বিয়েবাড়ি

বিয়েবাড়ি

যশোধরা রায়চৌধুরী

(ক্যাথারিন ম্যানস্ফিল্ড-এর একটি গল্পের ছায়ায়)

বিয়েবাড়ির জন্য সেজেগুজে তৈরি হওয়া যে কী ঝকমারির ব্যাপার! রাত্তিরে মুখে নাকে গুঁজে খাইয়ে দিল দুটোকে, ভাতেভাত। চ্যাঁভ্যাঁ ল্যাটর প্যাটর,  ওদের নিয়ে কেউ পার্টিতে যায়? এমনি ওমনি বিয়েবাড়ি ত নয়, খোদ রাসবিহারী সেনের মেয়ের বিয়ে। সাহেবি কেতা।  খাওয়ার পরে, নীলিমা ছোট ছেলে টুবুকে  বিছানায় গুঁজে দিল। শুধু রুমা রইল তাঁর সঙ্গে । কত্তার  কোট ব্রাশ দিয়ে ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করা, জুতো পালিশ করা সোজা কাজ নাকি? হাত বাটাতে হবে ত রুমাকে মায়ের সঙ্গে।  স্বামীর সবচেয়ে ভাল শার্টটা ইস্তিরি করলেন, তাঁর বুট পালিশ করলেন, কালো সাটিনের নেক টাই -টায় কয়েকটা সেলাইয়ের ফোঁড় ও দিতে হল বইকি। 

কত্তামশাই সেই যে আপিসে ছোট থেক মেজ তার থকে বড় সাহেব হয়েছিলেন। এখনো , সুটবুট টাইই পরেন বাইরে টাইরে গেলে। বিয়েবাড়িতেও ধুতিপাঞ্জাবির মধ্যে ঢোকেন না। 

রুমা আমার শাড়িটা একটু ঝেড়ে তারপর খাটের রেলিং-এ  ঝুলিয়ে রাখ।  তাহলে ভাঁজগুলো আপনিই সমান হয়ে যাবে। ইস্তিরি ত আর করা হল না।  বললেন গিন্নিমা। আর শোন, ভাইয়ের দেখা শোনা করবে কিন্তু, আর নিজে একদম বেশিক্ষণ জাগবে না, সাড়ে দশটার বেশি একদম না। আমাদের ফিরতে  অনেক রাত হবে ত। হ্যারিকেন জ্বলুক, যদি কারেন্ট যায় আবার। তুমি আলোটা ছোঁবে না, তুমি জান ত ছুঁলে কী হবে।  

রুমার বয়স নয়। সে মনে করে সে এতটাই বড় হয়ে গেছে যে চাইলে হাজারটা হ্যারিকেনকে ঠিক সামলে নিতে পারে। সে বলল, “আমি জেগে থাকিনা আর এট্টূ, , মা! টুবু যদি আবার উঠে দুধ খেতে চায়?”

  • সাড়ে দশটা মানে সাড়ে দশটাই। মা কড়া গলায় বললেন। বাবাকে বলব নাকি? বাবাকে বলে দিচ্ছি কথা শুনছ না তুমি। 

ঠোঁট ঝোলাল রুমা। কিন্তু… কিন্তু…

ওই যে বাবা আসছেন। যাও ত ও-ঘরে গিয়ে আমার নীল শালটা এনে দাও। আমি যখন থাকব না তুমি আমার কালো শালটা গায়ে দিতে  পার। এবার যাও দিকিনি!!

মায়ের কাঁধ থেকে কালো শালটা নিয়ে রুমা সযত্নে পরে নিল। গায়ে জড়িয়ে পেছনে গিঁট বেঁধে নিল ওটা দিয়ে। ভেবে দেখল, যদি ওকে সাড়ে দশটাতেই শুতে যেতে হয়, ও মায়ের শালটা গায়ে দিয়েই শোবে। মা মা গন্ধ আছে ওটায়। আর বিছানায় শুয়ে শুয়ে  শাল গায়ে দেওয়া , মায়ের এসব অপছন্দ, তাই একটু বদমায়েশি করার এই ভাবনা থেক বেশ একটা আরাম হল। গল্পবই গুছিয়ে রেখেছিল রাত জাগবে ভেবে…

