শুভশ্রী পত্রিকায় প্রকাশিত, ২০২০

 

 

বাঙালিনীর রান্নাঘরের বিবর্তন

যশোধরা রায়চৌধুরী

 

If you can organize your kitchen, you can organize your life. Louis Parrish 

 

শুরু করা যাক নেহাতই এক ভ্রমণ উশকানি দিয়ে। আপনি যদি কখনো যান নিউ মেক্সিকো নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ পশ্চিমের এক  রাজ্যে। সেটা রেড ইন্ডিয়ানদের দেশ । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে র ইতিহাস জানা থাকলে নিশ্চয়ি এটাও জানা যে অসংখ্য প্রজাতির অ্যাবরিজিনাল রেড ইন্ডিয়ানদের অগুনতি

anise aroma art bazaar
Photo by Pixabay on Pexels.com

মানুষকে মারতে মারতে,  উপজাতিদের নিজস্ব চিহ্ন মুছতে মুছতে তৈরি হয়েছিল আমেরিকার বিশাল উপনিবেশ। ২০০ বছরের সে ইতিহাস ছিল মোছার ইতিহাস। আজ আবার খুঁড়ে তোলার নতুন অধ্যায়। আজ সেই সব রেড ইন্ডিয়ানদের সংস্কৃতি অনেক মানুষের অধ্যয়নের বিষয়। সংস্কৃতি সংরক্ষণের চেষ্টা অব্যাহত, সে  জন্য সান্টা ফে , এক প্রাচীন শহরে আছে একাধিক যাদুঘর। সে যাদুঘরে দাঁড়িয়ে একটা অংশ দেখে আশ্চর্য হবেন হয়ত। অথবা আদৌ আশ্চর্য হবেননা, কারণ এ ত আমাদের চেনা সংস্কৃতি। সে অংশে রাখা আছে বাসন কোসন, আর দেওয়ালে লেখা আছে রেড ইন্ডিয়ানদের এক প্রজাতি নাভাহো ইন্ডিয়ানদের একটি কথা। কোন বাড়িতে কত সুখ তা তার রান্নাঘর দেখে বোঝা যায়। এই রান্নাঘরেই বোনা হয় পরিবারের সব সদস্যের মধযে ভালবাসার সুতো।  যে কোন গৃহের কেন্দ্রে থাকে রান্নাঘর, সেখানে তৈরি হয় গরম খাবার আর মানুষ ক্রমশ তার পরিবারকে ভালবাসতে শেখে। যে বাড়ির রান্নাঘর যত জমজমাট, সে বাড়ি তত সুখের আলয়। ইংরেজিতে একটা কথাই আছে, the home is where the hearth is… আর, সুখ হল ছোট্ট বাড়ি, যার রান্নাঘরটি বৃহৎ। বলেছিলেন আলফ্রেড হিচকক।(Happiness is a small house, with a big kitchen.)

 

অথচ ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, বাঙালিনীর দুর্দশার কারণ হল তার সারাবাড়ির মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সবচেয়ে ছোট সবচেয়ে ধোঁয়াধুলো ভরা অন্ধকার কোণের ঘরটিই তার রান্নাঘর। এবং এই রান্নাঘরে “আটকে” গিয়েই বাঙালিনির পরাধীনতা আরো বেশি বেশি করে আন্ডারলাইনড হয়েছে চিরটাকাল। আশৈশবের এই ধারণার পাশাপাশি বৃহৎ ও জনসমাকুল বড় পরিবারগুলির রান্নাঘরের , ও রান্না মহলের বিস্তৃতি ও আকার আমাকে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে, কবে আটকে গেল বাঙালিনী ছোট্ট আর অবহেলিত রান্নাঘরে? আনন্দের বদলে যেখানে দুঃখ অসুখ আর অস্বস্তি গজিয়ে উঠতে শুরু করল? আর আমরা, নবযুগের স্বাধীনতা কামী বাঙালিনীরা কি সেই পাক শালার ভোগের পাক থেকে বেরিয়ে আসতে পারলাম আদৌ আমাদের অসংখ্য গ্যাজেট সমাকুল নয়া জমানার রান্নাঘরগুলোতে। অনেক নতুন ফ্ল্যাট বাড়িতে যেগুলি ক্রমশ ওপেন কিচেন বলে অভিহিত হচ্ছে? 

 

বাঙালিনীর রান্নাঘরের বিবর্তন দেখব বলে এই লেখার অবতারণা। এ মহাসমুদ্র থেকে এক দুটি নুড়ি পাথর তুলে নেব শুধু। বাঙালিনীকে আমি দেখব আমার দিদিমার প্রজন্ম, আমার মায়ের প্রজন্ম ও আমার প্রজন্মের প্রেক্ষিতেই।  তার ভেতরেই ধরা পড়বে যা কিছু ধরা পড়ার। 

 

 

রাজস্থান বেড়াতে গিয়েছিলাম। যোধপুর জয়সলমীরের এ কোণে ও কোণে গোঁজা আছে বড় বড় প্রাচীণ হাভেলি । সেসব হাভেলির পুরাতাত্বিক খোপেখাপে, সিঁড়িতে, কুলুঙ্গিতে অতীত ধরা থাকে। মায়াময় জাফরিকাটা জানালা ও ছাতের কোণে লেখা থাকে কত না যুগের প্রণয় অথবা আভিজাত্যের ইতিহাস। কিন্তু সবচেয়ে অবাক করা হয় সেসব হাভেলির একটা ছোট্ট ঘর। রসুইঘর। সেখানে আজকের “ক্ষুদ্র পরিবার সুখী পরিবার” এর ট্যুরিস্ট দের জন্য শোভা বর্ধন করে আছে সুবিশাল সব হাঁড়ি কড়াই,  লালচে তামার ঘড়া, কুচকুচে কালো লোহার বিশাল পাত্রগুলি। এক একটা পাত্রে মানুষ সমান রান্না করা যায়। উনানের জন্য খাঁজযুক্ত এক বিশাল ঘর, চুলহা জ্বালাবার পরিপাটি বন্দোবস্তটির পাশাপাশি, প্রায় আধ মানুষ সমান উদুখল ও মজুদ। এসব দেখলে গা শিরশির করে। এবং এক সুবিশাল পরিবার-আত্মীয়স্বজন-লতায়পাতায় ঘেরা আশ্রিতমন্ডলী-কর্মচারীর গোটা সমাজের খাওয়া কীভাবে জুটত এই রান্নাঘরগুলো থেকে তার আন্দাজ পেয়ে আরো বেশি করে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

 

সমপরিমাণ উত্তেজনা হয়েছে জোড়াসাঁকোর রান্নাঘরের সরঞ্জামগুলি দেখে, দেখেছি নিচু নিচু জাপানি কায়দার টেবিল এনে , প্রাচীন সেই মাটিতে পাত পেড়ে আসন পেতে খাওয়ার চিরাচরিত আচারকে কীভাবে খানিক বিবর্তনের কায়দায় এগিয়ে নিয়ে গেলেন এই ঠাকুর পরিবারটি, জীবনের প্রতিক্ষেত্রে আলোকপ্রাপ্তির পথ যাঁদের কেটে বের করবার অবদান অনস্বীকার্য।  

 

