সাম্প্রতিক বাংলাকবিতার অন্নময় ভুবন

যশোধরা রায়চৌধুরী

 

একটা লেখা হয়ে উঠছে এবার

জমানো আমার পাখি পুড়ে গিয়ে সিদ্ধ হয় নুনে
হৃৎকমলিনী তাতে জুড়ে দেয় বিভিন্ন সবুজ
আমার হৃৎপিণ্ড এসে পড়ে যায় বিষাদ উনুনে …( কুন্তল মুখোপাধ্যায়) 

 

গল্প করছিলাম সংগীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগে। ঐ যে, ঔপন্যাসিকা নন যিনি ‘দুই বিঘে জমি” ও না, না, থুড়ি, শুধু বিঘে দুই-এর সম্পাদিকা। যশোদি একটা লেখা দিও। কী নিয়ে লিখব ভাই। বরং কবিতা লেখার প্রসেস নিইয়ে একটা মুক্ত গদ্য দিই? আসলে তোমাদের কাগজে এত ভাল ভাল বিষয়ে এত ভাল ভাল লেখা হয়ে গিয়েছে, কবিতা বিষয়ে নতুন বিষয় ভেবে ওঠাটাই ত একটা বিশাল কাজ, তাই না?

 

সংগীতা শুনবেই না।  না , আমরা ত কবিতাবিষয়ক বিশ্লেষণধর্মী লেখাই  ছাপি। কবিতাবিষয়ক কিছু একটা ভাব।

 

কিছুদিন আগে , মনে পড়ল, গল্প করছিলাম মথ পত্রিকার সম্পাদক, প্রিয় অনুজ  কুন্তল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। বাংলা কবিতার ভেতর কেমন করে জানি বহুদিন ধরেই রয়ে গেছে অন্নের কথা, রান্নার কথা, খাবারের কথা,  খাওয়াদাওয়ার কথা। 

 

 সেই যে ছোট্টবেলা থেকে শুনে আসছি  বাঙালির প্রিয় ব্যসন রান্না আর খাওয়া… অন্নব্যঞ্জনে মনপ্রাণ সমর্পিত রাখার কথা। রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাঁধা  মেয়েবেলা র কথা শুধু নয়, খাবারে পুরুষ নারীর বন্ধনটিও জব্বর , কেননা, “বাসনার সেরা বাস রসনায়”। 

অন্নের পার্লান্সে কথা বলে বাঙালি। অন্ন মেপে দেখে বহির্বিশ্বকে।  অন্ন দেখে দেবে ঘি, পাত্র দেখে দেবে ঝি.. এরকম অসংখ্য প্রবাদ প্রবচন ঘিরে আছে আমাদের বাঙালিদের অন্নচিন্তা-অবসেশনকে। সবচেয়ে বড় , কবিতা আর অন্নকে জুড়ে দেওয়া সংস্কৃত প্রবচন বোধ হয়, আজো বাঙালির মুখে মুখে ফেরে : অন্নচিন্তা চমৎকারা কাতরে কবিতা কুতঃ।

 

ভাত বা অন্নের সঙ্গে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মান্ডের ধারণা ভেতো বাঙালির  জুড়ে আছে। বাঙালির স্বাধীনতা ও দেশভাগ উত্তর অস্তিত্বে ত আরো বেশি করে ভাত নিয়ে একটি ভয় বা অনিশ্চিতি নিরাপত্তাহীনতার ধারণা লুকিয়ে আছে। অন্নের সঙ্গে আমাদের বঙ্গজনের  অতি জটিল এক সম্পর্ক। এক শাক্ত এক বৈষ্ণব সম্পর্ক। এক সুড়ঙ্গলালিত এক হাট খোলা সম্পর্ক। 

 

অন্ন ব্রহ্ম

 

বড় চেনা কথা অন্ন ব্রহ্ম। ফিরে যদি চলে যাই “ব্যাদের যুগে”। সেসময়ের কয়নেজ। শব্দযুগলের ভেতরে পরতে পরতে রয়ে যায় অস্তিত্বের নানা সত্য, প্রখ্যাত পন্ডিত সুকুমারী ভট্টাচার্য  বেদ উপনিষদের পাতায় পাতায় পড়ে, ক্ষুধা আর অন্ন নিয়ে কী বলেন দেখি। 

 

“বৃহদারণ্যক উপনিষদে শুনি, ‘প্রথমে এখানে (এই বিশ্বভুবনে) কিছুই ছিল না, এ সব মৃত্যু দিয়ে আবৃত ছিল। ক্ষুধা দিয়ে, ক্ষুধাই মৃত্যু-নৈবেহ কিঞ্চনাগ্র আসীস্মৃত্যু নৈবেদমাবৃতামাসীৎ। অশনায়য়াহশনায়া হি মৃত্যুঃ ‘ (২:২:১)। এ কথা ব্ৰাহ্মণসাহিত্যে বহুবার শুনেছি, এখন উপনিষদেও শোনা যাচ্ছে। অবশ্য বৃহদারণ্যক উপনিষদ তো সরাসরি শতপথব্রাহ্মণেরই শেষাংশ। ব্রাহ্মণসাহিত্যই যেন বিবর্তিত হয়েছে উপনিষদে, কাজেই এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। সেই প্রসঙ্গে আগের মতোই শোনা যায়, ‘অন্ন থেকে বীর্য–অন্নাদ্বীর্যম।’ (প্রশ্ন উপ, ৬:৪) এ যেন ব্ৰাহ্মণসাহিত্যেরই অনুবৃত্তি, চেনা কথার পুনরুচ্চারণ। ছান্দোগ্য বলে, ‘যে কুলে (বৃহৎ যৌথ পরিবারে) এ আত্মা বৈশ্বানর (অগ্নি)-কে উপাসনা করা হয়, সেখানে (লোকে) অন্ন আহার করে, শ্ৰী’র দেখা পায়, তার ব্রহ্মদীপ্তি আসে–অত্ত্যন্নং পশ্যতি শ্ৰিয়ং ভবত্যস্য ব্রহ্মবৰ্চসম। কুলে য এতমেবাত্মানং বৈশ্বানরমুপাস্তে।’ (ছা/উ ৫:১২:২; ৫:১৩:২; ৫:১৪:২; ৫:১৫:২) এই ধরনের কথাই শুনি অন্যত্র: ‘মহ হল অন্ন। অন্নের দ্বারাই সকল প্ৰাণ মহিমান্বিত হয়–মহ ইত্যন্নম। অন্নেন বাব সর্বে প্ৰাণা মহীয়স্তে।’ (তৈত্তিরীয় উপ. ১:৫৩) হঠাৎ শুনলে কেমন অবাক লাগে, উপনিষদের যুগে–যখন আধ্যাত্মিকতাই জয়যুক্ত, যখন ব্রহ্মাই পরম সত্যতখন নেহাৎ তুচ্ছ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় বস্তু অন্নকে এই গৌরব দেওয়া হচ্ছে: ‘অন্নের দ্বারা সকল প্রাণ মহিমান্বিত হয়।’ যতদিন গেছে ততই মানুষ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর ভাবে বুঝতে পেরেছে উচ্চ কোটির দার্শনিক চিন্তা গৌরবের বস্তু হলেও সে চিন্তার আধার যে শরীরটা, তাকে বাঁচিয়ে রাখে অন্নই, কাজেই চিন্তার মহিমা অন্নের ওপরে একান্ত ভাবেই নির্ভরশীল, এ অন্ন মহ, মহৎ, এর মধ্যে নিহিত প্ৰাণের মহিমা। অন্নেই এই সমস্ত প্রাণী নিহিত–অন্নে হীমানি সর্বনি ভুতানি বিষ্টানি।’ (বৃ/আ/উ ৫:১১:১)। সমস্ত প্রাণীর আধারভূত অন্ন, অন্ন বিনা প্রাণীরা জীবন ধারণ করতে পারে না, আর জীবনই যদি বিপন্ন হয় ত উচ্চ চিন্তা তো নিরবলম্ব হয়ে পড়ে। কাজেই এদের মুক্তদৃষ্টিতে অন্নের তত্ত্বটি খাটি ভাবেই ধরা দিয়েছিল। অন্য রকম চিন্তাও ছিল, কিন্তু এই ধরনের নির্মোহ দৃষ্টিও ছিল। …

