয়েছি তাঁদের লিখিত বাক্য বন্ধ, তাঁদের তৈরি ইমেজ, তাঁদের আত্মউন্মোচনের ভঙ্গি।
এর বহু বহু পরে, ১৯৯৩-৯৪ তে আমার লেখা ছাপাছাপির শুরু। ভাগ্যক্রমে, এর পরপরই কৃত্তিবাসের দ্বিতীয় পর্বের সূচনা এবং তার সাথে আমার নিজের স্পেশা, স্মরণীয় যোগাযোগটার সূত্রপাত। ১৯৯৮ বইমেলার ঠিক আগে একদিন জয় গোস্বামী আমার বাড়িতে ফোন করে জানালেন, পুরনো কৃত্তিবাসী শ্রী ভাস্কর দত্ত বিদেশ থেকে এসে কৃত্তিবাস পুরস্কার আবার চালু করার জন্য উদ্যোগী হয়েছেন। তাঁরই প্রদত্ত অর্থে এই পুরস্কার চালু হবার প্রথম বছরে, পুরস্কার পাচ্ছে বিভাস রায়চৌধুরী ও যশোধরা রায়চৌধুরী। আগের দিনই মিটিং-এ এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। খবরটা শুনে অনেক ক্ষণ কথা বলতে বপারিনি। মাথার মধ্যে হতভম্ব ভাবটা ছিল অনেকটা সময় জুড়ে। শোইশবে, কৈশোরে, যখনই কবিতা লেখার অপচেষ্টা করেছি, দিনের পর দিন কাঁচা, আবেগতাড়িত, দগদগে, নড়বড়ে কবিতায় ভরিয়ে তুলেছি গোপনে ডায়েরির পর ডায়েরি, তখন কবিতা ছাপা হবার স্বপ্নটাই কী অলীক ছিল। আর কৃত্তিবাসী কবিরাও ছিলেন কত দূরের তারকা। তারাপদ রায়ের হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছিলাম, পেছনে চেয়ারে বসে সুনীলদা অনুমোদনের হাসি হেসেছিলেন। এর আগে হয়ত এক আধবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, কিন্তু এই মঞ্চটি যেন একটি বৃহৎ পারিবারিক সম্মেলন ছিল। আর আমিও গুটিসুটি মেরে ওঁদের সকলের প্রিয় “মানসের ভাইঝি, দিলীপদার মেয়ে” হয়ে গেছি তখন, তারাপদদা খুবই নস্টালজিক ছিলেন পুরস্কার হাতে তুলে দিতে পেরে। অল্প কিছুদিন আগেই চলে গেছেন মানসকাকু, চিকিৎসা বিভ্রাটে, অকালে। পাশে বসা দিব্যেন্দু পালি ফিসফিস করে বলেছিলেন, ক্যাশ আছে, সাবধানে নিয়ো। শরৎ মুখোপাধ্যায়, বিজয়াদি অথবা সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত এর কিছু আগে পরে আপন করে নিয়েছেন, এক অদ্ভুত স্নেহ আর সহজ স্বীকৃতি ছিল তাঁদের।
ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর বিখ্যাত কবিদের প্রতিফলিত বিভা, ঠিক কোন জিনিশটা আমাকে টেনেছে কৃত্তিবাসের প্রতি? সে সবের আগেও আসলে টেনেছে কৃত্তিবাসের গভীর উত্তরাধিকার। নবপর্যায়ের কৃত্তিবাস কবিতা লেখবার এক মুক্ত ক্ষেত্র থেকে গেছে। সেই অনবদমিত, স্বীকারোক্তিমূলক ‘নতুন কবিতা’ লেখার কৃত্তিবাস এখনো ততটাই তরুণ যেমনটা পঞ্চাশ বছর আগে। সেটা পৃথিবীর ইতিহাসে খুব একটা কম সময় নয়। এতগুলো বছরের এপারে এসেও ‘কৃত্তিবাসের’ নামের সঙ্গে যে গভীর স্নব ভ্যালু জড়িয়ে আছে, সেই মূলধনকে ভাঙিয়ে ভাঙিয়েই আমরা , উনিশশো নব্বইয়ের কবিরা খেয়ে চলেছি।
( ২০০৪ এর কৃত্তিবাস সুবর্ণজয়ন্তী সমাপ্তি স্মারকগ্রন্থে সম্বলিত, সামান্য সম্পাদিত)

বিয়েবাড়ি

বিয়েবাড়ি

যশোধরা রায়চৌধুরী

(ক্যাথারিন ম্যানস্ফিল্ড-এর একটি গল্পের ছায়ায়)

বিয়েবাড়ির জন্য সেজেগুজে তৈরি হওয়া যে কী ঝকমারির ব্যাপার! রাত্তিরে মুখে নাকে গুঁজে খাইয়ে দিল দুটোকে, ভাতেভাত। চ্যাঁভ্যাঁ ল্যাটর প্যাটর,  ওদের নিয়ে কেউ পার্টিতে যায়? এমনি ওমনি বিয়েবাড়ি ত নয়, খোদ রাসবিহারী সেনের মেয়ের বিয়ে। সাহেবি কেতা।  খাওয়ার পরে, নীলিমা ছোট ছেলে টুবুকে  বিছানায় গুঁজে দিল। শুধু রুমা রইল তাঁর সঙ্গে । কত্তার  কোট ব্রাশ দিয়ে ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করা, জুতো পালিশ করা সোজা কাজ নাকি? হাত বাটাতে হবে ত রুমাকে মায়ের সঙ্গে।  স্বামীর সবচেয়ে ভাল শার্টটা ইস্তিরি করলেন, তাঁর বুট পালিশ করলেন, কালো সাটিনের নেক টাই -টায় কয়েকটা সেলাইয়ের ফোঁড় ও দিতে হল বইকি। 

কত্তামশাই সেই যে আপিসে ছোট থেক মেজ তার থকে বড় সাহেব হয়েছিলেন। এখনো , সুটবুট টাইই পরেন বাইরে টাইরে গেলে। বিয়েবাড়িতেও ধুতিপাঞ্জাবির মধ্যে ঢোকেন না। 

রুমা আমার শাড়িটা একটু ঝেড়ে তারপর খাটের রেলিং-এ  ঝুলিয়ে রাখ।  তাহলে ভাঁজগুলো আপনিই সমান হয়ে যাবে। ইস্তিরি ত আর করা হল না।  বললেন গিন্নিমা। আর শোন, ভাইয়ের দেখা শোনা করবে কিন্তু, আর নিজে একদম বেশিক্ষণ জাগবে না, সাড়ে দশটার বেশি একদম না। আমাদের ফিরতে  অনেক রাত হবে ত। হ্যারিকেন জ্বলুক, যদি কারেন্ট যায় আবার। তুমি আলোটা ছোঁবে না, তুমি জান ত ছুঁলে কী হবে।  

রুমার বয়স নয়। সে মনে করে সে এতটাই বড় হয়ে গেছে যে চাইলে হাজারটা হ্যারিকেনকে ঠিক সামলে নিতে পারে। সে বলল, “আমি জেগে থাকিনা আর এট্টূ, , মা! টুবু যদি আবার উঠে দুধ খেতে চায়?”

  • সাড়ে দশটা মানে সাড়ে দশটাই। মা কড়া গলায় বললেন। বাবাকে বলব নাকি? বাবাকে বলে দিচ্ছি কথা শুনছ না তুমি। 

ঠোঁট ঝোলাল রুমা। কিন্তু… কিন্তু…

ওই যে বাবা আসছেন। যাও ত ও-ঘরে গিয়ে আমার নীল শালটা এনে দাও। আমি যখন থাকব না তুমি আমার কালো শালটা গায়ে দিতে  পার। এবার যাও দিকিনি!!

মায়ের কাঁধ থেকে কালো শালটা নিয়ে রুমা সযত্নে পরে নিল। গায়ে জড়িয়ে পেছনে গিঁট বেঁধে নিল ওটা দিয়ে। ভেবে দেখল, যদি ওকে সাড়ে দশটাতেই শুতে যেতে হয়, ও মায়ের শালটা গায়ে দিয়েই শোবে। মা মা গন্ধ আছে ওটায়। আর বিছানায় শুয়ে শুয়ে  শাল গায়ে দেওয়া , মায়ের এসব অপছন্দ, তাই একটু বদমায়েশি করার এই ভাবনা থেক বেশ একটা আরাম হল। গল্পবই গুছিয়ে রেখেছিল রাত জাগবে ভেবে…

ওদিকে কত্তা ফিরলেন আপিসফেরত  পাড়া বেড়িয়ে, অনেক ক্ষণ এদিক ওদিক এলাকায় টহল দিয়ে আর মাতব্বরি করে। কাজেই ফিরেই তাড়া মারলেন। হাঁক পাড়লেন – আমার জামাকাপড়গুলো সব কোথায়? কিচ্ছু রেডি নেই , বোঝাই যাচ্ছে, আর ওদিকে সব্বাই বিয়েবাড়ি পৌঁছে গেছে!। আসতে আসতে আমি  দেখতেও পেলাম লোক ঢুকছে, সানাই-এর পোঁ ত কখন শুরু হয়ে গেছে । তোমার ব্যাপারটা কী! কী করছটা কী শুনি? এখনো ত তৈরিই হও নি। এভাবে ঝি সেজে ত বিয়েবাড়ি যেতে পারবে না। 

এই তো তোমার জামাকাপড়, সব রেডি করে দেখ সাজিয়ে রেখেছি। হাতমুখ ধুয়ে নাও।  রুমা,  বাবাকে তোয়ালেটা এগিয়ে দাও ত। সব রেডি আছে শুধু প্যান্ট ছাড়া। প্যান্টের ঝুল ছোট করার আর সময় পাইনি গো। যাবার পথে তলাগুলো বুটের ভেতর গুঁজে নিতে হবে।

হুঁঃ। কত্তামশাই গজগজ করলেন। এ ঘরে ত নড়াচড়ার জায়গা নেই। আমার ত জামা পরতে আয়নাটা লাগবে। তুমি বরং  প্যাসেজে গিয়ে শাড়ি পর। কী যে দেরি কর ! আগে থেকে তৈরি হয়ে থাকতে পার না? তোমাদের ত আবার সাজতে এক ঘন্টা লাগে। 

পাশের ছোট খুপরি বারান্দা ঘিরেছেন পর্দা দিয়ে। ওখানেই, অন্ধকারে তৈরি হওয়া নীলিমার কাছে কোন ব্যাপারই না। অন্ধকারে হাতড়ে বডিস এর হুক লাগালেন, সায়া পরলেন, শাড়ি জড়ালেন। ফিরে এসে স্বামীর পেছন থেকে আয়নায় উঁকি দিতে দিতে ব্রুচ আঁটলেন,  ব্রুচটা সোনার। বিয়েতে পাওয়া। কানে সোনার দুল পরলেন, গলায় হার। তারপরে মাথা ঢেকে নিলেন নীল শালে।  

যাচ্ছ কোথায়,  আমার টাইটা বেঁধে দিয়ে যাও, ডাক দিলেন গুপ্তসাহেব।  ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পতিদেবতা হাঁপাচ্ছিলেন জামাকাপড় পরতে পরতে।  তাঁর শার্ট খানা চমৎকার ইস্তিরি করা। আকাশি নীল শার্ট আর গাঢ় নীল প্যান্টে তাঁকে ইশকুলের সদাপ্রস্তুত ছোট্ট খোকার মত লাগছিল।  “আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?”

অপূর্ব! – বেঁটে নীলিমা গোড়ালির ওপর উঁচু হয়ে  স্বামীর টাই হিসেবমত মেপেজুপে বাঁধলেন।  এদিক ওদিকে শার্ট টেনে সোজা করে ফিটফাট করে দিলেন।  রুমা, এসে দেখে যা ত বাবাকে কেমন দেখাচ্ছে। 

গুপ্তসাহেব ঘরের  এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হেঁটে বেড়ালেন, তারপর  কোটটা পরলেন অন্যদের সাহায্য নিয়ে, তারপর বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন,  যতক্ষণ না  নীলিমা হাতের বটুয়া গুছিয়ে, টর্চ খুঁজ বেরোন। 

আরে চলো চলো- কাজ শেষ হল তোমার? পা চালাও এবার!

রুমা, হ্যারিকেন হাত দিবি না কিন্তু! বলে নীলিমা সদর দরজাটা  টেনে বন্ধ করে বেরিয়ে এলেন। 

সারাদিন ধরেই যে বৃষ্টি  হয়েছে তা নয়, তবে পথে দুপুরের দিকে খুব বৃষ্টিতে জল জমেছিল এখন নেবে যাবার পরে কাদা আর  পিছল হয়ে গেছে প্রচন্ড। নীলিমা  বেশ কয়েক সপ্তাহ বাড়ির বাইরে বেরোন নি , বেরনোর দরকারই বা কী – আর সারাদিনের হুড়োহুড়ির ফলে এখন যেন ঘেঁটে গেছেন, বোকা বোকা হয়ে গেছেন পুরো। দামি সিল্কের শাড়ি পরে আরো যেন জবুথবু। যেন মনে হচ্ছে রুমা ওঁকে বাড়ি থেকে ঠেলে বের করে দিল, আর সঙ্গের মানুষটি যেন ওঁর কাছ থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাবে! গুপ্তসাহেবের লম্বা লম্বা পায়ের হাঁটা এমন , পেছনে বেঁটকুল গিন্নির তোয়াক্কা নেই কোন। 

দাঁড়াও , দাঁড়াও !  আমার জন্য অপেক্ষা কর । উফ বাবা এখানে কী অন্ধকার । টর্চটা একটু জ্বালো না বাপু। 

নীলিমা চেঁচিয়ে ডাক দিলেন ।

 না , আমার জুতো নোংরা হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি এসো। 

একবার  একটা বেড়া দেওয়া পার্ক মত, তার কাছাকাছি এসে হাঁটাটা সহজ হয়ে এল, ধরে টাল সামলাবার জন্য বেড়াগুলো ছিল । বিয়েবাড়ি বেশি দূরে না। বিয়েবাড়ির সামনের পথটুকুতে আবার ছাই বালি ঘেঁষ  ফেলে বিয়েবাড়ির অতিথিদের আসার সুবিধে করে দেওয়া হয়েছে। যা বৃষ্টি আর কাদা কদিন ধরে! নভেম্বর মাসে এমন বৃষ্টি কে কবে দেখেছে। ঠান্ডাটা যেন আরো জাঁকিয়ে পড়েছে তাতেই। 

বিয়েবাড়ি তখন জমে উঠেছে। কলকল কথা, বেনারসির ঝলকানি।  রসে টইটুম্বুর।  আমোদ আহ্লাদে ভরা। আলো ঝলকাচ্ছে। ছাত থেকে আলোর মালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সামনের দরজাটাও ফুলের গেট দিয়ে , আলো দিয়ে সাজানো। বড় হলটায়, খোদ বিয়েবাড়ির কর্তাব্যক্তিরা কেটারারের লোকেদের বকাঝকা করে নিজেদের কর্তৃত্ব  জানান দিচ্ছেন। শুঁটকো কেটারারের লোক কোল্ড ড্রিংক্স এ গেলাস  কফির কাপ আর স্ন্যাক্স এর প্লেট ভর্তি ট্রে নিয়ে ক্রমাগত দৌড়োদৌড়ি করছে। 

রঙিন রঙিন প্রজাপতির মত কত কম বয়সী মেয়ে বিয়েবাড়িতে। হালফ্যাশনের সাজ।  নিজে কুঁকড়ে যান নীলিমা এসব দেখে। নিজের সাজটা বেশ পুরনো আর বাজে মনে হয়। 

নিচের গ্যাঞ্জাম থেক  এবার উঠতে হবে। বর বউ বসেছে দোতলায় মেন হল ঘরে।  

“সিঁঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে যান, ওপরে চলে যান”, কে যেন চেঁচাচ্ছিলেন। গুপ্তসাহেবও দেখা গেল এই কান্ডকারখানার বিশালত্বে সম্পূর্ণ অভিভূত হয়ে পড়ে, নিজের পতিসুলভ কর্তব্য , যথা স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গে থাকাটুকুও সম্পূর্ণ ভুলে, সিঁড়ির রেলিং ধরে অন্যদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে ওঠার চেষ্টা করে যেতে লাগলেন। বর বউ যেখানে বসেছে সেই  ঘরটিতে প্রবেশ করামাত্র গুপ্তসাহেবের   সহকর্মীরা তাঁকে দেখে হৈ হৈ করে উঠলেন। মিসেস নীলিমা গুপ্ত একবার ব্রুচটা ঠিক করে নিলেন, হাতদুটি জড়ো করে রাখলেন, একজন  অফিসারের স্ত্রী ও দুই সন্তানের মায়ের ঠিক যেমনটি থাকা উচিত তেমনই সভ্যভদ্র হয়ে রইলেন। 

হলঘরটি সত্যিই খুব সুন্দর। অনেক ছোট টেবিল ঘরের  মধ্য ছড়িয়ে রাখা। প্রতি টেবিলে ফুল, রেশমের ফিতে ও ঝালর। চেয়ার দিয়ে ঘেরা, চেয়ারের পিঠেও ঝালর।  এক দিকের প্লাটফর্মে বর বউ সিংহাসনে বসবে। একটা বিশাল ঝাড়লন্ঠন ছাতের থেকে ঝুলছে আর তার উষ্ণ উজ্জ্বল আলো প্রতিফলিত হচ্ছে কাগজের ফুল আর মালা দিয়ে সাজানো দেওয়ালে দেওয়ালে।   সবচেয়ে ভাল পোশাকে সাজগোজ করা অতিথিদের  লালচে মুখে সেই আলো পড়ে আরো উজ্জ্বল ও উষ্ণ  লাগছিল।

 এবার সিংহাসনে  বর বউ বসেছে। কনেটি গয়না আর লাল বেনারসি, লাল ওড়না সোনালি জরির তলায় সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে গেছে। জরির কাজের আড়ম্বরে ঢেকে গেছে রেশমের শাড়ি ব্লাউজ। তাকে দেখে মনে হচ্ছে একটা আইসিং করা কেক,  কেটে কেটে ছোট টুকরো করে পাশে বসা বরটিকে খাওয়ানোর জন্য একেবারে তৈরি। বর পরে আছে  সাদা কাপড়ের বন্ধগলা স্যুট, তার মাপের চেয়ে বেশ খানিকটা বড়ো। আজকাল এই ফ্যাশন উঠেছে, মাড়োয়ারিদের মত মাথায় পাগড়ি, সেটাও লাল সোনালি।  তাদের চারপাশে  সম্ভ্রান্ত সুশীলতার প্রতীক হয়ে বসে আছেন তাদের বাবা মায়েরা, আত্মীয়েরা। কনের ডানদিকে একটা টুলের ওপর উঁচুতে চড়ে বসেছে একটি ছোট্ট মেয়ে। তার  জরি বসানো সিল্কের গাউনটি কুঁচকেমুচকে আছে। এক কানের ওপর ফুলে গাঁঁথা একটা মুকুট ঝুলছে। সবাই একে একে যাচ্ছে, ওদের কাছে, বেদির ওপরে।  হাসছে, কথা বলছে,  বর বউকে গিয়ে উপহার দিচ্ছে , ছবি তোলাচ্ছে । বাইরের বৃষ্টিভেজার কাদার বোঁটকা একটা গন্ধ আর তার সঙ্গে এখানে এত আলোতে ভিড়ে মিশে থাকা ঘামের গন্ধ – সব মিলিয়ে মিশ্র একটা বদগন্ধে, হঠাৎ দম বন্ধ হয়ে এল নীলিমার।  

নীলিমা পুতুলের মত নিজের স্বামীকে অনুসরণ করলেন, বর বউ ইত্যাদিকে নমস্কারাদি সম্ভাষণ ইত্যাদি  জানিয়ে বেদি থেকে নামলেন। উপহারটা সব কলিগ মিলে কেনা হয়েছে , সেটা যে নিয়ে আসবে সে এখনো আসেনি।   গুপ্ত সাহেবের মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তিনি নিশ্চিত জানেন,  তিনি আজ চুটিয়ে মজা  করবেনই। তিনি যেন ক্রমশ ফুর্তিতে ফুলে উঠছেন, টগবগ করে ফুটছেন, পুরনো  চেনা চেনা লোকেদের দেখতে পেয়ে। ঐদিকে চল, এক সহকর্মী তাঁর বাহু ধরে টানল। ছাতের এক কোণায় ড্রিংক্স সার্ভ হচ্ছে লুকিয়ে। সেদিকে গিয়ে দু ঢোঁক মেরে আসবেন। 

নীলিমা এখন কী করবেন একা একা, বুঝে পাচ্ছেন না। হঠাৎ তাঁর শাড়ি ধরে টানল কে যেন। তাকিয়ে দেখলেন, মিসেস রায় তাঁকে ডাকছে। একটা খালি চেয়ার টেনে তাকে পাশে বসতে বলল। একটা গোল টেবিলের চারপাশে কটা চেয়ার পাতা। 

কোল্ড ড্রিংকস খাবে ত? মাটন শাম্মিকাবাব টা হেব্বি করেছে কিন্তু। খেয়েছ? 

মিসেস রায়ের বেশ চারদিকে চোখ ঘুরছে।  অ্যাই, তোমার না,  ব্লাউজের পেছন দিকে নিচের জামা বেরিয়ে আছে ,  তুমি যখন ঘরে ঢুকলে আমরা দেখে না হেসে পারলাম না, আর এই শাড়িটা কী গো? বমকাই? আমারো একটা আছে । এ মা ,  শাড়ির তলা থেকেও তোমার পেটিকোট বেরিয়ে আছে। ম্যাচিং পেটিকোট করাওনি?

এ বাবা, কী যা তা  ব্যাপার। নীলিমা আড়ষ্ট হয়ে হাত দিয়ে টেনে ব্লাউজ নামাতে গেলেন তারপর আঁচল দিয়ে গোটা পিঠ ঢেকে দিলেন।  ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়তে পড়তে ঠোঁট কামড়ে বললেন, এত তাড়াহুড়ো হল না বেরুবার সময়ে! 

যাক গে যা হবার হয়ে গেছে –  রায়গিন্নি বলল, নিজের মোটা মোটা হাত টেবিলটার  ওপর ছড়িয়ে দিয়ে , নিজের মকরমুখী বালা, আর ছ জোড়া সোনার চুড়ির দিকে গভীর সন্তুষ্টির সঙ্গে তাকিয়ে । তবে কিনা, একটু সাবধান হতে হয় ,বিয়েবাড়ির সাজ বলে কথা। 

আর এইরকম জাঁকজমক যে বিয়েতে সেখানে ত বটেই। চেঁচিয়ে বলল মিসেস ব্যানার্জি। দুটো কোল্ড ড্রিংক নিয়ে এসে টেবিলে রাখল। এই নীলিমা তুমি কী খাবে গো? আরে, দেখেছ, ফিল্ম স্টার এসেছে? ঐ ঐ যে সিরিয়ালে অ্যাক্টিং করেগো!  নীলিমার উল্টো দিকে বসল মেয়েটি। 

কান্ড দেখেছ,  ঋদ্ধিমার বাড়ির লোকের সেন্স নেই কোন। ঋদ্ধিমার ওই বাচ্চাটাকে ট্যাঁকে করে এনেছে। ওর নিজের  আগের পক্ষের বাচ্চা! ভাব, বিয়েটা করছে শুধু দ্বিতীয় বিয়ে তাই না, আবার বরটা ওর থেকে পাক্কা পাঁচ বছরের ছোট। 

তিন মহিলা বসে বসে কনের দিকে প্যাঁট প্যাঁট করে দেখতে লাগলেন। কনে একেবারে শান্তভাবে বসা। ঠোঁটে একটা শূন্য ফ্যাকাশে হাসি। শুধু ওর চোখ দুটি এদিক ওদিক অস্বস্তিভরা দৃষ্টি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। 

কেমন ট্যাল্ট্যালে চোখ দেখ  বাচ্চাটার! ফিসফিস করে বললেন মিসেস রায়। স্ন্যাক্স খাচ্ছে মুখে সস লেগে যাচ্ছে। বাচ্চাটা কি অ্যাবনর্মাল নাকি, গো? গলা নামালেন মিসেস রায়।  বাড়িতে রেখে এল না কেন ওটাকে?

নীলিমা ঘুরে তাকালেন কনের মায়ের দিকে। মহিলা নিজের ডিভোর্স করে দ্বিতীয়বার বিয়ে করা মেয়ের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়েই আছেন। একটা বুড়ো বাঁদরের মত বাদামি কপাল।  ভুরু কুঁচকে দেখেই চলেছেন আর খুব গাম্ভীর্যের সঙ্গে মাথা নাড়ছেন মাঝে মাঝে । কফির কাপ তোলার সময়ে তাঁর হাত কাঁপছে। একবার  বুনোদের মত করে থুতু ফেললেন মেঝেতে, কাবাবের মধ্যে টুথপিক গেঁথে খেয়ে তারপর সেই টুথপিক দিয়ে দাঁত খুঁটলেন। ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছলেন কিন্তু যেন চটচটে একটা অস্বস্তির পর্দা লেগে রইল মুখে। 

ঈষৎ মত্ত হয়ে ফিরে এসেছেন কনের বাবা। কোণে গিয়ে টেনে এসেছেন আর কি  খানিক। প্রাক্তন আমলা, সরকারের ঘর থেকে অনেক উপরি এনেছেন। নইলে কেউ মেয়ের দ্বিতীয় বিয়েতে এত খরচ করেনা। 

গিন্নির কোমরে খোঁচা দিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, আরে,  আনন্দ কর বুড়ি! এবার আর বিয়ে ভাঙবে না ঋদ্ধিমার। জামাইকে ঘরজামাই করছি। 

 তারপর পাশে থাকা নিজের শালা আর আর কটা পুরুষ অতিথির দিকে চেয়ে উনি চোখ টিপলেন, অতিথিরা অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল। 

আমি আনন্দই করছি ত!  প্রৌঢ়া  বিড়বিড় করে বল্লেন। মুঠি দিয়ে হাঁটুতে ঠেকা দিতে লাগলেন, সানাইতে যে সোহিনী বাজছে, যেন তারই তালে তালে।   কনের মা হিসেবে খুব গর্বিত, প্রমাণ করতেই হবে তাঁকে। 

মিসেস রায়  বললেন, উনি আসলে ভুলতেই পারছেন না ,  ঋদ্ধিমা কতটা  বেলাগাম হুল্লোড়ের জীবন কাটিয়েছে।  এই ঘরজামাই বরটাকে ত ওর বাবা এনে ওর ঘাড়ে চাপিয়েছে। মেয়েটা মোটেই আবার বিয়ে করতে চায়নি। বাবা শেষে শাসিয়েছে যে সম্পত্তির ভাগ দেবে না বিয়ে না করলে।  

আগের বরের সঙ্গে কী হয়েছিল, গো? নীলিমা ইন্টারেস্ট দেখানোর চেষ্টা করলেন। আগের বিয়েটা ভেঙে গেল কেন?

মহিলারা কাঁধ ঝাঁকালেন । 

আরে প্রেম করে বিয়ে ত, বুঝতেই পার। শরীরের টান। কদিনের সেই প্রেম ভোঁভাঁ। হাপিস হয়ে গেছে। একটা মেয়ের ত উচিত স্বামীকে সেবা যত্ন দিয়ে বেঁধে রাখা। তা না, যদি সারাক্ষণ শোয়াশুয়ির ওপর রাখে কদিন আর ভাল্লাগবে বল? 

হি হি করে হাসছিল দুই বান্ধবী, মিসেস ব্যানার্জি চোখের একটা ভঙ্গি করে বলল, উফফ দিদি তুমি পারও বটে। মেয়েটা সত্যি খুব কুত্তি, খালি আদাড়ে বাদাড়ে ছেলে ধরে বেড়াত কম বয়সে। 

মিসেস নীলিমা গুপ্ত নিজের কফির কাপের ভেতরে তাকালেন। ফুঁ দিয়ে ফেনাটার মধ্যে ছোট্ট একটা ফুটো করলেন। 

সেই, বিয়ে ত একটা পবিত্র বন্ধন।  

মিসেস ব্যানার্জি আরো বলতে লাগল। বরটাকে দেখছ না দিদি, অরুণাভ।  এই ছেলেটা একদম ল্যাদাড়ুশ। আমার কাকিমার পিসতুতো বোনের ভাশুরের ছেলে ত। আমরাই সম্বন্ধ দেখে দিলাম। ছেলের মা-বাবা নেই, একদম আইডিয়াল।  বলেছিল ছেলের নাকি মেয়েদের দিকে মনই নেই। ঐ আজকাল কী একটা উঠেছে না  , গে না কী যেন, ওইরকম হাবভাব।  কাজ ফাজ ও করেনা কোন । ছবিটবি আঁকে। ওকে এখানে গ্যারেজ করে দিল, ঘরজামাই করে দেবে, অঢেল টাকা আছে। মেয়ে উড়ে বেড়াবে আর জামাই ঘরে বসে আঁকবে। বলা যায়না, আবার, ছেলেটা হয়ত বিয়ে করে ঋদ্ধিমাকে সিধে করে দেবে পিটিয়ে। তখন সারাদিন পতিসেবা করে মরবে। বিয়ের পর মেয়েদের যে কত কী সইতে হয়!