রবীন্দ্রনাথের শৈশব স্মৃতি জীবনস্মৃতি বলছে চাকরবাকর পরিবেষ্টিত বড় হয়ে ওঠার কথা। বাঙালিনী ওই ধরণের বড় পরিবারে রান্নাঘরের কাছাকাছি থাকলেও, রান্নাঘরের অধিকারটি ছিল ঠাকুরের হাতে, অসংখ্য দাসদাসীর মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা হয়ে। সেসব বড় পরিবারের রান্নাঘর ম্যানেজমেন্ট এ গৃহিণীদের ভূমিকা ত ছিলই, নইলে চিত্রা দেব অসাধারণ এক “ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল” লিখতে পারতেন কি? পূর্নিমা ঠাকুরের ‘ঠাকুরবাড়ির রান্না” বইটিও স্মৃতিধার্য। অন্যা অনেকের কলমেও আগ্রহোদ্দীপক ঠাকুরবাড়ির রান্না নিয়েও অগণিত চমৎকার লেখা থেকে আন্দাজ করা যায় নতুন ধরণের এক্সপেরিমেন্টাল রান্নাবান্নায় অগ্রণী ছিলেন মেয়েরা। 

 

বাঙালিয়ানা ওয়েবসাইট থেকে জানছি, দ্বারকানাথ যে আভিজাত্যের নিশান উড়িয়েছিলেন, তাতে অনুমান করা মোটেই অসঙ্গত নয় যে, সেকালের বনেদি বড়লোকবাড়ির মত ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরেও চাকরবাকর-দাসদাসীর রমরমা ছিল। বাড়ির গৃহিণীরা মূলত কর্ত্রী ছিলেন, কর্মী নয়। এই অনুমান অংশত ঠিক। দেবেন্দ্রনাথের অনুশাসন নাকি এর মধ্যে কিছু বদল এনেছিল। ঠাকুরবাড়ির যে মেয়ে প্রথম বেথুন স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, সেই সৌদামিনী, মহর্ষির বড় মেয়ে, বাবার নির্দেশে দীর্ঘদিন হেঁশেলের ভার নিয়েছিলেন। যতই অর্থানুকূল্য থাক না কেন, বেহিসেবি আলস্যবিলাসে যেন কেউ অভ্যস্ত না হয়ে পড়ে, সেই তাগিদে এমন সিদ্ধান্ত নেন মহর্ষি। অপব্যয় রোধ তো এর বিশেষ কারণ বটেই, এছাড়া মেয়েদের গার্হস্থ্যধর্মের উপযুক্ত বিকাশ ও প্রসার এর প্রধান কারণ। শরৎকুমারী, বর্ণকুমারী তো রন্ধনপটু ছিলেনই, তবে প্রত্যেক মেয়েকেই নাকি প্রতিদিন অন্তত একটি করে তরকারি রাঁধতে হত। রসুই আর ভাঁড়ারের কর্তৃত্ব যে দায়িত্ববোধের জন্ম দেয়, তার যথাযোগ্য প্রকাশ ঘটানোই দেবেন্দ্রনাথের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল।

 

কবি স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর রান্না ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহলে খুব জনপ্রিয় ছিল। তার হাতের রান্না খেতে সবাই খুব পছন্দ করতেন, বিশেষত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি নাকি টকের সঙ্গে ঝাল মিশিয়ে বেশ নতুন পদ তৈরি করতেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও নাকি মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে বসে “বৈজ্ঞানিক প্রণালীর আহার” রাঁধার পরিকল্পনা করতেন। রাঁধতেন কবিজায়া। নির্দেশ দিতেন কবি। কখনো কখনো এসব খাদ্য অখাদ্যও হত নাকি। জানিয়েছেন খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় তাঁর কবি কথায়। রাণী চন্দ-র গুরুদেব বইতেও পাই কবির রান্না নিয়ে , খাওয়া নিয়ে নানা রকম বাতিকের কথা। 

 

 কবি ভ্রাতা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজ মেয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর “আমিষ ও নিরামিষ রান্না” দুই খন্ডের বই। সে দুটি  ত ভর্তি নতুন নতুন পদের বিবরণে। যা পড়া এক অন্য ধরণের ভ্রমণ। এই প্রজ্ঞাসুন্দরীই নাকি, রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশতম জন্মদিনে তাঁকে “ কবিসম্বর্ধনা বরফি “ রেঁধে খাইয়েছিলেন। 

বাংলা খাবারের মেনুকার্ডের জন্মও প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর হাতে, নাম দিয়েছিলেন “ক্রমণী”। 

 

কিন্তু রবি ঠাকুরের পরিবারকে সব বিষয়ে টান দেওয়া অপ্রয়োজনীয়। বাঙালির ফার্স্ট ফ্যামিলিটিকে সর্ব ব্যাপারে টেনে আনলে বাস্তব চিত্র থেকে সরে যাব আমরা। কেননা কলকাতায় ওইরকম ধনী পরিবার আর কটি? অনেকাংশে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্রের  হেঁশেল ও উনুনের কথাই আসল ধর্তব্য। মেয়েদের সঙ্গে উনুনের জটিল ও বাধ্যতামূলক আন্তঃসম্পর্কের মধ্যে দিয়ে কলকাতায় বাঙালিনিদের যার যার নিজস্ব রান্নাঘরের রাজনীতিটি গড়ে উঠেছে। এক দখলদারিত্ব, মমত্ববোধ আর অন্যদিকে প্রবল ভাবে পরিশ্রান্ত হবার চির আয়োজন বাঙালিনীর রান্নাঘর। “খাওয়ার পরে রাঁধা আর রাঁধার পরে খাওয়া”র চক্র থেকে যাদের মুক্তি নেই কোন। ছিল না অন্তত। রবীন্দ্রনাথ নিজেই এ লাইন লিখে দৈনন্দিন জীবনে মেয়েদের রান্নাচক্রে আটকে থাকা যেমন করে বুঝিয়েছেন, তাঁর নানা গল্পেও সে কথার সমর্থন আছে, আর আছে শরৎ সাহিত্যে , বিভূতিভূষণের লেখাতেও। 

 

স্ত্রীর পত্রে যখন মৃণাল লেখে, মনে অছে, ইংরেজ ডাক্তার এসে আমদের অন্দর দেখে আশ্চর্য্য হয়েছিল এবং আঁতুড়ঘর দেখে বিরক্ত হয়ে বকাবকি করেছিল। সদরে তোমাদের একটু বাগান আছে। ঘরে সাজসজ্জা আসবাবের অভাব নেই, আর,অন্দরটা যেন পশমের কাজের উলটো পিঠ; সেদিকে কোনো লজ্জা নেই, শ্রী নেই , সজ্জা নেই। সেদিকে আলো মিট্‌মিট্‌ করে জ্বলে; হাওয়া চোরের মতো প্রবেশ করে; উঠোনের আবর্জনা নড়তে চায় না; দেওয়ালের এবং মেজের সমস্ত কলঙ্ক অক্ষয় হয়ে বিরাজ করে। কিন্তু, ডাক্তার একটা ভুল করেছিল, সে ভেবেছিল, এটা বুঝি আমাদের অহোরাত্র দুঃখ দেয়। ঠিক উলটো অনাদর জিনিসটা ছাইয়ের মতো,সে ছাই আগুনকে হয়তো ভিতরে ভিতরে জমিয়ে রাখে কিন্তু বাইরে থেকে তার তাপটাকে বুঝতে দেয় না। আত্মসন্মান যখন কমে যায় তখন অনাদরকে তো অন্যায্য বলে মনে হয় না। সেইজন্যে তার বেদনা নেই। তাই তো মেয়েমানুষ দুঃখ বোধ করতেই লজ্জা পায়। আমি তাই বলি, মেয়েমানুষকে দুঃখ পেতেই হবে, এইটে যদি তোমাদের ব্যবস্থা হয়, তা হলে যতদূর সম্ভব তাকে অনাদরে রেখে দেওয়াই ভালো; আদরে দুঃখে ব্যাথাটা কেবল বেড়ে ওঠে।