ছান্দোগ্য উপনিষদে, আচার্য শিষ্যকে বলছেন ‘হে সৌম্য, মন হল অন্নময়–অন্নময়ং হি সৌম্য মনঃ ‘ (ছা/উ ৬:৫:৪)।অন্ন মহৎ, প্ৰাণি-মাত্রকেই জীবনধারণের জন্য অন্নের উপর ভরসা করতে হয়, কারণ অন্ন বিনা প্রাণরক্ষাই হয় না। তাই এদের বলতে হয় যে, ব্রহ্মা-আত্মা-ঐক্য কে যে অবধারণ করবে। অর্থাৎ জানবে সেই মন হল অন্নময়। এবং অন্নের এই মহিমার স্বীকৃতি নানা ভাষায়; আর এর স্বীকারের পিছনে আছে তার দুষ্প্রাপ্যতা। অন্ন সহজলভ্য হলে তার এত মহিমা কীর্তন থাকত না। বৃহদারণ্যক উপনিষদ খুব খোলাখুলি ভাবে বলেছে, অন্ন বিনা প্ৰাণ শুকিয়ে যায়—শুষ্যতি বৈ প্রাণ ঋতেহন্নাৎ।’ (বৃ/আ/উ ৫:১২:১) অন্নের মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘অন্ন বলের চেয়ে অধিক… অন্নকে যে ব্রহ্মা বলে উপাসনা করে সে অন্নবান, পানীয়বান লোকে প্রতিষ্ঠিত হয়–অন্নং বাব বলাণ্ডুয়ঃ… যোহন্নং ব্রহ্মেত্যুপাস্তেহান্নাবতো বৈাস লোকান পানবাতোৎভিসিন্ধ্যাত।’ (ছা/উ ৭:৯:১) এখানে প্রণিধান করবার মতো কথাটা হল, ‘অন্নকে যে ব্রহ্মা বলে উপাসনা করে।’ উপনিষদে মাঝে মাঝেই অনেক বস্তুকে ব্রহ্মা বলা হয়েছে, যেমন প্রাণ, মন, ইত্যাদি। এগুলি দার্শনিক তত্ত্বের উপাদান, ব্রহ্মের কল্পনা থেকে দূরে নয়। কিন্তু অন্ন? সে যে নেহাতই স্থূল বস্তুজগতের দৈনন্দিন প্রয়োজনের সাদামাটা বস্তু। ধর্ম দর্শন, ব্রহ্মাতত্ত্ব থেকে বহু যোজন দূরে তার অবস্থান। সেই অন্নকে ব্রহ্মজ্ঞানে উপাসনা করার কথা বলা হল।”

 

( অন্ন ব্রহ্ম, বেদে ক্ষুধা প্রসঙ্গ, সুকুমারী ভট্টাচার্য) 

 

সেই একই পাঠ বেঁকিয়ে চুরিয়ে দিতে পেরেছেন  ষাট দশকে এক ঘোষিত বামপন্থী কবি। যিনি নিশ্চিতভাবে পাঠবস্তু হিসেবে পড়েছিলেন হিন্দুর তথাকথিত ধর্মগ্রন্থ উপনিষদ, তৈত্তীরিয় উপনিষদের সেই উক্তি, ‘আমি অন্ন, আমি অন্ন, আমি অন্ন; আমি অন্নভোজী, আমি অন্নভোজী, আমি অন্নভোজী ( অহমন্নমহমন্নমহমন্নম। অহমন্নাদোহহমস্নাদোহহমান্নাদঃ।’ (তৈ/উ৩:১০:৬) অথবা এই কথা , যে অন্ন থেকেই প্রাণীরা জাত হয়, অন্ন দিয়েই জাত প্রাণীরা বেঁচে থাকে। অন্নে প্রবিষ্ট হয়ে প্রাণীরা লীন হয়ে যায়। 

সেই পাঠকে যুগোপযোগী করে নিয়ে, দুর্ভিক্ষ-উত্তর বাংলার জোতদার রাজনীতিক কালোবাজারিদের জন্য বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখলেন, 

“অন্ন আলো, অন্ন জ্যোতি, সর্বধর্মসার।

অন্ন আদি, অন্ন অন্ত, অন্নই ওঙ্কার। 

সে অন্নে যে বিষ দেয়, কিংবা তাকে কাড়ে,

ধ্বংস করো, ধ্বংস করো, ধ্বংস করো তারে।”

 

চিরদিনকার  কবিতাতেই ক্ষুধা আর মানুষের কথা বলে চলেনে কবি। কখনো ভঙ্গিটি অবচেতনের ভেতরে ঢেউ তোলা। “হা অন্ন, জো অন্ন” কবিতাটিতে,  দেবারতি মিত্র ভিখিরিদের ভিক্ষার কথা বলেন তিনি এভাবেইঃ

“পাহাড়ের নীচে ভিখিরিরা সারাদিন ভিক্ষে করে/ রান্নার কাঠকুটো কুড়িয়ে ফিরে এল। / তাদের মন কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলল না। / তাদের বুক ফাঁকা, পেটে আগুন,/ প্রাণ কেঁদে উঠল – ভাত, ভাত।“ ( হা অন্ন, জো অন্ন, দেবারতি মিত্র, মুজবৎ পাহাড়ে হাওয়া দিয়েছে) 

 

নব্বইপরবর্তী খাদ্যপানীয়জগতের উঁকি

 

আমাদের এ আলোচনা তবু ঘুরুক ফিরুক সাম্প্রতিক কালের বাতায়নে। কেননা আমাদের এই সময়ের তরুণদের লেখালেখিই আজ আলোচ্য। এক বা একাধিক কোণ থেকে আলো ফেললেও আমরা দেখছি বাঙলা কবিতার আজকের বাচনেও খাবার আছে। খাদ্যের রকমফের ঘটেছে। চিরাচরিত খাদ্যপানীয়ের পাশে এসে বসেছে ফাস্ট ফুড, বা স্ট্রিট ফুড, দুধের পাশে বসেছে মদ,  কফির দোকান এসে মাথা গলিয়েছে ছোট্ট চা- দোকানে চা আর লেড়ো বিস্কুটের পাশে।  

 

১৯৯০ থেকে ২০০০ আমরা জানি এই দুই দশকে বাংলা কবিতা্র ভাষা নানাভাবে পুনরাবিষ্কৃত হয়েছে,  নানাভাবে নতুন দিক নির্দেশ করেছে। এই নতুনত্বের একটা বড় অংশ মিশে আছে দৈনন্দিন ও বদলে যাওয়া জীবনযাপনের কথা হুবহু কথ্যভঙ্গিতে তুলে আনার দিকে। 