নীলিমা গুপ্ত চোখ দিয়ে  নিজের স্বামীকে খুঁজলেন।  ঐ ত নিজের সহকর্মীদের সংগে বসে। উনি জানেন, স্বামীমহাশয় খুব বেশি মদ্যপান করে এসেছেন। হাত পা খুব নাড়ছেন বুনোমানুষের মত। কথা বলার সময়ে মুখ থেকে থুতু ছিটকে পড়ছে চারিদিকে। 

হ্যাঁ তা ত বটেই। সম্মতি দিলেন নীলিমা।  একেবারে সত্যি। মেয়েদের কত কি যে শিখে উঠতে হয়। 

এই দুই পৃথুলা মহিলার মাঝখানটিতে গোঁঁজ হয়ে বসে আছেন বলে, নীলিমার উঠতেই ইচ্ছে করছে না। স্বামী ইঙ্গিত করলেন এর ওপরের তলায় খেতে যাবেন কিনা।

সানাইতে তান ধরেছে…  বাচ্চারা, স্বামী সব ভুলে গেলেন নীলিমা। নিজেকে আবার এক তরুণী মনে হল যেন। তীব্র মধ্যম… কোমল রে… অনেক যুগ আগে গান শিখতেন নীলিমা… বিয়ের আগে। সানাইটা একটু দুঃখের, খুব মধুর লাগল তাঁর। খড়খড়ে হয়ে ওঠা হাতদুটি ভাঁজ হয়ে আবার খুলে গেল টেবিলের ওপরে। হঠাতই ভাল লাগছিল তাঁর আর সেজন্যেই, কারুর মুখের দিকে তাকাতে সাহস হল না তাঁর। মুখ জুড়ে রইল হাসির আদল,  ঠোঁটের চারপাশে সামান্য নার্ভাস কাঁপুনি । 

মিসেস রায় এবার উঠে দাঁড়ালেন। চলো খেয়ে আসি। পরে জায়গা পাব না আর। এখন ফাঁকা যাচ্ছে। 

খাবার জায়গায় গিয়ে মিসেস রায় আবার  চেঁচিয়ে উঠলেন। হে ভগবান! ঋদ্ধিমার বাচ্চাটাকে একটা চিকেনের লেগ দিয়েছে  প্লেটে, টাল সামলাতে না পেরে সেটা মাটিতে ফেলে দিল, আবার কুড়িয়ে তুলছে। ছি ছি ছি। 

খেয়ে নামলেন ওঁরা। এই চলো চলো , অফিসের ওরা ডাকছে।  এখন একটা ঘোষণা হবে। তোমার স্বামী বক্তৃতা দেবেন গো নীলিমা। 

নীলিমা সোজা হয়ে শক্ত হয়ে বসলেন। 

গুপ্তসাহেব একাই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। হাতে একটা রুপোর বড় ট্রফি ধরে আছেন। ওইটা অফিসের সবার পক্ষ থেকে চাঁদা তুলে কেনা হয়েছে। সেটাই হাউমাউ করে বলছেন। অনেক আদিরসাত্মক রসিকতার সঙ্গে পাঞ্চ করে। একবার “দ্বিতীয়বার ন্যাড়া বেলতলায় যাচ্ছে” -টাইপের কিছু বোকা রসিকতা করলেন।  সবাই ওঁর বক্তৃতা শুনে হাসছিল, শুধু নীলিমার হাসি পাচ্ছে না।  সবাই হো হো করে হেসে  চীৎকার  করছিল ওঁর মুখভঙ্গি দেখে । ট্রফিটাকে যেন একটা শিশুকে কোলে নিয়ে যাচ্ছেন এমন ভঙ্গিতে ওঁর বর কনের দিকে নিয়ে যাওয়াটা দেখেও। 

নীলিমার  একটুও মজা লাগল না। চারধারের প্রতিটি অট্টহাস্যময় মুখের দিকে  তিনি তাকাতে লাগলেন, আর হঠাৎ সব মুখগুলোকেই তাঁর অচেনা মনে হল।  বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করল। ইচ্ছে হল আর কোনদিন বাড়ি থেকে বেরুবেন না। তাঁর মনে হল এই সব লোক আসলে তাঁকে নিয়েই হাসছে। এই ঘরে যত লোক , তার চেয়েও বেশি লোক হাসছে তাঁর দিকে চেয়ে। সবাই হাসছে, কারণ তারা আসলে ওর চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী।  

* * *

নীরবে হেঁটে বাড়ি ফিরল তারা। মিস্টার গুপ্ত লম্বা পা ফেলে সামনে সামনে। মিসেস গুপ্ত পেছনে পেছনে হুমড়ি খেতে খেতে।  বিয়েবাড়ি থেকে বাড়ি অব্দি রাস্তাটা বিষণ্ণ, কাদামাখা , কালচে, সামনে পড়ে আছে । 

 মুখ থেকে খালি শালের ঘোমটাটা খুলে খুলে যাচ্ছে ঠান্ডা দমকা হাওয়ায়, দূরে কোথায় যেন বৃষ্টি হচ্ছে খুব, একটু পরেই এখানেও এসে পড়বে দামাল মেঘের দল। হঠাৎ নীলিমার  মনে পড়ল, ফুলশয্যার রাত। এখন তাদের দুটো  বাচ্চা, টাকাকড়িও আছে… আচ্ছা নিজের জন্য একটা আলাদা ঘর, একটা আলাদা ড্রেসিং টেবিল কি করা যেত না? 

নাহ, এসবের মানে কী ? বিড়বিড়  করলেন মিসেস। কী লাভ এসবে? বাড়ি পৌঁছে নীলিমা প্রথমেই স্বামীর জন্য গেলাস, বোতল, বরফ, ড্রিংক্স-এর  ব্যবস্থা করতে লেগে গেলেন, চিনেবাদাম বার করলেন। রাতে শোবার আগে হাতের সব কাজগুলো সেরে ফেলতে হবে। তবু, কাজের ফাঁকেও,  এই হাস্যকর প্রশ্নটা তার আগে অব্দি নাছোড় হয়ে রইল তার সংগে। আচ্ছা আমার যদি একটা আলাদা ঘর থাকত। 

 রাতে গুরুপাক খেয়েছেন স্বামী, কিন্তু এখন আবার বোতল খুলে বসা চাইই চাই। 

মিস্টার গুপ্ত গেলাসটা নিয়ে তারিয়ে তারিয়ে চুমুক মারলেন। 

অম্বল হয়নি ত তোমার? নীলিমা জিজ্ঞাসা করলেন  টেবিলের ওপর বাহুদুটি ভর দিয়ে, বালিশের মত বুকদুটি টেবিলের সঙ্গে ঠেকিয়ে রেখে। 

না না অম্বল কী আর হবে। মাংসটা ভাল করেছিল বেশ। বিরিয়ানিটাও হেব্বি।  টাকা খরচা করেছেন মিস্টার সেন। বল? 

হুঁ।  বললেন গৃহিণী। 

কেন ভাল্লাগেনি নাকি তোমার?  

না না ঠিকই আছে। নীলিমা বললেন। কেমন যেন ভয়ে ভয়ে। 

নাহ , টাকার গন্ধ খুব। তাছাড়া এমন কিছু একটা খাওয়াটা ছিল না , বল?  চিংড়ি ছিল না মেনুতে। গলদা চিংড়ি না থাকলে আবার বিয়ের খরচ কী দ্যাখানো!

পা দুটো ছড়িয়ে দিয়ে  আরামকেদারায় বসে স্বামী বললেন। 

ন্‌ -না, স্ত্রী স্বামীর ছেড়ে   ফেলে দেওয়া জামাকাপড়গুলোকে কুড়িয়ে , গুছিয়ে তুলতে তুলতে বললেন । 

গুপ্তসাহেব  হাই তুললেন,আড়মোড়া ভাঙলেন , তারপর হাসতে হাসতে স্ত্রীর দিকে মুখ তুললেন।

মনে আছে তোমার?আমাদের ফুলশয্যা?

সে অনেক দিন আগের কথা ত। আমার মনে টনে নেই। 

তবে মনে ত ওঁর ছিলই। 

তুমি আমাকে সে রাতে রামধাক্কা  মেরেছিলে !!  আমিও তোমাকে শিগগিরই উচিত  শিক্ষা দিয়েছিলাম। প্রথম রাতেই বেড়াল মেরেছিলাম হা হা হা। 

আবার এখন কথা কইতে বসো না। অতিরিক্ত গিলেছ ত। শুতে এস। 

গুপ্ত চেয়ারের ওপর শরীর একদম এলিয়ে ,  আমোদ পেয়ে  খুঁক খুঁক হাসলেন। 

ঐ দিন রাত্রে তুমি মোটেই আমাকে এটা বল নি। ওরে কপাল, তোমাকে পোষ মানাতে আমার যা ঝঞ্ঝাটঝামেলা  করতে হয়েছিল সেদিন!  …

ছোটখাট মোটাসোটা নীলিমা  পাশের ঘরে চলে গেলেন। ছেলেমেয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছে। একেবারে ছোটটার বিছানার গদিটা ধরে দেখলেন, ভিজিয়েছে কিনা। তারপর নিজের ব্লাউজের হুক খুলতে শুরু করলেন। 

সবই এক।  নীলিমা  বিড়বিড়োলেন। সারা পৃথিবীতে, সব বিয়েই ত একই রকম। বড্ড বোকা বোকা এই সব ব্যাপার। 

তারপর কোথা দিয়ে জানি, বিয়েবাড়ি যাওয়ার স্মৃতিটাও মুছে গেল । বিছানায় শুয়ে পড়লেন উনি।   হাতখানা মুখের ওপর আড়াল করে রাখলেন ,  যেন বাচ্চা মেয়ে, বড় একটা রাক্ষস এখুনি এসে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ভয়েতে মুখ আড়াল করে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

গুপ্ত সাহেব বাড়িতে রাখা বোতল থেকে আরো খানিকটা টেনে, টলতে টলতে তখনই ত শোবার  ঘরে ঢুকলেন কিনা! 

রবীন্দ্রনাথ, পোশাকভাবনা ও নারীর চিত্রায়ণ

যশোধরা রায়চৌধুরী

দেহের সমাজতত্ত্ব

The body: a surface on which events are inscribed …Genealogy, as an analysis of where things come from is thus situated at the point of articulation of the body and history. Its task is to show a body totally imprinted with history, and history destroying the body.’ –Michel Foucaoult

পাশ্চাত্যে সোশিওলজি অফ দ্য বডি নামে যে বিষয়টির আমদানি ঘটেছে, তা কিন্তু মার্ক্স থেকেই গতি পায়, কেননা তিনিই প্রথম লক্ষ্য করেন, শরীরও কী ভাবে হয়ে উঠেছে প্রাতিষ্ঠানিক এক ক্ষেত্র, যার ওপরে নানা উৎপাদন প্রক্রিয়া মনোনিবেশ করেছে, তাকে বার বার বদলে দিতে চেয়েছে। (  the body is not only the indirect and unintended result of social relations but the target object of a systematic processing)। এরপর আসরে অবতীর্ণ হন ফুকো সাহেব, তিনি বললেন, ক্ষমতার ক্ষেত্র এই শরীরও, এবং ক্ষমতাই তাকে সাজায়, তাকে পেশ করে সমাজে, বলে দেয়, কীভাবে দেখা হবে একটি শরীরকে, কীভাবে তা আলাদা করে নেওয়া হবে অন্য শরীরের থেকে। এই সোশিওলজি অফ বডি বিষয়টি অতঃপর ঢুকে পড়ল বিদ্দ্বজ্জনদের গন্ডীতে, বইয়ের পর বই লেখা হল তা নিয়ে, আর , অতি সম্প্রতি, এই বিষয় জন্ম দিয়েছে আর এক নতুন বিষয়ের, যার নাম, সোশিওলজি অফ কনজিউমারিজম!

অথবা গ্ল্যামার শব্দটিই ধরা যাক। ধরা যাক না ক্যারল ডাইহাউজের “গ্ল্যামার : নারী, ইতিহাস, নারীবাদ” বইটির কথাই । এখানে গ্ল্যামারের সংজ্ঞা দিচ্ছেন ডাইহাউজ। যে গ্ল্যামার, ১৯০০ সালের আগে ব্যবহারই হত না, হলেই খুব ঝাপসা এক অর্থে। গ্ল্যামার প্রথম যুগে এক যাদুক্ষমতার মত, পরবর্তীতে ভাষার প্রতি পরতে গ্ল্যামার শব্দের ক্রমবিস্তারে তার অবস্থান বিলাস, ব্যসনে, প্রাচ্য-রেশমের সূক্ষ্ম-দুর্লভতার একজটিক ( exotic) -এ, নাটকীয় আড়ম্বর ঐশ্বররযে।  আরো পরে, ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত স্বপ্নকল্পনার উপাদান। হলিউড সিনেমার দাক্ষিণ্যে রোজকার থোড়বড়িখাড়া জীবন থেকে পালানোর উপাদান সেই গ্ল্যামার। যা প্রতিটি মার্কিন রমণীকে উজ্জীবিত করত, তার নিরেশ, নীরস দৈনন্দিন জীবনের নিরিখে আনন্দ দিত যে গ্ল্যামারের খোঁজ। জনপ্রিয় ফ্যাশন ও রুচির ক্ষেত্রে সিনেমার প্রত্যক্ষ প্রভাবের ব্যাপারটা মুভি থেকে টকির যুগ অব্দি স্পষ্ট হয়ে উঠল।  আর, সবচেয়ে বড় যে তফাত ঘটে গেল, তা হল, উচ্চবিত্তের আঙিনা থেকে সফিস্টিকেশন, রূপচর্চা আর পোশাকসচেতনতা নেমে এল মধ্যবিত্তের অন্দরে। অর্থাৎ সাজগোজ-গ্ল্যামার-পোশাক চর্চার মধ্যবিত্তায়নই সিনেমার সবচেয়ে বড় অবদান পাশ্চাত্যে, বিশেষত মার্কিন সমাজে।

আমাদের এই ক্ষুদ্র কথাবন্ধপ্রচেষ্টা আসলে রবীন্দ্রনাথের রচনাগুলির নিরিখে বাঙালির ফ্যাশন সমীক্ষা। যার অন্তরঙ্গ ও ওতোপ্রোত অংশ হল  ভারতীয় মেয়েদের চিত্রায়ণ । 

ফ্রান্সের ফ্যাশন জগতের গুরু ঈভস স্যাঁ লোরঁ কিন্তু বিখ্যাত লস্ট টাইমস বা হারিয়ে যাওয়া সময় উপন্যাসের লেখক মার্সেল প্রুস্তের লেখার দ্বারা অনুপ্রাণিত। প্রুস্ত তাঁর লেখায় পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলে এনেছিলেন সমসাময়িক প্যারিসের সালোঁ কালচার বা বসবার ঘরের সংস্কৃতিকে। পুঁজিবাদী ও বুর্জোয়া সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ফ্যাশন কালচার। এবং সাহিত্য যা জীবনের সহিত বিচরণ করে, তা কিন্তু ছবি, গান, চলচ্চিত্র, এবং সমসাময়িক ফ্যাশন থেকে উপাদান সংগ্রহ করবেই। যে লেখক যত সময় সচেতন, যত বস্তুনিষ্ঠ, তাঁর লেখা চরিত্র চিত্রণের সময়ে পরিধেয়কে গুরুত্বই শুধু দেবে না, ফ্যাশন সম্পর্কিত যাবতীয় ভাবনাচিন্তা ও যুগের হাওয়াকে লিপিবদ্ধ করবে, যেভাবে সমসাময়িক রাজনীতি লিপিবদ্ধ হবে, অথবা সমাজবীক্ষণ! আরেক ফরাসি কবি তথা যুগন্ধর শার্ল ব্যোদলেয়ার উপার্জন করতেন ছবি ও ফ্যাশনের সমালোচনা লিখে। তাঁর “ইন প্রেইজ অফ কসমেটিক্স” নামে একটি লেখাই আছে, যেখানে তিনি বলেছিলেন, শরীর বিনা ফ্যাশন নেই। পরিধানের পরেই একমাত্র কোন পোশাককে বিচার করা সম্ভব। তার বাইরে তা মৃত চামড়ার মত প্রাণহীন, সৌন্দর্য হীন। 

অন্তত এভাবে দেখার একটা শুরুয়াত বলা যেতে পারে এ লেখাকে। কিছু কিছু পর্যবেক্ষণও বলা যেতে পারে। প্রবন্ধ বা নিবন্ধের গুরুত্ব আমি একে দিতে নারাজ, পন্ডিতেরা সেসব কাজ করবেন।  রবীন্দ্রবীক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ এই দেখা। নারীকে দেখার চোখটি তাঁর সূক্ষ্ম এবং অন্তর্ভেদী, একইসঙ্গে অব্জেক্টিভ এবং তত্ত্বগতভাবে নির্যাসিত। কোথাও কোন ভাসা ভাসা ছায়া ছায়া আদল নেই। প্রতি নারীচরিত্র স্পষ্ট ও সু-নির্মিত। 

আমার বীক্ষণের প্রিয় বিষয় তো নানা মাধ্যমে নারীর  বদলে যাওয়া চেহারাছবি, এই নিয়েই যদি কথা বলতে বসি, আর কথাটাকে আটকে রাখি রবীন্দ্র বিশ্লেষণের ভেতরে? সেখান থেকেই কি নির্মিত হয়ে ওঠেনা, বাঙালি ও ভারতীয় নারীর এক ছবিও?

আমাদের সব হওয়া, সব বদলই কোথাও একটা গিয়ে একসুতোয় গাঁথা হয়ে উঠছে ক্রমাগত। নারীবাদ, পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে সমঝোতা ঃ এ একটা দেখার দিক। বিষয় হিসেবেই  কিন্তু নারীকে দেখতে অভ্যস্ত আমরা।  জনপ্রিয় সাহিত্য শিল্পের কাছে সেটাই প্রশ্নচিহ্নহীন ধরে নেওয়া। উপভোক্তা নারী পুরুষ যে-ই হোন, তাঁকে আমোদ দেবে, বিনোদন দেবে নারীর এই বিষয়-মূর্তিই। এটাই পুরুষ শাসিত সমাজের সহজ ছক।  নারী পুরুষের মিউজ, তার প্রেরণা, তার আকাংক্ষার বিষয় , সম্ভোগের বস্তু, হাসিল করার পণ্য ।

ফ্যাশন ব্যাপারটাকেও আমরা দেখতে পারি মেল গেজ-ফিমেল গেজ-এর দ্বৈততার নিরিখে। যে নতুন নিরীক্ষা তুলে ধরেছিলেন সিনেমা চর্চার ক্ষেত্রে লরা মালভে, তাঁর ‘ভিজুয়াল অ্যান্ড আদার প্লেজারস ‘ প্রবন্ধে, ১৯৭৩ সালে।  যা থেকে উঠে এসেছিল নতুন এক তত্ত্ব ।  লাকাঁ ও ফ্রয়েডের ধারা থেকেই জন্ম নিয়েছিল জনপ্রিয় ছায়াছবির নারীবাদী বিশ্লেষণের নতুন ধারণাটি, ‘ মেল গেজ ‘ বা ব পুং দৃষ্টির তত্ব । সে তত্ত্বও বলছে একই কথা । মূলস্রোত ছায়াছবি , হলিউডের বিখ্যাত ছবিগুলিই ধরা যাক, নারীকে দেখায় বিষয় হিসেবে। দুভাবে বিষয় করা হয় নারীকে। হয় ভয়ারিস্টিক বিষয়। সে পুরুষচোখে নারী লালসাময় বেশ্যা । নতুবা ফেতিশিস্টিক বিষয় । সে পুরুষচোখে , পুরুষচাহনিতে নারী দেবী, ম্যাডোনা, মা।

জ্ঞানদানন্দিনী ও শাড়ি পরার ধরণ পাল্টানো ঠাকুরবাড়ি 

জ্ঞানদানন্দিনী রবীন্দ্রসহোদর সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী। এই নারী বিবাহকালে কলকাতায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে নিজেকে তিনি আবিষ্কার করলেন কঠোর পর্দার মাঝে। ১৮৬২ সালে সত্যেন্দ্রনাথ যখন তার প্রবেশনারি ট্রেনিং এর জন্য ইংল্যান্ডে যান তখন জ্ঞানদানন্দিনীকেও সাথে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু পিতা দেবেন্দ্রনাথ সেটি মানলেন না। পরে জ্ঞানদানন্দিনীর সেজোদেবর হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার লেখাপড়ার দায়িত্ব নিলেন। তিনি বিখ্যাত ব্রাহ্ম শিক্ষাবিদ আয়াধ্যনাথ পাকড়ারাশি কাছেও শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৮৬৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন প্রথম ভারতীয় সিভিল সার্ভিস সদস্য হিসেবে ইংল্যান্ড থেকে ফিরলেন তখন জ্ঞানদানন্দিনী তার স্বামীর সাথে বোম্বেতে গিয়ে বসবাস শুরু করলেন।

বোম্বেতে গিয়ে জ্ঞানদানন্দিনী ইউরোপীয়দের সামাজিক বলয়ের মধ্যে পড়ে গেলেন এবং ইংরেজি আদব-কায়দা রপ্ত করতে লাগলেন। সামাজিক অবস্থানের এই পরিবর্তনের কারণে তার জন্য সঠিক ভাবে কাপড় পড়ার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ বাঙ্গালি কায়দায় শাড়ি পরার তখনকার প্রচলিত রীতি যা ছিল তা অনেকটাই আড়ম্বরপূর্ণ ছিল। স্বামীর সাথে গুজরাটে এক সফরে গিয়ে পারসি নারীরা যে শৌখিন কায়দায় শাড়ি পরেন,সেভাবে নিজের মত করে শাড়ি পরার কায়দা শুরু করলেন ।  এক্ষেত্রে তিনি নিজস্ব একটি স্টাইল চালু করলেন। তিনিই  প্রথম বাম দিকে আঁচল / পাল্লু দিয়ে শাড়ি পড়ার ধরনটি চালু করেন। সেটা ছিল পারসি স্টাইলের বিপরীত। ডান হাত দিয়ে যেন নির্বিঘ্নে কাজ করা যায় সেই চিন্তা থেকেই বাম কাঁধে আঁচল ফেলার বিষয়টি তিনি শুরু করেন। তিনি এমনকি ‘বামাবোধিনি প্রত্রিকা’ নামে একটি ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপনও করেছেন তার মত করে শাড়ি পরার প্রশিক্ষণ দিতে। কলকাতায় তার অনুগত প্রথম দিককার ছাত্রীদের মধ্যে একজন বিহারী লাল গুপ্তা আইসিএস এর স্ত্রী সৌদামিনী গুপ্তা। কলকাতার ব্রাহ্ম নারীদের মধ্যে তা দ্রুত জনপ্রিয়তা পেতে থাকলো “ব্রাহ্মিকা শাড়ি” নামে। পরে এটি পরার ধরনে পরিবর্তিত হয়ে “বোম্বাই দস্তুর” এবং শেষে নাম হয় ঠাকুরবাডির শাড়ি। ১৮৬৬ সালে ভাইসরয় লর্ড লরেন্সের দেয়া ভোজসভায় স্বামীর সাথে যোগ দিয়ে কলকাতায় জ্ঞানদানন্দিনী উচ্চবর্ণের পরিবারের রীতিনীতি ভাঙলেন।বাঙালি সমাজে আরো  দুটি জিনিসের প্রবর্তন করেন তিনি। একটি, সান্ধ্যভ্রমণ ও অন্যটি পরিবারে জন্মদিন পালন।

পাথুরিয়াঘাটার প্রসন্নকুমার ঠাকুরের সঙ্গে এই বিষয়ে দ্বিমত ও ঠাকুরবাড়ির ভেতরে একটা আপাত বিপ্লব, এই ঘটনার জন্য জ্ঞানদানন্দিনীকে আমরা মনে রাখব। বাঙালি মেয়ের শাড়ি পরার রীতিনীতি পাল্টে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের এই বৌদিদি। যাঁর আশ্রয়ে বালক ও কিশোর রবীন্দ্রনাথের মন ও মনন পর্যাপ্তপরিমাণে পুষ্ট হয়েছিল। সুতরাঙ লেখক রবীন্দ্রনাথ যে মেয়েদের পোশাক পরার রীতিনীতি সম্পর্কে সম্যক অবহিত হবেন এতে সন্দেহ নেই।  চিত্রা দেব লিখেছিলেন, তাঁর ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল বইতে ঃ

‘বাইরে বেরোবার জন্য জ্ঞানদানন্দিনী বাঙালি মেয়েদের দিলেন একটি রুচিশোভন সাজ। অবশ্য দেশি ধাঁচে শাড়ি পরা যে খারাপ তা নয়, তবে তাতে সৌষ্ঠব ছিল না। বোম্বাইয়ে গিয়ে তিনি প্রথমেই জবরজং ওরিয়েন্টাল ড্রেস বর্জন করে পাড়শি মেয়েদের শাড়ি পরার মিষ্টি ছিমছাম ধরনটি গ্রহণ করেন। নিজের পছন্দমতো একটু অদল-বদল করে জ্ঞানদানন্দিনী এই পদ্ধতিকেই রাখলেন।

… বোম্বাই থেকে আনা বলে ঠাকুরবাড়িতে এই শাড়ি পরার ঢঙের নাম ছিল ‘বোম্বাই দপ্তর’। কিন্তু বাংলাদেশে তার নাম হলো ‘ঠাকুরবাড়ির শাড়ি’। জ্ঞানদানন্দিনী বোম্বাই থেকে ফিরে এ ধরনের শাড়ি পরা শেখানোর জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। অনেক সম্ভ্রান্ত ব্রাক্ষ্মিকা এসেছিলেন শাড়ি পরা শিখতে; সবার আগে এসেছিলেন বিহারী গুপ্তের স্ত্রী সৌদামিনী। অবশ্য তখনও তার বিয়ে হয়নি। শাড়ির সঙ্গে জ্ঞানদানন্দিনী শায়া-সেমিজ-ব্লাউজ-জ্যাকেট পরারও প্রচলন করেন।

…‘বোম্বাই দপ্তর’র যেসব অসুবিধে ছিল সেগুলো দূর করবার চেষ্টা করেন কুচবিহারের মহারানী কেশব-কন্যা সুনীতি দেবী। তিনি শাড়ির ঝোলানো অংশটি কুঁচিয়ে ব্রোচ দিয়ে আটকাবার ব্যবস্থা করেন। তার সঙ্গে তিনি মাথায় পরতেন স্প্যানিশ ম্যানটিলা জাতীয় একটি ছোট্ট ত্রিকোণ চাদর। তার বোন ময়ূরভঞ্জের মহারানী সুচারু দেবী দিল্লীর দরবারে প্রায় আধুনিক শাড়ি পরার ঢংটি নিয়ে আসেন। এটিই নাকি তার শ্বশুরবাড়ির শাড়ি পরার সাবেক ঢং। বাস্তবিকই উত্তর ভারতের মেয়েরা, হিন্দুস্থানী মেয়েরা এখনও যেভাবে সামনে আঁচল এনে সুন্দর করে শাড়ি পরে, তাতে ওই ধরনটিকেই বেশি প্রাচীন মনে হয়। বাঙালি মেয়েরা অধিক স্বাচ্ছন্দ্যগুণে এটিকেই গ্রহণ করলেন, তবে জ্ঞানদানন্দিনীর আঁচল বদলাবার কথাটি তারা ভোলেননি, তাই এখন আঁচল বাঁ দিকেই রইলো। কিছুদিন মেমেদের হবল্ স্কার্টের অনুকরণে হবল্‌ করে শাড়ি পরাও শুরু হয়; তবে অত আঁটসাঁট ভাব সকলের ভালো লাগেনি। শাড়ির সঙ্গে সঙ্গে উঠল নানান ফ্যাশনের লেস দেয়া জ্যাকেট ব্লাউজ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘বিলিতি দরজির দোকান থেকে যত ছাঁটাকাঁটা নানা রঙের রেশমের ফালি’র সঙ্গে নেটের টুকরো আর খেলো লেস মিলিয়ে মেয়েদের জামা বানানো হতো।’[ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব, পৃষ্ঠা নং ১৯-২০]।

আবার মল্লারিকা সিংহ রায় বলেছেন, 

‘পোশাকের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা পড়াশোনা করেন, তাঁরা বলেন যে ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কোম্পানির সাহেব কর্মচারীরা ‘শাড়ি’ নামের পোশাকটি ভারতীয় নারীদের বৈশিষ্ট্য বোঝাতে নির্বিচারে ব্যবহার করতে শুরু করেন অষ্টাদশ শতক থেকে। কোম্পানি আমলের ছবিতেও ক্রমশ সাধারণ পরিধেয় আর বিশেষ উপলক্ষের পোশাকের ব্যবধান ঘুচে যেতে থাকে। অনেক সময়ে জাতি, শ্রেণি, ধর্ম ইত্যাদির বৈশিষ্ট্য বোঝাতে পুরুষ-নারীর জুটির ছবি আঁকা হত নৃতাত্ত্বিক নমুনা হিসেবে। এই ছবিগুলি প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে ভারতীয়দের পোশাক দিয়ে কেমন করে চিনে নিতে হবে, তার নথি তৈরি করা শুরু হল। ভারতের মানুষ যেন একটিমাত্র কালখণ্ডের মধ্যে তার পোশাকের দ্বারা চিহ্নিত হয়ে গেল, যার আর লয়-ক্ষয় নেই। এরই মধ্যে নারীদেহের আব্রু রক্ষার ব্যাপারে খ্রিস্টান পাদরিরাও নিজেদের প্রভাব খাটাতে শুরু করলেন। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ভিক্টোরীয় মানসিকতার প্রবেশ শুরু হল।…বিশ শতকের শুরুতে স্বদেশি আন্দোলনে, এবং তার অব্যবহিত পরে মোহনদাস গান্ধীর রাজনৈতিক বয়ানে পোশাক হয়ে উঠল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অন্যতম ক্ষেত্র। যে নারীরা আন্দোলনে যোগ দিয়ে পথে বেরিয়ে এলেন, তাঁরাও ক্রমেই এক বিশেষ ভঙ্গিতে কাঁধে আঁচল দিয়ে শাড়ি পরে তাকে করে তুললেন জাতীয়তাবাদীর পোশাক। এই ভাবে শাড়ি পরা প্রথম শুরু করেছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, ১৮৭০-এর দশকে, পার্সি ধরনে শাড়ি পরায় সামান্য কিছু অদল-বদল করে।’

রবীন্দ্রসাহিত্যের পোশাকবিপ্লব

প্রাচীনা মেয়েদের ছবি আঁকতে দেশজ,  ঘরোয়া ভংগিতে শাড়ি পরার মেইনস্ট্রিম  ছবিই প্রথমত ফুটেছে রবি কলমে। 

ধলেশ্বরীনদীতীরে পিসিদের গ্রাম।/ তাঁর দেওরের মেয়ে,

অভাগার সাথে তার বিবাহের ছিল ঠিকঠাক।/ লগ্ন শুভ, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেল–/

সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে।

/মেয়েটা তো রক্ষে পেল/ আমি তথৈবচ/ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসাযাওয়া–/ পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর। ( বাঁশি কবিতা, পুনশ্চ)

অথবা, 

রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,

/ ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন।/  আগে ওকে বারবার দেখেছি/

 লালরঙের শাড়িতে/

দালিম ফুলের মতো রাঙা;/

আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,/ আঁচল তুলেছে মাথায়;;

 দোলনচাঁপার মতো চিকনগৌর মুখখানি ঘিরে।/  মনে হল, কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব/

ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে,/ যে দূরত্ব সর্ষেখেতের শেষ সীমানায়/ শালবনের নীলাঞ্জনে।/থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা / চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে( হঠাৎ দেখা, শ্যামলী)

রবীন্দ্রনাথ নিজে পোশাক পরিচ্ছদ সম্পর্কে স্পষ্ট ও ক্ষুরধার মতামত রেখেছেন। তা পুরুষ হোক বা নারীর।  সমাজ নামের প্রবন্ধাবলীতে তিনি কোট ও চাপকান প্রবন্ধে  কাজের পোশাক হিসেবে বাঙালি পুরুষদের ইংরেজি পোশাককে গ্রহণ করা সম্পর্কে খুব তির্যক ও ব্যঙ্গাত্মক ভংগিতে লেখেন, 

“ইংরেজি কাপড়ের একটা মস্ত অসুবিধা এই যে, তাহার ফ্যাশনের উৎস ইংলণ্ডে। সেখানে কী কারণবশত কিরূপ পরিবর্তন চলিতেছে আমরা তাহা জানি না, তাহার সহিত আমাদের কোনো প্রত্যক্ষ সংস্রবমাত্র নাই। আমাদিগকে চেষ্টা করিয়া খবর লইতে এবং সাবধানে অনুকরণ করিতে হয়। যাঁহারা নূতন বিলাত হইতে আসেন তাঁহারা সাবেক দলের কলার এবং প্যান্টলুনের ছাঁট দেখিয়া মনে মনে হাস্য করেন, এবং সাবেকদলেরা নব্যদলের সাজসজ্জার নব্যতা দেখিয়া তাঁহাদিগকে “ফ্যাশানেব্‌ল” বলিয়া হাস্য করিতে ত্রুটি করেন না।

একে বিলাতি সাজ স্বভাবতই বাঙালিদেহে অসংগত, তাহার উপরে যদি তাহাতে ভদ্রোচিত পারিপাট্য না থাকে, তবে তাহাতে হাসিও আসে অবজ্ঞাও আনে। এ কথা সহজেই মুখে আসে যে, যদি পরিতে না জান এবং শক্তি না থাকে, তবে পরের কাপড়ে সাজিয়া বেড়াইবার দরকার কী ছিল।’

এই প্রবন্ধে তিনি চাপকান ও কোট পরিহিত বাঙালি পুরুষের পাশে শাড়ি পরিহিতা স্ত্রীদের বেমানান বলে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ,  পুরুষটির পাশ্চাত্য পোশাক ধারণ আর নারীর সাবেক পোশাকে থেকে যাওয়াকে তাঁর কাছে এক ধরণের গুরুচন্ডালী দোষে দোষাবহ বলেই মনে হয়েছিল।

তাই কি, তিনি অতি সযত্নে শেষের কবিতার অমিত রে চরিত্রটিকে নির্মাণ করেন? নিজের প্রোটাগনিস্ট হিসেবে?