 

রান্নাঘরগুলিও , বাঙালি মধ্যবিত্তের ঘরে যে “পশমের কাজের উল্টোপিঠ” এ কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নেওয়া যায় , আমাদের পূর্বনারীরা অন্তত এ বিষয়ে অন্যথা বলবেন না। আমার স্মৃতিতে দিদিমার বাড়ির সবচেয়ে আনন্দময় স্মৃতি খাওয়াদাওয়ার। সকাল থেকে রাত এক নিরবচ্ছিন্ন খাদ্যমেলা লেগে থাকা সে বাড়িতেও রান্নাঘরটি ছিল কালো কুচকুচে। কাঠের বা কয়লার উনুনে রান্না হয়ে তেল মশলা ময়লা সবটাই পাঁচ বছর বাদে বাদে “এলা” রং করানো ছাতটিতে উঠে গিয়ে সেঁটে যেত। 

 

এই একই বৈপরিত্যের বিবরণ কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অন্য লেখাতেও। উদ্ধৃত করি যোগাযোগের মধুসূদনের বাড়ির বিবরণটি, কুমুদিনী যে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিল। 

 

বাইরের মহলে সর্বত্রই মার্বলের মেজে, তার উপরে বিলিতি কার্পেট, দেয়ালে চিত্রিত কাগজ মারা এবং তাতে ঝুলছে নানারকমের ছবি– কোনোটা এনগ্রেভিং, কোনোটা ওলিয়োগ্রাফ, কোনোটা অয়েলপেন্টিং– তার বিষয় হচ্ছে, হরিণকে তাড়া করেছে শিকারী কুকুর, কিম্বা ডার্বির ঘোড়দৌড় জিতেছে এমন-সব বিখ্যাত ঘোড়া, বিদেশী ল্যাণ্ডস্কেপ, কিম্বা স্নানরত নগ্নদেহ নারী। তা ছাড়া দেয়ালে কোথাও বা চীনে বাসন, মোরাদাবাদি পিতলের থালা, জাপানি পাখা, তিব্বতি চামর ইত্যাদি যতপ্রকার অসংগত পদার্থের অস্থানে অযথা সমাবেশ। এই-সমস্ত গৃহসজ্জা পছন্দকরা, কেনা এবং সাজানোর ভার মধুসূদনের ইংরেজ অ্যাসিস্টান্টের উপর। এ ছাড়া মকমলে বা রেশমে মোড়া চৌকি-সোফার অরণ্য। কাঁচের আলমারিতে জমকালো-বাঁধানো ইংরেজি বই, ঝাড়ন-হস্ত বেহারা ছাড়া কোনো মানুষ তার উপর হস্তক্ষেপ করে না– টিপাইয়ে আছে অ্যালবাম, তার কোনোটাতে ঘরের লোকের ছবি, কোনোটাতে বিদেশিনী অ্যাক্‌ট্রেসদের।

 

অন্তঃপুরে একতলার ঘরগুলো অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে, ধোঁয়ায় ঝুলে কালো। উঠোনে আবর্জনা– সেখানে জলের কল, বাসন মাজা কাপড় কাচা চলছেই, যখন ব্যবহার নেই তখনো কল প্রায় খোলাই থাকে। উপরের বারান্দা থেকে মেয়েদের ভিজে কাপড় ঝুলছে, আর দাঁড়ের কাকাতুয়ার উচ্ছিষ্ট ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে উঠোনে। বারান্দার দেয়ালের যেখানে-সেখানে পানের পিকের দাগ ও নানাপ্রকার মলিনতার অক্ষয় স্মৃতিচিহ্ন। উঠোনের পশ্চিম দিকের রোয়াকের পশ্চাতে রান্নাঘর, সেখান থেকে রান্নার গন্ধ ও কয়লার ধোঁয়া উপরের ঘরে সর্বত্রই প্রসার লাভ করে। রান্নাঘরের বাইরে প্রাচীরবদ্ধ অল্প একটু জমি আছে, তারই এক কোণে পোড়া কয়লা, চুলোর ছাই, ভাঙা গামলা, ছিন্ন ধামা, জীর্ণ ঝাঁঝরি রাশীকৃত; অপর প্রান্তে গুটিদুয়েক গাই ও বাছুর বাঁধা, তাদের খড় ও গোবর জমছে, এবং সমস্ত প্রাচীর ঘুঁটের চক্রে আচ্ছন্ন। এক ধারে একটিমাত্র নিমগাছ, তার গুঁড়িতে গোরু বেঁধে বেঁধে বাকল গেছে উঠে, আর ক্রমাগত ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে তার পাতা কেড়ে নিয়ে গাছটাকে জেরবার করে দিয়েছে। অন্তঃপুরে এই একটুমাত্র জমি, বাকি সমস্ত জমি বাইরের দিকে। সেটা লতামণ্ডপে, বিচিত্র ফুলের কেয়ারিতে, ছাঁটা ঘাসের মাঠে, খোয়া ও সুরকি-দেওয়া রাস্তায়, পাথরের মূর্তি ও লোহার বেঞ্চিতে সুসজ্জিত।

 

বাহির আর অন্দরমহলের কী প্রচন্ড বৈপরিত্য । চোখ জ্বলে যেতে থাকে এই বৈপরিত্যে। কিন্তু একে নির্দ্বিধায়, বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করে এসেছে মেয়েরা যুগের পর যুগ। 

 

পথের পাঁচালিতে সর্বজয়ার রান্নাবাটির চিত্র, অপরাজিততে কাশীতে ধনীগৃহের রান্নাঘরে রান্নার কাজ পাওয়া সর্বজয়ার নিতান্ত করুণ অবস্থা, দারিদ্র্য, অসহায়তা ও অসুস্থতার কাহিনিও স্মর্তব্য এখানে। আরো পরে, কবিতা সিং হের নানা লেখাতে ফুটে উঠেছে এই বৈপরিত্য, ডাবল স্ট্যান্ডার্ড, এই  সব আশ্চর্য অবদমন আর অবহেলা উপেক্ষা। 

 

আসবেন অনিবার্যভাবেই আশাপূর্ণা দেবীও এই আলোচনায়। আলু কোটা, মাছ বাছা এইসবের আটপৌরে ঘরোয়া বর্ণনার ভেতর দিয়ে যিনি অনিবার্যভাবে তুলে আনবেন রান্নাঘরের রাজনীতিকে, নারীর সঙ্গে নারীর লড়ে যাওয়ার ইতিহাসকে, সমাজে পিতৃতন্ত্রের প্রতিভূ হয়ে শাশুড়ি বা পিশশাশুড়িদের অবস্থানকে, যার সঙ্গে নিয়ত সংঘাতে যেতে যেতে ক্ষতবিক্ষত হবে পরের প্রজন্মের বউমারা। এই সংঘাত মনস্তাত্বিক , রাজনৈতিক , সামাজিক। অনেক ক্ষেত্রেই যে সব রোগলক্ষণ দিয়ে এই সংঘাতকে বোঝান হবে তা হল রান্নাঘরের খুঁটিনাটি। এখানেই তার শক্তি আর ক্ষমতা। ছোটর ভেতর দিয়ে অনেক বড় কে বুঝিয়ে দিতে পারে সে। 