 

এই বিশেষ অভিমুখের একট বিশেষ অংশ, বাংলা কবিতায় খাওয়াদাওয়া, খাদ্য বস্তু, ফাস্ট ফুড, রান্নাবান্নার রেফারেন্স। কখনো সরাসরি কখনো বা প্রতীকে উপমায় ব্যঞ্জনায়, অন্নব্যঞ্জন, খাদ্য খাবার এসেছে কবিতায়। এসেছে বললে ভুল হবে, একটা ধার পেয়েছে, একরকমের মান্যতা পেয়েছে। কেননা আজকের কবিতা প্রতিদিনের যাপনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে নালেঝোলে কব্জি ডুবিয়ে আসক্ত-আলিঙ্গনাবদ্ধ। 

 

তোর পিঠের তিলগুলো দিয়ে নতুন রেসিপি বানিয়েছি। আজকে আমার সাথে লাঞ্চ

কর। আমাদের গন্ধ মিলেমিশে ভরে আছে ডাইনিং রুম । তোর হাতের নিচের দিকটা

খেতে খেতে মনে হয় বাঁ পা-টা একটু টেস্ট করি । নোনতা বুড়ো আঙুলের মাথাটা

জিভে নিই। ছ’ ঘন্টা ম্যারিনেট করা তুই গলে যাস আমার মুখের মধ্যে । ডানদিকের

বুকে এসে কিছুক্ষণ দম নিই । আর ওটা? ওটা রেখে দিই সবার শেষে খাব বলে । 

 

(স্বাগতা দাশগুপ্ত ,আ লা কার্টে)

 

এ লেখায় আছে ঔদ্ধত্য আর গ্লোবালাইজড বাঙালির  নিজস্ব মুদ্রা। একই ঔদ্ধত্য নিয়ে ,

বল্লরী সেন অনায়াসে লিখতে পারেন, দেহদানের ফি, দু পেয়ালা ধূমায়িত কফি। বা , অন্য আখরে, বিষাদের তামাশা আর ভালবাসার অক্ষমতাকে হুবহু  তুলে আনতে পারেন খাবারের অনুষঙ্গে, 

 

ধনিয়াখালির বাঁজা মেয়ে, কাপড়ের কমলা পাড়ে

কতবার সে তার কৈশোর মুছে ফেলেছে

গৃহে তার ১৮ বছরের পুত্র

প্রতিরাতে

একই খাটে শুয়ে

মাংসের কোয়াগুলো ফেলে দেবে বলে

ফ্রিজ থেকে বার করে, ভুলে যাওয়া কৌটোয় তার

যোনি খুলে রাখা আছে ২২ বছর…কদমের থেঁতলানো

পিন্ডের ওপর মায়া হয়। মনে হয় এই বুঝি ডাকলো কেউ

কেউ যেন বুক ফাটিয়ে কেঁদে বারণ করছে

আসলে কেউ নয়।

পর পর সমস্ত সংখ্যা প্রতারক। একে একে সব্বাই আমারি

গায়ের পরে ভাত উগলে দেয়। বিগতজনমের অন্ন তরকারি,

নৈহার ফেরত মেয়ে যেমন কান্নার ভেতরে ছুড়ে দেয়

টুকরো করা হরলিক্স বিস্কুট, চাদমালা হরফের পাশে।

( বৃষ্টিবাহী ফেরি, বল্লরী সেন ) 

 

অথবা , 

মনে-রাখা রোদ্দুর এখন বারখলোমিউ-এর ছাতিম

পাতায়

—তুই একা সব পোড়ানো মাছের ছালটুকু বসে

খেয়ে নিলি?

—একটাই খাবার প্যালেট, রঙ লাগছে দানায়

দানায়, মাছের ঘিলুর মতো অসমাপ্ত আকাশ

একটু করে সূর্যকে টেনে রাখতে চাইছে

—তোর গলা ওই বুঝি শুনলাম। বুঝি ভিড়ের

মধ্যে তোর ঘ্রাণ। জলে তোর নিস্তরঙ্গতা, কেবল

আসে আর চলে যায়

—ফর্কের পিনে তোকে কাঁটা ফুটিয়ে ছুঁয়ে দেবে

ছেলেবেলা, তখন আমরা ২২ বছর পর রুমাল

চুরির খেলা খেলবো

—তুই কেবল হাঁটুতে বল নিয়ে লোফালুফি করবি

আর হুস্ করে কফির মতো আমি উড়ে যাচ্ছি

পাহাড় রঙের একটা তুষারপাতে।

এখন এটাই আমাদের শীত শীত খেলা।

( বল্লরী সেন, সুরের শৌহর) 

 

সাঁওতাল পুরুষের মত বন্য তোমার রূপ/একমাত্র তোমার পাশেই নিজেকে মনে হয় তপ্তকাঞ্চন/…

বড় জোর রাতের ভদ্র গৃহস্থ রান্নায় আনব/মহুয়ায় ম্যারিনেট করা বনমোরগের স্বাদ।

 

                      ( রূপলাগি, পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়, শালপাতাটা ফেলার আগে)

ম্যারিনেট, মাইক্রোওয়েভ, কফিশপে বিধুর হয়ে ওঠে নব্বই-দুহাজারি বেলাগুলি। নিজেও লেখার মধ্যে এনেছিলাম ডালহৌসির চাউমিন গন্ধ, এনেছিলাম রোলের দোকান, নব্বইয়ের নতুন ভাষার ঝোঁকে, রোজকার যাপন বলার ঝোঁকে।  নব্বই পরবর্তী কবিরা, দুহাজার পরবর্তী কবিরা, হয় খুব উচ্চকিত ভাবে দ্যাখনদারি নিয়ে খাবার খাদ্যকে উদযাপন করেছেন, বাহারি আলো , কফিশপের গন্ধকে বরণ করেছেন মুক্ত অর্থনীতির খোলাবাজারে নেমে, নয়ত নস্টালজিয়া বিধুর মৃত্যুচেতনার দিকে মুখটি সযত্নে ফিরিয়ে নিয়ে ভারি নতমুখে নিচু কন্ঠস্বরে যাপন করেছেন খাবার ও মানবজীবনের অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক সংলগ্নতাই। বহু আগে নব্বইয়ের দুটো ধারা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেছিলাম একই অঙ্গে ইন্ডিয়া ও ভারতের কথা। আজও সেইরকম করেই দেখতে ইচ্ছে হয় , অথবা মিলেমিশে যেতে দেখি এই সময়ের কবিতায় ভারত ও ইন্ডিয়াকে। আলাদা করা যায়না। 

 

ঐ আলোঝলমল ফুড কোর্টের পাশে পাশে, নিবিড় নির্জনভাবে খাবারকে দেখা,  খাদ্যবস্তুর সঙ্গে মৃত্যু ও ধারাবাহিকতা চেতনার একটি নমুনা তাই এইরকম ও পাচ্ছি :

 