“অমিতর নেশাই হল স্টাইলে। কেবল সাহিত্য-বাছাই কাজে নয়, বেশে ভূষায় ব্যবহারে। ওর চেহারাতেই একটা বিশেষ ছাঁদ আছে। পাঁচজনের মধ্যে ও যে-কোনো একজন মাত্র নয়, ও হল একেবারে পঞ্চম। অন্যকে বাদ দিয়ে চোখে পড়ে। দাড়িগোঁফ-কামানো চাঁচা মাজা চিকন শ্যামবর্ণ পরিপুষ্ট মুখ, স্ফূর্তিভরা ভাবটা, চোখ চঞ্চল, হাসি চঞ্চল, নড়াচড়া চলাফেরা চঞ্চল, কথার জবাব দিতে একটুও দেরি হয় না; মনটা এমন এক রকমের চকমকি যে, ঠুন করে একটু ঠুকলেই স্ফুলিঙ্গ ছিটকে পড়ে। দেশী কাপড় প্রায়ই পরে, কেননা ওর দলের লোক সেটা পরে না। ধুতি সাদা থানের যত্নে কোঁচানো, কেননা ওর বয়সে এরকম ধুতি চলতি নয়। পাঞ্জাবি পরে, তার বাঁ কাঁধ থেকে বোতাম ডান দিকের কোমর অবধি, আস্তিনের সামনের দিকটা কনুই পর্যন্ত দু-ভাগ করা; কোমরে ধুতিটাকে ঘিরে একটা জরি-দেওয়া চওড়া খয়েরি রঙের ফিতে, তারই বাঁ দিকে ঝুলছে বৃন্দাবনী ছিটের এক ছোটো থলি, তার মধ্যে ওর ট্যাঁকঘড়ি; পায়ে সাদা চামড়ার উপর লাল চামড়ার কাজ-করা কটকি জুতো। বাইরে যখন যায় একটা পাট-করা পাড়ওয়ালা মাদ্রাজি চাদর বাঁ কাঁধ থেকে হাঁটু অবধি ঝুলতে থাকে; বন্ধুমহলে যখন নিমন্ত্রণ থাকে মাথায় চড়ায় এক মুসলমানি লক্ষ্মৌ টুপি, সাদার উপর সাদা কাজ-করা। একে ঠিক সাজ বলব না, এ হচ্ছে ওর এক রকমের উচ্চ হাসি। ওর বিলিতি সাজের মর্ম আমি বুঝি নে, যারা বোঝে তারা বলে– কিছু আলুথালু গোছের বটে, কিন্তু ইংরেজিতে যাকে বলে ডিস্‌টিঙ্গুইশ্‌ড্‌। নিজেকে অপরূপ করবার শখ ওর নেই, কিন্তু ফ্যাশানকে বিদ্রূপ করবার কৌতুক ওর অপর্যাপ্ত। কোনোমতে বয়স মিলিয়ে যারা কুষ্ঠির প্রমাণে যুবক তাদের দর্শন মেলে পথে ঘাটে; অমিতর দুর্লভ যুবকত্ব নির্জলা যৌবনের জোরেই, একেবারে বেহিসেবি, উড়নচণ্ডী, বান ডেকে ছুটে চলেছে বাইরের দিকে, সমস্ত নিয়ে চলেছে ভাসিয়ে, হাতে কিছুই রাখে না।“

রবি ঠাকুরের “শেষের কবিতা” বোধ হয় উপন্যাসে বাংলার ইঙ্গবঙ্গ সমাজের সাজপোশাকের ডিটেলিং-এর এক দিকদর্শন। এভাবে সূক্ষ্ম বর্ণনার ভেতর দিয়ে তুলে আনায় প্রমাণ পায়, সাজ ব্যাপারটা মেয়েদের একচেটিয়া ব্যাপার নয়, এর “ইউনিসেক্স” চরিত্রটা বেশ ফুটে ওঠে। তবে, অমিত চিরকালই একটি ব্যতিক্রম। তবে এর পরই মেয়েদের ফ্যাশনদুরস্ততার বর্ণনা এসে পড়বে, যা আমাদের এই লেখার পক্ষে এক অতি উপাদেয় উপাদান…

“এ দিকে ওর দুই বোন, যাদের ডাকনাম সিসি এবং লিসি, যেন নতুন বাজারে অত্যন্ত হালের আমদানি– ফ্যাশানের পসরায় আপাদমস্তক যত্নে মোড়ক-করা পয়লা নম্বরের প্যাকেট-বিশেষ। উঁচু খুরওয়ালা জুতো, লেসওয়ালা বুক-কাটা জ্যাকেটের ফাঁকে প্রবালে অ্যাম্বারে মেশানো মালা, শাড়িটা গায়ে তির্যগ্‌ভঙ্গিতে আঁট করে ল্যাপ্‌টানো। এরা খুট খুট করে দ্রুত লয়ে চলে; উচ্চৈঃস্বরে বলে; স্তরে স্তরে তোলে সূক্ষ্মাগ্র হাসি; মুখ ঈষৎ বেঁকিয়ে স্মিতহাস্যে উঁচু কটাক্ষে চায়, জানে কাকে বলে ভাবগর্ভ চাউনি; গোলাপি রেশমের পাখা ক্ষণে ক্ষণে গালের কাছে ফুর ফুর করে সঞ্চালন করে, এবং পুরুষবন্ধুর চৌকির হাতার উপরে বসে সেই পাখার আঘাতে তাদের কৃত্রিম স্পর্ধার প্রতি কৃত্রিম তর্জন প্রকাশ করে থাকে।“

এর পরই পাঠক হিসেবে আমাদের তৃষিত অপেক্ষা হবে লাবণ্যের আবির্ভাবের জন্য। সেটা এইরকম…

“একটি মেয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। সদ্য-মৃত্যু-আশঙ্কার কালো পটখানা তার পিছনে, তারই উপরে সে যেন ফুটে উঠল একটি বিদ্যুৎরেখায় আঁকা সুস্পষ্ট ছবি– চারি দিকের সমস্ত হতে স্বতন্ত্র। মন্দরপর্বতের নাড়া-খাওয়া ফেনিয়ে-ওঠা সমুদ্র থেকে এইমাত্র উঠে এলেন লক্ষ্মী, সমস্ত আন্দোলনের উপরে– মহাসাগরের বুক তখনো ফুলে ফুলে কেঁপে উঠছে। দুর্লভ অবসরে অমিত তাকে দেখলে। ড্রয়িংরুমে এ মেয়ে অন্য পাঁচজনের মাঝখানে পরিপূর্ণ আত্মস্বরূপে দেখা দিত না। পৃথিবীতে হয়তো দেখবার যোগ্য লোক পাওয়া যায়, তাকে দেখবার যোগ্য জায়গাটি পাওয়া যায় না। …মেয়েটির পরনে সরু-পাড়-দেওয়া সাদা আলোয়ানের শাড়ি, সেই আলোয়ানেরই জ্যাকেট, পায়ে সাদা চামড়ার দিশি ছাঁদের জুতো। তনু দীর্ঘ দেহটি, বর্ণ চিকন শ্যাম, টানা চোখ ঘন পক্ষ্মচ্ছায়ায় নিবিড় স্নিগ্ধ, প্রশস্ত ললাট অবারিত করে পিছু হটিয়ে চুল আঁট করে বাঁধা, চিবুক ঘিরে সুকুমার মুখের ডৌলটি একটি অনতিপক্ক ফলের মতো রমণীয়। জ্যাকেটের হাত কব্‌জি পর্যন্ত, দু-হাতে দুটি সরু প্লেন বালা। ব্রোচের-বন্ধনহীন কাঁধের কাপড় মাথায় উঠেছে, কটকি কাজ-করা রুপোর কাঁটা দিয়ে খোঁপার সঙ্গে বদ্ধ।“

এই যে সাজ, যা বিংশ শতকের প্রথমার্ধ পররযন্ত উচ্চবিত্ত ইংরিজি শিক্ষিত মেয়েদের, তিররযকভাবে যাকে বলা চলে ব্রাহ্ম সাজ, সেই ফ্যাশনদুরস্ততার  পরিশীলিত বয়ান, যতটাই ইংরেজ শাসনের সঙ্গে সিংক্রনিক, ততটাই বসবার ঘর, বাইরের ঘর, বৈঠকখানার কালচারে চোবানো। একেই বোধ হয় বলে স্যালঁ (salon) কালচার!

যে মেয়েরা হিন্দু অন্তঃপুরে, সেই একই সময়ে , তাঁদের সাজও হয়ত বা উঠে এসেছে শরৎসাহিত্যে অথবা তরুণতর উপন্যাসসাহিত্যের বিবরণে। কিন্তু এত স্পষ্ট ও সচেতনভাবে এসেছে কি? তবে একথা বলাই যায় যে বঙ্গ বধূদের ঘরোয়া সাজের ভেতরে সেলাই করা ব্লাউজ ( সে যুগের ভাষায় যা জ্যাকেট) সেভাবে কিন্তু ছিল না বললেই চলে। শেমিজ হয়ত বা এসে উঠেছে ।  ফ্রিল দেওয়া হাতার যে কদর্য ক্যারিকেচারটি আমাদের আজকের সময়ে বাঙালি অন্তঃপুরিকামাত্রের অঙ্গে যে কোন নাটক বা সিরিয়ালে দেখি, অন্তত ততটা অনান্দনিক ছিল না সেই খালি গায়ে জড়ানো দিশিমতে পরা শাড়ি বা থানের বিশুদ্ধতা।

হিন্দু অন্তঃপুরের ভেতরে রাবীন্দ্রিক বিবরণের ঐ জ্যাকেট – সিল্ক শাড়ির সাজ যে কতটা বেমানান ও আরোপিত ছিল, স্বয়ং রবি ঠাকুরই তা স্পষ্ট করেননি?  ‘ঘরে বাইরে’তে, যখন এই ফ্যাশন গায়ের জোরে আমদানি হয় নিখিলেশের দ্বারা, বিমলের ওপরে? যে হালফ্যাশয়ানের প্রতি অগাধ সন্দেহ নিখিলেশের প্রাচীনপন্থী বিধবা বউদির। …বিমলের কন্ঠস্বরে তা অনেকটা এইরকম…”এখনকার কালের বিবিয়ানার নির্লজ্জতা! আমার স্বামী আমাকে হাল-ফেশানের সাজে-সজ্জায় সাজিয়েছেন– সেই সমস্ত রঙবেরঙের জ্যাকেট-শাড়ি-শেমিজ-পেটিকোটের আয়োজন দেখে তাঁরা জ্বলতে থাকতেন। রূপ নেই, রূপের ঠাট! দেহটাকে যে একেবারে দোকান করে সাজিয়ে তুললে গো…” সেই বিমলকেই যখন সন্দীপবাবুর সামনে যাবার জন্য সাজতে দেখা যায় তখন তা এইরকমঃ সেদিন সকালে মাথা ঘষে আমার সুদীর্ঘ এলোচুল একটি লাল রেশমের ফিতে দিয়ে নিপুণ করে জড়িয়েছিলুম। দুপুরবেলায় খাবার নিমন্ত্রণ, তাই ভিজে চুল তখন খোঁপা করে বাঁধবার সময় ছিল ন। গায়ে ছিল জরির পাড়ের একটি সাদা মাদ্রাজী শাড়ি, আর জরির একটুখানি পাড়-দেওয়া হাত-কাটা জ্যাকেট।    আমি ঠিক করেছিলুম এ খুব সংযত সাজ, এর চেয়ে সাদাসিধা আর-কিছু হতে পারে না। এমন সময় আমার মেজো জা এসে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। তার পরে ঠোঁটদুটো খুব টিপে একটু হাসলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, দিদি, তুমি হাসলে যে? তিনি বললেন, তোর সাজ দেখছি।“

পঞ্চাশ ষাটের দশকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বহু লেখায় মেয়েদের সাজপোষাকের বর্ননা পাই। রবি ঠাকুরের মত পুংক্ষাণূপুংক্ষ না হলেও, তাতে স্পষ্ট লেখা থাকে একটা দ্বৈততার কথা, সিসি লিসি বনাম লাবণ্যে যে লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে। একদিকে আছে অতি চর্চিত, মহার্ঘ, অতি সচেতন সাজগোজের উগ্রতা ( পড়ুন = চরিত্রের উগ্রতা), যা নায়িকা নয়, প্রতিনায়িকা অথবা সরাসরি ভ্যাম্পের রোলে ঠেলে দেয় নারীচরিত্রগুলোকে, অন্য দিকে অসচেতন, ঢলোঢলো কাঁচা সৌন্দর্য, যা আত্মার বিশুদ্ধতাকে দেহসৌষ্ঠব ফুঁড়ে নায়কের চোখের সামনে হাজির করছে। নায়িকারা সর্বদাই কিছুটা সাজগোজে অন্যমনস্ক হবেন, এ যেন তারপর থেকে দাঁড়িয়ে গেল বাংলা আইডিওলজির সঙ্গে সমান্তরালে, সাহিত্য শিল্পেও।

দেখা যাক, সুনীলের প্রতিদ্বন্দ্বী-তে কীভাবে এসেছে এই সংজ্ঞায়ন।

“মেয়েদুটির নাম মালবিকা আর কেয়া। মালবিকা তার পায়ের জুতো, শাড়ির রং, আংটির পাথর, হাতব্যাগ, টিপ সব মিলিয়ে পরেছে। চুল বাঁধার ধরন দেখলেই বোঝা যায়, সে এক-একদিন এক-এক রকমভাবে চুল বাঁধে। নিজের রূপ সম্পর্কে মেয়েটি সজাগ। মুখে সেই হালকা অহংকারের ছায়া পড়েছে। কেয়া মেয়েটি খানিকটা এলোমেলো স্বভাবের, পোশাকের পারিপাট্য নেই, কিন্তু মুখখানি তার ভারী সুন্দর – বড় বড় চোখদুটিতে সরল সৌন্দর্য। “

এই বর্ণনা থেকে লেখকের বা তার নির্মিত নায়কের পক্ষপাত স্পষ্ট, বাংলায় এই পক্ষপাত কিন্তু চলবে, একেবারে কালবেলা-র মাধবীলতা পর্যন্ত।  বলা ভাল সমরেশ মজুমদারে এসে বাঙালি মেয়ের এই ইমেজ কালমিনেশনে পৌঁছবে। “মাধবীলতাকে সে চেনে না… শুধু এটুকুই মনে হয়েছে মেয়েটি নরম এবং বোকা নয়। …মাধবীলতার নিজস্ব চিন্তাভাবনা আছে, এবং সেটাকে গুছিয়ে স্পষ্ট ভাষায় বলার ক্ষমতা রাখে। এরক সতেজ ডাঁটো আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে কোনও মেয়েকে অনিমেষ দেখেনি। কলকাতায় এসে নীলার সঙ্গে আলাপ হয়েছি। নীলা অবশ্যই খুব ডেসপারেট মেয়ে, কোনও রকম ভিজে ব্যাপার ওর নেই। কিন্তু নীলা কখনওই আকর্ষণ করে না, বুকের মধ্যে এমন করে কাঁপন আনে না। যে কোনও পুরুষবন্ধুর মতো নীলার সঙ্গে সময় কাটানো যায় …নীলার মানসিকতা বদ্ধ, মাধবীলতার মতো এমন দ্যুতি ছড়ায় না। “

রাবীন্দ্রিক লাবণ্যর থেকে আলাদা হয়েও আসলে কোথাও এক থেকে গেছে মাধবীলতা। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নারীচরিত্র, বহু কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ের মত আমারও কমবয়সের ফ্যান্টাসির উপাদান সে। সবচেয়ে বড় কথা , সে মেয়ে মেয়ে, সে নারী, অথচ নারীর যে অবয়বটি আরোপিত সেই তথাকথিত “ফ্যাশন”-সর্বস্ব নয়, আবার নীলার মত “পুরুষালি”-ও হলে তাকে চলবে না।

এখানেও বহাল রয়েছে পুরুষের দৃষ্টিকোণ, অবশ্যই। নির্মাণ যে করছেন একজনে পুরুষই!

রবীন্দ্রউত্তরাধিকারী ঋতুপর্ণ ঘোষ

এর বহু পরে, ২০০০ সালের আশেপাশে আমরা পেয়েছি ঋতুপর্ণ ঘোষ নামের এক বিজ্ঞাপন নির্মাতা ও চিত্র পরিচালককে, বাংলা ও বাঙালির উত্তর গোলোকায়ন নন্দন তত্ত্বের ক্ষেত্রে যাঁর ভাবনাগুলি অপ্রতিরোধ্য। ঋতুপর্ণের বিশেষ প্রবণতা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এবং অন্য প্রবণতা, পোশাক পরিচ্ছদের ডিজাইনিং, নানা ধরণের ফেব্রিকের বাছাই বিষয়ে বিশেষ অনুধ্যান ও আগ্রহ। নিজের পোশাক সচেতনতার “অ্যান্ড্রোজেনাস” চরিত্র সম্পর্কে তিনি ছিলেন মুক্তকন্ঠ যেমন, তেমনই এই রাবীন্দ্রিক পোশাকসচেতনতার একটি দিক তাঁর লেখা থেকে , আলোচনা থেকে বার বার উঠে এসেছে। 

একদা একটি টিভি চ্যানেলে ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ নামে একটি টক্ শো সম্প্রচারিত হত। সেই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ব‍্যক্তিরা অতিথি হয়ে সেখানে আসতেন। অপর্ণা সেন, সুধীর চক্রবর্তী, জয় গোস্বামী, কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য, চন্দ্রিল ভট্টাচার্য ও আরো অনেকের মতো একটি এপিসোডে অতিথি হয়ে এলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।

এই ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসাহিত‍্য-নির্ভর-ছবি সম্পর্কে ঋতুপর্ণ ঘোষের অবজারভেশানগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো সাজালে মোটামুটি এরকম দাঁড়ায়— ক. চলচ্চিত্রকারদের কাছে রবীন্দ্রনাথ আখ‍্যানে আটকে আছেন। তাঁর মতে, রবীন্দ্রনাথের গল্প-আশ্রিত ছবি যেগুলো আমরা দেখি সেগুলির মধ্যে কোনোটাই তাঁর খুব রাবীন্দ্রিক লাগে না। ‘চারুলতা’ ছবিটা তাঁর খুব প্রিয় কিন্তু ছবিটাকে তিনি রাবীন্দ্রিক বলে মনে করেন না। ‘নষ্টনীড়’ আর ‘চারুলতা’ আলাদা ভাবে তাঁর খুব ভালো লাগে কিন্তু ‘চারুলতা’কে রবীন্দ্রগল্পের চিত্রায়ণ হিসেবে ততটা ভালো লাগে না। ‘তিনকন‍্যা’ দেখে তাঁর মনে হয় ‘পোস্টমাস্টার’ খুব সহজেই বিভূতিভূষণের ছোটোগল্প হতে পারে, ‘মনিহারা’ ত্রৈলোক‍্যনাথের একটা গল্প আর ‘সমাপ্তি’ প্রভাতকুমারের। নিজের বানানো ‘নৌকাডুবি’ যে-কোনো সময় শরৎচন্দ্রের গল্প হতে পারে! খ. তিনি রবীন্দ্রনাথকে সিনেমায় খুঁজে পান কুরোসাওয়ারর ‘র‍্যান’ দেখে। অন্ধ তোসুরুমারু একাকী হেঁটে যাচ্ছে ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্গের ল‍্যান্ডস্কেপের উপরে দিয়ে, ঠিক খাদের ধারে এসে তার হাত থেকে পড়ে যায় একটি থানকা। আমরা, দর্শকরা, দেখি থানকায় আমিদা বুদ্ধের ছবি আঁকা যেটি তার দিদি সু তাকে দিয়ে অপেক্ষায় থাকতে বলেছিল। দর্শক একটু আগেই জেনে গেছে তার দিদি সু আর ফিরবে না। ক‍্যামেরা দূর থেকে দেখতে থাকে, ছবি শেষ হয়। এই দৃশ্যকল্পনাটাই তাঁর মনে হয় রাবীন্দ্রিক। গ. পিটার ব্রুকের ‘মহাভারত’-এ যখন গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যাচ্ছে প্রথম সাক্ষাতের জন্য তখন ‘ধীরে বন্ধু ধীরে ধীরে’ গানের ব‍্যবহারটাই তাঁর কাছে রাবীন্দ্রিক মনে হয়। এই গান হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ‘ফাল্গুনি’ নাটকে অন্ধ বাউলের গান। এই বাউল জন্মান্ধ ছিল না। সে যখন অন্ধ হলো তখন ‘অন্ধকারের বুকের মধ্যে আলো’ দেখতে পেতো, অন্ধকারকে তার আর ভয় লাগতো না। সে গান গাইতে গাইতে যায় আর বলে ‘আমার গান আমাকে ছাড়িয়ে যায়— সে এগিয়ে চলে, আমি পিছনে চলি’। ঘ. তিনি মনে করেন তাঁদের মতো যাঁরা রিয়েলিস্টিক সিনেমা বানান তাঁদের পক্ষে রবীন্দ্রনাথের সাবলাইমটা টাচ্ করা মুশকিল।

ঋতুপর্ণ ঘোষ রবীন্দ্র জন্ম সার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তৈরি করেন এক ডকুড্রামা। সেই চলচ্চিত্রটির গোটাটা জুড়ে, এবং তাঁর রবীন্দ্র আখ্যান নির্ভর চোখের বালি জুড়েও, তিনি রবীন্দ্র যুগের পোশাক পরিচ্ছদের যে চিত্রায়ণ করেছিলেন তা ছিল অনবদ্যভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ ডিটেলে সাজানো। খদ্দরের, রেশমের, হাতে বোনা / তাঁতের কাপড়ের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে অতি মাত্রায় সচেতন ঋতুপর্ণ আমাদের দেখিয়েছিলেন, রাবীন্দ্রিক সাবলাইম শুধু তত্ত্বের বিষয় নয়। তার নন্দনতত্ত্বের মধ্যে পোশাক কোন হেলাফেলার বিষয় নয়। বরং গভীর জানা, শোনা, অনুধ্যানের বিষয়। 

তথ্যসূত্র :

ইন্দ্রনীল মণ্ডল, আমার রবীন্দ্রনাথ: ‘ঘরে বাইরে’ প্রসঙ্গে ঋতুপর্ণ ঘোষ, গুরুচন্ডালী

উইকিপিডিয়া

মল্লারিকা সিং হ রায়, দেহের সীমানা ঠিক করবে কে, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১১ এপ্রিল ২০২২, 

চিত্রা দেব, ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল

পাপড়ি রহমান,  রাইজিং বি ডি পত্রিকা

Madison Mainwaring, Fashion Regained, Paris Review

সবিতাভাবি ও নারীর যৌনতার ব্যবহার্যতা

সবিতা ভাবি একটি উত্তরভারতীয় পর্ণ চরিত্র। চরিত্রটির বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছিল কার্টুনচিত্রের মাধ্যমে। শ্যামা স্থূলাঙ্গী, পীনপয়োধরা, বিবাহিতা ভাবি রূপে তাকে পাওয়া গিয়েছিল। আর সঙ্গে সঙ্গে গৃহীত হয়েছিল সে জনমানসে। পড়ুন পুরুষমানসে। বিবাহিত স্ত্রীলোক, কিন্তু স্বামীর দ্বারা উপেক্ষিতা। বা স্বামী কাজে ব্যস্ত, অন্যমনস্ক, কিম্পুরুষ, উদাসীন যা খুশি। এক্ষেত্রে অশোক নামের এই স্বামীটি উহ্য। সবিতাভাবি সচরাচর তরুণতর দেবরদের সঙ্গে যৌন খেলায় অংশ নেন। তিনি নিম্ফোম্যানিয়াক , পুরুষ পেলেই মাথা চিবিয়ে খান ইত্যাদি ইত্যাদি। 

এই কার্টুন নিয়ে বেশ হৈ চৈ হয়। ২০১০ থেকে কিছুদিন এইসব চলে। তারপর নানা আপত্তিতে বন্ধ হয়ে যায়। এই বে-আইনি ঘোষণা বা ব্যান নিয়ে নানা রকম আলোচনা উঠে আসে জনমানসে। এ বিষয়ে উল্লেখ্য এই , যে, যে কোন রকম পর্নোগ্রাফিই নিষিদ্ধ ভারতে, কাজেই এ নতুন কিছু নয়। তবে ইন্টারনেট মাধ্যমে নিষেধকে বলবৎ করা খুব কঠিন নিঃসন্দেহে। 

  আসল ওয়েবসাইটটি ভারত সরকার অশ্লীলতা বিরোধী আইনে সেন্সর করেছিল। বিশিষ্ট ভারতীয় লিবার্টিয়ান ব্লগার এবং সাংবাদিক অমিত ভার্মার  সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিল এই নিষেধাজ্ঞা। মূলধারার মিডিয়া কলামিস্টরা “নেট ন্যানি” সরকারের “মধ্যস্থতাকারী, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা” র পরিচায়ক এই নিষেধাজ্ঞার সমালোচনায় নেমেছিলেন। সবিতাভাবির  চরিত্রটি ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে একটি অনলাইন আন্দোলন হয়েছিল। 

  ২০১৩ সালে সবিতা ভাবিকে মুখ্য চরিত্র করে সিনেমাও করেন পুনীত আগরওয়াল, ব্রিটেনের বাসিন্দা ।  উদারবাদী, ভোগবাদী,  মার্কিন সংস্কৃতির অনুসারীদের অসভ্যতা বলে বেশ কিছু দক্ষিণপন্থী, রক্ষণশীল প্রাচীন পন্থীর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সে বিষয়েও। এই সমস্ত কথাই তুলে আনে সবিতা ভাবির অপ্রতিরোধ্যতা। বাধা দিলে বেড়ে বেড়ে যায় যে জনপ্রিয়তা।  

সমাজ বিজ্ঞানীরা আজকাল যে কোন জনপ্রিয় মাধ্যমের মধ্যেই খোঁজেন বিষয়। তাই, আজ সবিতাভাবিও আলোচনার অধ্যয়নের বিষয়। কেন সবিতাভাবিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে? বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এর তিনটে কারণ। এক, ভারতীয় নারীদের ওপর যুগ যুগ ধরে চেপে বসে আছে সুখ সম্বন্ধে একটি অপরাধবোধের অনুভব। নারী আর যাই করুক, যৌন সুখ সে নিতে পারেনা, নিজের ইচ্ছা কামনা বাসনা চরিতার্থ করলেই সে হয়ে যায় নষ্টা স্ত্রীলোক। তার আদর্শ হল সীতামাঈ-এর মত দুঃখ পাওয়া। তার আদর্শ হল অন্যদের সেবা করে করে শরীর পাত করা। কিন্তু নিজের জন্য শরীরী সুখের বন্দোবস্ত কোনভাবেই সে করবে না। সবিতাভাবি এই স্টিরিওটাইপ থেকে বের করে আনছে ভারতীয় নারীকে। 

দুই, ভারতীয় ভাবিদের স্টিরিওটাইপে সে বসবাস করছে, সে শাড়ি পরিহিতা গৃহবধূ। কিন্তু একই সঙ্গে সে ভেঙে ফেলছে সেইসব স্টিরিও টাইপ। 

তিন , সবিতাভাবি এক উচ্চবর্ণের উচ্চবিত্ত মহিলা হলেও, সে নানা ধরণের মানুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করছে, তাদের জাতি , শ্রেণী বা লিঙ্গ বড় কথা নয়। 

এক ওয়েব লেখক, যিনি সবিতাভাবির কমিক্স এর উদ্ভট প্লট কয়েকটির উদ্ভাবনকারী , তিনি লিখেছিলেন, সবিতাভাবি কেন তরুণদের মন কেড়েছিল। এক, তার নটি-পনা বা দুষ্টুমির কারণে। অর্থাত আবার সেই স্টিরিওটাইপ ভাঙা। আর দুই, তার দেশি-পনা বা দেশজ ভাবধারাটির জন্য। সে যে ভারতীয় নারী, তাই সে চেনা। প্রধানত পর্ন-জগতের সব নারীচরিত্রই আজকের দিনের পুরুষের কাছে বিদেশি চরিত্র, বা বিদেশিভাবাপন্ন চরিত্র। একমাত্র সবিতাভাবিই দেশজ। ভাববার মত বিষয়।

ভারতীয় মেয়েদের যৌনতাবোধ ও তাকে স্বীকার-অস্বীকার

এসো সৌদামিনী, বলো কীভাবে আমার চুলগুলি

কালো হয়ে উঠতে পারে, দন্তরুচি পাহাড়চুড়োয়

জমা বরফের মতো, কীভাবে চোখের নীচে কালি

চলে যাবে বলে দাও, চর্চা করো পায়ের ফাটায়ও

সৌদামিনী, আমি চাই আমার এ বুড়ি শরীরের

সব দোষ সব খুঁত ঢেকে যাক তোমার প্রলেপে

হাসছ বুঝি? শোন বলি, কোনদিন জাগবে না ভেবেও

যখন শরীর জাগে, জেগে ওঠে, কেউ আর পালাতে পারেনা। ( সুতপা সেনগুপ্ত, নাপতিনীর সঙ্গে কথা)