ওদিকে কত্তা ফিরলেন আপিসফেরত  পাড়া বেড়িয়ে, অনেক ক্ষণ এদিক ওদিক এলাকায় টহল দিয়ে আর মাতব্বরি করে। কাজেই ফিরেই তাড়া মারলেন। হাঁক পাড়লেন – আমার জামাকাপড়গুলো সব কোথায়? কিচ্ছু রেডি নেই , বোঝাই যাচ্ছে, আর ওদিকে সব্বাই বিয়েবাড়ি পৌঁছে গেছে!। আসতে আসতে আমি  দেখতেও পেলাম লোক ঢুকছে, সানাই-এর পোঁ ত কখন শুরু হয়ে গেছে । তোমার ব্যাপারটা কী! কী করছটা কী শুনি? এখনো ত তৈরিই হও নি। এভাবে ঝি সেজে ত বিয়েবাড়ি যেতে পারবে না। 

এই তো তোমার জামাকাপড়, সব রেডি করে দেখ সাজিয়ে রেখেছি। হাতমুখ ধুয়ে নাও।  রুমা,  বাবাকে তোয়ালেটা এগিয়ে দাও ত। সব রেডি আছে শুধু প্যান্ট ছাড়া। প্যান্টের ঝুল ছোট করার আর সময় পাইনি গো। যাবার পথে তলাগুলো বুটের ভেতর গুঁজে নিতে হবে।

হুঁঃ। কত্তামশাই গজগজ করলেন। এ ঘরে ত নড়াচড়ার জায়গা নেই। আমার ত জামা পরতে আয়নাটা লাগবে। তুমি বরং  প্যাসেজে গিয়ে শাড়ি পর। কী যে দেরি কর ! আগে থেকে তৈরি হয়ে থাকতে পার না? তোমাদের ত আবার সাজতে এক ঘন্টা লাগে। 

পাশের ছোট খুপরি বারান্দা ঘিরেছেন পর্দা দিয়ে। ওখানেই, অন্ধকারে তৈরি হওয়া নীলিমার কাছে কোন ব্যাপারই না। অন্ধকারে হাতড়ে বডিস এর হুক লাগালেন, সায়া পরলেন, শাড়ি জড়ালেন। ফিরে এসে স্বামীর পেছন থেকে আয়নায় উঁকি দিতে দিতে ব্রুচ আঁটলেন,  ব্রুচটা সোনার। বিয়েতে পাওয়া। কানে সোনার দুল পরলেন, গলায় হার। তারপরে মাথা ঢেকে নিলেন নীল শালে।  

যাচ্ছ কোথায়,  আমার টাইটা বেঁধে দিয়ে যাও, ডাক দিলেন গুপ্তসাহেব।  ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পতিদেবতা হাঁপাচ্ছিলেন জামাকাপড় পরতে পরতে।  তাঁর শার্ট খানা চমৎকার ইস্তিরি করা। আকাশি নীল শার্ট আর গাঢ় নীল প্যান্টে তাঁকে ইশকুলের সদাপ্রস্তুত ছোট্ট খোকার মত লাগছিল।  “আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?”

অপূর্ব! – বেঁটে নীলিমা গোড়ালির ওপর উঁচু হয়ে  স্বামীর টাই হিসেবমত মেপেজুপে বাঁধলেন।  এদিক ওদিকে শার্ট টেনে সোজা করে ফিটফাট করে দিলেন।  রুমা, এসে দেখে যা ত বাবাকে কেমন দেখাচ্ছে। 

গুপ্তসাহেব ঘরের  এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হেঁটে বেড়ালেন, তারপর  কোটটা পরলেন অন্যদের সাহায্য নিয়ে, তারপর বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন,  যতক্ষণ না  নীলিমা হাতের বটুয়া গুছিয়ে, টর্চ খুঁজ বেরোন। 

আরে চলো চলো- কাজ শেষ হল তোমার? পা চালাও এবার!