“পিতৃতর্পণের দিনে পূর্বপুরুষেরা ছাই খুঁজতে আসেন

বসতবাড়িতে, কর্মক্ষেত্রে, চেনা চা দোকানে…তিনি দেখছেনঃ তাঁর লাগানো

তুলসিগাছটা আর নেই – যে আরামকেদারায়

বসে রোদ্দুর মাখতেন, সেটা বারান্দার এক কোণে

বর্গী আক্রমণ হয়ে গেছে…। … সেই হাওয়ায় তিনি ফিরে যান…

বাড়ির নতুন বউ স্বপ্নে দেখে বাবা এসেছেন।

চা খাচ্ছেন, সঙ্গে এক জামবাটি মুড়ি-চানাচুর…”( ‘মহালয়া’ , রাজদীপ রায়, জন্মান্ধের আলো)

 

মগ্ন এক পারিবারিক নস্টালজিয়া বিধুরতা আমাদের ছেয়ে ফেলে, তুচ্ছ হয়ে ওঠে অসামান্য। 

অন্য এক কবির অন্য কবিতায় আসে মশলাবাগানের গন্ধ। 

“সবাই তো জানে আমি আর ঈশ্বর খুব মিশুক নই

তেজপাতার বস্তা থেকে ঘ্রাণ নেই তেজপাতা ও অবয়বের

অসমাপ্ত এস এম এস করি, মোবাইল হারাই ছায়াপথে

কথা বলতে গিয়ে বারবার হোঁচট খাই “( তেমন মিশুক নই, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, জলবিষুব জংশন)

 

ছোট্ট চা দোকান

ছেলেরা চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয় , মেয়েরা চা বানিয়ে দেয় ছেলেদের। এমন এক অলিখিত জেন্ডার ঘটিত, লিঙ্গবৈষম্যের অদৃশ্য মানসিক প্রি অকুপেশনের বেড়াজাল আছে হয়ত বা। তবু চায়ে পে চর্চা থামে না আমাদের। ইংরেজরা বছর দেড়শো আগে বাঙালিকে চা ধরিয়েছিল… আর চায়ের চাষ করিয়েছিল বঙ্গভূমির দার্জিলিং প্রদেশে… তারপর থেকে চা নিয়ে কত না মজা , খেলা , কবিতা, আনন্দ, ছড়াকাটা, ব্যঙ্গবিদ্রূপ ও আমাদের। আমাদের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে চায়ের ওতোপ্রোত সম্পর্ক এনে ফেলা হল কীভাবে তা নিয়ে মূল্যবান কাজ করেছেন শ্রী গৌতম ভদ্র। আমাদের দেখা শুধু সামান্য এ চা বিবরণী কীভাবে আলতো ছায়াপাত করেছে আআদের সাম্প্রতিক  সমসাময়িক কবিতায়। 

 

“শীতকাল চলে এল/ গড়াল বিকেল/ এঁটো কাপ ডিশ ধুরে ধুরে দেখি/ জল শুকিয়ে আসছে কেটলির/ নিভু নিভু আঁচ… বেকারি বিস্কুট থাক/ চানাচুর কেক/ থাক সিগারেট…”

 

এ কবিতা চা দোকান চালানোর কবিতা। নারী না পুরুষ কন্ঠ বলছে এ কথা? ধাঁধা থেকে যায়। শেষকালে ধাঁধা কাটে হয়ত বা। “আচমকা ঢুকে পড়ো যদি/ আর বৃষ্টি নামে/ঝড় ওঠে কালবৈশাখীর/ সংগে প্রেমিকাও থাকে যদি/ উনুনে পড়বে আঁচ/ চায়ে দেব আদা ও এলাচ/যদি মনে ধরে/ ছোট্ট এই চায়ের দোকান/ তোমাদের/ গোলাপ… গোলাপ…”

 

এ কবিতা লিখেছেন তিলোত্তমা বসু, বইয়ের নাম ছোট্ট চা দোকান। এর পরে পড়ব আর একটি কবিতা, নাম “চা”। 

 

রবিবারের বিকেলগুলো বেশ শ্লথভাবে কেটে যায়। এমনই এক সাধারণ রবিবার। সন্ধে পাঁচটা নাগাদ নিয়ম মত মধ্য গ্রামে “চা নাও”বলে ডাক দিয়ে তিতি-রমা সরে যায় অন্য কাজে। টেবিলের সামনে গিয়ে দেখি দুটি কাপে চা রয়েছে। একটি ধূমায়িত অন্যটি নয়। বুঝি ধূমায়িত কাপটি চার, অন্যটি আমার। কারণ ঠান্ডা চা-ই আমার পছন্দ। 

 

চিনি ছাড়া, দুধ ছাড়া, চালু ও স্পেশাল বহুবিধ চা পাশাপাশি অনেক দেখেছি সর্বত্র। কিন্তু একই সঙ্গে বানাও দুকাপ চায়ের একটি ধূমায়িত অন্যটি ঠান্ডা হওয়া সম্ভব কীভাবে?

 

রান্নার এই সূক্ষ্মতম ব্যবহারিক দিকটি প্রতিদিন নজর এড়িয়ে যায়, কারণ আমার নজর সবসময় সুবিধা গ্রহণের দিকে ঝুঁকে থাকে। তবু কোনো এক শান্ত শ্লথ দিনে দৃষ্টিবান হয়ে উঠি। দেখি গৃহকর্ম নিপুণতা – বিশুদ্ধ নিপুণতাকে ছাড়িয়ে চলে যায় কোনো এক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিভেদ দর্শনের দিকে।  ( চা, প্রদীপ সিং হ, পরমার্থ ও লোকাল থানা)

 

ইফ চা কামস, ক্যান বিস্কুট বি ফার বিহাইন্ড? চা আর বিস্কুটের সখ্য ত সর্বজনবিদিত। বিশেষত লেড়ো বিস্কুট। 

 

“আমরা ক্লান্ত হয়ে লোকাল ট্রেনের সিটে/ পাশাপাশি বসি/ মানুষের শব্দহীনতা নিয়ে আলোচনা করি/ চায়ে লেড়ো বিস্কুট ডুবিয়ে খেতে খেতে বুঝি/ আমাদের একটাই পৃথিবী। ( ৯, অনির্বাণ কর, ঈশরের মেসযাপন ) 

 

একরকমের ভালবাসা ও “চা খাওয়ানো” যে সমার্থক, তা আমরা অদিতি বসু রায়ের কবিতা থেকে জানি। 

“বাগানে মোড়া পেতে বসে শব্দছক মেলাতে পারিনি বলে,/ প্রতিবেশীর বিয়েতে নিমন্ত্রণ হয়নি।/ সুতির শাড়িতে ফলস পরাই না বলে, ভাত পুড়ে গেছে।/ ফেরত খুচরো না গোনায় পাড়ার পাগল চা খাইয়েছিল একবার। “ ( পিন নম্বরহীন কলকাতা, অদিতি বসুরায়, পালটাচ্ছে ইউজার নেম) 

 

ফাস্ট ফুড জিন্দেগি

 

নয়ের দশক থেকে ফাস্ট ফুড হল আমাদের নিজস্ব কথনবিশ্বের অংশ । পথে চলতে চলতে দেখা শোনা শোঁকা ও খাওয়া প্রতিটি দুরন্ত খাবার আমাদের কবিতার ভেতরে গুঁড়ি মেরে ঢুকেছে। আমার নিজের লেখা লেখিতে এসেছিল টং টং আওয়াজ করে যাওয়া দোসার গাড়ি অথবা রোল চাউমিনের কর্নার দোকান… আজো তাদের অপ্রতিরোধ্য আগমন। 

 

অরিন্দম রায় লিখছেন, 

 