ভারতের মেয়েদের কাছে যৌনতা একটি ট্যাবু শব্দ। আনন্দ তবু চলে, কিন্তু সুখ ? তার উদবোধন বা উদযাপন নৈব নৈব চ। নিম্ফোম্যানিয়াক নারী সমাজে অমিল নয়, কিন্তু তারা আদর্শগত ভাবে আমাদের কাছে “ঢলানি” ” খানকি” বা “নষ্টা”, “মন্দ মেয়ে”। যে কোন মেয়ে যে নিজের ইচ্ছেতে পুরুষে উপগত হয় সেই নষ্ট বা মন্দ, এটাই আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতির শিক্ষা। নিম্ফোম্যানিয়াক শব্দটিই আমরা ছোটবেলায় শিখেছিলাম নেগেটিভ বা মন্দ শব্দ হিসেবে। 

লায়লা খোন্দকার তাই ত লেখেনঃ

‘সীতা নামের অনেক মেয়ে তো ভারতবর্ষে আছে, আপনি কি এমন কাউকে চেনেন যার নাম দ্রৌপদী?’ এ ধরনের প্রশ্ন একমাত্র আনিলাই করতে পারে। কোনো কোনো পাঠক হয়ত জানেন যে, সে আমার সহকর্মী- অসম্ভব মেধাবী ও কর্মদক্ষতায় অতুলনীয়। ‘দ্রৌপদী নামে পরিচিত কেউ আছে বলে তো মনে পড়ছে না। কেন বলুন  তো?’ উত্তরে বলি। আনিলা মন্তব্য করে, ‘আমার মনে হয় ভারতবর্ষের সমাজ দ্রৌপদীর মতো প্রতিবাদী নারীর জন্য এখনো তৈরি নয়, তাই মা-বাবারা তার নামে মেয়ের নাম রাখে না। বরং সীতার মতো সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করা নারীই বেশির ভাগ মানুষের পছন্দ।’ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর ‘কৃষ্ণা কুন্তী ও কৌন্তেয়’ বইটির দ্রৌপদী বিষয়ক অধ্যায়টি পড়ি। এই নারীর তীক্ষè বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব ও মানসিক শক্তিতে মুগ্ধ না হয়ে উপায় আছে কি? পাশাখেলায় যুধিষ্ঠির তাকে ‘পণ’ রেখে হেরে যাওয়ায় তার কঠিন প্রশ্নের সামনে ‘জ্ঞানী’ কুরুবৃদ্ধরা নিরুত্তর থেকেছে। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী সীতা ও দ্রৌপদীর তুলনামূলক আলোচনা করে লিখেছেন :

‘রামায়ণের সীতা এবং মহাভারতের দ্রৌপদী- এই দুজনেরই একমাত্র মিল হলো যে তারা অযোনিসম্ভবা- অর্থাৎ কিনা তাদের জন্মে অলৌকিকতার গন্ধ আছে। কিন্তু এই দুই মহাকাব্যের নায়িকা চরিত্র এত বিপরীত যে ভয় হয়- একের পরিস্থিতিতে আরেকজন পড়লে কি করতেন। কল্পনা করতে মজা পাই- যদি দন্ডক বনে লক্ষণের গন্ডির বাইরে বেরিয়ে এসে দ্রৌপদী ভিক্ষা দিতেন রাবণকে, তবে হয় তাপসবেশী রাবণের দাড়ি- গাছি উপড়ে দিতেন দ্রৌপদী, আর সীতা যদি শ্লথবাসা হতেন উন্মুক্ত রাজসভায় তবে তিনি তক্ষুণি ধরণী দ্বিধা হবার মন্ত্র পড়ে চিরতরে ঢুকে পড়তেন পাতালে; মহাভারত কাব্যখানাই অসমাপ্ত রয়ে যেত। যদি বলেন রাজসভায় দ্রৌপদীই বা এমন কি করেছেন যে, আমরা তার গুণপনায় মুগ্ধ হচ্ছি। আমি বলব অনেক কিছু করেছেন, যা সর্বংসহা সীতার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সীতাকে যদি রামচন্দ্র বলতেন যে তুমি সভায় এসে শ্বশুরের সামনে কান্নাকাটি কর তাহলে তাই করতেন। তার পক্ষে কি রামচন্দ্রকে ‘জুয়াড়ি’ সম্বোধন করে এই প্রশ্নটা করা সম্ভব হতো যে, পাশা খেলায় আগে নিজেকে বাজি রেখে হেরেছেন, না আগে তাকে বাজি রেখেছেন…

এ তো রীতিমতো ‘ল-পয়েন্ট’। সভাসদদের কারও পক্ষে এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব হয়নি।’

দ্রৌপদীর মতো যেসব নারী এই ধরনের বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন করে অসংগতিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, তাদের জন্য সমাজটা কি এখনো তৈরি হয়েছে? কিছু মানুষ বোধহয় সময়ের আগেই পৃথিবীতে চলে আসে অথবা তারাই তৈরি করে ভবিষ্যৎ- নিজেদের হৃদয় খোড়া বেদনা আর সাহসের বিনিময়ে। মনে পড়ে গেল আরেকজন প্রবল মানুষ মহাশ্বেতা দেবীর ‘চোলি কা পিছে’ গল্পে ‘বিখ্যাত হিমালয় চড়িয়ে’ শীতল মালিয়ার বর্ণনা :

‘শীতল নাকি দুটো মানুষ। হিংস্র ও অ্যাগ্রেসিভ শীতল বারবার হিমালয়কে আক্রমণ করে। শান্ত, কোমল শীতল এ জল-গাছ নৈঃশব্দে ডুবে বসে থাকে। হিমালয় ও সল্ট লেক ব্যতীত ভারতে কত না প্রাকৃতিক শোভা আছে। শীতল সেসব ল্যান্ডস্কেপ সহ্য করতে পারে না। শীতল মনে মেজাজে ২০৯৪ সালের মেয়ে, অথবা শীতলের শতাব্দী এখনো আসেনি।’

দ্রৌপদী, আনিলা আর শীতলের মতো নারীদের শতাব্দী কবে আসবে?

লায়লা খোন্দকারের তোলা প্রশ্নগুলি যদিও যৌনতা সম্পর্কিত নয়, তবে মেয়েদের স্ব ইচ্ছা আর মেয়েদের কাম ইচ্ছাকে প্রায়ই আমরা গুলিয়ে ফেলেছি। গুলিয়ে গেছে স্বৈরিণি ও স্বৈরতান্ত্রিক। ছোটবেলায় স্ব+ঈর, সন্ধিবিচ্ছেদ শিখে মাকে প্রশ্ন করেছিলাম, স্বাধীনতা সুন্দর শব্দ, কিন্তু স্বৈরতন্ত্র খারাপ কেন? আসলে স্বৈর শব্দটিতে আছে স্বেচ্ছাচারিতার গন্ধ।

স্বৈরতন্ত্র খারাপ শব্দ, আর স্বৈরিণী ট্যাবু শব্দ। ১৯৭৫ সাল, আমার বয়স দশ। তখন এমার্জেন্সি। কাগজে কাগজে ইন্দিরাজির বিষয়ে বাছা বাছা শব্দপ্রয়োগ। সদ্য গল্পবই পড়া জ্ঞান নিয়ে, একবার ভুল করে ইন্দিরা গান্ধির সম্বন্ধে স্বৈরাচারী শব্দটি প্রয়োগ করতে গিয়ে বছর দশেক বয়সে স্বৈরিণী শব্দটি ব্যবহার করে ফেলেছিলাম বলে রাম বকুনি খেয়েছিলাম আমার মায়ের কাছে। কী সব কথা বলছ! মায়ের মুখ চোখ দেখেই মনে হয়েছিল, নিষিদ্ধ শব্দ ওটা, যদিও তখনই কোন না কোন বইতে পড়েই তো জেনেছি শব্দটা ( দুপুরবেলায় ছুটির দিনগুলো তো মা-দিদিমাকে ঘুমোতে দিয়ে যা হাতে পেতাম সব পড়ে ফেলতাম বাছবিচার না করেই বড়দের বইয়ের আলমারি থেকে) । তখন, যখন সবার আড়ালে খুব পড়ছি, পাঁজির রসালো বিজ্ঞাপন। প্রচন্ড বিশাল আকারের বাঁধাকপি ফলানোর উপায় থেকে মন্ত্রপূত তাবিজ কবচ দিয়ে পুরুষকে বশে রাখার বিশেষ উপায় পর্যন্ত।

তো, সেই সময় থেকে মাথায় প্রশ্ন ঢুকে গেলঃ স্ব – ঈর কেন মন্দ? মন্দ মেয়ে কাকে বলে? একবার ক্লাস টুয়েল্ভে আমার বান্ধবী পুষ্পিতার সঙ্গে হাজরা মোড়ে ওদের বাড়িতে, আমাদের বাড়ি থেকে দু পা দূরে, য়াড্ডা দিতে দিতে দেরি করে ফেলেছিলাম। বোধ হয় সাতটার বদলে সাড়ে সাতটা বা আটটায় ফিরেছিলাম। মা খুব রেগে বলেছিলেন, নষ্ট মেয়ে। এই বকুনিটার অন্য মানে আছে ততদিনে বুঝে গিয়েছি।

“শুয়েছি যাদের সঙ্গে – তাদের বিরুদ্ধে আমি অস্ত্র ধরতে পারব না দামিনী

সুন্দর সরণি ওরা, ঐ পথে ঢিল আমি কিছুতেই ছুঁড়তে পারব না

করুণ মধুর ওরা – যদিও লম্পট সর্দার,

সে লাম্পট্য কীভাবে যে সহ্য হয়েছে বারবার;

হাতে ছিল রামধনু তাদের, বৃষ্টিভেজা, আমি সেদিকে তাকিয়ে

বলেছি –

ঈশ্বর, দিয়ো না শাস্তি, জটিল সমাজ কাঠামোয়

ওরাই আমার

         সম্ভব করেছে বহু বিয়ে…

( অতিবিবাহিত, শ্বেতা চক্রবর্তী)

আমাদের যখন কাঁচা বয়স, তখন সদানন্দ রোডের তপন থিয়েটারে দীর্ঘকাল ধরে দুটি নাটক চলত। একটির নাম ছিল নহবত। যেটা নিশ্চয়তই ছিল নিরীহ বিবাহ কাহিনি। কিন্তু দ্বিতীয়টির বিজ্ঞাপন আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করত, তার নামের জন্য, বারবধূ।

বার। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম বারোজন বধূর কাহিনি। পাঁচ ছয় বছর বয়স আমার তখন। মাকে জিগ্যেস করে উত্তর পাইনি। মা অযথা উত্তর না দিয়ে গম্ভীর কেন হয়ে গেলেন বুঝিনি। সহজ প্রশ্নের সহজ উত্তর মেলেনি, বারবধূ মানে কী?

“দিদিমণি, আমি ভাল হতে চাইনা আজকাল

আমি খারাপ হয়েই থাকতে চাই

খারাপ হলেই আমি একা অন্ধকারে বিস্তীর্ণ এ আকাশের নীচে

দাঁড়াতে পারব

আর সারাটা সকাল ঘুমোব দারুণ ঘুম

দিদিমণি, বিকেলে সাজার পরে

সন্ধেবেলায় আমি দাঁড়াব ঈশান কোণে

একা ঈশ্বরীর মতো

মানুষের অপেক্ষায়

খারাপ হলেই আমি দাঁড়াতে পারব

দুঃখী, কামুক, লম্পট – বাতিল হয়ে যাওয়া

মানুষের অপেক্ষায়- বৃষ্টি আর ঝড়ে …

( শ্বেতা চক্রবর্তী , জাদুমণি)

সবিতা ভাবি মন্দ মেয়ে কিনা, সেকথা সমাজের পিসেমশাই বা গুরুমশাইরা বলবে। তবে এটা ঠিক, যে সবিতাভাবির বাইরেটা সংসারির আর চরিত্রটা তথাকথিত হাফগেরস্তের। সে কমপ্রোমাইজ করছে সংসারে, যেমন টা বাস্তবে অনেক মেয়ে করে। কিন্তু পুরোপুরি স্বৈরিণী হবার হ্যাপা আছে। সমাজের চোখে পতিতা হবার হ্যাপা বলে গেছেন শরৎচন্দ্র থেকে আশাপূর্ণা সকলেই। 

শরৎচন্দ্রের পতিতাপ্রেম

এ সূত্রে শরৎচন্দ্রের নারী চরিত্রদের নিয়ে দুচার কথা উঠেই পড়ে, আর এ উল্লেখে জড়িয়ে যায় তাঁর সমাজবীক্ষাও । সুকুমার সেন বলছেন, অনেক উপন্যাস ও গল্পে, “মৃতপ্রায় সমাজে নারী সম্পর্কে অযথা উৎপীড়নের চিত্র প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। পূর্ব্ব বর্তী লেখকেরা এমন অবস্থায় সমাজ-ব্যবস্থাকে অকরুণ মানিয়াছেন, তবে অন্যায় বলেন নাই এবং অমান্যও করেন নাই। শরৎচন্দ্রও অমান্য করিতে সাহস করেন নাই, তবে অন্যায় বলিয়াছেন মুক্তকন্ঠে ।”

শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন, সমাজ জিনিশটাকে আমি মানি, কিন্তু দেবতা বলে মানিনে।

শরৎচন্দ্রের আমাদের সাহিত্যে যে অবদান সবচেয়ে বড় সেটা পতিতার প্রেম ও একনিষ্ঠতার ধারণা। ( পরবর্তী ছায়াছবির দুনিয়ায় এই  মডেল খুব প্রচল হবে) কিন্তু সুকুমার সেনের বক্তব্য, টেক্সট বুক মরালিটি বা পুথিগত নীতিবোধের বাইরে বৃহত্তর চারিত্র্য নীতির ধারণা এবং সমাজের অনুবীক্ষণে যারা পতিতা তাদের মহত্বের এই ধারণা, এগুলো রবীন্দ্রনাথের হাতফেরতা হয়েই নাকি শরৎচন্দ্র পেয়েছেন। তবে তিনি অস্বীকার করেননি  যে শরৎচন্দ্র একনিষ্ঠ প্রেমকে সতীত্বধারণার খাঁচা থেকে বের করে এনেছিলেন।  শরৎ এর মতে, “সতীত্বের ধারণা চিরদিন এক নয়। পূর্ব্বেও ছিল না, পরেও হয়ত একদিন থাকবে না একনিষ্ঠ প্রেম ও সতীত্ব যে ঠিক একই বস্তু নয়, এ কথা সাহিত্যের মধ্যেও যদি স্থান না পায়, ত এ সত্য বেঁচে থাকবে কোথায়?”

তার চেয়েও গুরত্বপূর্ণ উল্লেখ সুকুমার সেনের লেখায় আছে। সেটা হল এই যে এক সময় শরৎচন্দ্র বাঙলা দেশের কুলত্যাগিনী বঙ্গরমণীর ইতিহাস সংগ্রহ করেছিলেন। তাতে বিভিন্ন জেলার সহস্রাধিক হতভাগিনীর নাম, ধাম, বয়স , জাতি, পরিচয় ও কুলত্যাগের সংক্ষিপ্ত কৈফিয়ৎ লিপিবদ্ধ ছিল। শরৎচন্দ্র হিসেব করে দেখেন, এই হতভাগিনীদের শতকরা সত্তরজন সধবা। বাকি ত্রিশটি মাত্র বিধবা। প্রায় সকলেরই হেতু লেখা ছিল, অসহ্য দারিদ্র্য ও স্বামী প্রভৃতির অসহনীয় অত্যাচার – উৎপীড়ন।

শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন,  “সমাজসংস্কারের কোন দুরভিসন্ধি আমার নাই। তাই বইয়ের মধ্যে আমার মানুষের দুঃখ বেদনার বিবরণ আছে, সমস্যাও হয়ত আছে, কিন্তু সমাধান নেই। ও কাজ অপরের, আমি শুধু গল্পলেখক, তা ছাড়া আর কিছুই নই। “

পার্বতীর বেদনার উৎস দেবদাসের কাপুরুষতা, না সমাজের অদ্ভুত ব্যবস্থা? যে ব্যবস্থা দুটি শিশুকে এক সঙ্গে থাকতে দেয়, কিন্তু বিবাহিত হতে দেয়না সামাজিক কিছু তুচ্ছ বিধিনিষেধের কারণে? ্সামাজিক দিকেই পাল্লা ভারি। কিন্তু পার্বতীর চরিত্রকে অবাস্তব বলা যায় না একেবারেই, বরং তার বৃদ্ধ স্বামী ও নতুন সংসারের সঙ্গে ব্যবহারের ভেতরে অনেক ভাবনার রসদ জড়ো হয়। আত্মত্যাগের মাহাত্ম্য ইত্যাদি ইত্যাদির পরেও ,আমি দেখি শান্ত সজাগ বুদ্ধিমতী ও “প্র্যাকটিকাল” পার্বতীকে, যে নিজের গায়ের গয়না সৎ মেয়েকে খুলে দিয়ে একধরণের যুদ্ধবিরতি ও শান্তিস্থাপনের চমৎকার কূটবুদ্ধির পরিচয় দেয়।

একইভাবে , চন্দ্রমুখী ক্ষমতায়িত নয়, কিন্তু ক্ষমতার প্রতিভাস তার আছে। যে মুহূর্তে পুরুষ এসে তার পায়ে লুটোচ্ছে, মেয়েটি নিজেকে ভুবনেশ্বরী বোধ করছে। তার সৌন্দর্য এবং তার আপাত স্বাধীন জীবনচর্যার ফলেই সে গ্রামে ফিরে গিয়ে থাকতে পারে। পাড়ার মুদির সঙ্গে টাকাপয়সার হিসেব কষে ও বাড়ি কেনাবেচা, ভাড়া করা ইত্যাদির  সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সব বাস্তব, তবে দেবদাসের প্রতি তার প্রেম একটু অবাস্তব।

 চন্দ্রমুখীর  গৃহ ত্যাগ বা পতনের কারণ বিবৃত হয়নি। তার ব্যাকগ্রাউন্ড এর অভাব লেখাটাকে অবাস্তব করছে । আর , সবচেয়ে অদ্ভুত একবার দেখা হতেই দেবদাসের ঘৃণায় মুগ্ধ হয়ে তার প্রতি গজিয়ে ওঠা প্রেম ও  আনুগত্য । কিন্তু সেটাই শরৎচন্দ্রের নির্মাণ, দেখাবার বিষয়, তাঁর অভিপ্রেত।

চন্দ্রমুখী সম্বন্ধে একটি বক্তব্য পাওয়া গেল এক লেখকের কাছে যিনি নিজে হিন্দি অনুবাদে পড়েছেন দেবদাস।  ইংরেজি ভাষায় উর্ণাভি উপন্যাসে্র লেখক সুমেধা ভার্মা ওঝা। মৌর্য যুগের এক চৌষট্টি কলায় পারদর্শিনী নায়িকাকেন্দ্রিক উপন্যাস লিখেছেন  সুমেধা।  রাঁচির মেয়ে। ওঁর দিদিমা ও মা বাংলায় পড়েছিলেন শরৎচন্দ্র,  কারণ দিদিমা শান্তিনিকেতন এর ছাত্রী ছিলেন, আর রাঁচির সব লাইব্রেরিতে বাংলা বইয়ের সম্ভার ছিল ঈর্ষা করার মত।

তো, এই শরৎ অনুরাগিনীর মতে, চন্দ্রমুখী হল সংস্কৃত নাটকের বসন্তসেনা থেকে প্রসাদের আম্রপালী হয়ে বাহিত রাজকীয় গণিকা ট্রাডিশনের প্রতিভূ।  অর্থাৎ,  শরতের নির্মাণে গণিকার যে পুন:প্রতিষ্ঠা তা যেন ভারতীয় সংস্কৃতির অতীত গরিমার দিকেও এক পা দিয়ে রাখে।

আশাপূর্ণার পৃথিবী

পুড়বে মেয়ে, উড়বে ছাই, তবে মেয়ের গুণ গাই। এই প্রাকৃত মতবাদকেই বার বার নানাভাবে ব্যক্ত করেছে বাংলার রক্ষণ শীল সমাজ। আশাপূর্ণা তার টিপ্পনী কেটেছেন আশ্চর্য দক্ষতায় ও সততায়। গৃহলক্ষ্মী থেকে কুলকলঙ্কিনী হয়ে যাওয়া কত সহজ, একাধিক গল্পে যে কথা তিনি বলতেন? আ ছিছি বলে সমাজ কীভাবে একটি মেয়েকে দেগে দেয় কুলটার ছাপ্পায়?

এখনো কি দেখিনি ডিভোর্সি শুনে একটি মেয়ের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া বাড়িভাড়া চাইতে গেলে? দেখিনি অন্য পুরুষের প্রতি সামান্যতম প্রশ্রয় দেখলে  পাড়াশুদ্ধ অফিসশুদ্ধ এমনকি পরিবারের ভেতরেও বাঁকা হাসি অথবা প্রচন্ড ব্ল্যাকমেলিং এর চাপ?  

আশাপূর্ণা শহর গ্রাম মফস্বল নির্বিশেষে একটাই সমাজে, ৯০ শতাংশ মানুষ তখন যেভাবে ভাবে, বাঁচে, অন্যদের, থুড়ি মেয়েদের বাঁচতে বাধ্য করে, সেই মাপা চাপা বন্ধ কুয়োটায় (মতান্তরে স্বর্গটায়) বসে  লিখে চলেছেন ত সেই জগতটারই কথা। ডকুমেন্টেশন। নিপুণ হাতে শুধু লিখে রাখা, কতটা নরক হয়ে যেতে পারে, গৃহলক্ষ্মীদের স্বর্গটা। কেন এক ঝুড়ি মাছের পাশে শুয়ে থাকা মেছুনি রজনীগন্ধার গন্ধ নিয়ে গল্প বলবেন ? ,  জেলখানার কয়েদি তার সলিটারি সেলের ভিজে ভিজে নোংরা দেওয়ালের গল্পই ত লিখবেন । অনেক উপরে,   নীলাভ জানালার খুপরিটা ছাড়া যার কাছে বড় আকাশ নেই কোন, তার নীহারিকা পুঞ্জ নিয়ে কথা বলা কতটা হাস্যকর হত। আশাপূর্ণা আসলে যে মেয়েদের  লেখাগুলো লেখেন সেগুলো ঐ সতীলক্ষ্মী, সতীসাধ্বীর স্টিরিওটাইপের আড়ালেই প্রেমের বাসনার গল্প।  চাপা লড়াইয়ের গল্প, সেগুলো। তাইই,  সাবভার্শান। পরিস্থিতির দলিল তৈরি করে তিনি আসলে বলছেন একটা চূড়ান্ত বাস্তবতার কথা। বাস্তবতা থেকে উদ্ধারের স্বপ্ন বলছেন না সব সময়ে। বরং চাপা গলায় বলছেন, অনুদ্ধারটা এসে দেখে যাও তোমরা।  বাস্তবতার ভেতরের অলিগলি, গুপ্তঘাত, নানা রকমের বিপজ্জনক শুঁড়িপথ উন্মোচন করছেন, আপাতদৃষ্টিতে গোলগাল গল্পগুলো বলবার ছলেই। স্বামীপরিত্যক্তা এক মেয়ের শুদ্ধ বৈধব্য যাপন, বনাম, এক রাত্রে স্বামীর সঙ্গেই দেখা হওয়া। স্বামী চলে যান।  পরদিন সকালে কুলকলঙ্কিনী বলে দেগে দেওয়া হয় তাকে। এই ভয়াবহ স্ববিরোধ… এসব গল্পকে তুলে এনেছেন তিনি কী সাবলীলভাবে।

একটি ছোট গল্পে যিনি লিখেছিলেন, এক বধূর স্বামীর মৃতদেহ বাড়িতে আসার পর, স্ত্রী, শোক করবার বদলে,  স্বামীর কাছে কে গোপন চিঠি লিখত,  সেটা জানার জন্য মৃতের পকেট থেকে বাড়ির ডাকবাক্সের চাবি খুঁজছে, এমন এক সংঘাতময়, বীভৎস নিষ্ঠুর সত্যের গল্প।

মূলত বধূদের গল্প বলেন তিনি , বলেন বদ্ধ জীবনের গল্প। রবীন্দ্রনাথের “চরণতলাশ্রয়ছিন্না মৃণাল” এর থেকে এই গল্প অনেক আলাদা। কারণ এতে লেগে আছে মেয়েজীবনের আঁশগন্ধ। রক্তের ছাপ। 

যৌনতা দিয়ে কাজ হাশিল করা কি নারীর ক্ষমতায়ন? না!

বার বার সবিতা ভাবির আখ্যানে আমরা দেখছি সবিতা ভাবি পুরুষদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে, দুধ ওয়ালা গ্যাসওয়ালা সবাইকে যৌনতা ফ্রি তে দান করছে আর তারাও বিনিপয়সায় কাজ করে দিয়ে যাচ্ছে তার। পর্নোগ্রাফির মূল কাজ সাহিত্য রচনা করা না, সিরিয়াস কথা বলা না। বরং উত্তেজিত করা। মানুষের স্বপ্ন কল্পনাকে উদবোধিত করা, কিন্তু শর্ট টার্মে। সে কাজে সবিতাভাবি সফল হতে পারে। তাই বলে এটা কোন দীর্ঘস্থায়ী প্রকল্প হতে পারেনা নারীস্বাধীনতার, এটা নারীস্বাধীনতা নয়। এটা পুরুষকে সুরসুড়ি দেবার যন্ত্র হতেই পারে যদিও। হাসিল করতেই পারে কিছু আপাত উদ্দেশ্য। সুখদান। এবং সুখ প্রাপ্তিও। এর মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ সম্ভব। যদিও সবিতাভাবি সিরিজের এক লেখক সুমিত কুমার লিখেছেন, 

I do not want to talk about how the character liberates women etc. In my head they don’t need anyone or any character to liberate them. They are liberated, they liberate themselves. It’s an individual who does things. If serendipitous thing like an encounter with a fictional character helps it, then great. I think dissection is just useless debate, which wastes essential time which we can use to take action, useful small acts that begin change.

মিটু, সাম্প্রতিক যে আন্দোলন বারে বারেই হানা দিচ্ছে, তার সূত্রে বাংলাভাষার এক ঔপন্যাসিক সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, নারীর ক্ষমতায়ন নাকি সম্ভব হয় যখন সে তার যৌনতাকে “ব্যবহার” করতে শেখে তখন।  

মিটু আন্দোলনের ঝড় উঠলেই  সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে কাউন্টার করা হয় মেয়েদের sexual favour নেওয়া দিয়ে। মেয়েরা কি sexual favours নেয়?? শ্মশানের নিস্তব্ধতা! এখানে নারী হিসেবে হিরণ্ময় নীরবতা অবলম্বনই সতী নারীর লক্ষণ। কিন্তু সেই কবে থেকে সব কিছু উল্টো বলা অভ্যেস করে ফেলেছি। একদিকে গায়ের রং, শরীরের গঠন এসবের discrimination এর বিরুদ্ধে গর্জে উঠি আমরা। প্রচুর লেখালেখি হয় এই নিয়ে। প্রচুর সদর্থক সংলাপ তৈরি হয়। অন্যদিকে সেলফি ক্যামের বিউটি মোডে সব শ্যামবর্ণ সাদা থেকে সাদাতর হতে থাকে। আসল চেহারা মুছে দিয়ে নাক, মুখ, চোখ সব ল্যাপালেপি হয়ে যায় সেই পুরোনো সৌন্দর্যের ধারণাকে প্রতিষ্ঠা দিতে গিয়ে। মুখের দাগ ঢাকি, ব্রণ ঢাকি। ফ্রেকেলস্ ঢাকি। বয়েস ঢাকি। দেখা যায় আসল রূপের ইতিহাস বিকৃতি ঘটে গেছে কখন অজান্তে। কেন যখন মননের স্তরে discrimination এর বিরোধিতা করি তখন একই সঙ্গে সেলফি ক্যামকে জাদু আয়নার মত ব্যবহার করি আমরা মেয়েরা? করি কারণ, এটা হল আমাদের বডি পলিটিক্স। কোন angle থেকে ছবি তুললে আমাকে রোগা লাগবে এটা আমার বডি পলিটিক্স। আমরা যখন আনখশির ডুবে যাই এই সব প্রেজেটেশনে তখন বুদ্ধিমত্তা দিয়ে আমরা সে সব অস্বীকারও করি। তাই সমস্ত পৃথিবী জুড়ে women empowerment যখন আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ উচ্চতায় পৌঁছোচ্ছে তখনই কিন্তু কোটি কোটি ফোন বিক্রি হচ্ছে শুধু সেলফি ক্যামের গুণমান বিচার করে এবং তার আসল ক্রেতা মেয়েরাই। তখনই কিন্তু নারীর পরিণত মন, অভিজ্ঞতা এসবের থেকে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে তার youthful look, চিরাচরিত সৌন্দর্যের ধারণায় নিজেকে ফিট করানো।