 

৩। গ্রামীণ জীবন আর শহরজীবন

 

কোথায় যেন, মনে হচ্ছে এই লেখাটি লিখতে লিখতেই, আমি ধরতে পারছি একটা প্যারাডাইম শিফট। একটা জল বিভাজিকা। মা যা হইয়াছিলেন থেকে মা যা হইয়াছেন এর মত। বাঙালি মেয়ে আর রান্নাঘরের সম্পর্কের যেন দুটি ধাপ। কোথায় যেন একটা রেখা । যার আগে সব নিশ্চয়তই মুগ্ধতার , সর্বসুন্দর ছিল না। কিন্তু পরের পর্ব বড় বেদনার। নঙর্থক। 

 

 অবনতিটি কি তবে  ঘটে গিয়েছে গ্রামীণ জীবন থেকে শহর জীবনে আসতে আসতে। শিল্পবিপ্লব, নগর পত্তন, নগরায়নের বিষ বাষ্প, ইংরেজ শাসনের পাকে পাকে জড়ানো কৃত্রিমতার হিসেব  – এই উপাদানগুলি, বলা ভাল ফ্যাক্টরগুলি এসে ধীরে ধীরে পালটে দিল সবাইকে জড়িয়ে নিয়ে গ্রামের মেয়ের বাঁচা, যেখানে কাজগুলিও ছিল ভাগ বাঁটোয়ারা করা। বহু নারীর এক যৌথ কৃত্য। 

 

রাণী চন্দের “আমার মা’র বাপের বাড়ি” বইটি যদি দেখি ( বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ১৯৭৭), ছত্রে ছত্রে দেখব কত না আনন্দ রন্ধনের পাকে পাকে। 

 

সরস্বতী পূজার কথা বলতে গিয়ে বলছেন রাণী, “ আজ ঘরে ঘরে জোড়া ইলিশ আসে। মামীরা জোড়া ইলিশের কপালে সিঁদুর পরিয়ে উলুধ্বনি দিয়ে বাজার থেকে আনা মাছ ঘরে তোলেন। কচি, বাচ্চা মাছ। আজকের দিনের মাছ ভাজতে নেই, সাঁতলাতে নেই। ‘একছাইয়া’ করে কেটে ফোটানো হলুদজলে মাছ ছেড়ে পাতলা ঝোল রাঁধতে হয় এই ইলিশের। “ এইভাবেই লেখেন তিনি অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে কাসুন্দি করার পদ্ধতি। সরষে ধোয়া, ঢেঁকিতে কোটা, শুদ্ধ পবিত্রভাবে কাসুন্দি তৈরির বৃত্তান্তে লেগে থাকে উৎসব, আনন্দ। মালিন্য থাকে না কোন। আমসত্ত্বের দিনে উঠোন ছেয়ে আমসত্বের ছাঁচ পড়ার গল্প লেখেন রাণী। নানা রকম পাথরের ছাঁচ। পাটি চাটাই চিকনাই, কাসারি রেকাবি বগি থালাগুলিও আমসত্ত্বের জন্য ব্যবহার করার কথা বলেন তিনি। মায়ের শৌখিন কাজ, আর দিদিমার ঢালা কাজ । এই ভাষা গুলির ব্যবহার বলে দেয় রান্না-বান্না এক যৌথ যাপনের অঙ্গ, সে এক অনেক বড় সমাজধর্ম। 

 

এখানে রান্নাঘর কোন ছোট ঘর না। তা নদীর পাড়, উঠোন, ধান ভাণার জায়গা, ধানের মরাই, সর্বত্র ব্যাপ্ত। সেখানে উনুন সূর্য দেব, উনুন সময়, উনুন এমনকি গ্রীষ্মবর্ষাশরৎশীত বসন্ত। 

 

রাণী চন্দ বলছেন, শনির পূজা, নারায়ণ সেবা, হরির লুট, বারব্রত – সব কিছুরই ভিড়ই উঠোনে। রাণী চন্দের দিদা, অন্নপূর্ণার অন্য এক রূপ যেন। নিরিমিষ রান্নাঘরের সামনে বর্ষার জল থেকে শোল মাছের বাচ্চা গামছায় ধরার গল্প থেকে, মুড়ি মুড়কি নারকেল নাড়ুর তৈরির গল্প, সবটাতেই এই অন্নপূর্ণার ভান্ডার পূর্ণ থাকে তাই। 

 

রান্নাঘরের এই সাবেক আনন্দময় বৃত্তান্ত কি অনেকটাই ভেঙে ভেঙে গেল না, শহরে এসে? তবু তার স্বাদটি লেগে থাকল লীলা মজুমদারের ‘রান্নার বই’ তে ( আনন্দ, ১৯৭৯)। যে বইয়ের ভূমিকায়  তিনি লেখেন, রান্নাঘরের বাঁদী শব্দটির বিপরীতে রান্নাঘরের রাণীদের দাপটের কথা।আবার তিনিই লেখেন, মধ্যবিত্ত পরিবারে রান্না হয়ে কয়লার উনুনে। “নোংরা হয়, ধোঁয়া হয়, বাসন বেজায় পোড়ে, রাঁধুনীর মুখে বেজায় আঁচ লাগে এবং প্রচুর তাপ নষ্ট হয়, অর্থাৎ একশো বছর আগের অসুবিধাগুলো এখনো দিব্যি প্রকট। “

 

এর পর তিনি নানা রকম ধোঁয়াশূন্য চুল্লির কথা তোলেন। স্টোভ , যা কেরোসিনে চলে, তার কথাও বলেন। 

 

এভাবেই ক্রমশ আমরা প্রবেশ করছি আমাদের সময়ে। মা মাসিদের যুগ থেকে গ্যাসে রান্না করার চল হল। এখন ত সর্বজনের কাছে লভ্য করতে প্রধানমন্ত্রীর যোজনাই রয়েছে। 

 

কবিতা সিং হ তাঁর ‘ক্ষমা’ নামের এক গল্পে হুবহু তুলে আনেন এক বিশাল যৌথ পরিবারে নববধূ হয়ে আসা এক শিক্ষিতা কর্মরতা মেয়ের কথা। বেমানান বউ। যৌথ পরিবারের মহাপরাক্রান্ত শ্বশুর। শাশুড়িকে মারেন ধরেন। অত্যাচার করেন। কেউ কিছু বলে না।  শাশুড়ি দাওয়ায় বসে কুটনো কোটেন।

 

 এখানেও পাব রবি ঠাকুরের স্ত্রীর পত্রের যেন এক সমর্থন।  এ বাস্তবতা কলকাতার বহু বহু বছরের মধ্যবিত্ত সংসারের। 

“লতার নাকে সেই ড্যাম্পের গন্ধ এখনও লেগে আছে। যেন এখনও সেই গন্ধ পাচ্ছে। যে গন্ধ পচনের উপমা। নষ্ট গন্ধ। শেষ হয়ে যাওয়ার গন্ধ। সেই নড়বড়ে প্রাচীন বাড়িটা তার মনের মধ্যে এখনো দুঃস্বপ্নের মতো বসে আছে। নীচের তলায় কতগুলো অন্ধকার ঘর। দিনের বেলায় সেখানে তেলচিটে ন্যাড়া বালব জ্বালতে হয়। ভাঁড়ার ঘর, পুজোর ঘর, রান্নাঘর, ঠাকুর চাকরদের ঘর। “