সমস্ত শহর আমি চুরি করে রেখে দেবো নিজের ভেতরে/ যেভাবে ধোসার পেটে লুকনো তরকারি থাকে/ দক্ষিণ ভারত থেকে/ নিছক বেদনা কিছু মিশে যায় সম্বরের ঘ্রাণে। / গ্রাহক যা বোঝে না/ শুধু রাঁধুনিই জানে ( ধোসা, অরিন্দম রায়, নির্বাচিত শূন্য)

 

এ কবিতার ভেতর আছে মন খারাপের ঘ্রাণ, সঙ্গে ভিন প্রদেশের সংস্কৃতিকে আপন করা বাঙালির অভিজ্ঞান। 

 

অথবা অভিজিৎ বেরা লিখছেন, 

 

“ওদিকে হিন্দিগান, এদিকে কুকুর। মাঝখানে বিকেলের ধোসাওয়ালা ঘন্টি বাজাচ্ছে। … আয়াদের সঙ্গে বাচ্চারা ঘরে ফিরলে হিন্দিগান বন্ধ হবে…হোমওয়ার্কের সামনে ঢুলতে ঢুলতে বাচ্চাগুলো দেখবে/ ক্লাসের মিস ধোসা বানাচ্ছে,/ ওরা তার মধ্যে টপাটপ ঢুকে পড়ছে। / এর থেকে ভাল পালানোর জায়গা আর হয়না। “( পালানোর জায়গা, অভিজিৎ বেরা , গডজিলার নিজস্ব ইতিহাস) 

 

ডিম্ভাত , ডিম্ভাত!!!

ডিম-পাঁউরুটির মত জীবনে, তুমি এলে

একটি হলুদ রঙের কলা…

নিটোল আকার দেখে, বিশ্বাস করো,

ভারি খিদে পায়… ( ডিম পাউঁরুটির কবিতা, রাজশ্রী চক্রবর্তী ,  )

 

এমন দিন পড়ল, বাংলার রাজনীতির পুরো এলাকাটাই দখল করে নিল ডিম্ভাত অথবা ডিম+ভাত। কোন এক ময়দানে কোন এক ব্রিগেডের সভায় যোগদানকারীদের ডিমভাতের প্রলোভন দেখানোর নামই রাজনীতি, এমন এক ডিসকোর্স টাটকা তাজা হয়ে উঠে এসেছে এ ভুবনে। অন্যদিকে মিডডে মিলে শিশুরা এক পেট ভাত পাচ্ছে কিন্তু একটা ডিম পাচ্ছে কিনা তা নিয়ে তরজা উঠছে চরমে।   ভাবতে আশ্চর্য লাগে, এসব ঘটছে আমাদেরই তথাকথিত বিশ্বায়িত সময়ে।

ডিম নামক বিষয়টি হয়ত বা আমাদের , যারা ৬০ দশকের সন্তান, তাদের জীবনে ছিল গুরুত্বপূর্ণ, কেননা হ্যাচারিগুলির রমরমার তখনই শুরু। আমাদের শৈশবে কারো বাড়িতে সৌজন্য সফরে গেলে, চা মিষ্টির পাশে যদি একটা ডিমভাজা জুটত তা ছিল মহার্ঘ। পিকনিকে অবশ্য খাদ্য ছিল ডিমসেদ্ধ আর কলা দিয়ে কাঁচা পাউরুটি। এসব ছাপিয়ে তারপর দৈনন্দিন জীবনের পরতে পরতে ডিম অনুপ্রবেশ করল। এমনকি পথখাদ্য হিসেবে সবচেয়ে সুলভ হল ডিম। তারের খাঁচার মত গোল ঝুড়িতে তাই ডিমসেদ্ধ অলংকার হয়েছে, রাস্তায় উনুন পেতে ডিম পাউরুটি বিক্রির সুলভতা পাওয়া গেছে। অনেক অজস্র ডিম ভাজার গন্ধ আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে আকুল করেছে।   তাই কি, আমাদের সময়ের কবিদের কবিতায় ডিম , ডিম, ডিম আর ডিম? 

লাল লঙ্কার মিশেল দেওয়া ডিমের  ঝোলের খোঁজ/ খিদের মুখে ভাতের পাতে যেমন/           তোমায় তেমন খুঁজেছি রোজ রোজ। …ডিমের মত স্বাদু এবং পুষ্টিকর ছেলে/সোনালি চুল রূপোর মেয়ে পেলে/দারুণ দিনে বুঝো/ঘাম, তেল আর আঁচের গন্ধ খুঁজো । ( রূপকথার পরে, পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়, জাদুদেবতার জন্য) 

               অথবা

“ডিম ভেঙে প্যানের উপর ছড়িয়ে দিতেই, তুমি পৃথিবীর গোলাকার নিয়ে শুরু করলে খেলা। তাতে ছড়িয়ে দিলে পেয়াঁজের কুচি। ভূখন্ড মূলত ক্ষমতায় চিহ্নিত, তাই, নুন ও সামান্য গোলমরিচের গুঁড়ো ছাড়া খাবার অযোগ্য। 

প্লেটে, কাঁটাচামচের পাশে টম্যাটো ও চিলি সস ঢেলে , পরিবেশনের আগে রাষ্ট্রসংঘের ঢংয়ে এই যে হাসলে;

মনে হল, অতিথির প্রতি

ভারতীয় সংস্কারের কথা। 

( আপ্যায়ন, পল্লব ভট্টাচার্য, নিঃশব্দের নীচে) 

 

কামনা বাসনার সঙ্গে অতএব মিলেমিশে যাবে ডিমটোস্ট। 

 

ততক্ষণে আমি প্লেটনিক যুদ্ধে হেরে গেছি, কথা বলেছি/ সূপ ঢেলে দিয়েছিল তারপরি রোয়িং রোয়িং/ দক্ষিণ থেকে চলে গেছি প্রায় হিন্দ সিনেমা পর্যন্ত/ আর দীর্ঘ ছায়া আমাদের ঐ অর্থোডক্স চার্চ/ বন্ধ সিনাগগ অবধি গিয়ে পড়েছে/ তেল কালি ঢালা অর্ধেক বন্ধ ট্রাম লাইনের পাশে/ লোহাগুদামের পাশে চামেলি ফিল্ম লেট ক্যাপিটালিজম/ চা ডিমটোস্ট সোনি শোরুম শ্রী শ্রী চন্ডীর পাশে/ আমাকে নগ্ন কর প্রকাশনা সংস্থার একটু আগে। ( ডিজায়ার, ঈপ্সিতা হালদা, কা আ)

 

ডিম পর্ব শেষ করতে হয় এই অনবদ্য কবিতাটি দিয়ে। অভিজিৎ ঘোষের লেখা। 

আজ ডবল আনন্দ।/ মা রাঁধছে হাঁসের ডিমের ঝোল/ সাথে পোস্তর বড়া, / আমরা সবাই অবাক চোখে মাকে দেখছি / যেন প্রথমবার…/ডিমের ঝোল ফুটছে টগবগিয়ে, / যেন নিঝুম রাতে হাজার খুরের শব্দ/ ঝোল নেমে কড়াইয়ে পড়েছে পোস্ত,/ ফটফটিয়ে শব্দ/ আমাদের জোড়া জোড়া চোখ/গিলে খাচ্ছে মাকে – আর মাকে মনে হচ্ছে দশভূজা…/এক হাত সামলাচ্ছে ডিমের ঝোল/ অন্য হাত পোস্তর বড়া,/ কোনোটায় গরম ভাত,/ বাকি হাতেরা আটকে রাখছে/ আমাদের, ঘরের কোণে/ আজ মহালয়া/ দেবীপক্ষের শুরু।  ( আজ মহালয়া, অভিজিৎ ঘোষ, অলীক বাড়ির খোঁজে) 