মেয়েদের বডি পলিটিক্স কথাটা কবে সারফেস করে সভ্যতায়? বলা মুশকিল। মোটামুটি ভাবে বলা যায় পুরুষের সঙ্গে সমান তালে বাইরের জগতে কাজ করার অধিকার, পুরুষের সমান wages পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাতৃত্বের ছুটি, সন্তান পালনে রাষ্ট্রের সাহায্য, অ্যাবরশনের অধিকার, প্রজননদের ওপর অধিকার, বার্থ কনট্রোল, মেয়েদের শরীরের ওপর সোসাইটির কনট্রোল, violence against women, objectification of women body, ইত্যাদি কত গুলো নারীর একান্ত নিজস্ব প্রতিবন্ধকতাকে overcome করাকেই মেয়েদের বডি পলিটিক্স বলা হয়। কিন্তু এসব বাদ দিয়েও মেয়েদের একটা অন্য মাত্রার বডি পলিটিক্স আছে যেটা নিয়ে একেবারে কথা বলা হয় না। সেটা হল তার শরীরকে, যৌনতাকে তার প্রয়োজনে তার ব্যবহার করার বাস্তবতা। ব্যবহার করা হয়? হ্যাঁ হয়। মেয়েরা নিজেদের যৌনতাকে হাজার হাজার বছর ধরে ব্যবহার করে এসেছে এটাকে না সত্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, না বাস্তব বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। এটার একটা empowering দিক আছে। সেটা যেদিন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বুক ফুলিয়ে মেয়েরা বলতে পারবে- সেদিন, সেদিন পুরুষতন্ত্র শেষ! কেন এটাকে এই উল্টো দিক থেকে দেখতে দেওয়া হয় না? কেন যৌনতার সওদাকে শুধু অন্য মাত্রার শোষণ বলে চিহ্নিত করা হয়? ধর্ষণ, মলেস্টেশন, যৌন হেনস্থা ছাড়াও নারীর যৌনতার ক্ষমতার দিকটাকে এরকম চাদরের তলায় রাখা হয়। কারণ তা না হলেই নারীর মরালিটি নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক প্রশ্ন ওঠে। তখন এটা হয়ে যায় নৈতিক হার, চরিত্রহীনতা, বেশ্যাবৃত্তি, কমপ্রমাইজ, অসতীপনা। এই বিশেষণ গুলো মেয়েরা আড়াল করতে বদ্ধপরিকর কারণ তাহলেই আবার পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সে ব্রাত্য হয়ে যাবে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সাপোর্ট পেতেই সে নিজের যৌনতার ক্ষমতা ব্যবহার করা সম্পর্কে innocent সেজে থাকার চেষ্টা করে যায়। কিন্তু যতবার মেয়েরা আঁচল খসিয়েছে ( এই সব উদাহরণ গুলো ভারতীয় সভ্যতার কনটেক্সটেই দেব, প্যান্টি হোস নামিয়েছে বলব না), যতবার পেটের ভাত থেকে শুরু করে চাকরির উন্নতিতে কাপড় তুলেছে ততবার আসলে মেয়েদের বডি পলিটিক্স জিতে গেছে। এই জিতে যাওয়াটাকে হেরে যাওয়া হিসেবে দেখানোর বয়ান হল sexual favour। আসলে উল্টোটা। কোন favour নেয়নি মেয়েরা। মেয়েদের ক্ষমতার উৎস যদি মেয়েদের শরীর হয়, তাহলে মেয়েদের যৌনতা হল বন্ধুকের নল। মেয়েদের যৌনতা যদি চাকা ঘোরায়, ভাতের ব্যবস্থা করে, ইনক্রিমেন্ট আনে, পদোন্নতি আনে, সুযোগ হিসেবে দেখা দেয় তাহলে স্বীকার করতে হবে যে সেই যৌনতা একটা ক্ষমতা। Power. মেয়েরা favour নেয়নি, সেই ক্ষমতাকে ব্যবহার করেছে। মেয়েরা ব্যবহৃত হয়েছে বলতে যতটা অনায়াস, ব্যবহার করেছে বলতে ঠিক ততটাই ভীত, শঙ্কিত কারণ এখনো কোন স্ফিয়ারেই এই বয়ানের acceptance নেই। ঠিক যেমন ভাবে ক্লিওপেট্রা তার রূপ, শরীর, যৌনতা, কন্ঠস্বর, কটাক্ষ সব ব্যবহার করেছিলেন সিজার কিংবা আন্টনিকে বশ করতে, নিজের অতুল ঐশ্বর্য, ক্ষমতাকে ধরে রাখতে, রানীর আসনকে ধরে রাখতে, সাম্রাজ্য বিস্তার করতে, প্রজাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবহার করেছিলেন ঠিক সেভাবেই দুর্ভিক্ষের সময় কোন অজ্ঞাতকুলশীলা নিজেকে মহাজনের অঙ্কশায়িনী করে আঁচলে চাল বেঁধে এনেছে কারণ তার যৌনতাই তার আয়ের উৎস। তার ক্ষমতা। হ্যাঁ, কিছুদিন আগে slut walk হয়েছে, আমি যদি slut হই তাতে তোর বাপের কি- এটা বুক বাজিয়ে বলেছে মেয়েরা, কিন্তু এখনো যৌনতা যে বিশুদ্ধ ক্ষমতা এটা কেউ বলছে না। আসলে পুরুষের শরীর কি নারীর থেকে আলাদা? পুরুষের শরীরকে কি killing machine হিসেবে ব্যবহার করেনি সভ্যতা? কিন্তু কি আশ্চর্য তাকে বলা হয়েছে বীর, fighter, সৈনিক। Killing machine হিসেবে পুরুষকে তো লজ্জা পেতে হয়নি? পুরুষের masculinityকে এই ভাবে কদর করা হয়েছে কারণ পুরুষের masculinity আর সভ্যতার সাম্রাজ্যবাদী স্বভাব একে অন্যের পরিপূরক। একটা ছাড়া অন্যটা নেই। পুরুষের masculinity পুরুষের অস্ত্র। তার স্বীকৃতি আছে। কিন্তু মেয়েদের যৌন ক্ষমতার কোন স্বীকৃতি নেই।

স্বীকৃতি নেই বলেই যে ব্যাপারটা নেই তা কিন্তু নয়। উপরন্তু তাকে লজ্জার আবরণ পরানো হয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে। এই কারণেই মেয়েরা তাদের অনিচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের শরীরে থাবা বসানোর প্রতিবাদ করলেই তারা তো প্রয়োজনে সেক্সুয়াল ফেভার নেয় এই বলে তাদের কোনঠাসা করে দেওয়া হয়। হ্যাঁ মেয়েরা সেক্সচুয়াল ফেভার নেয় কারণ সেটাও মেয়েদের বডি পলিটিক্স। আর এখানে মরালিটির প্রশ্নটা? পুরোটাই পুরুষ নারীর কাছে যে সতীপনা কামনা করে তার অনুরূপ। এখানে মরালিটিটা মেল chauvinism এর সমানুপাতিক। নারীর সতীপনার primary ধ্যানধারণা নারীর কাছে কি সেটা নিয়ে আমরা প্রশ্ন করছি না কেন?”

এই ধারণার ভেতরে আপাত চাকচিক্য আছে। কিন্তু আছে একটি মেজর ফ্ল বা গুরুতর অসুবিধের জায়গা। কারণ, এই ধারণা নারীবাদী আন্দোলনের, মিটু আন্দোলনের, এমনকি মেয়েদের নিজের শরীর পুনরধিকার করার অ্যাজেন্ডাটাকেই মিথ্যা করে দেয়। যৌনতাকে ব্যবহৃত হতে দেওয়ার বাধ্যতাকে দেখায় সচেতন চয়েস হিসেবে , শোষণকে দেখায় জয় হিসেবে। পরবর্তীতে শোষিতের অবস্থানটা গুলিয়ে যায় এবং ভিক্টিমদের ভেতরে দুটো বিভাগ তৈরি করে। শোষিত হয়ে সফল নারীরা নিজেদের শোষণ ভুলে নিজেদের পিঠ চাপড়াতে শেখেন কেননা তাঁরা নিজের যৌনতাকে ব্যবহার করে আপাত সাফল্য পেয়েছেন। আর, এই বক্তব্য নারী আন্দোলনকে ও যৌনতাকে ব্যবহার না করা অজস্র নারীর লড়াইকে মিথ্যে করে দেয়।

প্রাসঙ্গিকভাবে অধ্যাপিকা অনুরাধা কুন্ডা এর বিপক্ষে লিখেছিলেন, 

নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য মেয়েরা যৌনতা ব্যবহার করতেই পারেন, এটা নিয়ে একটা তর্ক উঠেছে বটে। আমার মতে যৌনতা ব্যবহার এমপাওয়ারমেন্টের উৎস হতে পারে না। ওটা দিয়ে যা হয়, তা আর যাই হোক এমপাওয়ারমেন্ট নয়।

মানুষমাত্রেই নিজেকে সুন্দর প্রতিপন্ন করতে চায়।সুন্দরের একটা চাহিদা আছে।তবে সেটা সবসময় যৌনতা নির্ভর নয়।

মেয়েরা বেশি সাজে, বেশি পোজেসিভ, বেশি সৌন্দর্য সচেতন, এ সকল মিথ তৈরির পেছনে আর্থ সামাজিক কারন আছে। অনেক অনেক মেয়ে সকাল থেকে আয়না দেখার সময়ই পায় না।কোনোমতে একটা হাতখোঁপা করে কাজে চলে যায় ।তৎসত্ত্বেও বিউটি পার্লারের রমরমা আছে। মেক ওভার আছে ।ব্রাইডাল আছে।মেয়েদের মাথায় ঢোকানো হয় যে তাদের মলাট ই ললাট।আর ললাট হল বিবাহ।সেটার মূলে থাকবে সলিড অর্থনীতি । অথবা পুরুষের মনোরঞ্জন । সেক্সুয়ালিটি সম্বল করে মনোরঞ্জন বিবাহ অন্তর্ভুক্ত হলে সেটা সুখী দাম্পত্য । কর্পোরেট সেক্টর হলে ডীল। বিনোদন জগত হলে কাস্টিং কাউচ। পড়াশোনার জগত হলে আঁতেলেকচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং । আমাদের এক সহপাঠিনী ল্যাবে যাবার সময় ঘোষণা করে লো নেক ব্লাউজ পরে যেত। তাতে নাকি নাম্বার সহজে মেলে।এটা এমপাওয়ারমেন্ট বলতে আমার বিলক্ষণ আপত্তি আছে। শরীর ব্যবহার করে বডি পলিটিক্সে কিছু ফায়দা তোলা ই কি নারীবাদ?তাহলে তো জিগোলো জুটলেই মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠা পেয়ে যেতো।

হ্যাঁ ।সেলফি ক্যামেরা আছে বটে।এডিট করার হাজার কারসাজি আছে।গ্লো আছে।কিন্তু নারীবাদ মেয়েদের ঐ এডিট করা ছবির বাইরেই নিয়ে যেতে চায় ।

প্রসাধনী মেখে বা ছবি এডিট করে নিজেকে সুন্দর প্রতিপন্ন করার মধ্যে একধরনের বিপন্নতা প্রকাশ পায়।বাঁধাগতের সুন্দর হয়ে ওঠার চেষ্টা আছে।একজন পুরুষ যখন নারীর রূপের প্রশংসা করেন, তার মধ্যে যৌন ইচ্ছা থাকতে পারে।আবার নাও পারে। একজন মেয়ে যখন মেয়ের রূপের প্রশংসা করে সেখানে যৌন ইচ্ছা থাকার সম্ভাবনা কম। ফলে মেয়েরা যখন মেয়েদের প্রশংসা করেন, তখন সেটা অনেক বেশি অবজেক্টিভ। অনেক ক্রিটিক্যাল । কাজেই অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যও হয়ে ওঠে অনেকরই কাছে।

আমি মনে করি মেয়ে বা পুরুষ সুন্দর হয়ে উঠতে চায় মূলত নিজের জন্য।নিজের চোখে নিজেকে ভালো লাগা ভীষণ মূল্যবান।এটা মানুষের সেক্সুয়ালিটির একটা অংশ বটে।যেটা তার ব্যক্তিত্বকে মর্যাদা দেয় ।সেল্ফ লাভ ।নিজের চেহারা , সাজগোজ নিজের পছন্দ হলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে।

তবে কি এটাকে মানুষ( শুধু মেয়ে নয়) হাতিয়ার করবে? যৌনতা তাহলে শুধু দেহজ?

ক্লিওপেট্রা যৌনতা ব্যবহার করে অ্যান্টনিকে পদতলে এনেছিলেন বটে।কিন্তু ঘোর কেটে যাবার পর অ্যান্টনি বিরক্তিতে ক্লিওপেট্রার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।উদ্দাম ও ইরোটিক যৌনতা হাতিয়ার করে রাণী দেশের সর্বনাশ করতে উদ্যত হলেন। অ্যান্টনির ও।ভদ্রলোককে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে টেনে আনলেন।লোকটার দেশ, সংসার সব গেলো।।ফল আমরা সবাই জানি। প্রেম নয়।শুধু কামনা ছিল। অতএব ধ্বংস অনিবার্য ।কোল্ড অক্টাভিয়া আর হট ক্লিওপেট্রার মধ্যে বাই পোলারিটি তৈরি করে অ্যান্টনিকে হিরো করে দেওয়া সোজা খেলা।

আর শেষ পর্যন্ত কিন্তু অ্যান্টনি ক্লিওপেট্রার বাঁধন থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত যদি রুশোর কথা বলি, তবে তিনিও তো মেয়েদের যৌনতা অবলম্বন করেই পুরুষকে ” বশ” করতে বলেছিলেন।রুশোর মতে মেয়েদের যৌনতা একটা হাতিয়ার, যেটা “ব্যবহার” করে মেয়েরা পুরুষের ” প্রভু” হয়ে উঠতে পারে।যৌনতা ও ছলনাকে মেয়েদের অস্ত্র করে দেখিয়ে পুরুষ বারবার মেয়েদের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করেছে। এটা এমপাওয়ারমেন্ট নয়। এ যদি এমপাওয়ারমেন্ট হয়, তবে কাস্টিং কাউচ কে বলতে হবে ক্ষমতার আসন। তাই যদি মর্যাদার হত তাহলে পারভিন বাবি থেকে শুরু করে কঙ্গনা রানাওয়াত রা কেঁদে কেঁদে অভিযোগ করতেন না।শেক্সপিয়ার ডার্ক লেডিকে ব্যাড এন্জেল বা ইভিল বলতেন না।রুশো বলেছিলেন কোমলতার ছলনায় পুরুষকে প্রলুব্ধ করে , তার মিস্ট্রেস হয়ে ওঠাই নারীর কাজ। এটা ভুল প্রমান করতে উওলস্টোনক্রাফ্ট একা অতদিন আগে লড়ে গেলেন। যৌনতাকে হাতিয়ার করা মেয়েদের আন্দোলনকে দুশো বছর পিছিয়ে দেবে।

পুরুষের যৌনতা ও মেয়েদের যৌনতার ধরন আলাদা।এই বেসিক জায়গাটা মানতে হবে।মেয়েদের যৌনতা র সঙ্গে মেনস্ট্রুয়েশন, মাতৃত্ব, মেনোপজ জড়িত। এমনকি মেনোনজের পর যে যৌনতা অন্তর্হিত হয় না, তাও এখন প্রমানিত। জন্ম নিয়ন্ত্রণ আসার পরে মেয়েদের বডি কন্ট্রোল এসেছে। কিন্তু তাও সার্বিক নয়। এ প্রসঙ্গে বোভ্যায়া একটা মারাত্মক সত্যি কথা বলেছেন

“In coition, man uses only an external organ , while woman is stuck deep within her vitals”. এটা বড় অনিবার্য সত্যি। শরীর বাইরে এবং অভ্যন্তরে।আরেকটা কথাও জরুরী ।কেন ধর্ষণ বা অনভিপ্রেত সঙ্গম মেয়েদের কাবু করে ফেলে? ” Woman, once penetrated ….feels trespassed in upon her flesh.”

নিজস্ব, আভ্যন্তরীণ শারীরিকতার কারনেই মেয়েদের শুচিবোধ সংক্রান্ত নিয়মগুলো এসেছে । সেই নিয়ম বাদ দিলেও, হাইজিন ও হরমোনের কারনে মেয়েদের যৌনতা, মেয়েদেরই। তার একটা নির্মাণ আছে।সেটা পুরুষের চেয়ে ভিন্ন। এমপাওয়ারমেন্টের দোহাই দিয়ে তার বিনির্মাণ করা যাবে কি? মেয়েদের অরগ্যাজম, যা কিনা পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি সময় সাপেক্ষ ও দীর্ঘকালীন, পাল্টে যাবে? আর শুচিতাবোধ, যা কিনা দৈহিক, মানসিক এবং বৌদ্ধিক ও বটে সেটা মেয়েদের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়।পুরুষের মধ্যেও সেই বোধ থাকার কথা। বাস্তবে আছে কি নেই সেটা ব্যক্তিসাপেক্ষে প্রযোজ্য ।তবে থাকলেই ভালো।

বহুকাল আগে উওলস্টোনক্রাফ্ট নারীবাদের নাম ও জানতেন না।কিন্তু যৌনতাকে হাতিয়ার করে প্রতিষ্ঠিত হবার (?) পন্থকে বর্জন করার লড়াই শুরু করেছিলেন।

যৌন আকর্ষণ ক্ষণস্থায়ী । পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছাড়া সম্পর্ক টেঁকে না।কাজ ও সম্মানিত হয় না। অন্যান্য সব শারীরবৃত্তীয় কাজের মতো যৌনতা ও পবিত্র । তার মর্যাদা থাকবে না? ইন্দ্রাণী বোরা( মুখার্জি) যৌনতা হাতিয়ার করে বেশ একটা জায়গা করেছিলেন বটে। অনেকেই করেন। অনেকেই করে থাকেন অথচ চুপেচাপে।কেন পাব্লিকলি বলেন না?সমাজের ভয়? তাহলে আর এমপাওয়ারমেন্ট কি হল? ইমরান খান বুক বাজিয়ে বলে গেছিলেন ” All Indian film stars are prostitutes”. কেউ তো কিছু প্রতিবাদ করলো না? শরীর ব্যবহার যদি ক্ষমতা দিত , তাহলে সামাজিক স্বীকৃতি ও দিত।যৌনক্ষমতা ব্যবহার করে পাটরাণী হয়ে ওঠা মহিষীরা চিরকাল সময় ফুরোলে দুয়োরানি হয়ে চোখের জল ফেলতেন, আজ ও ফেলেন।

এটা শরীরকে হ্যাটা করা হচ্ছে না। আবার শরীর নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করার ও কোনো যুক্তি নেই।

যৌনতা এমপাওয়ারমেন্টের অস্ত্র বা বন্দুক হলে নারীবাদ জন্মাতো না। দেবদাসী বা নগরনটীরা এমপাওয়ারড ছিলেন না।বা ততটুকুই ছিলেন যতটা সমাজপিতারা অনুমোদন করতেন। তারপর তাঁরা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতেন বই নয়। শরীর ব্যবহার করে এমপাওয়ারমেন্ট দেখিয়েছেন মণিপুরের মেয়েরা।অথবা মহাশ্বেতার দ্রৌপদী। যেখানে কাউন্টার অ্যাটাক হচ্ছে।শোষক থমকে যাচ্ছে।

কাজ কাজের জায়গায় থাকুক।যৌনতা থাক তার নিজস্ব জায়গায়। তাতে দুইই মর্যাদা পাবে। এমপাওয়ারমেন্ট

নারীবাদের বহুস্বর এবং বহুস্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত । যৌনতার অস্ত্র দিয়ে তাকে পাওয়া যাবে না।আবার এমপাওয়ারমেন্টের সঙ্গে হায়াররার্কি ও চলে আসে। সেখানে মালকিন- কাজের মাসি , শিল্পপতি – শ্রমিক, বিগ হাউস লেখক- লিটল ম্যাগাজিনের লেখক এসব আলোচনাও ওঠে। অনেক অনেক জটিলতা। যৌনতা নিজেই একটা জটিল বিষয় । তাকে হাতিয়ার করে জটিলতা বৃদ্ধি বই কিছু হবে না।তাতে নারী আন্দোলনের বিস্তর ক্ষতি ।

দুটি মতামতই হুবহু পেশ করলাম। এবার ভাবনার ও বেছে নেবার কাজ পাঠকের। 

দুটিই ফেসবুক পোস্ট এবং বহু পঠিত।

তবে আমার হেলে থাকা  অনুরাধার দিকে। সবিতাভাবি উত্তেজক হতে পারে, নারীর “অন্যরকম” মডেল হতে পারে, কিন্তু তা পর্নোগ্রাফিই মাত্র। পর্ন চরিত্র যা পুরুষ ফ্যান্টাসিকে খাদ্য জোগায় তা নারীকে মুক্তি দিতে আসেনি, নারীর মুক্তির প্রশ্নটা একেবারেই অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে।

অন্য দিকে, পর্ন ব্যান করা অনুচিত সেটা এই কারণেই , যে, যে কোন  পর্ন ব্যানের মতই এক্ষেত্রেও নিষিদ্ধকরণ দিয়ে শুধু যৌনতার ওপর পেষণ নামিয়ে আনাই সম্ভব হবে,  আপত্তিকর ডিনায়ালের সংস্কৃতিকেই বহাল রাখা হবে। জনগণকে পরিণত বুদ্ধির বা পরিণত মানসিকতার ভাবার বিরোধী। প্রাপ্তবয়স্ক জনগণকে প্রাপ্তবয়স্ক ভাবার বিরোধী।

তবে শেষ কথা কিন্তু এটাই,  যে, 

“যৌনতা এমপাওয়ারমেন্টের অস্ত্র বা বন্দুক হলে নারীবাদ জন্মাতো না। দেবদাসী বা নগরনটীরা এমপাওয়ারড ছিলেন না।বা ততটুকুই ছিলেন যতটা সমাজপিতারা অনুমোদন করতেন। তারপর তাঁরা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতেন বই নয়। শরীর ব্যবহার করে এমপাওয়ারমেন্ট দেখিয়েছেন মণিপুরের মেয়েরা।অথবা মহাশ্বেতার দ্রৌপদী। যেখানে কাউন্টার অ্যাটাক হচ্ছে।শোষক থমকে যাচ্ছে।

কাজ কাজের জায়গায় থাকুক।যৌনতা থাক তার নিজস্ব জায়গায়। তাতে দুইই মর্যাদা পাবে।”

বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের কবিতা

তর্জনীকে দাঁড় করিয়ে রাখেন যে কবি

যশোধরা রায়চৌধুরী

তুমি ভাব/ আমি তোমার/ আজ্ঞাবহ দাস/ জলের মতো দেখো/ নানাপাত্রে রাখো/ জালা কুঁজোয় গ্লাস ঘটিতে/ এই আমাকে, আমায় নিয়ে/ প্রভু তুমি কী প্রসন্ন/ আত্মতুষ্ট প্রভু/ ভাব তোমার পদপ্রান্তে/ সেবাধন্য দাস/ একচক্ষু সুখের পাখি/ আমার মূর্খ প্রভু। (তুমি ভাবো)

আমার প্রভুর জন্য নামে প্রথম কাব্যগ্রন্থের এই বিস্ফোরক লেখাটি একেবারেই বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের হস্তচিহ্ন ধারণ করে আছে। এক আশ্চর্য নিচুকন্ঠে বলা , শান্ত উচ্চারণে ধরা আছে বিস্ফোরণটি। 

বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের কবিতা আগে যেভাবে পড়েছি,  তাঁর চলে যাবার পর সেই পড়াটা বেশ কিছুটা পাল্টে গেছে এ কথা মানতে দ্বিধা নেই। এক কবিকে বুঝতে গেলে হয়ত , দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতেই হয়, তাঁর মরদেহের অবসান অব্দিই অপেক্ষা করতে হয়। এটাই কবির ভবিতব্য।

আপাতত  তাঁর কবিতাসংগ্রহ,  শ্রেষ্ঠ কবিতা,  এগুলো হাতে নিয়ে পরপর তাঁর প্রতি বই ধরে ধরে পড়ছি। শুরু থেকে তার চলন দেখছি।  ভ্রমণ দেখছি।

আর সেই ভ্রমণে বিজয়া মুখোপাধ্যায় খুবই অপ্রত্যাশিত চমক উপহার দেন। তাঁর এক এক লেখা এক এক রকম, কোন এক মাপের এক মেটে  ঢং তাঁর লেখা থেকে  পাইনা, আর তাই অস্বস্তির সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময় আসে।

ঠিক কী লিখতেন বিজয়া মুখোপাধ্যায়? আমরা যারা বাংলা কবিতার মোটাদাগের পাঠক, যে কোন পাঠের  কবিতাকে আমরা লেবেল এঁটে দিতে চাই, বিষয়  নামক একটা অসার জিনিস,  আমরা নানাভাবে ভাগ করি।  একটা ভাগ হয় বিষয়ভিত্তিক।  যেমন বর্ষার কবিতা,  গ্রীষ্মের কবিতা এইরকম  মোটা মোটা ভাগ।  আরেকটা ভাগ হয় থিমের, দর্শনের ভাগ।  পেছনের ভাবনার বিভাগ।  থিম শব্দটা  শুনলেই আজকাল থিমের পুজো এসে পড়ে । কিন্তু আমি ঠিক যা  বলতে চাইছি তা হল, ভাবনার ধরণ বা ঝোঁক বা প্রবণতা দিয়ে ভাগ করা। কোন কোন কবির প্রিয় বিষয় মৃত্যুচেতনা, কারোর প্রেম বা যৌনতা।  বিজয়ার কবিতা যদি আমরা খুব মন দিয়ে দেখি দেখব , তিনি এভাবে কোন চেনা ঝোঁকের হাতে ধরাই দেন না।

তারপর অনেক পড়তে পড়তে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাঁর চিন্তা প্রক্রিয়াটাকেই যেন  তিনি কবিতা আকারে লিখে রাখতেন। আর সেই চিন্তাপ্রক্রিয়ার অনেকটা ঘিরে থাকে লেখালেখি।  বিষয় বা থিম বলতে আসছে  তাঁর মুহূর্তিক ভাবনারাজি। তাই  সেখানে এসে পড়ছে মেজাজের নানান রঙের ছবি । তার মধ্যে আবার অনেকটাই লেখা নিয়ে তাঁর ভাবনার কথাও।

বিজয়া

কখনো কখনো রাগ ক্ষোভ আনন্দ দুশ্চিন্তা, কখনো কেবল একটি দেখা, কারুকে, তা মানুষ বা মানুষীও হতে পারে। আবার তা কোন দৃশ্যও হতেই পারে। এইসব দর্শন,  এইসব চিন্তা  কবিতায় থিম  হয়ে আসছে।  আমি বার বার লক্ষ্য করছি যে তাঁর কবিতাগুলো  আমরা “একজন নারীর কবিতা” “নারীবাদী কবিতা” এইসব তকমায় ফেলতে কখনোই পারছি না। সেসব লেবেল দিতে গিয়ে  ব্যর্থ হচ্ছি। এমনকি সামাজিক সচেতনতার কবিতা বলতেও ব্য র্থ হচ্ছি।

 অথচ অনেকগুলি কবিতাই এমন যে  নারীবাদী কবিতা সংকলন করতে গেলে যায় তাতে রাখতে হয় । যেমন পুঁটিকে সাজে না। কবিতাটি একদা ব্যবহার করেছিলাম এক উত্তর সম্পাদকীয়ের মুখবন্ধে, যার অভিমুখ ছিল নারী।

আবার , যেমন এই কবিতাটি।  পড়লে মনে হয়, কেন এমন অদ্ভুত কথা ভাবব আমরা, যে, নারীত্ব –পুরুষত্ব-নির্বিশেষ একটি “বাদ” বা ইজম ছাড়া নারীবাদ আর কিছুই নয়? যে তত্ত্বে স্থিরবিশ্বাস রেখে একের পর এক প্রতিবাদ ছুঁড়ে দিতে হয়, স্লোগান লিখতে হয় ক্রমাগত , তবেই একমাত্র খবরের কাগজের হেডিং-এর মত করে লেখা হয়ে উঠবে নারীবাদী কবিতা? এমন অতিসরলীকৃত না ভেবে, বরং, পোস্ট মডার্ন বা অধুনান্তিক তত্ত্ব থেকে নারীবাদ বিষয়ে একটা কথা ধার নেব এখানে।  অন্যভাবে দেখানোর ফলে দেখার সুবিধে করে দেবে বলে।

“জীবের সঙ্গে জীব মিলে মিশে যে ডাঙায় জীবনের যৌথতা চালায় সেই চলাচলের ক্ষেত্রই ‘অঞ্চল’। আলাদা এক খন্ড ভিটেমাটি বলে সে ডাঙাকে যদি চাক্ষুষ চেনা না যায়, তাহলেও। যে কোন অঞ্চলেরই ন্যূনতম একটা আত্মশক্তি চিহ্নিত সার্বভৌমতার দরকার থাকে।

যেমন ধরুন নারীবাদ যে সম্ভব হচ্ছে তার কারণ, মেয়েরা এই অর্থে একটা অঞ্চল। তাঁরা যে আলাদা কোনো ভূখন্ডে থাকেন না, পুরুষদের সঙ্গে এক বারিতে এক পাড়ায় এক দেশেই থাকেন, সেটা নারী অঞ্চলের সংহতির অন্তরায় নয়। নারী অঞ্চলের স্বাতন্ত্র্য চাওয়া মানে ছেলেদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ভূমিতে থাকতে চাওয়ার অলীক কল্পনা নয়। মেয়েদের স্বাভাবিক স্বপ্নের পুরোন দাবিরই পরিস্ফুট রূপ। যে পরিস্ফুটনের ধরণটা অধুনান্তিক পর্বের আঞ্চলিকতার লক্ষণে চিহ্নিত। “ (প্রবাল দাশগুপ্তের “অধুনান্তিক এলাকা” প্রবন্ধ থেকে)

আমার মতে, সমস্ত কবিতাই আসলে মানুষেরি কবিতা, একইসঙ্গে  ঘটনাক্রমে মেয়েলিখিত হলে, সেই কবিতার একেবারে ভেতরে থেকে যায় , হঠাত হঠাত জেগে ওঠে এমন এমন সব মেয়েমানুষের কথা, মানুষ হিসেবে অস্বীকৃত হয়ে অপমানিত বিক্ষুব্ধ মেয়ের মনের কথা, এমন সব সত্য হঠাৎ করে ভেসে ওঠে কবিতার মধ্যে, যে আমরা স্তম্ভিত হই, স্পৃষ্ট হই, ঋদ্ধ হই। ঠিক যেভাবে এক পুরুষ কবির কলম অনবরতই লিখে চলে পুরুষজমিন, এক নারী লেখেন নারী অঞ্চলের কথাই, সে অঞ্চল বাত্যাবিক্ষুব্ধ হোক বা শান্ত, সেই ভূগোলটার খবর আমরা পেতে পারি তাঁর লেখায়, নিরবচ্ছিন্নভাবে, যদি না তিনি সচেতনে অন্য লিঙ্গের বাচনে কিছু বলতে চান।

আসলে এই সময়ে, আমাদের এই গড়পড়তা নারীত্ব কখনো কোন বাদের ঝান্ডা নিয়ে দাঁড়ায়না। আবহমান মানুষের কথা বলে। যে মানুষের পরাজয় হয়ত নারীর পরাজয়, হয়ত মানুষের পরাজয়।

মা আর মেয়ে গান গাইছে, ‘আমারে কে নিবি

ভাই, সঁপিতে চাই – ‘

অন্ধকার কেউ কারুর মুখ দেখতে পায় না গলার সুর, কথার ছন্দ মিশে যায় গানে কার

মনের ভেতরে কী ছবি জাগেকেউ জানে না

শুধু গেয়ে চলেসঁপিতে চাই  আপনারে

মা আর মেয়ে দিনের আলোয় ওরা

কেউ কারুকে দুচক্ষে দেখতে পারে না রাগে ওদের

গা জ্বলে যায় চিৎকারে পাড়া মাত

বাপের বাড়ি বেড়াতে এসে মেয়ের এত কীসের

নালিশ, মায়ের এত কীসের বিবাদ–  আমি

ভাবি অথচ ঝাঁপ দিয়ে যখন অন্ধকার নামে

সব খোঁচাগুলি একাকার করে দেয়, তখনই ওদের

গলায় জড়ো হয় সুর কোমল ধৈবতে গান্ধারে

ওঠানামা করে সে, কড়িমধ্যম ছুঁয়ে জলের

আওয়াজ তুলে খেলে যায়

পুরুষহীন বাড়ির জানলার পাশে বসে

গান গেয়ে যায় দুই নারী কোমল হয়ে আসে

ব্যক্তিতা ওরা আর মামেয়ে থাকে না,

তখন দুই পরাজিত মানুষী, আবহমান বন্ধু

( ওরা, ভাষায় যেটুকু বলা যায় (২০০৫) গ্রন্থ থেকে)

“আমি শুধু অক্ষরের দানা তোমার পায়ের সামনে রেখে আসি যদি লাগে কাজে পুঁথি পড়া কাজে”।

কিন্তু তবু লোভ সম্বরণ করতেই হয়। শুধুই  নারীবাদী কবিতা বলে দাগিয়ে দেওয়া অন্তত মুখোপাধ্যায়ের কবিতাকে খুব কঠিন ।  প্রথম বই থেকেই এই ধরণের অসংখ্য কবিতার কথা  বলা যায় যার কেন্দ্রে আছে একজন নারী। কিন্তু  কবিতাটি কে যেন নারীবাদী কবিতার ভেতরে ঠিকঠাক ফেলা যায় না । মনীষাকে কবিতাটি যেমন আশ্চর্য এক লেখা। ‘ক্লান্ত শরীর’  ‘ অগাধ জলের আমন্ত্রণ’  আর এইসবের পরে আসছে দুজন প্রেমিকের কথা যাদের ভেতরে আছে  ঠান্ডা লড়াই। একেবারে শেষে আছে, এক জন প্রতিস্পর্ধীর গল্প, আর   ” কেননা তোমার সেই প্রতিস্পর্ধী মারা গেছে কাল কোন এক প্রসূতি ভবনে “এই দিয়ে কবিতা শেষ হচ্ছে।

একটা কবিতা সেখানে বলছেন “আমি ক্রন্দনহন্তারক পুত্র চাই।” তারপরে ঈশ্বর হাসলেন এবং তাঁর নিরুপায় চোখ থেকে বিশাল অশ্রু ঝরে পড়ল।

 এই কবিতা কে আপনি কি বলবেন এই কবিতা আশ্চর্য কবিতা, এবং বিশুদ্ধ কবিতাও বটে।

বিজয়া মুখোপাধ্যায় মূলত মগজ এর কবি, ভাষার কবি,   ভাষা সচেতনতার কবি । তাই তাঁকে বিষয়ের ভেতরেই এসে পড়ছে ভাষা, ভাষা নিয়ে কথা। মেটা ল্যাংগুয়েজের কথা এসে পড়ছে। বিষয় দিয়ে তাঁকে যদি  ধরতে নাও পারি , ভাবনার থিম দিয়ে ধরতে পারি । থিম যেগুলো বারবার ঘুরে আসছে।  বিজয়ার সবচেয়ে প্রিয়  বোধ হয় লেখা বিষয়ক, বা কবিতা বিষয়ক কবিতা অর্থাৎ কবিতা লেখার প্রসেস কে নিয়ে লেখা কবিতা।

“কিছু শব্দ অতিকষ্টে শিখেছি শৈশবে/ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তারই নিপুণ বিন্যাস/ করি, দাবি করি উচ্ছ্বসিত আহা – মরি।” ( অঙ্গীকার করো অন্ধকার)

সম্পত্তি কী নিয়ে লিখছ, বল কবিতার কী বিষয়?