 সিঁড়ির তলার অন্ধকার  একটি ঘরকে চুনকাম করে নিজের মত করে  থাকতে শুরু করে বরণ-করে-না-আনা বউটি। কারণ ছেলে নিজের মতে বিয়ে করেছে। তারপর একদিন বউটি নিজের ছোট কেরোসিন স্টোভ এনে চা বানানোর আয়োজন টুকু করে ফেলে। মানে একটা চার দেওয়ালের মধ্যে যেন স্বাধীনতার স্বাদ। নিজের রান্নাঘর হল না। অন্তত ক্লান্তি অপনোদনের চা টুকু ত হল। 

 

কিন্তু  এই সাম্যাবস্থা ক্ষণিকের। স্বামী দেবকুমারের সঙ্গে লতার ঝগড়া বাড়তে থাকে। দেবকুমারের মা তার বাবার কাছে জো হুজুর। লতা নয় কেন। দেবকুমারের দাবী বাড়ে। লতা বোঝে দেবকুমারের ভেতরেও আছে তার বাবারই রক্ত। পুরুষত্বের দাবি।  সে হঠাত শোনে, তার ক্যাবলা নিরীহ শাশুড়ি তার স্বামীকে ভাত ডাল বেড়ে দিতে দিতে বলছে, “একদিন বেধড়ক মার দে, তাহলেই দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে…”

 

 তারপর লতা সে ঘরে ঢুকে আসে। স্বামীকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। তারপর কি হল দেখে নেওয়া যাক কবিতা সিং হের কলম থেকে। 

 

দেবকুমার তার পিছনে ছুটে গিয়ে উঠোনের মাঝখানে ফেলে তাকে প্রচন্ড মারল। শাশুড়ি নীচের উঠোনে দাঁড়িয়ে, আর দেওর ননদ ওপরে বারান্দায় দাঁরিয়ে সব দেখল। … কিন্তু কিছু বলল না। 

 

সে এক অদ্ভুত দিন।  লতা তার ঘরে ফিরে গিয়ে… ঘরের কোণে যে কেরোসিনের বড় ক্যানটা রাখা ছিল সেটা নিয়ে সারা ঘরে ছিটিয়ে দিল। তারপর দেহসলাই এর বাক্সটা হাতে করে দাঁড়াল। কি ভয়ংকর জ্বালা। আগে সে ভাবত বাঙালি ঘরের বউ রা আগুনে পুড়ে মরে কেন? আসলে এতদিনে বুঝতে পারল ওই পোড়ার জ্বালা তাদের জ্বলএন্র প্রতীক। 

 

এভাবেই বিংশ শতকের বাঙালিনি রান্নাঘরের পলিটিক্স স্থাপিত হয়। একদিকে শোষণ বঞ্চনা। অন্যদিকে টিন টিন কেরোসিনের ধোঁয়া ও আগুনের মধ্য দিয়ে প্রতীক তৈরি হয়। রান্নাঘরের বাঁদীর। 

 

৪।পরিবেশ বান্ধব রান্নাঘরের গল্প

 

আমার শৈশব দেখেছে আমার দিদিমাকে। যিনি রাণী চন্দের সমসাময়িক প্রজন্ম। আর দেখেছে মাকে। কবিতা সিং হের প্রজন্ম। চিনে নিয়েছে অন্নপূর্ণাকে দিদিমার মধ্যে।  আর নীরবে ক্ষয়ে যাওয়া পরিশ্রমে নুয়ে যাওয়া এক একাকী পথিককে মায়ের মধ্যে। তবু। দুজনেই শিখিয়ে গিয়েছেন রান্নাঘরের ভেতরে আছে অনেক পাঠ। আজকের পরিবেশ নিয়ে সচেতনতার যুগে এ পাঠগুলো বার বার ফিরে দেখার। 

 

ও বাংলা থেকে চলে আসা বাঙালরা ১৯৪৭ এর পর থেকে পাতে এক কুচি ভাত , আধখানা লঙ্কা ফেলেন নি। লেবু বা সজনে ডাঁটা বা আমের আঁটি শেষতম ছিবড়ে না হওয়া অব্দি ফেলেননি।

আমাদের ছোটবেলা জুড়ে মা , মাসি, পিশি, দিদা, মায়ের পিশিমা, সবার রান্নাঘরগুলোও এক একটা রিসাইক্লিং এর আস্ত কারখানা ছিল। রান্নার আগে কত না প্রস্তুতি। সেই সব অপার্থিব স্বাদের আলুর খোসার ছেঁচকি বা পটলের খোসার ছেঁচকিগুলো কে ভুলবে? অথবা লাউয়ের খোসার জিরিজিরি ভাজা, যাতে একটু আলু আর কুমড়ো পড়লে তা নিজেই হয়ে ওঠে একটি পদ? ভাত বাসি হলে জলে ডুবিয়ে পান্তা যেমন, তরকারি বাসি হলে সে তরকারি গরম করার তরিকাও কত রকমের। তেল গরম করে একটা শুকনো লঙ্কা ফেলে ছ্যাঁকছোঁক করলেই একদম ফ্রেশ। মাংসের ঝোল অবশ্য যত বাসি আর যতবার ফোটানো, ততই মজে অপূর্ব স্বাদ, ওটা রান্নাঘরের বেদবাইবেলেই লেখা। আর হ্যাঁ, কে ভুলতে পারে, একটু পুরনো একটু টকে যাওয়া মুশুরডালকে জল মেরে মেরে টক ডাল বানানোর রীতি। সঙ্গে তেঁতুল শুকনো লঙ্কার শুদ্ধিকরণ। আঁট হয়ে আসা সেই ডাল দিয়ে একথালা ভাত হাপুশহুপুশ করে খেয়ে নেওয়া যেত।

রসগোল্লা ঘরে এলে, মিষ্টি খাওয়া শেষ হলে রসটা চাটনিতে যেত, আর হাঁড়িটি গাছ পোঁতার জন্য বারান্দায় যেত । কাঁচা আম উঠলেই আচার হত। পাকা আম বেশি পাকলেই গুড় দিয়ে গুলে ঘ্যাঁট পাকিয়ে আমসত্ত্ব দেওয়া হত, চাঁচারির ওপর তেল মাখিয়ে প্রচুর রোদ্দুর, কাজেই সোলার এনার্জির সদ্‌ব্যবহার। চাঁচারির চালনির ছক কাটাকাটা দাগ পড়ে যেত আমসত্ত্বগুলোতে। কালো হয়ে আসা,  ছোটমুখওয়ালা টিনের ডালডা কৌটোয় সে আমসত্ত্ব তোলার আগেই যে অর্ধেক হাপিশ হয়ে যাচ্ছে সেটা অবশ্য ধর্তব্যের মধ্যেই ধরা হত না। আমসত্ত্ব আর আচার চুরির বৈধতা ছেলেপিলেগণকে দেওয়া ছিল। যা কিছু প্রভূত উৎপাদিত হত এবং পাওয়া যেত, তাই কিছু না কিছুভাবে সংরক্ষণ হত তো। শুকিয়ে, গুটিয়ে, নেড়ে চেড়ে, নানাভাবে রক্ষা করার নামই নাকি গৃহিণীপনা। কস্মিনকালেও এর সঙ্গে কৃপণতার কোন যোগ আছে নাকি?