 

মাংস  মনোরম

সকল ফুলের কাছে এতো মোহময় মনে যাবার পরেও/ মানুষেরা কিন্তু মাংসরন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। /বর্ণাবলেপনগুলি কাছে গেলে অর্থহীন, অতি স্থূল ব’লে মনে হয়। ( বিনয় মজুমদার)

বিনয় মজুমদার চিরনমস্য আর বেদবাক্য প্রতিম তাঁর সামান্যীকরণ বা জেনারালাইজেশনগুলি । তা থেকেই ডেরিভেটিভের মত নেমে এসেছে পরবর্তীতে আমাদের প্রজন্মের হাতে মাংস-ভজনার সমস্ত ঝালমশলা যেন। রবিবারের  মাংস রান্নার ঘ্রাণ মিশ্রিত, প্রেশার কুকারের সিটিমুখরিত বেলা বারোটা মধ্যবিত্তের স্বর্গ ছিল বহুকাল, মাংস খাওয়া আমাদের সারা সপ্তাহের বেঁচে থাকায়ে খুলেছড়িয়ে মিশে যাবার আগে। নস্টালজিয়া তবু পিছু ছাড়েনা, মফস্বলি বিয়েবাড়ির  নস্টালজিয়া যেমন উঠে এসেছে এই লেখায়ঃ

“চেনা লোকেদের বিবাহ যেমন, অঘ্রাণের শেষে মফঃস্বলে / ফিরে যেতে হত। যশোর রোডের ধারে সন্ধ্যে নেমে এলে/ আমরা খেতে বসতাম। কেটারিংয়ের নিবু আলোয়/ থাল থেকে ধোঁয়া উথত, চাক চাক রসাল মাংস/ দিয়ে যেত ওরা।…অমনি মৃত্যুচিন্তা ভয় তাঁর বুঝি দাঁড়ানোর কথা ওই পারে। কেননা মরাপশুদের অস্তিত্বে ভরা বিষণ্ণ জলপাই / কাদার দাগ, সরলতাভরা এ সংকেত আর কী বা! / ওসব দর্শনচিন্তা দূর ঘেঁসে যেত। বরং  ছেঁদো নিমন্তন্নের প্রতি/ আগ্রহ ছিল ঢের। চিবানো অসম্ভব বুঝে গিলতাম এক তাল চর্বি “ ( পলায়ন, ঈপ্সিতা হালদার, কা আ) 

“খিদে আনো, মালকিন, নিরামিষ ভাতে/ দু-হাতা ছড়িয়ে দাও মাংসের ঝোল” (  নিরামিষ, দেবব্রত কর বিশ্বাস, শ্রীগোপাল মল্লিক লেন) 

“চড়ুইভাতির কথা, মাংসের তলাটা ধরে যাওয়া/ ঝাল, উহু, জল! জল! একচোখে বলা হল হাসি/ ভালোমানুষের মতো মুখ করে সমস্ত দুপুর/ দলছুট, আমরাই বরাবর হারিয়ে গিয়েছি” ( এপিটাফ, তৃষ্ণা বসাক, গোপন ট্যাটু) 

 

“চৈত্রশেষের বাতাস ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল / বলো বস্‌ , কাল মাংস হচ্ছে তো তাহলে? দই? খুব ভোরে স্নান? / তেলচিটে গেঞ্জি আর জাঙিয়ার ওপোর গলিয়ে নেবে আদ্দির পাঞ্জাবি? / বিকেলে আশ্রম যাবে? কাব্যলোক? রবীন্দ্রসঙ্গীত?/ ফেরার পথে কি ছুঁয়ে যাবে লক্ষ্মী বস্ত্রালয়? শ্রীহরি ভাণ্ডার? “ ( সংক্রান্তি, প্রবুদ্ধসুন্দর কর, নৈশশিস) 

 

 দার্শনিক ভুবন = অন্নভুবন

জীবনমরণের প্রতীক হয়ে ওঠে রান্নার হাঁড়ি আজকের কবিতায় , এ আমরা বারংবার দেখেছি। খাদ্যের চিত্রকল্প বহুদূর চলে যায় অনায়াসে। 

“অন্ধের উনুনে বসানো হয়েছে, কড়াই/ ফুটছে সংকেত, পুড়ছে কার কব্জির/ শিরা উপশিরা/ নিজেকেই রেঁধে বেড়ে খেতে হয়/ প্রতিদিন খাওয়ার সময়/ অর্ধপরিচিত ভিক্ষুকরা/ তার পাত খাবলায়” ( তিন,  সুকল্প চট্টোপাধ্যায়, নিরর্থ) 

আসলে গোটা ব্রহ্মান্ড এক বৃহৎ রান্নাঘর হয়ে উঠছে এসব লেখায়ঃ

“আমি সাধারণত মায়ের রান্নাঘরের দিকে মুখও বাড়াইনা/আজ একটু কৌতূহলে উঁকি দিয়ে দেখি নানা রকমের/বয়ামে বোতলে মশলাপাতি, তেজপাতা, পাঁচ ফোড়নের সাথে//কোনোটাতে জ্যেঠু, কোনোটায় পিসি, আবার কোনোটায় দাদু বা ঠাম্মা! … ( মা দিবস, ঋক অমৃত, কলেজ স্ট্রিটের চ্যাপলিন) 

“শ্রাদ্ধবাড়ি এমন একটা জায়গা যেখানে প্রত্যেকের বর্তমান ও ভবিষ্যতের একসঙ্গে নেমন্তন্ন থাকে। শ্রাদ্ধে গেলে দেখা যায়, মানুষ প্রথমে খুব কাঁদে। তারপর আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যে জল দেয়। তারও পরে খেতে বসে বলে, “দাদা, এখানে আরেকটা লুচি দিন না”। এদিকে যিনি মারা গেছেন , তিনি একটা ঘরের কোনা বেছে নেন। শরীরে তাঁর রজনীগন্ধার  পারফিউম। তাঁকেও দেওয়া হয় লুচি, ধোকার ডালনা এইসব । লুচি এককালে তাঁরও প্রিয় ছিল। এখন লজ্জায় চাইতে পারেন না আর…” ( শ্রাদ্ধ, পৃথ্বী বসু, খইয়ের ভেতরে ওড়ে শোক)

এইসব জন্ম ও মৃত্যুর কথকতা যেন অশেষ। মৃত্যুকে পোষ্য করে তোলার এই অনবদ্য কবিতাটি পড়া যাক। 

“হাঁটুর সমান মৃত্যু সারাদিন পায়ে পায়ে ঘোরে/ সে যদি না থাকে তার ছায়া/ থাকে দূরে-কাছে/ ল্যাজ নাড়ে, বুভুক্ষু তাকায়/ ঝকঝকে স্টিলের থালায়/ ঝুঁকে পড়ে/ কাছে ডাকি তাকে/ সে আমার বিষণ্ণতা চেটে চেটে খায়।” ( পোষ্য, হিমালয় জানা, ভূতের শহর থেকে)