-“বাংলাদেশ, শরণার্থী, সবুজের অভিযাত্রিত্রয়।’

যখন বিন্যস্ত হবে তোমার এই সাম্প্রতিকতার

ঢেউগুলি, কী হবে তখন?

  • ‘সেজন্যে তো রাখা আছে প্রকৃতির নাম ব্যবহার

গাছপালা, নদীপথ কিংবা ধর জীবন যৌবন।’

( কবিতাবার্ষিকী)

 একটি লেখা আছে “কবিতা কীভাবে হয়”  যা আমার কথাকে কিছুটা সমর্থন জোগাবে।

 ‘কবিতা কীভাবে হয়/ নিছক কবিতা/ চেহারায়, ছন্দে , অবস্থানে/ শব্দে পিরামিড কর, অথবা মন্দির, তার মানে/ একটি একটি শব্দ প্রতি লাইনে বেশি দাও/ ঋজুদেহ অথবা কৌণিক শব্দ ভেঙে অক্ষর বসাও পর পর / পংক্তি বাড়ে, – দীর্ঘকাব্যে চাই পরিসর। /…

কি বিষয় কবিতার প্রিয়?/ কিছুই অচ্ছুত নয় জেনেছ  যদিও/ তবু তবু –  স্বীকারোক্তি,  জীবন যন্ত্রণা ?…আত্মরতি অনন্বয়,  অথবা যৌনতা অথবা কবিতা কিছু বস্তু- অভিজ্ঞতা?”

এই কবিতাটি আছে “ভেঙে যায় অনন্ত বাদাম” এই বইটিতে।  “ভাষায় যেটুকু বলা যায় ” বইটির নামটিই ত এই মেটা ল্যাংগুয়েজ করে ফেলেছে। এর ভেতরেও এমন বেশ কিছু কবিতা বিষয়ক কবিতা আছে, যেমন  ‘লিখতে-লিখতে লিখতে -লিখতে’ প্রথম কবিতার নাম।

যার শেষ লাইন –  “যারা শুধু লিখতেই পারে …আসন ছাড়া, কাগজ ছাড়া,  কলম ছাড়া –  লিখতে- লিখতে লিখতে- লিখতে এক সময়ে শুকিয়ে গিয়ে মরে যায় ।”

আরেকটি কবিতা  “আমরা যারা”।  এই একই গ্রন্থে।

ভাবি, কবি যথার্থ ভিখিরি?  – এই বাক্য দিয়ে শুরু হয় কবিতা। তারপর কবি প্রশ্ন রাখেন –

 পাঠ কাকে প্রতিভা দিয়েছে? /মেধাবীকবির জায়গা এ জগতে নেই শোনা যায়।/ কবি হবে হতবুদ্ধি, উদ্ভ্রান্্‌ অদ্ভুত/ সে দেখেনা বর্ণ দৃশ্য – তার কানে গভীর কল্লোল /তার দৃষ্টি জলের পাতালে/ যে ঠান্ডায় লালচক্ষু রুই/ একান্ত গোপনে গর্ত ঢাকে, ভেতরে গর্ভের ডিম।

অন্য কবিতা “মুখচোরা মানুষ”। অত্যন্ত ভাবে এই সিরিজের উল্লেখ্য। কবিকে যথার্থ ভিখিরি অথবা মুখচোরা মানুষ ভাবার এই সচেতন আইডেন্টিফিকেশনে বজয়া অব্য র্থ।  বিজয়া বলেন,

একজন মুখচোরা মানুষ, মধ্যবয়সী। …সমস্ত ঘটনা লক্ষ করে  আর হাঁটে। রাস্তায় প্লাস্টিকবাজার, ইনজকেশন দেওয়া বাহারি ফুল, ধুলোমাখা তেলেভাজা। আর, যেন কত ডেসিবেল শব্দ? এই সব কিছু ফেলতে-ফেলতে সে যখন জলের ধারে পৌঁছয়, তার হাতে থাকে এক রত্তি বিকেল। …’

গোটা লেখাটিই অসামান্য।

বিজয়ার এই আত্মসচেতন, সেলফ রিফ্লেকটিভ, মেটা ল্যাঙ্গুয়েজের কবিতাগুলি অনবদ্য । এক ভাষা পরিচর্যাকারী হিসেবে তাঁকে চিনেছি। আমাদের খুঁতখুঁতে, শব্দ সচেতন বিজয়াদি । কৃত্তিবাস পত্রিকার জন্য তাঁর সাক্ষাতকার নিতে গিয়ে দেখেছি। দেখেছি জেনেছি তাঁর সংস্কৃত ভাষার প্রতি আদর, প্যাশন। আবার আমার কবিতায় ব্যবহৃত হিন্দি বা ইংরেজি শব্দ নিয়ে তাঁর খুঁটিয়ে আলোচনা টেলিফোনে, আপত্তি সহ, সেসব ও দেখেছি।

অক্ষর সাধক বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় লেবেল  দেওয়া যায়না। “আমি শুধু অক্ষরের দানা তোমার পায়ের সামনে রেখে আসি যদি লাগে কাজে পুঁথি পড়া কাজে”।

“প্রেম অতিথির মতো/ কখনো ঢুকে পড়ে অল্প হেসে”

তা বলে কি প্রেমের কবিতা লেখেন নি বিজয়া মুখোপাধ্যায়?

অমোঘ, অন্ধকারাচ্ছন্ন, বিষাদে স্নাত। এভাবেই প্রেমের কবিতাকে ভেবেছেন বিজয়া। জীবনানন্দীয় আবহে এই কবিতাগুলি তিনি লিখেছেন, বাংলা কবিতার সেই ধারাবাহিকতায়।

 কবিতাটির নাম হল “সঙ্গী” – আমরা যার সংগে নিত্য বসবাস করি/ তার নাম প্রেম নয়, উদবেগ। / প্রেম অতিথির মতো/ কখনো ঢুকে পড়ে অল্প হেস/সমস্ত বাড়িতে স্মৃতিচিহ্ন ফেলে রেখে / হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়। / তারপর সারাক্ষণ/ আমরা কেউ আর উদবেগ/ আমরা একজন আর উদবেগ/ বসবাস করি/ রাত থেকে দিন, দিন থেকে রাত। “

এক আদ্যন্ত সচেতন প্রেম ও অপ্রেমের কবিতা। শহুরে শিক্ষিত কবিতা। জীবনানন্দীয় কবিতাও বটে।  জীবনানন্দের আসল পরিচয় কিন্তু তাঁর ঐ অন্ধকারই।  হেমন্ত বিকেলের ম্লান আলোয় স্নাত। ওই মরবিডিটি… ওই অন্ধকার, ওই করুণ মলিন মোটর… চালিকাশক্তি, যা কবিতার ভেতরে চুম্বক স্থাপন করে, কবিতাটিকে চালায় ত বটেই, পাঠককেই চালায় কবিতাটির দিকে। অমোঘ আকর্ষণে টানে আমাদের।

লেখক ও বিজয়া

হারিয়ে যাওয়া ভাষা

শীত পড়তেই গ্রামবাংলায় শুরু “বড়ি” দেওয়ার পালা – বার্তাবাহী

যশোধরা রায়চৌধুরী

একটা স্বপ্ন দেখে প্রায়ই ঘুম ভাঙে আমার। একটা চ্যাপ্টা চৌকো উঠোন। উঠোনে অনেক রোদ্দুর। রোদ্দুরে পাট পাট করে একদিকে মেলে দেওয়া বিছানাবালিশ। ভাদ্রের রোদ্দুরে শুকোচ্ছে। রোদ্দুরের রং কাঁচা হলুদের মত। অনেক বৃষ্টি হয়ে যাবার পর বাঙ্গালায় এমন রোদ্দুর বিকশিত হয়। 

এই স্বপ্নটা হয়ত বাঙালির যৌথ স্বপ্ন। উঠোনের অন্য দিকে বিছানো আছে সাদা কাপড়ের ওপর আচার ও বড়ি । আমসত্ত্ব। হাতে করে পাকা আম আর গুড় ঘুটে সেই তরলকে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে সূর্যকিরনের মহিমার তলায়। তাইতে তৈরি হচ্ছে আমসত্ত্ব। বেতের জালি বাচাটাই বা কুলো ধামা ইত্যাদির ওপর। ফলত শুকনোর পর সেই পাতলা কালচে অসামান্য স্বাদের আমসত্ত্বের এক পিঠে খাঁজকাটা কাটা দাগ, প্যাটার্ন তৈরি হয়েছে। ছিঁড়ে ছিঁড়ে সেই আমসত্ত্ব খেতে হয়। চুরি করে খেতে বেশি মজা। 

বাঙালি এখনো স্বপ্ন দেখে সেইসব কাচের বয়ামে রাখা পাতলা সাদা থান কেটে মুখ ঢেকে বাঁধা আমতেলের। স্বপ্নে দেখে। আচার খায় এম টি আরের, আর ভাবে মায়ের বা ঠাম্মার বা দিদার তৈরি আচারের কথা। 

আমার স্বপ্নের এই উঠোনটা কোথাও নেই , ছিল না। এ শুধু অল্প করে গল্পে পড়া। রাণী চন্দের “আমার মায়ের বাপের বাড়ি” গল্পে পড়া। আমার দিদার , মায়ের স্মৃতিচারণে শোনা। আমার দিদার বাড়িতে উঠোন ছিল না ছাত ছিল, তবে দিদুর সে ছাতে উঠে যাওয়া সম্ভব ছিল না বিশেষ। ষাটোর্ধ দিদুকে পেয়েছি তবু এই কাল্পনিক উঠোনের কেন্দ্রে। 

আসলে স্মৃতি ত ভাষাবিশ্বও। দিদুর কথা থেকে সেই বিশাল সুন্দর কাল্পনিক পরিবারের কথা আমার প্রজন্মে চুঁইয়ে এসেছে। 

দিদুর গল্পে সদ্য বিবাহিত দিদুকে ঢাকার ডাক্তারের পরিবার থেকে বরিশালে আসতে হয়। আর আত্মীয়ারা যখন ঘিরে ধরে ঘোমটা সরিয়ে নব্যবধূর নাক চোখ ইত্যাদি পরীক্ষা করছেন, গায়ের রং পরনের কাপড়ের কোণ পাকিয়ে তা দিয়ে রগড়ে দেখছেন আসল না পমেটম মাখা, অথবা শাড়ির খোল ধরে পরখ করছেন অথবা ডাক্তার মানে বড়লোক বাবা কত গয়না দিয়েছেন তা দেখছেন, তখন ধনিকন্যাকে এক বিদগ্ধ পিসশাশুড়ি বলে ওঠেন, শোন মনু, এইহানে লুসিপুরি জোটবে না, মুরিসিড়াই খাইতে অইব। অর্থাৎ বাপের বাড়িতে যত খুশি লুচি পুরি খেয়ে এসেছ বটে, এখানে সেসব পাবে না। মুড়ি আর চিঁড়েই খেতে হবে। 

দিদুদের গল্পে থাকত খাটের তলায় জমানো রাশি রাশি নারকেলের কথা। রাশি রাশি আমের কথাও। যে ঋতুর যে ফসল, যে ফল, সেসব এসে জড়ো হত, জমা হত খাটের নিচে। কাঁঠাল খাবার পর জড়ো হত কাঁঠালের বীজ বা আঁটি। আর তা নিয়ে তোইরি হত জমজমাট গল্প। কাঁঠালের আঁটি প্রথমে শুকিয়ে তারপর উনুনের নিচের ছাইয়ের মধ্যে মরা আঁচে ভাজা ভাজা করে, অথবা শুকনো কড়াতে টেলে বা খোলা ভাজা করা হত। তারপর সেগুলো হয়ে যেত যখন তখন খাওয়ার জিনিস। 

আমাদের আজকের ভাষায় স্ন্যাকস। 

দিদুর গল্পে আছে এইসব ও। ওদের যৌথ স্মৃতির বিষয়ীভূত যা যা। বাচ্চা ছেলে, জেঠিমার কাছে এসে কাঁঠালের আঁটি চেয়েছে খেতে। জেঠিমা ব্যস্ত , বলেছে জ্যেঠার কাছে চাইতে। বাচ্চা বলেছে, জ্যাঠা শালায় ত দিল না। জ্যেঠিমা ক্ষিপ্ত। বলেন, জ্যাঠাকে শালা বলিস? যা প্রণাম কর গিয়ে। প্রণাম করা হল সে ভাষায় “হোগা উপুত করে হ্যাবা দেওয়া”।  হে অর্বাচীন পাঠক, এখানে হোগা পশ্চাদ্দেশ এবং হ্যাবা সেবা বা প্রণাম। 

“জেডিমা লো জেডিমা মোগে এউগ্যা কাডালের আডি দে 

চা গিয়া তোর জ্যাডাড্ডে হে হালায় ত দিলে না

জ্যাডারে কও হালা

হোগা উপুত কইরা হ্যাবা দে হ্যাবা দে”

এটা পড়ার সময় জ গুলো সব z  উচ্চারণ হবে। 

দিদুদের ভাষাবিশ্বটাও লোপাট হয়েছে তাদের বসবাস, তাদের ব্যবহারিক অভ্যাসের মত। তাই, ভাদ্রমাসে বৃষ্টি থেমে একটা দিন যখন শুকনো হয়, রোদ্দুর হয়ে ওঠে, যখন টেনে টেনে ভাল শাড়ি, সব বিছানা বালিস ওই কাল্পনিক উঠোনটায় এনে ফেলতে হয় , রোদ্দুর খাওয়াতে হয়, তখন বলতে হয়, “ওরে আজ বেশ খরা করেছে। সব রোদে দে রে। ” বা “খরা হইসে দেইখ্যা,  সব টাইন্যা বাইর করলাম, এখন দ্যাখো কী আজাইরা কান্ড, আবার মেঘ কইর‍্যা আইল!

এখন মনে হয় আমাদের এসব ভাষা হারানো দিদুর তৈরিপুরনো জমাট বাঁঢা উলের জামা দিয়ে বানানো শতরঞ্চিটা হারিয়ে ফেলার থেকে বেশি দুঃখের। দিদুর প্রিয় কথাগুলোর একটা ছিল লান্ডিভাস্যি। কোনকিছু ঘেঁটেঘুঁটে ফেলা , গুবলেট করে ফেলাকে বললত লান্ডিভাস্যি করে ফেলা। এই গত পরশু শব্দটা আমার কাছে ফিরে এল বাংলাদেশের এক জনপ্রিয় ফুড চ্যানেলের বক্তার ভাষায়। পোলাওটা ফ্রাইং প্যান ধরে ধরে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে মশলার সঙ্গে মেশাতে হবে, সেই কথাটা বোঝাতে গিয়ে বক্তা বললেন , আপনারা আবার হোটেলের শেফের মত কইর‍্যা এইটা মিশাইতে গিয়া বেশি ঝাঁকাইয়া লান্ডিভাস্যি কইর‍্যা ফেলবেন না য্যান। 

শব্দটা শুনে মাথার মধ্যে ঝনঝনিয়ে ফিরে আসে সেইসব দিদু দিন। খাটের ওপর বসে নির্দেশ দিয়ে দিয়ে দিদু সবাইকে দিয়ে কাজ করাতে পারতেন। ফরসা, নরম , থলথলে তার বাহু, আমি সেই নরম হাত ময়দার মত চটকাতাম। পুজো হবে ঘরে, সরস্বতী বা লক্ষ্মীপুজো, ঘর ধোয়া দেওয়া হত, মুছে আসন পাতা হত, বড় বড় পাথর কাঠের বারকোশ আর তামার পরাত নামান হত। পুরনো চটে যাওয়া, জরি কালো হয়ে যাওয়া বেনারসি শাড়ি বের করে টাঙিয়ে দেওয়া হত ব্যাকগ্রাউন্ডে। তারপর ছোট ঝাপসা হয়ে আসা ক্যালেন্ডার থেকে কেটে বের করা দেবী চিত্রের পট রাখা হত। 

মা চালের গুঁড়ো গোলা বা কথ্যভাষায় পিটুলি গোলা দিয়ে আল্পনা দিচ্ছে, ফুলছড়া, লতাপাতা, কলকা। আল্পনাটা একটা জ্যান্ত বস্তুর মত, জীবন্ত লতাগাছের মত গড়াতে গড়াতে ফর্ম নিচ্ছে, শেপ তোইরি হচ্ছে। নিখুঁত সিমেট্রি বা প্রতিসাম্য নেই সে আল্পনায়। গাছের ডালের মত ছড়াচ্ছে । গোল হয়ে আবার এদিকে ওদিকে আঁকড়া বা শুঁড় বের করে আনছে। সেই আল্পনা যতদূর যায় ততদূর পাতা হয় থালায় থালায় কাটা ফল মূল, গোটা পঞ্চফল, মিষ্টির পাত্র, থালা, পরাতে ধানদুব্বো, কোশাকুশিতে গঙ্গাজল…লক্ষ্মীপুজোয় বাতাবি লেবু মাখা, রান্না করা লুচি মোহনভোগ, দই খই, বাতাসা, চিনির মঠ। 

কোনকিছু লান্ডিভাস্যি হয়না দিদুর পৃথিবীতে। সব চক্রাকারে সুসমঞ্জস সুষমায় থাকে। 

বাঙাল শব্দ বা কথা আজো অনেক স্মৃতি টেনে আনে। ঘর দোর নোংরা করে রাখলে মা বলতেন গু গু কইর‍্যা রাখস। 

এ দেশিদের হেগো শব্দের প্রতি প্রীতি সর্বজন বিদিত। নোংরা করে রাখা ঘরকে হেগোডাঙা বলা হয় পশ্চিম বঙ্গের ভাষায়। হাওড়ার মানুষ, বলেন, হরি বল মন রসনা, খেজুর গাছে পোঁদ ঘোষো না, ঘষতে ঘষতে পড়বে রক্ত, তবেই জানব হরিভক্ত। ও বাংলায় হোগা প্রচলিত আর এ বাংলায় পোঁদ। কোনটাই বিশেষ সু উচ্চ ও সুসামাজিক মান্য ভাষা নয়। এমন কথা শব্দ, কত কথা তবু, হারাচ্ছে আমাদের ভাব ভাষা কথনবিশ্ব থেকে। 

দিদুর বাড়ির আরেক গল্প মনে পড়ল। এক দল আত্মীয় দূর পরবাস থেকে বেড়াতে এসেছিলেন সে বাড়িতে। আত্মীয় বা জ্ঞাতি, কিন্তু ততটা উচ্চবিত্ত নন, হয়ত অভ্যাসে ততটা পরিশীলিত নন। হয়ত নোংরা তারা। মাথায় উকুন বা গায়ে খোসপাঁচড়াও থাকতে পারে, হয়ত ছারপোকাও দু একটা। 

তা বেশ কিছুদিন বাড়িতে থেকে তাঁরা যখন চলে গেলেন শেয়ালদায় ট্রেন ধরতে,  প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দিদা বিশাল উনুনে বিরাট ডেকচিতে সোডার জল ফুটিয়ে তাঁদের ব্যবহৃত যাবতীয় বিছানার চাদর বালিশের খোল, লেপের ওয়াড় সব ভিজিয়ে দিতে নির্দেশ দিলেন। আর বাকি বিছানাগুলো টেনে টেনে ছাতে নিয়ে রোদে দেওয়া হল। 

ঘন্টাখানেক এসব কর্মযজ্ঞ চলছে , ইতিমধ্যে সেই তাঁরা ফিরে এলেন। শেয়ালদায় গিয়ে বসে থাকার পর জানা গিয়েছে তাঁদের ট্রেন বাতিল। আবার পরদিনের সেই ট্রেনে চাপতে হবে। 

ফিরেই তাঁরা হাঁ। এত এত বিছানার চাদর কাচা হচ্ছে, সোডা সাবান ফোটানোর গন্ধ চারদিকে, আর রোদে পড়ে আছে ন্যাড়া ন্যাড়া সব তোষক বালিশ!

বাড়িতে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। অদ্ভুত লজ্জাকর পরিস্থিতি একেবারে!

এসব হল বাঙালির ইদানীং -কার “ভাইরাস ভীতির” বহু আগের কথা। যখন বাঙালি রাস্তা থেকে এসেই রাস্তার কাপড় ছেড়ে ফেলত। সবাই সাবান কাচত বাইরে থেকে আনা কাপড় চোপড় ছেড়ে। আর হাত পা ধুত এক ঘন্টা ধরে ঘরে ঢোকবার আগে। ব্যাকটেরিয়ার নাম না শুনলেও, কলেরা ওলাউঠো প্লেগ আর জাপানি ইনফুলুয়েঞ্জা ম্যালোরির জ্বর এসবের ভয়ে কাতর বাঙালি। ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়। নোঙরা ও গু গু হয়ে যাবার ভয়। 

এই সেদিন পরশপাথর ছবিতে দেখলাম সন্ধেবেলা বৃষ্টি ভিজে আসা পরেশবাবু ওরফে তুলসী চক্কোত্তিকে বলছেন তাঁর গিন্নি, শুনছি কোথা থেকে একটা জাপানি ইনফুলুয়েঞ্জা এসেছে, অবেলায় ভিজে এলে? এখন যদি জ্বরজারি হয়?

এই সব পুরনো কথা এখন বড় উষ্ণতা আনে, ওম আসে জীবনের বিশাল এক পর্বের।

খ্যারেকুটে আগুন দিয়া পেত্নি বইসে আলগুসাইয়া

আমাদের মাতামহী , প্রমাতামহী, তাঁদের সমস্ত রকমের আত্মীয়াদের ভেতরে পরস্পরের বিষয়ে কূটকচালি করে, এ ওর নামে কুকথা বলে, লাগানিভাঙানি দিয়ে মহাকান্ড বাঁধাতেন। আর এই যে নানা জনকে নানা রকম কথা বলে অন্যদের মধ্যে নিপুণভাবে ঝগড়া লাগিয়ে দিতে পারা, এই গুণটি যাদের থাকে, তাদের সম্বন্ধেই ওই উক্তিটি করা হয়ে থাকে। খ্যারেকুটে মানে কাঠকুটো বা খড়কুটোয় আগুন দিয়ে, পেত্নী আলগোছে আরাম করে বসে থাকে আর আগুনের শোভা দেখে। অন্যদের নারদ নারদ বলে যুদ্ধ লাগানোর যে কোন পরিস্থিতিতেই এ কথা  যে প্রযোজ্য, তা আশাকরি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। 

চীৎকার আর কাতরোক্তির মধ্যখানে যে আর্ত রব, তাকে বাঙাল রা বলতেন , কুওইর পাড়া। কেউ জোরে কেঁদে উঠলে, বলাই বাহুল্য সে মেয়ে, চীৎকার করে ঝগড়া করলে বা ডাকাডাকি করলে, মায়েরা অবলীলাক্রমে বলতেন , কুওইর পাড়তাসস ক্যান?

এইসব গল্প লতায়পাতায় আমাদের কাছে চলে এসেছে। আমার কাছে এসেছে। আজ আর এসব কথা বাতাসে ভাসে না। তবু ভাবখানা অসীম ও অনন্তে, চিরন্তন ভাববিশ্বে ঝুলে আছে। 

যেমন আমাদের আরেক বন্ধুর দিদার কথাগুলি মন থেকে যায়না।  বাগবাজারের সেই দিদা প্রতিদিন সকালে রাশি রাশি মুড়ি আর আলুর চপ দিয়ে জলখাবার করতেন। একদিন হঠাৎ অনুভব করলেন আলুর চপে স্বাদ পাচ্ছেন না সেভাবে। বয়সের সঙ্গে ক্রমশ জিভের তার চলে গেছে। 

দিদা বলে ওঠেন,  আলুর বড়াটা ঘুইঁট্টা ঘুইঁট্টা লাগে যে। 

ঘুঁটের মত স্বাদ হীন হয়ে যায় যখন আলুর চপ, জীবন যখন শুকায়ে যায়, সেই মধ্যবয়সে উপনীত , পঞ্চাশোর্ধ আমিও অনুভব করেছি, অধিকাংশ খাদ্যে স্বাদ নেই তেমন। শুধু খাদ্য কেন, এই সব জীবিত বিষয়েই আকর্ষণ কমে যাচ্ছে কি ? জীবন কি সত্যিই ঘুঁইট্টা ঘুইঁট্টা লাগে না আজকাল?

রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা – অণু ঔপন্যাসিকা

রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা 

 

 

 

 

 

 

 

 

পাত্রপাত্রী পরিচয় ঃ

নায়ক নায়িকা-

শশধর বাবু, জেন্ডারে নারী কিন্তু আত্মায় রবিনসন ক্রুসো, বসবাস কর্মস্থল ভুবনেশ্বর, ও

তাঁহার পরিবার পরিজন, কলিকাতাস্থ বাটীতে। ঘনিষ্ঠ তম আত্মজন “জাতিস্মর” মহাত্মা তৃণ, (কেন জাতিস্মর কিছু পরে জানা যাইবে), দার্শনিকতায় প্লেটো বুদ্ধ ও উইটগেনস্টাইনের যোগফলকে তিন দিয়া ভাগ করা এক্স ফ্যাক্টর , ও স্বীয় অস্থিমজ্জার অংশ কোকিলাবেন, বিংশতিবর্ষীয়া, সবুজচুলো পিক্সিকাট।

পার্শ্বনায়ক –

কেন্দ্র সরকার

ওড়িশা সরকার

পশ্চিমবংগ সরকার

( এই তিন চরিত্রই আসল, নায়ক নায়িকা দেব কোয়েলের ন্যায় ডিস পেন্সেবল। পার্শ্বনায়ক রা কখনো পরিত্রাতা কখনো ভগবান কখনো ভিলেন। কেহ রজতাভ কেহ কমল মিত্র কেহ ছায়া দেবী। ইহাদের আকর্ষণেই হল ভর্তি হয়)

মূল প্রতিনায়িকা – ক্রুয়েলা ডেভিল করোনাদেবী

পশ্চাদ্ পটঃ

ডিসেম্ব্র ১৯ থেকে করোনাদেবীর আত্মপ্রকাশ , চিনা মাতা নামেও ইনি সুপ্রসিদ্ধা ও করালবদনা। ইনি এমন সর্বস্ব ধ্বংস কারিকা যে শশধরা বাবুও স্মৃতিভ্রষ্ট হইয়া এঁর নাম করতে ভুল্যা গ্যাসেন প্রথম ড্রাফটে। এর ভয়ে থরহরি কম্পমান দ্যাবা পৃথিবী। তবে এই মাতাকে তুষ্ট বা নষ্ট করার নানা উপায় থাকলেও বিবিধ উপায়ের মধ্যে শঙ্খ ঘন্টা আদির পাশাপাশি তালাবন্দি বা লকডাউন নামক এক বিধান আছে। ভারত এই তালাবন্দি বিধান চিরকাল বিশ্বাস করেছে। উদাহরণ – ভুলভুলাইয়া নামক হিন্দি চিত্র। (অক্ষয়কুমার শোভিত। )

 

 

পর্ব ১

 

 

লকডাউন ভার্শান ১.০ ছিল, ২৪ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল অব্দি। ভদ্রমহোদয়গণ আপনাদের স্মরণে থাকবে যে তার আগে ২২ মার্চ ছিল জনতা কারফিউ ও থালা বাজানোর মওকা। ওড়িশা সরকার, নবীন বাবু, ২১ রাত থেকেই রাজ্যের লকডাউন ঘোষণা করেছেন। শশধরবাবু নবীন প্রশস্তি গাহিলেন। জানেন না ইহাই বাঁশঝাড় হইবে কিয়দ্দিন পর।

তার ও আগে ১১ মার্চ দোল যাত্রার ছুটি কাটিয়ে ফিরে গিয়েছেন শশধর ভুবনেশ্বর। করোনাভীতি তখন তুংগে এবং ওয়াটস্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম বিবিধ ষড়যন্ত্র তত্বে পরিপূর্ণ। ২২ হইতে,  মিডিয়া চীৎকৃত করোনাভয়প্রচারক প্রোগ্রাম সমূহে পরিপূর্ণ। অথচ বাগিচা কোকিল দোয়েলের চীৎকারে গুঞ্জিত। আশ্চর্য বৈপরিত্য। আঙিনায় ময়ূর নাচানাচি করিতেছে নানা শহরে, চিতাবাঘ রাস্তা পার হইতেছে নির্ভয়ে। অথচ বাঘা সরকারি কর্মীরা সব বাড়িতে বন্দী। wfh শব্দবন্ধ খুব টি আর পি পাইল। উহা প্রায়শই গুলাইয়া যায় যে শব্দবন্ধের সহিত তাহার অর্থও অতি নিকটবর্তী। তাহা wtf.!!!!!!