ফেলে দেওয়ার কোন সিন ছিল না আমার মায়ের রান্নাঘরেওবাসি পাউঁরুটির তরকারি আমি এখনো বানাই, একটু পুরনো না হলে , একটু শুকিয়ে না উঠলে ওই টুকরো করে কাটা রুটিগুলোর ভাজাভাজা ভাবটা খোলতাই হয়না। শুনেছি ঠিক এইভাবে মারাঠিরা আটার রুটি , মানে যাকে ওঁরা বলেন পোলি, তার সবজি বানানো হয়। বাড়তি , ঝড়তি পড়তি যে কোন খাবার দিয়ে অসম্ভব ভাল ভাল স্ন্যাক্স তৈরি এক সর্বভারতীয় কৃতি।

অ্যান্সিলিয়ারি বাকি যা যা উদ্‌বৃত্ত হত রান্নাঘর থেকে, তা অবধারিতভাবে যেত বেড়াল বা পাখিদের খাদ্য হিসেবে। শেষ পর্যায় গাছেদের। মাকে দেখতাম মনোযোগ দিয়ে একটা বালতিতে জমিয়ে, ডাল ধোয়া জল চাল ধোয়া জল গাছের গোড়ায় দিতে। শুনেছি, আমার এক বান্ধবীর মা রান্নাঘরের পেছনের জমিতে এত রকমের সবজির জল, সবজিগুলোর বীজশুদ্ধ ফেলতেন যে সেখানে এক রীতিমত বীজতলা হয়ে, নানা সব্জির গাছ গজিয়ে উঠেছিল।

অল্প লইয়া থাকি তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়। এই গানটাও ঐ সব মা-দিদারা গাইত খুব। কিন্তু তা বলে কোন দীনতা ছিল না তো ঐ অন্নপূর্ণা প্যাটার্নের মহিলাদের মধ্যে? বাড়িতে দীয়তাং ভুজ্যতাং চলছে, চলছেই। কত লোকের পাত পড়ছে , যার মধ্যে অনেকেই অনাত্মীয়, পরিচিতমাত্র, গ্রামসম্পর্কের ভাইপো বা ভাইঝি। আর কী কী সব অদ্ভুত নাম হত বাঙালদের এই মামা মাসি কাকা ভাইবোনদের। বুজুন লালু ভুতো ভ্যাদন মনা বংকা।

সেই সব ভাইবোন ভাশুর দেওর সার দিয়ে বসে পড়লে, কারুর পাতে একটা গোটা ডিম তো অন্যদের আধখানা ডিম। মামাদের কাছে গল্প শুনতাম , বয়সে বেশি বড় নয় এমন এক কাকা, তাদের পাত থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিতেন ডিম  বলতেন,  বুঝিস না, আমার ডিমটা লাগে, শরীরটা বাড়ছে না? বাড়ন্ত গড়ন। পুরো টেনিদার গল্প।

সত্যিই তো ডিম কম পড়তই সংসারে। তাই তো, দিদার ঐ সুতো দিয়ে কেটেকুটে মাঝে মাঝেই ডিমসেদ্ধ ভাগবাঁটোয়ারা। তার পরের স্টেজে, ডিমক’টা দিয়ে অমলেট করে সেই অমলেটই কেটে কেটে ঝোলে ফেলে দেওয়া। পাতলা বা গরগরে টমেটো পেয়াঁজ রসুনের ঝোল, তার মধ্যে ভাসমান অমলেটের টুকরো। আহা। এর পরের সেটেজ, আরো যখন টানাটানি, দশজনকে তিনটে ডিম দিয়ে ঝোল করে দিতে হবে , তখন তো ডিম ফেটিয়ে তার মধ্যে ময়দা বা ব্যসন , পেঁয়াজকুচি দিয়ে গোল গোল বড়া ভেজে ঝোলে দেওয়া।

সবটাই ছিল অল্প লইয়া ম্যানেজ করার ছক।

নাঃ কোন কৃপণতা ছিল না। বরং আজকের যুগের কোন ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিট্যুটে , এ নিয়ে একটা লেকচারে ডাকা যেত দিদাকে। সর্বক্ষণ হাসিমুখে, পজিটিভ থেকে, অল্প সামর্থ্যের মধ্যে যাকিছু পাওয়া যায়, সবকিছুকে অপটিমাল লেভেল অব্দি ব্যবহার করে নিতে পারার ক্ষমতা, আমাদের নেই।

ছোট্টবেলায় শরৎ চাটুজ্জের মেজদা পড়তাম আমরা ইস্কুলের বাংলা বইতে। সেটায় মনে আছে, বহুরূপীর বাঘসজ্জার একটা দড়ির লেজ নিয়ে শেষ মন্তব্য, পিশিমার? রেখে দাও, ওটা কাজে লাগবে।

ওই এক লাইন নিয়ে অনেক টীকা টিপ্পনী লিখেছি ইশকুলে। কিন্তু তার বেশি, আমাদের মাতৃতন্ত্রের মুখে ওই কথাটা শুনেছি উচ্চারিত হতে। সবকিছুই ছিল  রেখে দাও, কাজে লাগবের দলে। এখন ফেলার কালচার এসে আমাদের গ্রাস করেছে। অল্প অল্প করে ভাত ডাল বানিয়ে ফ্রিজে রেখে রেখে খাওয়া। তাই বাসি পচা নেই। জামাকাপড় তো গন্ডায় গন্ডায় কেনা হয়, কাজেই ফেলে না দিলে আলমারিতে জায়গা কোথায়? ইউজ অ্যান্ড থ্রো-র যুগে, আমাদের জীবদ্দশায় দেখে ফেলেছি যে সংরক্ষণের ঘোর অভ্যাসগুলি, সেগুলোই বেশ কল্পকথা। 

 

ঠাকুমা, দিদু আর মায়ের ছিল শিশিবোতল জমানোর বাধ্যতা। কে জানে, ওরা আর সব গৃহিণীদের মতই, নাকি একটু অদ্ভুতই! কেন যেন আমাদের বাড়ির লোকেরা, কিছুতেই ফেলতে পারত না কিচ্ছু। একের পর এক জ্যাম জেলির বোতল আসত বাড়িতে, পরে, কাগজ-কাবাড়িওয়ালার কাছে দেওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। “কাজে লেগে যাবে” সব। এমনকি যারা মিষ্টির দোকানের রসগোল্লার হাঁড়িটি বাড়িতে এলেও,  রসগোল্লা খাবার পর রসটা চাটনির জন্য তুলে রাখে, এবং হাঁড়িটা বারান্দায় তুলসি চারা পোঁতার জন্য, জ্যান্ত শিশিবোতল তারা আর কী করেই বা কোন প্রাণে ফেলে দেয়?