আরেকটি আশ্চর্য কবিতায় পড়ি মৃত্যু অনুষঙগের এক ধান থেকে প্রস্তুত বস্তু খইয়ের মাহাত্ম্যকথন। আবিষ্কার করি বৈষ্ণব কবিতার এক নব রূপ। এই সময়ের কথনে। 

 

“মায়ের দুধের এই দেহ/ এই দেহে/ আমার ঠাকুরের অবগাহন/ হৃদিপদ্মাসনে তাঁর ঠাঁই/ প্রহার -সুন্দর খই/ দুধের বাটিতে ভিজিয়ে/ আমার পূজন / তাঁর নিত্যখাদ্যরূপ/ তাঁর জাগরণভূমি” ( খই হয়দ, গৌতম দাস, আশ্চর্য চাদর)

এক খাদ্যজগতের ক্ষুধাপ্রবণতার ভেতরে অনন্ত সম্ভাবনা থেকে যায়, কবি তাকে শুধু খুঁড়ে তোলেন। এক গা অশরীরী শিরশিরে স্বপ্নসম্ভব কল্পনা জগৎ উঠে আসে এ কবিতায় :

বাসনকোসনের শব্দ শুনে উঠে বসি। সারা ঘর খাবারের গন্ধে ভরে আছে

এতখানি স্পষ্ট নয় যে কাউকে দেখাব…

ডাইনিং টেবিল ঘিরে জটলা করছে দু চারটে মানুষ। ভোরবেলা

ভাঁড়ারের দিকে ছুটে যাই। দু চামচ গুঁড়ো দুধ, একখাবলা চাল, 

দু – চারটে আলু যেন কম কম লাগে।  ( সাবকনশাস, শ্যামসুন্দর মুখোপাধ্যায়, হলুদ দাগের বাইরে পথচারী ) 

একেবারেই অন্যভাবে ভুবনকে দেখেন বিশ্বজিৎ রায়, যখন বিপ্লব আর সংসারকে এক লাইনে এনে ফেলেন তিনি। 

বিশ্বাস করুন কোনো বিপ্লব কখনো করিনি। রোজ সকালে উঠে দুধ গরম করি, ছেলের টিফিন গুছোই, চা করি। তখন ওর মা ঘুম থেকে উঠে রুটিন গুছোয়, পাশের ঘর থেকে নিয়ে আসে ইশকুলের জামা কাপড়। নিয়মিত বাজার করা আমার অভ্যেস— মাছ চিনি, কিনতেও পারি, হাতে বেগুন নিয়ে লোফালুফি করে বলে দিতে পারি কচি না বুড়ো, পোকা আছে কি নেই। বাবা শিখিয়েছিল। মা দূরে থাকে— সপ্তাহান্তে যাওয়ার চেষ্টা করি। বাবা বাজার ফেলে চলে যাওয়ার পর মায়ের যে একা লাগে জানি। তবে বাড়ি ফেলে এসে মা থাকতেই চায় না আমার এখানে, ন-মাসে ছ-মাসে আসে। লালচে টম্যাটো রান্নায় দিতে মা খুব ভালোবাসে, আমি নিয়মিত কিনি। পেনশন তুলি, ফলের সময় নিয়ে আসি ফল। এইসব নিত্য ছা-পোষা কাজে আমার বেশ ঘাম হয়, রান্না করে শার্টের আঁচলে হলুদ মুছতে বিশ্বাস করুন জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের থেকে বেশি সুখ পাই। কড়ায় যখন ফালা ফালা করে কাটা আলু আর পটলের পাশে ফুলে ওঠে বড়ি তখন মায়া এসে জমে আমার ভেতরে। ঠাকুর সাজাতে পারি, জানি কীভাবে আলুর খোসা দিয়ে রাঁধা যায় আশ্চর্য ঝাল। বুঝি কীভাবে চালানো যায় কম পয়সায় সংসার, পিঁপড়েরা মুখে করে কখন বয়ে আনে ডিম, কখন ডেকে ওঠে গায়ে গায়ে লেগে থাকা টিকটিকি। এইসব দৃশ্যের মধ্যে থাকি, শুধু কখনো কখনো কতগুলো শব্দ এসে ডাক দিয়ে যায়। রাত নিভে গেলে বাসি চাঁদ পড়ে থাকে ভোরের শিয়রে। শব্দেরা এলে শুধু মনে মনে বয়ে যাই— রাঁধছি, শার্টের আঁচলে মুছছি হাত, আর শব্দের পিছু পিছু বাড়ি ছাড়ছে মন। একে আর যাই হোক বিপ্লব বলে না, গেরস্থালির ভূত বলা যেতে পারে।” ( গেরস্থালির ভূত, বিশ্বজিৎ রায়, গেরস্থালির গদ্য) 

 মধ্যবিত্ত বাঙালির স্বপ্ন আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে, সবটাই ভাত আর রান্নাঘরের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে কজন পারেন, যাঁরা পারেন তাঁদের সূক্ষ্মসংবেদী মননকে আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, অর্ধনারীশ্বর এক বিশ্বের প্রতিভূ। 

“স্বপ্ন বললে এটুকুই – গরম ভাতের সঙ্গে ডাল আর কাগজি লেবুর গন্ধ মনে পড়ে যায়” ( ২৭, অরিন্দম রায় , রোজনামচা) 

 নির্মাল্য মুখোপাধ্যায় এক কবি, যিনি তাঁর একটি সিরিজ কবিতার নামকরণই করেছেন, “লীলা মজুমদারের রান্নার বই থেকে”।

যার শুরুর কবিতায় আছে, “পার্বণী রান্নাকথা বাঙালির ঘরে/ মনোসুখে গৃহিনীরা ব্রতয়ারী পড়ে”  । তারপর একে একে আসে নানা কবিতা। শ্রীভোগ, ডাল আর নটেশাক, মিটলোফ, মার্মালেড, এলোঝেলো কুচোগজা, লাউচিংড়ি বাংলাদেশের। প্রতিটি কবিতাই উল্লেখ্য , এক এক লেখায় উঠে আসে বাঙালি ও রান্নার এক এক পদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা অনুষঙ্গ, কাহিনি, গল্পগাথা। 

লাউচিংড়ির গল্পে পিসিমা , গোপালভাঁড়, এলোঝেলোতে প্রাইমারি ইশকুল, হেড মাস্টার মশাই, আবার মিটলোফ মার্মালেডে উদুখল, কলম্বো বন্দর, সারেং এর নোটবুক , সাগরের জলের নুন আর লেবুর মার্মালেড। ডাল আর নটেশাক কবিতায় আসে বাসস্টপ,  মাধবী হোটেল আসে, আসে দুর্গা গণেশ। 

 

নির্মাল্য আরো এক কবিতায় লেখেন শুভবিবাহের খাতার কথা। আদ্যন্ত নস্টালজিয়ায় চোবানো সেই লেখায় আছে বিয়েবাড়ির খাওয়া দাওয়ার বর্ণনা। কলাপাতা,  আরম্ভে মাটির গেলাসে জল, নুন আর লেবু, রাধাবল্লভী আর কুমড়োর ছক্কার কথা আছে। 

 

                         

 

 

নারীকবিতায় রান্নাঘর আর ফ্রিজ আর ভাতের পাত

  নারীর কবিতায় রান্নাঘর রান্নাবান্না এসেছে অবিরল স্বচ্ছন্দগতিতে, যেটা স্বাভাবিক ত বটেই আমাদের সামাজিক কাঠামোয়। আটের দশকের চৈতালী চট্টোপাধ্যায় সুতপা সেনগুপ্ত সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়দের কবিতায় নারীজগতের প্রতিনিধিত্ব করেছে আঁশবটি উনুন নুন আগুন ও মাছ। কিন্তু পরবর্তীতে এই রান্নাঘরের প্রতীক আরো বিস্তৃত এবং লক্ষণীয় হয়েছে।

তুমি আমার প্রথম পাতের নিমবেগুনের তিক্ত স্মৃতি হওনি ভাগ্যিস !