শশধরের এদিকে একাকিত্ব, ওদিকে অনিশ্চিতি। এক বৎসর আগের ফণির দিন মনে পড়া অনিবার্য।

তফাত এই যে বিজলিবাতি ও নেট আছে। নেট অবশ্য ঠিকে ঝির মত আসা যাওয়া করে এবলা ওবলা।

রবিনসন ক্রুসো সত্ত্বা তুংগে। রোজ নব নব আবিষ্কারে মত্ত শশধর। কিছু ফেলা যাবে না, অল্পে সন্তুষ্ট হতে হবে। রাঁধাবাড়া দারুণ এক্সপেরিমেন্টাল। লাউ দিয়ে মাংসের ঝোল রাঁধা বা বাগানের বিবিধ ছেঁড়া ফাটা ফল মূল, শেষ বেলার পালং আর শীর্ণ ইঁচড় দিয়ে কাজ চালাবেন। সব জিনিস রোদ্দুরে এনে ফেলবেন।

শুধু রাত্রে ঘুমে আলুর ট্রাকে চেপে কলকাতা পালানোর স্বপ্ন দেখেন। ট্রাক ড্রাইভারের হেল্পার সেজে বা আলুর বস্তার তলায় লুকিয়ে।

এদিকে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। দুপুরে ভীত ও বাসন মেজে ক্লান্ত দেহে যখন শোব শোব ভাবছেন, দিল্লি ফোন করে বলছে অডিট রিপোর্টে কী কী ঢুকবে তার তালিকা পাঠাতে।

এদিকে বিষের সংগে খোঁজ নেই। ওদিকে কুলোপানা চক্কর। ফিল্ড ফর্মেশন সব বন্ধ। নো অডিট পার্টি। কারণ ওড়িশা সরকার সম্পূর্ণ লকডাউনে। যেখানে মূল ক্রিয়াকর্ম বন্ধ সেখানে তার অডিট হবে কী!!

 

 পর্ব ২

 

এই উপন্যাসের ভাষা ও ভাব হাস্য রস সিঞ্চিত কেন, অনেকে প্রশ্ন তুলিতেছেন। তাঁহাদের নিকটে আমার প্রশ্ন, স্বনামে, পাত্র পাত্রীকে নির্দিষ্ট করিয়া লিখিলে অনেকের গুসসা হইবার সম্ভাবনা, সরকারি চাকুরেমাত্রই জানেন কন্ডাক্ট রুলে আটকাইবে। হাস্যকৌতুকের বর্মাচ্ছাদন বড়ই সুবিধাজনক। সহজে ক্যাঁক করিয়া ধরিবার পূর্বেই পাখি পলাইয়া যায়। উপরন্তু ইতিমধ্যেই শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় থাকা পাঠকের আপাত মুক্তি ঘটে। 

 

এই আপাত কৌতুকের অন্তরালে কী প্রচন্ড দুর্বহ দৈনন্দিনতার পাঁচালি আছে তাহা গুণী ও সহৃদয় মাত্রেই বুঝিবেন। 

 

যাহা হৌক, মূল গল্পে প্রবেশ করা যাউক।  মূল গল্পে দেশ কাল ও আমাদের পাত্রপাত্রীরা এমন ভাবে জড়াইয়া আছেন যে কোনটা পার্সোনাল কোনটা পলিটিকাল বোঝা যাইতেছে না। 

 

২১ মার্চ থেকে রাজ্য ও কেন্দ্রের লকডাউন লকডাউন খেলা শুরু হল। প্রথমে রাজ্য বলে টুকি, আমি করে দিলাম বন্ধ আমার সকল দরজা, খুকি!

 

তখন কেন্দ্র বলে তাইত, রাজ্য বলছে চাইনা যাতায়াত। তবে থাকুক ট্রেন বন্ধ আর বন্ধ হোক বিমান গতায়াত। একে একে সমস্ত বন্ধ হল, গাড়ি ঘোড়া, বাইক, ট্রেন , প্লেন।  ফাঁকা রাজপথে ক্রিকেট খেলাও। 

 

একটি মিডিয়া রিপোর্ট বলিতেছে  ভারত আবার লাইসেন্স রাজে ফিরিয়া গিয়াছে। ২০২০ ও করোনামাতা আমাদের সমূলে বর্তমান হইতে উৎপাটিত করিয়া অতীতে নিক্ষেপ করিয়াছে। এখন আবার তেলের লাইন জলের লাইন পাউরুটির লাইন। রেশনের জন্য অধীর অপেক্ষা ইত্যাদি। বাজারে আজ রুটি আছে ত মাখন নাই। কাল মাখন আসিলে তাহা পাঁচশো গ্রামের প্যাকেট । একশো গ্রাম চাহিলে উপায় নাই। তিনশো টাকায় বড় প্যাকেট ই লইতে হইবে। 

 

একটি হিসাব বলিতেছে , মার্চ হইতে ৬৬০ টি সরকারি বিজ্ঞপ্তি আনিয়াছে কেন্দ্র সরকার। এবং ৩৫০০ সরকারি বিজ্ঞপ্তি সবকটি রাজ্য সরকার মিলিয়া। শশধর বাবুর স্মরণে আছে যে উড়িষ্যা সরকারের বিজ্ঞপিপত্র প্রায় পর্বতপ্রমাণ, এবং কেন্দ্র সরকারের ততোধিক। এই সব তাঁহার মোবাইল ফোনে ওয়াটস্যাপ মাধ্যমে আসিয়া তাঁহার মোবাইল ক্র্যাশ করিয়া দিয়াছে একাধিক বার। 

 

করোণামাতার কৃপায় ডাবলিং রেট শব্দটি অতি প্রচল ইদানীঙ। আজ যতজনের করোণাকৃপা ঘটিয়াছে, তার ডবল বা দ্বিগুণ জনের করোনা আক্রান্ত হইবার মধ্যে কটি দিনের ফারাক? ইহা দ্বারা গণৎকারগণ পাটি পাতিয়া বলিয়া দিতেছেন কতদিনে ভারতের সব লোক আক্রান্ত হইবে। 

 

তা, শশধরবাবু ও তাঁহার বন্ধু জামিলা কামিলা সোপ্রানো নন্দানো প্রমুখ প্রায়ই আলোচনা করেন, যে, সরকারি বিজ্ঞপ্তির ডাবলিং রেট করোনার ডাবলিং রেটের অধিক দ্রুত। তিন চার দিনেই ডবল হইতেছে। 

 

২১ দিন দ্রুত কেটে গেল রবিনসনগিরি করতে করতে। গাছ থেকে আম পেড়ে সেই আম কেটে খর রোদে দিয়ে সেই আমকে আচারে পরিণত করা হল। তারপর  ইঁচড়ের পরোটা, ছোলার পায়েস ইত্যাদি বানানো হল। প্রচুর কেক বেক করা হল, প্রচুর অমূল্য দুধের গুঁড়ো আর কনডেন্সড মিল্ক ধ্বংস করে পিঠা বানালেন শশধর, তার অর্ধেক এত ভুলভাল হল, যে ইঁটের মত শক্ত, খাওয়াই গেল না। 

 

ইতিমধ্যে বংগ সরকারের নিন্দায় কান পাতা যায়না। ছায়াদেবী প্রথমে প্রশংসা কুড়ালেন তারপর নিন্দা । কেননা তিনি মিষ্টির দোকান খুলে দিয়েছেন, এইদিকে মহিলারা এতদিনে রসগোল্লা ঘরে বানানোর আর তার ছবি দেবার কম্পিটিশনে ব্যস্ত ফেসবুক জুড়ে। 

 

ক্রমশ সংখ্যা বাড়ছে আক্রান্তের । ক্রমশ কাছে আসছে  মৃত্যুর পদধ্বনি। গাঢ় থেকে গাঢ়তর পোঁচে আঁকা ছবিগুলিতে এবার পড়ছে নানা রং। হয় করোনা নয় ক্ষুধায় মরো না, বলে এক পালা খুব ভাল কাটতি পাচ্ছে। লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক বাচ্চাকাচ্চা সহ হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিতে পথে নেমেছেন, তাঁরা কেউ লাঠির বাড়ি খাচ্ছেন, কেউ জল খাদ্যের অভাবে ঝরা শিউলির মত শুকিয়ে ঝরে পড়ছেন পথে পথে। 

 

শশধরবাবুর নিজের খাস আর্দালি যেদিন শশধরবাবুর জন্য ডিম কিনতে গিয়ে পুলিশের লাঠির বাড়িটি খেয়ে আসতে পারল না, সেই দিন শশধরবাবু প্রথম কেঁদে ফেলল। ফোন করে মহাত্মা জীবনবান্ধবকে বলল, আমি ত আর পারিনা!

 

আর কত সেলাই করা, আর কত আমের আচার! আর কত কাব্য লেখা, খবরে মজুর মৃত্যুর ছবি দেখা। ডিনায়াল মোডে আছি। কিন্তু আর ত সয় না প্রাণে! সখা হে আমাকে উদ্ধার করহ। 

 

 পর্ব ৩

জীবনবান্ধব বলিলেন, রোসো। রুশো কী বলিয়াছেন শুনহ। আর কনফুসিয়াস ও, বুদ্ধও, বলিয়াছেন বর্তমানে বাঁচ। একটি করিয়া দিন কাটাও।

শশধর কহিলেন – না আ আ আ আমি এখন দর্শন শ্রবণ করিব না। আমি বাড়ি যাব। ভ্যাঁ ভ্যাঁ ভ্যাঁ।

জীবনবান্ধব মহাত্মা মানুষ। বলিলেন, ধৈর্যং রহু। আর, তোমার ত তিন বছরের পোস্টিং বিগত প্রায়। আর কদিন ই বা তোমাকে রাখিবে কেন্দ্র। তুলিবেই ত! কাজেই সেই কয়দিন দাঁতে দাঁত দিয়া থাক। দুপুরে নেটফ্লিক্স ও রাতে আমাজন প্রাইম দেখ।

ইতিমধ্যে ক্রাইসিস ঘনীভূত। সমস্ত দেশের অর্থনীতি এক মন্দা আক্রান্ত অবস্থায়। কে না জানে যে মন্দায় ধর্ম, দর্শন, গুরুবাদ ও হিন্দি সিনেমার কাটতি হয়।

ধার্মিকগণ  বলিল,  ভিন্ন ধর্মের সব দোষ। করোনামাতা কুপিতা না হইবেন কেন, বলিতে লাগিল সনাতন ধর্মের লোক আড়চোখে অপরকে দেখিয়া। যেকোন বিধর্মীকে দেখিলে করোনাদুষ্ট ভাবিতে শুরু করিল সবে। যে কোন চিনাচেহারার উত্তর পূর্বাঞ্চলীয়কেও।।কোন বহিরাগতকে দেখিলে সন্দেহ। যে কোন ডাক্তার নার্স কে গৃহ হইতে তাড়ানো। এইসব হইতে লাগিল। মানে মনুষ্য সমাজের যত আদিম সদ্‌ গুণ ছিল সব উদ্ভাসিত।

লকডাউন ভার্শান ১.০ থেকে ক্রমে আমরা লকডাউন ভার্শান ২.০ তে আসিলাম৷ এবার মোমবাতি হাতে ধরাইয়া ৩ মে অব্দি এক্সটেন্ড। পথ দেখাইলেন নবীন বাবু। তাঁহার চার কোটির রাজ্যে তখন সংখ্যা ৮৫ হইতে ৯০। কী বিশাল লাফ!! সুতরাং তিনি গলা বাড়াইয়া বলিলেন টুকি, লকডাউন বাড়িয়ে দিলাম এবার বেরোও দেখি!

কেন্দ্র সুযোগ পাইয়া, রাজ্য চাইতেছে রাজ্য চাইতেছে বলিয়া ভীষণ রাজ্যদরদি হইল। এদিকে শশধর মূর্খের মত ১৭ এপ্রিলের প্লেনের টিকিট জীবন বান্ধবকে না জানাইয়া কাটিয়া বসিয়া আছে। ফাঁকেতালে ক্যান্সেল। ইতি পূর্বে আরেক সেট ২৭  মে-র টিকিট ক্যান্সেল হইয়াছিল। 

 শশধরের ন্যায় মূর্খ কি আর আছ? ওই কয়েক কোটি ভারতবাসী যাহারা রেলের টিকিট কাটিয়াছিল বাড়ি যাব বাড়ি যাব বলে৷ ১৪ এপ্রিলে।  তা কী ক্যান্সেল হয় নাই?

দুর্জনে বলিয়া থাকে,  মাত্র ৬৭ কোটি টাকা নাকি রেভিনিউ করিয়া ফেলিয়াছে রেল  কোম্পানি সবার কুড়ি টাকা ক্যান্সেলেশন ফি কেটে। সব বাতিল।

মুম্বই স্টেশনে সেই মূর্খ ভারতবাসী, খাটিয়া খাওয়া ভারতবাসীর কী হইয়াছিল, দেখেন নাই?  ভিডিও দেখিয়া লইবেন।

পর্ব ৪

সুতরাং ভালোই বন্দোবস্ত হইল। একবার করিয়া লকডাউন এক্সটেনশন হইবে, শশধর ডুকরাইয়া উঠিবেন, মহাত্মা তাঁহাকে আশ্বস্ত করিবেন গীতার নিষ্কাম কর্ম বলিয়া, ইতোমধ্যে সরকার বাহাদুরের অপরূপ দূরদৃষ্টির ফলে আরো কটা মজুর মরিবে এবং আবার হা হুতাশে পাড়া মাত।

যেন কলে চাপা পড়িয়া,  না খাইয়া,  আলুর ফলন খারাপ হইয়া বা ঋণ না শুধিতে পারিয়া আগে মানুষ মরে নাই। শশধরদের দরদ যেন কতই ছিল। ইতিমধ্যে  মধ্যবিত্ত বাঙালি  পূর্ণিমা চাঁদ ও ঝলসানো রুটির ছবি সাঁটাইতেছে কিন্তু  ফুল স্যালারি গোটা এপ্রিলে কাজ না করিলেও  কাজের লোককে দিতে হইবে ভাবিয়া বুক ফাটাইতেছে। কতজন এই দুঃখ সহিতে না পারিয়া  লোক পুনর্বহাল করিলেন। এদিকে কত উচ্চ পদস্থ স্যালারিড ব্যক্তির স্যালারি হইল না। 

আবার কত লোক একের পর এক স্ত্রীঘটিত জোক্স বানাইয়া বাজারে ছাড়িয়া দিলেন। কত লোক বিবিধ প্রতিষ্ঠানে অভাবী বেরোজগারের জন্য  নিজ দানের পরিমাণ লিখিয়া পেশ করিলেন।

মহাত্মা বলিলেন৷ হে শশধর, শ্রবণ করহ। তুমি খাইতে পাও, মাথার উপর অটুট ছাত বর্তমান। স্যালারিও পাইলে। ক্রন্দন তোমাকে সাজেনা। তোমার ন্যায় প্রিভিলেজপ্রাপ্ত বাড়ি যাব বাড়ি যাব ক্যান করে?

দিল্লি ধুয়া ধরিল, ক্যান করে? ক্যন করে?

ওদিকে দিল্লি তলব দিল। ভিডিও কনফারেন্সে আইস। আপিস খুলিতে হইবে। আপিচর গণ পুরা ও স্টাফগণ ৩৩% আসিবে। লকডাউন ভার্শান ২.০ জগত মধ্যে সর্বাপেক্ষা  কর্মময় লকডাউন বলিয়া ঘোষিত প্রতিষ্ঠিত ও খ্যাত হইবে। তোমার সকালে বাসন মাজা ও ঘর মোছার পরে তুমি অফিসে গিয়া কাজ বা কাজের ভাণ করিবে, মুখোশের আড়াল হইতে কথা বলিবে ( জানি, এতদিন ও তাহাই বলিতে, রূপককে আমরা বাস্তব করিলাম মাত্র) ও ফিরিয়া আসিয়া সব জামাকাপড় গরম জল সাবানে দিবে।

ফুল স্যালারি পাও, বাড়ি যাব বাডি যাব করিবে না। অত্যন্ত এক্সট্রা অর্ডিনারি সারকামস্ট্যান্সেস না হইলে লকডাউনে কেহ ছুটি নিবে না। আর যাহারা যাহারা ছুটিতে ছিলে তাহারা ছুটিতেই থাকিবে।

এমতাবস্থায়, শশধরের সহকর্মিনী বাঙালিনি সেই যে ছুটিতে কলিকাতা গিয়াছিলেন, তিনি আর ফিরিতে পারেন নাই। সেই আপিসের চার্জ শশধরকে আগে ৩ মাস দেখিতে হইয়াছিল, পরে আরো কতদিন দেখিতে হয় কে জানে। নিজেকে ভারবাহী গর্দভের ন্যায় মনে হইতেছে। সহকর্মিণীর প্রতি ঈর্ষা তুঙ্গে উঠিয়াছে। 

শশধর স্বপ্নে ভুয়া মেডিকাল সার্টিফিকেট দেখিতে লাগিলেন। দেখিলেন তাঁহার মাথার টিউমার বা পেটে কষ্টিপাথর বা যাহা যাহা মনুষ্যের চোখে দেখা যায় না তাহাই হইয়াছে বলিয়া ডাক্তার লিখিয়া দিয়াছে ও তিনি অ্যাম্বুলেন্স ম্যানেজ করিয়া কলিকাতার পথে।।।

কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সের কথা ভাবিলেই বুক ধড়ফড় করে। করোনামাতার দয়া যদি ছিটেফোঁটা থাকে উহাতে?

আর, গেলেও আবার ছুটি অন্তে ফিরে আসতে ত হবে!! তাহলে!!

 

 পর্ব ৫

ধৈর্যচ্যুতি ঘটিতে পারে তাই বার বার লকডাউনের দিনপঞ্জি লিখিতে চাহিনা।

সবার যে একভাবে লকডাউন পালন হয় নাই কে না জানে। প্রিভিলেজ এর ব্যাশকম আছে। কিন্তু লক্ষ করলে নিশ্চিত দেখা যাইবে যে কোটাপুরণ সকলের হইতেছে।

যথা, কোকিলাবেন কোনদিন গৃহকর্ম করে নাই। তাহার অভ্যাস হইয়া গেল ঘর মোছা। মহাত্মা কোনদিন বাসন মাজেন নাই। তিনি এখন সাবান প্রস্রবণে স্নাত হইয়া বাসন মাজিতেছেন ক্রমাগত। সে কী তৃপ্তি, জন্মের বাসন মাজিয়া লইবেন।

শশধরের আড়াই দিন ঘরে থাকা সহে না। তিনি শপাহলিক। সপ্তাহে তিন দিন কাছারি হইতে গৃহে সরাসরি ফিরিবার অভ্যাস নাই। আজ গ্রসারি ত কাল উইন্ডো শপিং। পরদিবস ভুবনেশ্বর ইউনিট দুইতে চুলের কিলিপ ও লেসের ফিতা খুঁজিতে যান। পথ পার্শ্বস্থ বাজার হইতে অলিগলি, খাদি কেন্দ্র হইতে ঝাঁ চকচকে শপিং মল সর্বত্র ঘুরিবেন।

সেই বাবুটি আজ করোনামাতার দাক্ষিণ্যে জুজু। ফেব্রুয়ারিতে শেষ বাজার গিয়াছিলেন। এখন সব দোকান বন্ধ। গৃহবন্দিত্বের কোটা পূরণ হইয়াছে শশধরের।

সব কষ্ট মানা যায়, শুধু ফুচকা ও ঝালমুড়ির জন্য প্রাণ কাঁদে। এও ভাবেন, তাঁহার প্রিয় ফুচকাওলা ও ঝালমুড়ি ওলারা করিতেছে কী? যাহাদের দিনগত রোজগারে অন্ন আসে। ফোন তুলিয়া ফোন করেন হাজরাস্থিত বস্তির বিশালদেহী কিন্তু বালকতুল্য বুদ্ধির শংকুকে। উহার বৌদি রোজ টাকা রোজগার না করিয়া আনিলে তাহাকে ভাত দেয় না সচরাচর, তাই শংকু এর বাড়ির কলতলা ঝাঁট দিয়া ওর বাড়ির ময়লা পরিষ্কার করিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া টাকা রোজগার করে। আজ সেও গৃহে। বৌদি বলে, ফ্রি পায় নাই তবে রেশন দোকানে লাইন দিয়া রেশন মিলিয়াছে। শংকুকে ফোন ধরাইলে শংকু জানায়,  টাকা পাঠান দিদি, টাকা না হলে খাব কী। উহার কন্ঠ শুনিয়া ধড়ে যেন প্রাণ আসে। শশধর বলিয়া ফেলে, এই নাম্বারে পে টি এম আছে? শংকু বোঝে না! শশধর জিভ কাটিয়া ভাবে, ইহার নাম ডিজিটাল ডিভাইড।

ডিজিটাল ডিভাইডের ফাঁকে ফাঁকে পড়িয়া মরিতেছে ছাত্রেও। যাহার ফোর জি আছে সে সতত অনলাইন ক্লাসে, তাই সতত অ্যাহেড। যাহার নাই সে হোস্টেল ছাড়িয়া দেশ গাঁয়ে ফিরিয়া বোকা হইয়া থাকিবে।

এদিকে করোনা আগমনের গুরুগুরু ধ্বনি ক্রমশ যুদ্ধ দামামা হইয়া বাজে। ক্রমে রাজ্যে রাজ্যে বিভেদ আনিতেছে করোনা।

করোনা পূর্ব কালে, প্লেন উপচাইয়া পড়িত উড়িষ্যাগামী বাঙালি টুরিস্ট। বারমুডাশোভিত বৃহৎ উদরের দাদা, শাড়ি ছাড়িয়া টপাস করিয়া  টপ জিন্স পরা বৌদি, মাথায় স্ট্র হ্যাট। আর নেট স্যাভি বালক বালিকা প্লেনে উঠিয়া কোনার্ক পুরী চিলিকা বৃত্তান্ত আলোচনা করিত আর নয়ত ফোনে গেম খেলিত।

কথিত আছে পুরী বাঙালিদের সম্পত্তি। মিথ্যা নহে। পুরীর অর্থনীতি বং টুরিস্ট নির্ভর বটেই। 

ইদানীং আরো আছে কিট ও কিম, সোয়া ও সাম, আরো অজস্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি ছাত্রদল। সবার সংগে শশধর বাবুর দেখাসাক্ষাৎ এয়ার এশিয়ার বাজেট ফ্লাইটে। গিস গিস করিত উড়িষ্যা আগমনকারী বাঙালি।

ইদানীং দুই মাস যাবত কোথায় সেই বাঙালি আর কোথায় উড়িষ্যার অর্থনীতি চাংগাকারী বাঙালির প্রতি প্রীতিপূর্বক সম্ভাষণ।

কেবলই নীরবতার মাঝে মাঝে দাঁড়ি সেমিকোলন এর ন্যায় ভীতিকর টুইট আসে। পুলিসের কমিশনার বা চিফ সেক্রেটারি সহসা মধ্য রাতে জানান, উড়িষ্যায় ১০০ ক্রস করিল করোনা আক্রান্ত। কেননা পশ্চিম বংগ হইতে আসিয়া পড়িয়াছে এক দল করোনাবাহক ব্যাক্তি।

কেহ বলে না ইহাদের ডেমোগ্রাফি। ইহারা মূলত উড়ষ্যাবাসী, না কি বাঙালি? শুধু গ্রামে গ্রামে বার্তা রটিল, শেষাবদি west bengal returnee মানেই ভয়াবহ ব্যাপার।

বর্ডার ক্রস করিলেই হাতে কোয়ারান্টাইন ছাপ্পা পড়িবে। কোয়ারান্টাইন সেন্টারে অর্থাৎ ফাঁকা স্কুল বাড়িতে রাখা হইবে west bengal returnee গণকে। খবরে প্রকাশ তাহার ভিতরে ১৫০ জন খারাপ ব্যবস্থা দেখিয়া পলাইয়াছে। তাহার ভিতরে খুঁজিয়া খুঁজিয়া ৫০ জনকে আবার ধরিয়া খাঁচায় পোরা হইয়াছে।

এইসব খবর সচরাচর  রাতের দিকে আসে। আর সারারাত ঘুমান না শশধর। চিরুনি চালাইলে ঝপাৎ করিয়া এত্ত চুল পড়ে৷ খাবারে স্বাদ নাই। হাত ধোয়া একমাত্র ব্যসন।

সর্বাপেক্ষা দুঃখ, কেহ তিনি কলিকাতা ফিরিবার নাম করিলে আঁতকাইয়া ওঠে।

ওড়িয়া বলে ওরে বাবা ওখানে রোগ খুব ছড়াইতেছে। যাইবেন না।

বাঙালি বলে ওখানে তুই ভাল আছিস খুব। একদম খারাপ অবস্থা আমাদের এখানে। আসিস না।

শশধর ভাবেন ওগো মরণ হে মোর মরণ, আমি যে তোমাকেই প্রিয় বলিয়া জানিয়াছি!

পর্ব ৬

একদিকে এই অবস্থায় গোটা ভারতের সংখ্যা বাড়িতেছে, অন্যদিকে রাজ্যগুলির সংখ্যা। আর প্রতি রাজ্য বলিতেছে, আমার বর্ডার ক্রস করিয়া করোনারুগি আসিতেছে ভিন রাজ্য হইতে।

অনুভব হইল, এ আসলে এক মহাদেশ। প্রতি রাজ্য এক এক স্বকীয় সীমাবিশিষ্ট দেশ। বর্ডার ক্রস করিতে ভিসা পাসপোর্টের জরুরত হয়। বে আইনি অনুপ্রবেশের সম্ভাবনায় সবাই সংগীন উঁচাইয়া আছে।

বর্ডার ক্রশ করিতে গেলে লাঠিপেটা, জেল, শুট অ্যাট সাইট ইত্যাদির ভয়। আলুর ট্রাকে উঠিলে নিস্তার নাই। খবরে শশধর পড়েন, কত জন পরিযায়ী শ্রমিক সিমেন্ট মিক্সারের খোঁদলে লুকাইয়া ঘরের ছেলে ঘরে ফিরিতে গিয়া ধরা পড়িয়াছে। মাথার উপর হাত তুলিয়া বাহির হইয়া আসিতেছে তাহারা এমন ছবিও ভাইরাল।

শশধর এইসব ভাবেন আর বক্ষ দুরুদুরু কম্পিত হয়। কোনদিন কি আর বাংলা উড়িষ্যার সীমানা পার হইবেন?

এতদিন উড়িষ্যা বাংলাকে বিশ্বাস করিতে ছিল না। এবার বাংলার প্রত্যুত্তর, সমস্ত বর্ডার বন্ধ। হুঁ হুঁ বাবা, আমাদের দোষারোপ আর লুকিয়ে আমাদের রাজ্যেই করোনা আশীর্বাদ ধন্যদের ঢুকিয়ে দেওয়া? নেহি চলেগা।

শামলা মাথায় কাচারি যান বটে, তবে শশধরের প্রাণে মাঝে মাঝে সাহিত্যের বাই ত চাপিত। তাই সে সাহিত্য কীর্তি স্থাপন করিয়া তিনি দিল্লি তে।চিঠি ছাড়েন।তিন বৎসরের বনবাস যাপনের চিত্র আঁকেন সযত্নে। ক্রন্দনের বেগ খুব শব্দের মাধ্যমে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। যে পড়িবে সে বিচলিত হইবেই। 

অতঃপর অপেক্ষা। নিশ্ছিদ্র শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষা। শুধু সাইন্স অ্যান্ড সিম্বলস খোঁজেন। ওই গাছের ফুলটা যদি পড়ে, আমার পোস্টিং অর্ডার হইবে। এই বিড়ালটা যদি দৈবাত দই ভাত টা শেষ করে, আমার পোস্টিং অর্ডার হইবে।

এক সন্ধ্যায় সজনে ডাঁটার স্তূপ লইয়া বসিয়া দুঃখের সংগে ইডলি সম্বর খাইতেছেন, মহাত্মা ফোন করিলেন।

এইরূপ কথোপকথন হইলঃ

যঃ ৩০ এপ্রিল রিটায়ার করছেন কলকাতার ক আপিসের খ বাবু। আমাকে ত ওখানে দিতে পারত, বলো?

মঃ অত ভেবে লাভ নেই, কী আর করা, যা হয় হবে। দেখ জীবনে নানাকিছুই ত হল, এটাও হচ্ছে। লাফালাফি না করে আরো দুটো ইডলি খাও…

যঃ ভাবি না ত। জান না এক মাস খবর ও দেখিনি? জান না এখানে কীভাবে আছি? কতদিন মাছ খাইনি?

মঃ মাছ ভক্ষণ সুলক্ষণ না। কলকাতায় সব কাকুরা রোজ মাস্ক নামিয়ে মাছের বাজারে গিয়ে হইহল্লা করছে। মাছে কিছু হয়না। শুধুই মারকুরি।

য ঃ উহারা আমাকে পোস্টিং যদি না করে আমি ভুয়ো ডাক্তার সার্টিফিকেট দেব।

মঃ ছটফট কর না।।আর কতদিন বা তোমাকে ওখানে রাখবে। এর আগেও ত বদলি হয়েছ। এবার ও হবে। বদলিও পৃথিবীর নশ্বরতার মত অমোঘ। কনফুশিয়াস ও কার্ল পপার বলেছেন…

যঃ (চীৎকার করিয়া) মহাত্মা তৃণ, আর তোমার এইসব জ্ঞান শুনতে চাইনা। Confucius my foot. It’s not helping me anymore.

শশধর সজোরে ফোন কাটেন ও বিছানায় উপুড় হইয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে থাকেন। আহা যেন উনবিংশ শতকের নায়িকা।

অলৌকিক ভাবে, বিড়ালের দই ভাত খাইয়া উদ্গারে বিশ্বাত্মা তৃপ্ত  হইয়া যায়। ফলত,  পরদিন তাঁহার পোস্টিং অর্ডার আসিয়া যায়। কলিকাতার সেই ক অফিসে, খ বাবুর জায়গায়।

তবে উপরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে, এই অর্ডার বলবতী হইবে দেশের পথঘাটে যাতায়াতের রেস্ট্রিকশন পাতলাহালকা হইলে। conditional.to the lifting of movement restrictions

উহাতে বলা আছে ১ মে বা তাহার পরে যে কোন দিন শশধর জয়েন করিতে পারেন।।

আহা এ যেন সোনার পাথরবাটি।

মাথায় আনন্দ আর দুশ্চিন্তা যুগপত নৃত্য করে। বহুদিন পর পেট ভরিয়া ভাত খান। ভাল ঘুমান।

পরদিবস উঠিয়া জানেন, ৩ মে র লকডাউন ১৭ মে অব্দি দীর্ঘায়িত।

 

 

 

পর্ব ৭

(signs and symbols ও angels and demons নামের মাহাত্ম্য)

লকডাউনে এক জোক খুব চলিতেছে। যদি আপনি গৃহবন্দি অবস্থায় নিজের গাছ পালা বা ফ্রিজের সহিত কথা বলেন, পোষ্যদের সংগে মনোলগে ব্যাপৃত হন, ভয় পাইবেন না। ইহাই স্বাভাবিক।

ভয় কখন পাইবেন? যখন তাহারা আপনার কথার  প্রত্যুত্তরে কথা বলিতে শুরু করিবে।

১১ মার্চ হইতে ফাঁকা বাড়িতে। মে মাসের ১ তারিখ হইতে বিড়ালদের সংগে মনের প্রাণের কথা বলা শুরু হইল৷ ‘ওরে, আমার সমস্যাটা শোন! ওরে, তোরা ভাল করে খা, দেখিস যেন আমাকে এবার বর্ডার পেরতে দেয়। ভেহিকল পাস ইসু হয় যেন’

এইবার বেড়ালেও উত্তর দেয়। ম্যাঁও ম্যাঁও ম্যঁও উঁ উঁ উঁ….