হ্যাঁ, আমার ঠাকুমা যখন নিজেই টমেটো সস বানাতেন, তখন, বা আচার বিলি বন্দোবস্ত করতেন, তখন সেই সব শিশিবোতলের ডাক পড়ত। মিটসেফ নামে একটা জিনিশ থাকত সব বাড়িতে। কালচে, তেলচিটে, বাদামি থেকে কালো হয়ে যাওয়া জালে ঘেরা একটা আলমারি। ভেতরে অনেক দূর অব্দি অন্ধকারে সার সার দাঁড়িয়ে থাকত সব আচারের শিশি ও বয়াম। বয়ামে আচার বানানোর পর, মেয়েরা বাপের বাড়ি এলে তারা শ্বশুরবাড়ি ফেরার সময়ে সেই ছোট ছোট হরলিক্সের শিশিতে করে দু তিন রকম আচার যাবে না তো কী? ছেলে মেয়েরা দূরে হোস্টেলে পড়তে গেলে, তাদের সঙ্গে তিলের বা নারকেলের নাড়ু, মুড়কি, মোয়া এসব বানিয়ে বানিয়ে,  বোতলে ছাড়া আর কিসে করেই বা দেওয়া হবে। মনে নেই, অপুকে সর্বজয়া তার পড়তে যাবার সময়ে ট্রাঙ্কে কী কী বাঁধাছাঁদা করে দিয়েছিল?

ঠিক একইরকম ভাবে, গ্রীষ্মের সব ফল ফলাদি আচার হয়ে বোতলে ঠাঁই পাবে, আর শীতেরগুলিও। এমনকি, যে সব সরু মুখ টমেটো সসের বোতল আসবে বাড়িতে, সেগুলিও ধোয়া হয়ে গেলে, তার ভেতরে ভরা হবে অনেক টমেটো নুন আদা রসুন দিয়ে সেদ্ধ করে, ঠান্ডা করে, কাঁই আলাদা করে, ছেঁকে আবার বড় পাত্রে অল্প আঁচে ভিনিগার, চিনি, সব মিশিয়ে,  ঘন করে তোলা ঘরোয়া টমেটো সস। সেই সসের স্বাদ বড় কোম্পানির সসের থেকে অনেক বেশি ভাল, সে বলাই বাহুল্য। ঠাকুমা প্রতি শীতেই আমাদের জন্য নামে নামে এমন বেশ কিছু বোতল রেখে দিতেন।

এই ভাবেই বাড়িতে সার দিয়ে সাজানো ধোয়া বোতলগুলি, রান্নাঘরের কোণায় সযত্নে সাজানো থাকত। থাকত ভাঁড়ারঘরের পেছন দিকে। ভরা বোতলেরাও থাকত। গ্রীষ্মের ছুটির দীর্ঘ দুপুরে চুরি করে খাবার জন্য। লীলা মজুমদারের গল্পে যে আচার ভেবে ভুল করে কে যেন একটা মরা আরশোলাও তুলে এনেছিল। ভাঁড়ার এত অন্ধকার!

শিশি বোতলের গল্প বলতে শুরু করলেই মনে এসে যাবেন সুকুমার রায়।

মিশিপাখা শিখিপাখা আকাশের কানে কানে

শিশিবোতল ছিপিঢাকা সরু সরু গানে গানে 

নেড়া এই গানটা খুব নরমসুরে গেয়েছিল, আমাদেরও মনে থেকে গেছে যুগ যুগ। “হিজিবিজ্‌বিজ্‌ বলল, ‘হ্যাঁ, গানটা ভারি শক্ত ।’

ছাগল বলল, ‘শক্ত আবার কোথায় ? ঐ শিশি বোতলের জায়গাটা একটু শক্ত ঠেকল, তাছাড়া তো শক্ত কিছু পেলাম না ।’ …

এসব বোতলের গল্প পলিপ্যাকের যুগে এসে কি হারিয়ে বা ফুরিয়ে যাবে? কাচের বোতল ক্রমশ বেমিল হতে হতে ডোডোপাখি হয়ে গেছে। হরলিক্স কোম্পানিই কাচের বোতল বন্ধ করে পেট বোতল করেছে বহুদিন। শুনি, অনেক পরিবেশ সচেতন মানুষ আবার নতুন করে কাচের বোতল ব্যবহারের ডাক দিচ্ছেন আজকাল। প্ল্যাস্টিক বর্জনের কর্মসূচি নিচ্ছে নানা দেশ-রাজ্য-মিউনিসিপালিটি যখন, এ কথা ভাবাই যেতে পারে।

কিছু ফেলতে না পারা দিদা-ঠাকুমাদের পুরনো ছেঁড়া শাড়ির ন্যাকড়ার জায়গায় টিশ্যুপেপার আর বোতলের জায়গায় পলিপ্যাকের থলথলে শরীরগুলো, ক্রমশ ‘সুবিধেজনক’ আর ‘ইউজ অ্যান্ড থ্রো’ –মায়াহীনতায় গ্রাস করে নিচ্ছে আমাদের। যেভাবে লোপাট হয়ে যাচ্ছে দিদিমা ঠাকুমারা আর পিশতুতো মামাতো মাসতুতোরাও!

এই সময়ে দাঁড়িয়ে, আমাদের অনেক পুরনো দিনের ছাতগুলো বড্ড মায়ার হাতছানি দেয়। কাপড়ের ঢাকনি পরানো সার সার বোতল তেল –আম-কুল-তেঁতুল –লেবু নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে স্মৃতির ওপারে। মন কেমন করে ওঠে।

 

 

৫। বিশ্বজোড়া রান্নাঘর

 

শেষ করি আবার এক বিদেশের গল্প দিয়েই। ইরানের মেয়ে, থাকেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন সামিন নোসরত। বইয়ের পাশাপাশি আছে তাঁর টিভি সিরিয়াল, সমনামী। আছে নিজস্ব ব্লগ ও। বইটির নাম salt fat acid heat .,,,নুন তেল টক তাপ… এই চার জিনিসের সমন্বয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে সামিন খুঁজে ফিরেছেন রান্নার ম্যাজিক, যাদু, রহস্য। কিন্তু শেষ মেশ তিনি ফিরে এসেছেন নিজের রান্নাঘরেই। আর বলেছেন, বাড়িতে আত্মীয়দের ডাকলে তাঁদের কেও স্যালাডের পাতা কুটতে বা অলিভ অয়েলে মশলা মিশিয়ে সস তৈরি করতে কীভাবে উৎসাহিত করেন তিনি। কেন করেন? কারণ রান্না যে কোন কষ্টকর ক্লান্তিকর বিরক্তিকর প্রক্রিয়া না তা বোঝাতে চান। ফ্রেশ ইনগ্রেডিয়েন্ট, মানে তাজা সবজি তাজা মাছ মাংস তাজা মশলা শাক এইসব দিয়ে যে রান্না, তাকে ভুলতে বসেছে পাশ্চাত্যের মানুষ। 

 

আমারো এটাই প্রতিপাদ্য। সামিন নোসরতের  রান্নার বই পড়ে, তাঁর শো দেখে ভেতরের প্রতিটি তন্ত্রীতে টান পড়ল। মনে পড়ল রাণী চন্দের ‘আমার মার বাপের বাড়ি’র পাতাগুলোই আবার। মনে পড়ল আমার দিদিমাকে, আবার।

মেয়েদের সংগে রান্নাঘরে র সম্পর্ক বহুদিনের কিন্তু গ্রামীণ, প্রিকলোনিয়াল সময়ে তা ছিল সহজ, জৈবিক, স্পষ্ট। এবং অনবদমিত। শোষণ মুক্ত। মেয়েরা নয় শুধু, গোটা পরিবার ঘিরে থাকত উনুনকে। a home is where the hearth is.