হওনি মধ্যিখানের পাঁচমেশালি  নিরামিষ-আমিষের সাত-সতেরো ।

মনেই নেই অতরকম পদের অতরকম স্বাদ । শেষ পাতের দই-মিষ্টি

ভেবেও তো তোমাকে খুঁজিনি ।

#

আজ তোমার কাছে এসেছি সব অভিজ্ঞতা পার হয়ে ।

তুমি আমার সব-ভোলানো মুখশুদ্ধি হবে ?

                (মুখশুদ্ধি, পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়, শালপাতাটা ফেলার আগে)

  প্রথমে ফ্রিজ থেকে বের করা তারপর/স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পৌঁছনোর জন্য/নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা-/এরপর গ্যাস পুড়িয়ে গরম করলেই ব্যস ,/বাসি খাবার নিমেষে টাটকা ।/ভ্যাপসা আবহাওয়ায় পচিয়ে ফেলার চেয়ে/বাসি সম্পর্ক কিছুদিনের জন্য/ফ্রিজের শৈত্যে ফেলে রাখা ভালো ।  (বাসি খাবার অথবা,পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়,যতসব অলক্ষ্মীপনা)

 একটা গোটা বই রান্নাঘর নিয়ে, লিখে ফেলেছেন ২০০০ পরবর্তীর এক মেয়ে কবি তুষ্টি ভট্টাচার্য , বইয়ের নাম কুইজিন। প্রতীকে আর উপমায় রান্নাঘর হয়ে উঠেছে একটি মেয়েজীবনকে নানাভাবে দেখার আয়না। তুলনাগুলি সমর্থ হয়ে উঠেছে । রেসিপির ঢং এনেছে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনাকর এক ধর্ষিত, খন্ডিত, উৎপীড়িত মেয়েজীবনের কাহিনিকে। কয়েকটি নমুনা পেশ করা গেল।     

উপুড় করে রাখা কড়াকে নারীর নিতম্বের মত লাগে/নারীবাদী কড়া চিৎ হয়/উনুনে চাপে ( কড়া, তুষ্টি ভট্টাচার্য, কুইজিন) 

রুটি করার পরে চাটুটা তখনও গরম ছিল/এ চাটুতে হাত দিলে ফোস্কা পড়ে না/জল ঢেলে দিলে ছ্যাঁক করে শব্দও ওঠে না/ এবার ওই চাটু মাজবে গোপালের মা/ছাই পাওয়া যায় না বলে/টব থেকে একমুঠো মাটি আর সাবান দিয়ে/রগড়ে রগড়ে তুলে ফেলবে আটা পোড়ার দাগ/ঝকঝকে সাফ হয়ে চাটু উঠে যাবে বাসনের তাকে/রাতে রুটি করার সময়ে/ওকে আবার নামানো হবে তাক থেকে (চাটু,তুষ্টি ভট্টাচার্য, কুইজিন)

 

 “আমার খিচুড়ির সুবাস তখন/বৃষ্টি নামাচ্ছে।” (  খিচুড়ি , তুষ্টি ভট্টাচার্য, কুইজিন)

পটলের গা থেকে চেঁছে নিচ্ছ সবুজ/যে ধার থেকে ধারালো হল ছুরি/তার কোন সবুজ ছিল না।/অন্তঃসারশূন্য বীচি বাদ গিয়ে হাঁ হাঁ করা পেট/অপেক্ষায়-/পুর তৈরির মধ্যে কোন রহস্য নেই/যেমন আছে পেটের মধ্যে লুকিয়ে থাকায়…(  দোলমা , তুষ্টি ভট্টাচার্য, কুইজিন)

চৌকো করে কেটে রাখা ভেটকির টুকরোকে/ভিনিগারে ভিজিয়ে রাখতে হয়/মাছের থেকে আঁশটে গন্ধ আলাদা করে নেওয়াই দস্তুর/আর তখনই কেটে ফেলতে হয় মাপমত কলাপাতা/নারকোল-সরষের মাখামাখির মধ্যে ফেলে দিও কিছু লঙ্কার ঝাল /কলাপাতায় সযত্নে মুড়ে নেওয়ার আগে তেলের কথা ভুল না!…মাইক্রোওয়েভের চালাক বাক্সে মিনিট দশেক রেখে দিলে বুঝবে/পুড়ে যাওয়া সবসময়ে দৃশ্যমান হবে, এমন কোন কথা নেই! (ভেটকির পাতুরি, তুষ্টি ভট্টাচার্য, কুইজিন)

 চকচকে চামড়ায় আরও একটু তেল মাখানো হল/ধারালো ছুরির ডগা দিয়ে/নিতম্বের উঁচু হয়ে থাকা মাংস পিন্ড খুবলে নিয়ে/যৌনাঙ্গ বরাবর লম্বালম্বি চিরে দিলাম দেহটা/ভেতরের তুলতুলে মাংসে গুঁজে দিলাম রসুনের কোয়া/এরপর আগুনের লকলকে শিখায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পোড়ানো।/চামড়া পোড়া গন্ধে ঘর ভরে যাচ্ছে –/কুঁকড়ে ছোট হয়ে আসছে বডি –/আমার খুব গান পাচ্ছে -/আহা বড় জ্বালাপোড়া! জলে ডুবে যদি একটু ……/   খুঁটে খুঁটে তুলে ফেললাম পোড়া চামড়ার ছাল/নুন, লঙ্কা আর ঝাঁঝালো তেলের মলম দিয়ে/ভেতরের তুলতুলে মাংসটা চটকে মেখে/ওপরে ছড়িয়ে দিলাম সবুজ সরস টাটকা ধনেপাতা…লুব্ধক বেগুন ধর্ষিত হওয়ার জন্যই জন্মায় –/এ কথা জেনে যাওয়ার পরে আমার কোন পাপবোধ নেই। ( ধর্ষণ , তুষ্টি ভট্টাচার্য, কুইজিন)

 এ তালিকা দীর্ঘ। এ লেখা অনন্ত। আরো  অনেক উদাহরণ বাইরে রয়ে গেল। তবু, মূল প্রবণতাটুকু যেন ধরা গেল মনে হয়। এটুকুই … তারপর ত পাঠকের নিজস্ব সফর শুরু। 

 

 

flat lay photography of vegetable salad on plate
Photo by Ella Olsson on Pexels.com

 

2 thoughts on “সাম্প্রতিক বাংলাকবিতার অন্নময় ভুবন

  1. প্রখর আপ্লুত হলাম । তুষ্টির কুইজিন অপূর্ব লাগল, পিশাচিনীর ব্রেকফাস্ট মনে এল । বহু বছর আগে হয়ত একদিন স্বয়ং তোমার সঙ্গে কথাও হয়েছিল এ নিয়ে ।

Leave a comment