গভীর নিশ্চিন্তি। চিকেনের হাড্ডি রান্নাঘরের জানালার পাশে রাখেন শশধর। চিড়ে দই, পাউরুটি দুধের পাউডার।…

আহা ওরা খাক। আমাকে এসে এসে বৈড়ালিক ভাষায়  বলুক, সব ঠিক হ্যায়৷ আল ইজ ওয়েল।

পোস্টিং অর্ডার খাতায় কলমে হইয়াছে। তাহাতেই হঠাৎ মহাত্না তৃণ দর্শনের খুঁটিনাটি ছাড়িয়া দিলেন। একেবারে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়া গিয়া আস্তিন গুটাইতে লাগিলেন। বেশ বেশ, এখান থেকে একটা গাড়ি অ্যারেঞ্জ করে ফেলি তবে, না কি? বল? চলে যাই তোমার ওখানে। তোমাকে পিক আপ করে আবার চলে আসি!!

প্রাণে খর গ্রীষ্মেও মলয় বাতাস বহে। কিন্তু যাই বলিলেই যাওয়া যায়??????

হ য ব র ল র বিড়ালটা ভুবনেশ্বর এর বাংলোর হাতার দেওয়ালে বসিয়া ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করিয়া হাসে।

বলিল, অত সোজা না। প্রথমে দেখতে হবে বংগের  ওয়েবসাইটে stranded person হিসেবে অ্যাপ্লাই করা যায় কিনা। west bengal এগিয়ে বাংলা সাইটে যান দিকি।

কাঠি লইয়া মাটিতে একটা দাগ কাটে।

তারপর দেখতে হবে উড়িষ্যা সরকারের সাইটে একজিট পাস দিচ্ছে কিনা। তবে উড়িষ্যা সরকারের আমলা যখন, সেটা বোধ হয় হয়ে যেতেও পারে।

আরেকটি দাগ।

তারপর দেখতে হবে মিনিস্ট্রি অফ হোম অ্যাফেয়ার্স এর কোন ক্ল্যারিফিকেশন এসেছে কিনা। ৪৪০০ কোভিড সংক্রান্ত অর্ডার। অনলাইন গিয়ে একে একে ডাউনলোড কর আর পড়।

যে যে অ্যাক্টিভিটির জন্য লকডাউন শিথিল হয়েছে তার ভেতরে কি কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীর বদলি পড়ছে?

মনে রাখা দরকার যে এখন দেশে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট চলছে। উহাকে লংঘন করিলে সিধা জেল। অথবা কোয়ারান্টাইন সেন্টারে স্থান।

দাগের পর দাগ মাটিতে পড়িতেছে।

খানিক পরে বেড়াল এক চোখে তাকাইয়া বলিল, তাহলে মোদ্দা কথা দাঁড়াইল কী!!

এইরকম….( নিচে চিত্র দ্রষ্টব্য)

|]]+++++]]]]]\\\>00000>>>\\\\\??????|||||—–<<<<<-

))))000000______///////]]][++++[/.,.’;>>><<<?????

এখন প্রয়োজন একটা ব্রেইন ওয়েভ। একটা বিস্ফোরণ। অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী। অনেক এঞ্জেল।

আসিল ও তাই। বাচ্চা বাচ্চা ডেপুটি, পঃ বংগের এ জি বন্ধু, অবসৃত আই এ এস দম্পতি। অসংখ্য মানুষ বুদ্ধি দিতেছেন।

এঞ্জেল আছে, ডেমন ও আসিতেছে।

 

পর্ব ৮ 

 

এঞ্জেল গণ একের পর এক জিনিস পাঠান। ইনবক্স ভরিয়া যায়। যশধরের জন্য আসে নানা লিংক, ওয়েব সাইটের। নানা রকম  তথ্য, নানা উপদেশ। আশায় বুক বাঁধেন শশধর । মহাত্মাও খোঁজ নেন। বুদ্ধি দেন। পরিকল্পনা করেন। ভবিষ্যতের দিশা না দেখিলে দর্শন, আর দিশা দেখিলে কর্মযোগ। এই  হিসাব চলে মহাত্মার। 

 

আর শশধর এখন দর্শন কে বিড়াল দ্বারা রিপ্লেস করিয়াছেন। যেই একটা কিছুতে আটকান, ম্যাঁও ম্যাঁও করিয়া ডাকেন। বিড়ালের ভাষাতেই তাহার সহিত বাক্যালাপ করেন। কে আবার কষ্ট করিয়া প্রথমে বাংলা বলিয়া পরে তাহা বৈড়ালিক ভাষায় অনুবাদ করিবে। 

 

দুর্জনে বলিয়া থাকে, ভারত এখন পুলিস স্টেট। দুর্জনে এও বলে যে সত্তর দশকের লাইসেন্স রাজ ফিরিয়া আসিয়াছে। অতীব দুর্জন যাহারা তাহারা আবার আমেরিকার সেই পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা বলিতেছে। যেখানে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা গিয়াছিল, সহপাঠীদের একাংশকে বন্দি ও একাংশকে পুলিশ সাজাইবার কিছুদিনের মধ্যে পুলিশ ছাত্রেরা বন্দি ছাত্রদের উপর অকথ্য অত্যাচার করিতে শুরু করিয়াছে। 

 

এঞ্জেল ডেপুটি বলে, ম্যাডাম পশ্চিমবংগ  থেকে  একজিট করতে দিচ্ছে, এনট্রির লিংক খুলছে না।  অন্য ডেপুটি বলে ম্যাডাম আপনি বলে এতদিন রইলেন। অন্য কেউ হলে অনেক আগেই অসুখের বাহানা দিয়ে পালিয়ে যেত। আরেক ডেপুটি জানায়, উড়িষ্যার পুলিস আমরা অডিট করি ম্যাডাম। আপনি ত হোম সেক্রেটারির চা পার্টিতেও গেছিলেন। ওনাকে ফোন করে উড়িষ্যার পাস এর কথা বলে দিন। 

 

কিন্তু আসল সমস্যা প বঙ্গ লইয়া। কোথা হইতে কেন্দ্রীয় বাহিনী না কেন্দ্রীয় টিম আসিয়া শুলুক সন্ধান করতে শুরু করিয়াছে। কমল মিত্রের সহিত ছায়াদেবীর কীরূপ ছায়াযুদ্ধ চলিতেছে কে না জানে। এইসব কারণে রাজ্যের বর্ডার টেনশনে পরিপূর্ণ। কেন্দ্রীয় সরকারি চাকুরে শুনিলে বঙ্গবিধাতার হার্ট অ্যাটাক হইতেছে। কাহাকেও ঢুকিতে দিতেছে না।  সূচ্যগ্র মেদিনী বা মেদিনীপুর , কিছুই ছাড়া নাই। উপরন্তু রেড জোন হইয়া গিয়াছে উড়িষ্যা সংলগ্ন পশ্চিম মেদিনীপুর। অনেকে ভুল করিয়া বলিতেছে  রেড লাইট এরিয়া। ইহা লইয়া কুপিত বঙ্গবিধাতা , পুলিশের উপরে কড়া পাহারা রাখিবার সমস্ত ক্ষমতা  অর্পিত। 

 

ইতিমধ্যে পাড়ার এক ভ্রাতৃসম ফোন করিয়া শশধরের সাহায্য চাহিয়া বসিল। জানাইল তাহার এক ভায়রা ভাই ঝাড়খন্ডের দেওঘরে আটক। তাহাকে উদ্ধার করিতে হইবে। 

 

কীমাশ্চর্যম অতঃপরম। নিজেকে সাহায্য করিতে অক্ষম শশধর বাবু তাহাকে সাহায্য করিয়া ফেলিলেন। ঝাড়খন্ডের এজি অফিসে জানাইতেই দু দিনে দেওঘরের এস ডি ও পাস দিয়া দিল। আর এই বালকটি যাদবপুর থানা হইতে এক হাড় জিরজিরে পাস লইয়া গাড়ি লইয়া বাহির হইয়া পড়িল অকুতোভয়ে ও বীরদর্পে। শশধর বুঝিলেন সকলি সম্ভব। 

 

ইতোমধ্যে কলকাতা স্থিত এজি , শশধরের অন্য  এক এঞ্জেল, তাহার হবু আপিসের চার্জ দেখিতেছেন। এইসব অলৌকিক বারম্বার ঘটিয়া থাকে শশধরের জীবনে। ফলত তিনি তাহাকে আশ্বস্ত করিলেন, গাড়ির বন্দোবস্ত হইতেছে। এইবার তুই পাসের বন্দোবস্ত কর। হোম ডিপার্ট্মেন্টে সিধা ফোন লাগা।

 

কলিকাতার পুলিস অডিট যে এজি করেন তিনি সদ্য জয়েন করিয়াছেন। লকডাউনে তাহার আপিস একেবারেই খালি। তাছাড়া কে না জানে যে  পুলিশ কথা শোনেনা।

 

শশধর এবার মরিয়া। ইহাও  অলৌকিক!  তিনি যে কলেজে পড়িয়াছিলেন কলিকাতার সে প্রাচীন কালেজের ছয় ব্যচের সিনিয়র প বঙ্গের অতিবড় আমলা এখন হোমসেক্রেটারি। ধৃষ্টতা করিয়া তাঁহাকে ওয়াটস্যাপে মেসেজ লেখেন। কালেজের নাম করিলে আজো অনেক কাজ হয়। অন্তত প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময় চমৎকার হইলে। উনি আরো এক যিনি  এঞ্জেল তালিকায় উঠিলেন।

 

কিন্তু কাজের কথা তুলিতেই টিভির অনুষ্ঠানে র সেই পরিচিত  ঢ্যাং-ং-ং  করিয়া নিচুতারে বাঁধা ক্র্যাশিং সাউন্ড অন্তরীক্ষে বাজিয়া উঠিল। তিনি হাত তুলিয়া দিয়া  বলিলেন, আসলে আপাতত  খুবই ঝামেলায় আছি আমরা। পুলিশকে বলা হয়েছে সবাইকে আটকাতে। আমাদের কোন ডিসক্রিশন আপাতত নেই। কাজেই আপনাকে গাড়ির পাস দেওয়া আদৌ এই মুহূর্তে সম্ভব হবে না হয়ত। আর  কদিন পর ভাবা যেতে পারে। অবস্থা পর্যালোচনা করে জানাব। 

 

অল্পবয়সে স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের উপর আধারিত এক কাহিনি মনে দাগ কাটিয়াছিল। টরচার বাই হোপ। আগুস্ত ভিলিয়ের দ্য লিল আদাম রচিত বিখ্যাত কাহিনি। বন্দীকে মুক্তির আশা দেখানো হইতেছে, আর প্রতিবার মুক্তির একেবারে নিকটে এলেই তাহার সে সম্ভাবনা রদ করা হইবে। আশা করিতে করিতে ধুকুপুকু প্রাণ বাঁচি বাঁচি করিয়া উঠে, আবার নিরাশার অতলে তলায়। ডাঙায় তোলা মাছের মত খাবি খায় বন্দি। সেই বন্দি দেখে গরাদের ভারি দরজা অল্প ফাঁক । কিন্তু অতি সাবধানে  কাছে গেলেই ক্যাঁচ করে বন্ধ হয়ে যায়। ওভাবেই প্রোগ্রামড থাকে সব। একেবারে শেষ দৃশ্যে কেউ কোথাও নেই, সে বেরিয়ে প্রায় পড়েছে। তারপর তাকে সান্ত্রী এসে পাকড়াও করে। ধক করে প্রাণপাখি বেরিয়ে যায় তার । মৃতদেহটা পড়ে থাকে। 

 

এই মুহূর্তে শশধরের অবস্থা তাইই।

 

অধীর অপেক্ষায় এইভাবে সাতদিন কাটে। শেষাবধি সেরা অলৌকিক। সেই প্রাজ্ঞ আপিচর নিজে ফোন উঠাইয়া শশধরকে বলেন, আপনার কাজ হয়ে যাবে। তবে গাড়ি কিন্তু উড়িষ্যা ঢুকলে ঝামেলা। আমরা আমাদের বর্ডার অব্দি পাস দেব। আপনি উড়িষ্যার নাম্বার প্লেটের গাড়িতে জলেশ্বর অব্দি আসবেন। বর্ডারে গাড়ি বদল করবেন। 

 

সমস্ত বাগান গান গায় সমস্ত আকাশ বিকশিত হয় রৌদ্রে। 

 

এবার উড়িষ্যা। পশ্চিমবঙ্গ  ইমেলে যে পাস দিয়াছে তাহাতে তারিখ নাই। উড়িষ্যা বলে, না না একটা ডেট দিতে হইবে। কবে যাবেন বলে দিন। তাছাড়া কোন পয়েন্ট দিয়ে ঢুকবেন তাও সিস্টেমে তোলা হবে। চেকপোস্টের নাম বলুন। ইহুদিরা জার্মানি ছাড়িয়া সুইজারল্যান্ডে পালাইতেছে এমন কত না সিনেমা সারা জীবনে দেখা হইয়াছে। সেসব দৃশ্য চোখে ভাসে শশধরের। পোঁটলাপুঁটলি গোছান। অতি রগরগে ঘ্যানঘেনে সব কবিতা লেখেন। সেন্টিমেন্টে চোবান। 

 

সব শেষে আরো তিন দিন ঘষ্টানোর পর, উড়িষ্যার পাস আসে। তাও এজি আপিসের সক্রিয় এঞ্জেলদারির ফল। সাধারণ মানুষ কীভাবে যাবে, কীভাবে পাবে এসব পাস? যাদের সত্যি দরকার? মাথায় ঢোকেনা। এত ধরাধরি চেনাশুনোর পর এত কষ্ট? কী ভয়ানক । 

 

যেদিন সব পাস হস্তগত, তার ঠিক পরশুদিন সকাল সকাল গাড়ি বন্দোবস্ত হইয়াছে। উড়িষ্যা নাম্বার প্লেট, সরকারি নাম্বার প্লেট। 

 

সব যখন ঠিকঠাক, তারিখ ও ফিক্সড,  তখন দিল্লি বলে, এখন জয়েনিং করিবে কী! এখন ত লকডাউন। আগে মাসখানেক থেকে অডিট রিপোর্ট ফাইনালাইজ করে দিয়ে যাও!

 

শেষ পর্ব ( পর্ব ৯) 

 

জাতিস্মর ও “ছাতা ধর রে”

 

কী উপায়ে শশধর দিল্লির হাত হইতে নিস্তার পাইলেন তাহা উহ্য রইল। ইহা ট্রেড সিক্রেট। করোনামুক্তি ইহা হইতে অনেক সহজ। আসলে নরম মাটি পাইলে আঁচড়ায় বলিয়া একটা কথা আছে। এইবার শশধরের হাড্ডিগুড্ডির দৃঢ়তার টেস্ট হইল। 

 

 দুই রাত নির্ঘুম কাটাইলেন, খাবার খাইতে পারিলেন না, খাইলেও বমি হইয়া গেল। টেনশনের হদ্দমুদ্দ হইল। তিনি কৃতজ্ঞ কারণ তাঁহার এঞ্জেলকুল ফোন যোগে তাঁহাকে সর্বপ্রকার সহযোগিতা করিলেন। সরকারি রেড টেপের ফাঁসের বজ্র আঁটুনি যেমন ভয়াবহ হইতে পারে তেমনই লুপ হোল মানে ফসকা গেরো বাহির করাও এক শিল্প। তাছাড়া একটি পোস্টিং অর্ডার বার বার পাঠ করিয়া তাহার ভিতরের শাঁসটুকু লইতে হয়।  ইমপ্লিকেশনগুলি বাহির করা প্রায় ধাঁধা সমাধানের ন্যায় গুরুতর কর্ম। সেবিষয়ে শশধর পাকা মাথার সাহায্য পাইয়া গেল। শেষ বাধা পার হইল। 

 

সবের পর বিধ্বস্ত নিদ্রাহীন রাত্রির অন্ত হইল। সুড়ঙ্গের শেষে আলো আসিল। সকাল সকাল সব জুনিয়র আসিয়া শশধরকে বিদায় জানাইলেন সামাজিক দূরত্ব মানিয়া। কোন ফুল না উপহার না করমর্দন না। শুধুই পাশে দাঁড়ানো। শশধরের চোখে জল আসিল। দস্যু রানির ন্যায় সে মুখে মুখোস বাঁধিয়া চল্লিশ চোরের সহিত দাঁড়াইয়া ছবি তুলিল। 

 

গাড়ি প্রথম পাঁচ ঘন্টা চলিল ৭০ কিমি গতিতে। ভুবনেশ্বর হইতে সকাল ৮ ঘটিকায় বাহির গমন। সকলেই বলিয়াছে পাঁজি দেখিয়া যাইবেন। বেস্পতিবারের বারবেলা বা শনিবারের কালযোগ ইত্যাদি এড়াইয়া নিতান্ত কুসংস্কারাচ্ছন্নের ন্যায় শশধর শুক্রবার বাহির হইলেন। আগের দিন বুদ্ধ পূর্ণিমা ছিল। সেই চাঁদ দেখিয়া আকুল হওয়া তাঁহার ঘটে নাই। শুধু বুদ্ধের শিক্ষা , আত্মনিয়ন্ত্রণের ও লিভ ইন দ্য প্রেজেন্টের , ইহাই মর্মে লইয়াছেন। 

 

নির্বিঘ্নে হ্যান্ড ওভার সম্পন্ন হইয়াছে শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতে। অতঃপর রবীন্দ্রজয়ন্তী তিথিতে আমাদের যাত্রা হল শুরু এখন ওগো কর্ণধার, তোমারে করি নমস্কার, গাহিতে গাহিতে আর অনলাইনে রবীন্দ্রজয়ন্তী দেখিতে দেখিতে বাহির হইলেন।

 

উড়িষ্যার রাষ্ট্রীয় হাইওয়ে নং ১৬ অতীব দুর্দশাগ্রস্ত দেখিলেন। ড্রাইভার উড্র দেশীয় কিন্তু খুব স্মার্ট। সে বলিল রাস্তার এই হাল আগে দেখে নাই। হয়ত লকডাউনে রাস্তা মেনটেনেন্স একেবারেই হইতেছে না। 

 

সাড়ে বারোটা বাজিল। সাড়ে চার ঘন্টা। কটক, ভদ্রক, মহানদী ব্রাহ্মণী পার হইয়া বালেশ্বর  চলিয়া গেল। দাঁতে দাঁত , ক্ষমাহীন শশধর ভাবিতেছেন, এত এত বেড়াইয়াছি সারাজীবনে , গত তিন বছরে, আর কিন্তু আসিব না, উড়িষ্যা! বহুত ভুগাইয়াছ আমাকে। যদিও মালপত্র সব পড়িয়া আছে। তাহার জন্য লকডাউন উঠিলে ফিরিতে হইবে অন্তত একবার। 

 

 রাস্তা ভাল হইলে আরো দ্রুত হইত। ওদিকে মহাত্মা ততক্ষণে আগে ভাগে বাহির হইয়া এন এইচ ষোল দিয়া ঝড়ের বেগে আসিয়া ৪৫ মিনিট পূর্বেই পৌঁছাইয়া গিয়াছেন। ফোনের টাওয়ারের প্রব্লেম । কথা হইতে পারে নাই ভাল করিয়া। 

 

সারা পথ জল পান করিলেন না শশধর। জলবিয়োগের কোন স্কোপ নাই বলিয়া। ডিম রুটি কফি। একবার থামিয়া এইসব ব্যাগ হইতে বাহির করিয়া খাইলেন। তারপর আসিল জলেশ্বর। 

 

 টা টা বলিয়া জলেশ্বর টোল ট্যাক্স বুথ হইতে উড়িষ্যার গাড়িকে ছাড়িয়া দিলেন। 

 

এইবার পশ্চিমবঙ্গের গাড়ির সম্মুখীন।  পশ্চিমবঙ্গের বর্ডার পার হইয়া, উড়িষ্যায় ঢুকিয়া আবার পশ্চিমবঙ্গে যাইবে। এই বার আসল মজা।’

 

তাহাদের  পুলিশে ধরিল!

 

এক্ষণে  এপিসোড ব্রেক করিবার চূড়ান্ত ইচ্ছা হইতেছে। কিন্তু না, সবাইকে শেষে আনিয়া আর সাস্পেন্সে রাখা না। বলিয়া ফেলি। 

 

ইনোভা গাড়িতে মহাত্মা ও শশধরের প্রায় দুই মাস পর দেখা সাক্ষাত হইল। আকাশ হইতে পুষ্প বৃষ্টি হইল না, বাতাসে শংক ঘন্টা বাজিল না, এমনকি দুজনের মুখ ও আচ্ছাদিত মুখোশে। তবু চারিচক্ষুর মিলন হইল। যে গৃহে কাক চিল বসে না সেগৃহেও আজ প্রেমবাতাস বহিতেছে, বিরহের এমন গুণ। সামাজিক দূরত্বের কারণ নাই, এমনিতেই পাবলিক ডিসপ্লে অফ অ্যাফেকশন যে মহাত্মার অতি না পসন্দ তা ইতিমধ্যে সব পাঠক বুঝিয়াছেন। সুতরাং তাঁহারা যেন কিছুই হয়নাই মুখ করিয়া গুটিগুটি গিয়া গাড়িতে উঠিলেন ও দু কদম গিয়া গাড়ি হইতে নামিতে বাধ্য হইলেন। 

 

পুলিশ বলিল, যান থার্মাল স্ক্যানিং করান। নাম বলুন, বাবার নাম, ঠিকানা সব বলুন, ল্যাপটপে উঠবে। 

 

স্থানটি পুলিশে পরিপূর্ণ। এবং যাত্রিকুল পুলিশকে ফাঁকি দিতে নানাভাবে উৎসুক। একটি বড় গাড়ি আসিয়াছে। বারোজনের দল । পুলিশ বলিতেছে সবাই লাইন দিয়ে ডিসট্যান্স মেনটেন করে আসুন। সবাইকে পর পর স্ক্যান করা হইবে। কিন্তু সে গাড়ি থেকে এক একজন আসছে আর কুমিরছানার খেলা খেলছে। 

 

এক আশাদিদি টাইপ বেচারি মহিলা আছেন। না আছে ঢাল না আছে তলোয়ার, না আছে পিপিই। শুধু গ্লাভস ও মুখোশ ভরসা। তিনি টেম্পারেচার মাপিতেছেন স্ক্যানার দিয়ে। 

 

আছে এক ক্ষুদ্র তাঁবু। একেবারেই চারজন মানুষের বসার স্থান। লাইন দেওয়া ডিসট্যান্সিং মানা যাত্রিকুল সব বাইরে। বেলা একটার খর রোদে দন্ডায়মান। 

 

মিনিট পনেরো রৌদ্রে দাঁড়াইবার পর আশাদিদি কপালের কাছে স্ক্যানার ধরিলেন। শশধরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটিয়া উঠিল।  “হল না হল না , বেশি আসছে বেশি আসছে”। 

 

তীরে এসে তরী ডোবে ডোবে। তাপমাত্রা জ্বরের অধিক। 

 

মহাত্মার কপালে ধরিলেন। তিনিও অধিক। 

 

ড্রাইভার হেল্পার দ্বয়ের কপালে ধরা হইল। তাহাদের ও। সকলেই ৩৮ প্লাস।

 

চেন্নাই হইতে বরাবর গাড়ি চালাইয়া আসা ভেলোরের অসুস্থদল একই লাইনে আছেন। তাহাদের ও ৩৮। কেয়াবাত। 

 

এক ভেলোর প্রত্যাগতা মুখোশ খুলিয়ে খোশ গল্প করিতেছেন। শশধর ধমক দিলেন –  ম্যাডাম,  মুখোশ!

 

পথে অনেক তামিলনাড়ু নাম্বার প্লেট দেখা গিয়াছে। ইঁহারা সকলেই ঐ ঐ সব স্থান প্রত্যাগত। বর্ডারে আকুল ভাবে প্রতীক্ষারত। অসুস্থ, সুস্থ, কাঙাল, ড্রাইভার সব ঘেঁষাঘেঁষি হইয়া চেক পোস্টে। 

 

আশাদিদি শশধর সহ  সবাইকে গাড়িতে ফিরৎ পাঠাইলেন। যান এ সি চালাইয়া গাড়িতে দশ মিনিট বসিয়া তবে আসুন। 

 

রৌদ্রমুখরিত হাই ওয়ে হইতে আবার এসি শীতল গাড়ি। আবার গমন। দ্বিতীয়বার মহাত্মা ও ড্রাইভার রা পাস করিলেন। শশধরের মাথাগরমের ধাত। ভাল করিয়া রুমাল দিয়া মুছিলেন। একটু স্যানিটাইজার লাগাইতে ভুলিলেন না। ঘোমটা দিলেন।

 

হঠাৎ ব্রেন ওয়েভ, ড্রাইভার বলিল, গাড়িতে বড় ছাতা আছে ম্যাডাম, ওইটা নিয়ে যাই?

 

বার বার তিনবার। এইবার না হইলে কোয়ারান্টাইনে চালান। তৃতীয়বার শশধর চলিতেছেন। হীরক রাজার মন্ত্রীর ন্যায়। পিছনে ড্রাইভার ছাতা ধরিয়া। আশা দিদির সামনে আবার অন্য যাত্রীদের ভিড়। চীৎকার চেঁচামেচি হইতেছে। 

 

বিশাল ছাতায় অন্ধকার করিয়া আছে। এবার ৪০ ডিগ্রির সূর্যতাপ কী করিবে? কাঁচকলা। 

 

শশধর পাস করিলেন। 

 

লাইফ ইজ স্ট্রংগার দ্যান ফিকশন। লালমোহন উবাচ। 

 

এইবার সাট্টিফিকেট রচিত হইতেছে। ল্যাপটপ দেখিয়া আশা হয় সবার খবর কেন্দ্রীয় কোন ডেটাবেসে জমিবে। কিন্তু জমিল কই। সাট্টিফিকেট যন্ত্রনির্গত নহে! হস্তে লিখিত। 

 

১৪ দিন হোম কোয়ারান্টাইনের বিধান আছে উড়িষ্যা আগতার জন্য। 

 

এইবার আবার যাত্রা। শুনশান পথ। একশো স্পিডে গাড়ি চলিল। 

 

 কিন্তু হাইওয়ে অপরূপ। পরিচ্ছন্ন। গর্ত বিহীন। প্রচুর সাদা দাগে বাম্পার স্পিড ব্রেকার নির্দিষ্ট করা। অপরূপ মেদিনীপুর। হাইওয়েতে ভিজা ধান মেলিয়া মাড়াই বাছাই ঝাড়াই চলিতেছে। কাজের উৎসাহ, মানুষের ডিসট্যান্সিং মানিয়া কৃষিকর্ম দেখিয়া মন ভরে। 

 

উড়িষ্যা সাইডে এসব ছিল না। মাইল মাইল ফাঁকা মাঠ ছিল। এখানে কৃষির রমরমা। বাংলা হাসছে। 

 

হাইওয়ে দিয়া আসিতে আসিতে মাথায় পুঁটলি অনেক শ্রমিকদের চলিতে দেখিয়াছেন। ইহাদের গন্তব্যনিশ্চয় প বঙ্গ। কে বলে প বঙ্গে ভাল কিছু নাই। এই ত এত মানুষের গন্তব্য । এই ত এত মানুষের কর্মব্যস্ততার চিত্র। এই ত হাই ওয়ে এত ভাল। এগিয়ে বাংলা!

 

চিরকাল বিপরীত শ্রবণ করি আমরা। 

 

ঠিক আড়াই ঘন্টা লাগিল। স্বপ্নবৎ উড়িয়া সাঁতরাগাছি পার হইলেন, হাওড়া হইয়া বিদ্যাসাগর সেতু ও মা ফ্লাইওভার। 

 

শুরুতেই শশধর বলিয়াছিলেন, কাল সারারাত ঘুম হয় নাই উত্তেজনায়। আজ এখনো এতটুকু ঘুম পাচ্ছে না কেন বল ত?

 

মহাত্মা অসামান্য বাণী দিয়াছেন। “তুমি ত আর নকল ডক্টর হাজরা নও, যে, পাশে জাতিস্মর বসে রয়েছে, সোনার কেল্লাও একটু পরে পৌঁছে যাবে, তাও ঘুমিয়ে পড়বে?”

 

বাংলা বর্ডার ক্রস হইল কিনা, নির্বিঘ্নে থার্মাল স্ক্যানিং ও সার্টিফিকেট প্রাপ্তি হইল কিনা, সব জানিবার জন্য শশধরের উড়িষ্যাবাসী এঞ্জেলকুল ও কলিকাতাবাসী এঞ্জেলকুল অধীর আগ্রহে  মোবাইল পাশে লইয়া অপেক্ষা করিতেছিল। এ রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার তুলনা নাই । একেবারেই মেরিকমের বায়োপিকের সমতুল্য। সুসংবাদ পাইয়া সবাই স্বস্তির শ্বাস ফেলিলেন।  সুদূর মুম্বই শহরে প্রণম্য শুভাকাঙ্ক্ষী প্রবীণ বুরোক্র্যাট দম্পতি রান্না চাপাইলেন। 

 

আর হ্যাঁ দেখা গেল যে হিন্দি সিনেমার অন্তে যেরূপ, এ কাহিনির অন্তে সব ভিলেন ভালমানুশ হইয়া গিয়াছে। 

 

বাড়ি আসিয়া প্রথমেই দেখা হইলা কোকিলাবেনের সহিত। প্রতি লকডাউন এক্সটেনশনে সে কাঁদিয়াছে। তবে বাকি সময় কোকিলের ন্যায় গান গাহিয়াছে। আজ  কোকিলাবেনকে…. না, জড়াইয়া ধরিলেন না। দূর হইতে দুই হাত নিমাই এর ন্যায় উঠাইয়া ভার্চুয়াল আলিংগন নৃত্য করিলেন।

ইতি রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা সমাপ্ত ।