আধুনিকতা, শিল্প বিপ্লব পরবর্তী অবস্থায় এটা পালটে গেল। ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক অবস্থায়, টান পড়ল খাদ্য বস্তুতে। আর মেয়েরা হলেন রান্নাঘরে র বাঁদী। রান্নাঘর হল অন্ধকার ছাইপাঁশ এর গাদার পাশের এক বন্দিশালার নাম। 

মেয়েদের অনবদমিত মুক্ত স্বাধীন ভাবতে ভাবতেই দেখলাম, রান্নার শিল্পগুণ হারিয়ে গেছে। রান্না হয়ে গেছে এক দিনগত পাপক্ষয়।  এক দু প্রজন্মে সবাই রান্নাকে এক অভিশাপ মনে করতে লাগলাম। যৌথ পরিবারগুলো আদিতে ছিল যৌথ কর্মশালা। শহরের প্রেক্ষিতে সেটা হয়ে গেল পৈশাচিক , নারকীয়। দায়হীন , ঘষ্টে চলা অভ্যাস। মনে করে দেখুন তপন সিং হের সেই “গল্প হলেও সত্যি” ছবি। পঞ্চাশ দশকে তৈরি ছবি । রান্নাঘর, তার সামনের উঠোন, তার উল্টোদিকের দালানে বসে সবার খাওয়া দাওয়া। এই যৌথ পরিবারে সুখ শান্তি নেই। আছে ঝগড়া, কর্মবিভাগ নিয়ে ক্ষোভ। নোংরা পিছল দালান। কেউ তা পরিষ্কার করার কথা কোনদিন ভাবেইনি। এই হল ঔপনিবেশিক রান্নাঘর। রবীন্দ্রনাথ যে ছাইগাদার কথা লিখলেন, তপন সিং হের ছবিতে ফুটে উঠল তার আরোও ২৫ -৩০ বছর পরের ছবি। স্বাধীনতা উত্তর কলকাতার তীব্র সংকট ময় দিনকালের ছবি। সেখানে রান্নাঘরই মাইক্রো কসম। ছোট আকারে আমাদের বিশ্বভুবন। কেউ দায়িত্ব নেবে না । সবাই একে অপরকে দুষবে। 

 

আরো পরে আসবে স্বাধীনতা। আপাত দৃষ্টিতে। পোস্ট কলোনিয়াল বা উত্তর ঔপনিবেশিক জমানায় আমরা মুক্ত হলাম। যৌথ পরিবার ভেঙে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি হল। জা ননদ শাশুড়ি গিয়ে মিক্সি আর মাইক্রোওয়েভ এল। আমাদের বাড়িতে ঢুকল রাশি রাশি গ্যাজেট। তৃষ্ণা বসাক তাঁর ‘প্রযুক্তি ও নারী’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন রান্নাঘরে হামানদিস্তা বা শিল নোড়ার বদলে মিক্সি ঢুকে পরিশ্রম লাঘব করল হয়ত, কিন্তু মেয়েদের দূরত্ব বাড়াল একে অপরের সঙ্গে। দূরত্ব বাড়ল রান্নার উপকরণের সঙ্গে। এখন মিক্সি টিকে ধুয়ে তুলে রাখতে প্রচুর সময় লাগে। পরিচ্ছন্ন রাখতে হয় প্রতিটি যন্ত্রকে। জীবনযাপন একাকিত্ব ময়, অনেক নারী মিলে মিশে গল্প করতে করতে রান্নার পরিসর চলে গিয়েছে। ক্রমশ কর্মরত , ঘরে বাইরে শোষিত মেয়েদের জীবন আরো চাপের হয়ে যাচ্ছে। 

 

 মেয়েরাও পুরুষদের সমান হল, তাতে ক্ষতি এই হল যে মার্কিন বাত্তি ওয়ালা মেয়েরা সারা সপ্তাহ প্রোটিন বার আর রেডিমেড প্রোটিন শেক খেয়ে কাটায়। দিনান্তে ক্লান্ত দেহে মাইক্রোওয়েভে পিৎসা গরম করে খায়। ভাল খেতে না পাওয়া, তাজা খাবার না পাওয়া,  সেটাও কম দাসত্ব না। তাজা সব্জি, তাজা স্যালাড খেতে হলে যে পরিমাণ পরিশ্রম তাতে দিতে হয়, তা আনন্দহীন হয়ে গিয়েছে। “সময় নেই” এর ভূত তাদের তাড়া করেছে। তাই বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। খাবারের স্বাদই শুধু কমেনি, জীবনের সাধ ও কমেছে। 

পুরুষরা আদি যুগ থেকে রান্নাঘরে যেত না বলে মহিলাদের ও আর রান্নাঘরে না যাওয়াটাকে আমরা স্বাধীনতা মানলাম। উল্টোটা হওয়া উচিত ছিল, পুরুষ নারী উভয়ের মিলিতভাবে রান্না করা চালু হওয়া উচিত ছিল। সেটা ত হল না। দার্শনিক লেখক অরিন্দম চক্রবর্তীর “স্নেহগেহবন্ধুত্ব” প্রবন্ধেও এই কথাই আছে। স্নেহ বা গৃহের টান কমছে। সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে গিয়ে তাই গৃহ ভেঙ্গে যাচ্ছে। মেয়েদের দেওয়া সেবা, যত্ন, স্নেহ, এগুলোর অবমূল্যায়ণ শুরু কবে? যেদিন থেকে বাঁধা মাইনের চাকরিতে ছেলেদের বাইরে যাওয়া, প্রতিটি ঘন্টাকে সু-উপায়ী বা প্রডাক্টিভ করে তোলার প্রয়োজনীয়তা মাথার মধ্যে গেঁথে দিলেন ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসক। ঘড়ি ধরে কাজ করে ট্যাঁকে মাইনের টাকা যে আনছে সেই শুধু সমাজে কর্মী। বাকিরা এলেবেলে আলতু ফালতু। তাই সেবা, যত্ন, গৃহ শ্রম ক্রমশ মূল্যহীন। যেমন মূল্যহীন সংসারের সেই সব পুরুষেরা যাঁরা গান গাইতেন ছবি আঁকতেন, পাড়ায় ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন, এর জুতো সারাতেন ওর বাজারটা করে দিতে যেতেন, শ্মশানবন্ধু হতেন। কুমড়ো কাটা বট ঠাকুর হতেন। কলোনিয়াল ভাষায় তাই হল ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান। এই হিসেবে দেখলে লিওনার্দো দাভিঞ্চির মত শিল্পীও আজকের সমাজে এলেবেলে গণ্য হতেন। 

 

পোস্ট কলোনিয়াল সময়ে রান্নাঘর মেয়ে পুরুষ সবার জীবন থেকেই উঠে গেল। পড়ে রইল রেস্তোরাঁ, টেক অ্যায়ে, রেডি টু ইট, প্যাকেজড ফুড, রান্নার লোক প্রমুখের তোইরি রান্না। অ্যালিয়েনেশন ঘটল টোটালি। রান্নার প্রক্রিয়ায় যে আনন্দ আছে, এটা যে সবাই মিলে ভাগ করে নিয়ে করার মত জিনিস, খেতে যতটা ভাল লাগে, রান্না করতেও ততটাই ভাল লাগা উচিত, এসব কথা  পাশ্চাত্যকে আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন সামিন নোসরতের মত অনেকে। আমাদের কবে ভ্রমমুক্তি ঘটবে কে জানে। 

 

Leave a comment