রুমা, হ্যারিকেন হাত দিবি না কিন্তু! বলে নীলিমা সদর দরজাটা  টেনে বন্ধ করে বেরিয়ে এলেন। 

সারাদিন ধরেই যে বৃষ্টি  হয়েছে তা নয়, তবে পথে দুপুরের দিকে খুব বৃষ্টিতে জল জমেছিল এখন নেবে যাবার পরে কাদা আর  পিছল হয়ে গেছে প্রচন্ড। নীলিমা  বেশ কয়েক সপ্তাহ বাড়ির বাইরে বেরোন নি , বেরনোর দরকারই বা কী – আর সারাদিনের হুড়োহুড়ির ফলে এখন যেন ঘেঁটে গেছেন, বোকা বোকা হয়ে গেছেন পুরো। দামি সিল্কের শাড়ি পরে আরো যেন জবুথবু। যেন মনে হচ্ছে রুমা ওঁকে বাড়ি থেকে ঠেলে বের করে দিল, আর সঙ্গের মানুষটি যেন ওঁর কাছ থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাবে! গুপ্তসাহেবের লম্বা লম্বা পায়ের হাঁটা এমন , পেছনে বেঁটকুল গিন্নির তোয়াক্কা নেই কোন। 

দাঁড়াও , দাঁড়াও !  আমার জন্য অপেক্ষা কর । উফ বাবা এখানে কী অন্ধকার । টর্চটা একটু জ্বালো না বাপু। 

নীলিমা চেঁচিয়ে ডাক দিলেন ।

 না , আমার জুতো নোংরা হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি এসো। 

একবার  একটা বেড়া দেওয়া পার্ক মত, তার কাছাকাছি এসে হাঁটাটা সহজ হয়ে এল, ধরে টাল সামলাবার জন্য বেড়াগুলো ছিল । বিয়েবাড়ি বেশি দূরে না। বিয়েবাড়ির সামনের পথটুকুতে আবার ছাই বালি ঘেঁষ  ফেলে বিয়েবাড়ির অতিথিদের আসার সুবিধে করে দেওয়া হয়েছে। যা বৃষ্টি আর কাদা কদিন ধরে! নভেম্বর মাসে এমন বৃষ্টি কে কবে দেখেছে। ঠান্ডাটা যেন আরো জাঁকিয়ে পড়েছে তাতেই। 

বিয়েবাড়ি তখন জমে উঠেছে। কলকল কথা, বেনারসির ঝলকানি।  রসে টইটুম্বুর।  আমোদ আহ্লাদে ভরা। আলো ঝলকাচ্ছে। ছাত থেকে আলোর মালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সামনের দরজাটাও ফুলের গেট দিয়ে , আলো দিয়ে সাজানো। বড় হলটায়, খোদ বিয়েবাড়ির কর্তাব্যক্তিরা কেটারারের লোকেদের বকাঝকা করে নিজেদের কর্তৃত্ব  জানান দিচ্ছেন। শুঁটকো কেটারারের লোক কোল্ড ড্রিংক্স এ গেলাস  কফির কাপ আর স্ন্যাক্স এর প্লেট ভর্তি ট্রে নিয়ে ক্রমাগত দৌড়োদৌড়ি করছে। 

রঙিন রঙিন প্রজাপতির মত কত কম বয়সী মেয়ে বিয়েবাড়িতে। হালফ্যাশনের সাজ।  নিজে কুঁকড়ে যান নীলিমা এসব দেখে। নিজের সাজটা বেশ পুরনো আর বাজে মনে হয়। 

নিচের গ্যাঞ্জাম থেক  এবার উঠতে হবে। বর বউ বসেছে দোতলায় মেন হল ঘরে।  

“সিঁঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে যান, ওপরে চলে যান”, কে যেন চেঁচাচ্ছিলেন। গুপ্তসাহেবও দেখা গেল এই কান্ডকারখানার বিশালত্বে সম্পূর্ণ অভিভূত হয়ে পড়ে, নিজের পতিসুলভ কর্তব্য , যথা স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গে থাকাটুকুও সম্পূর্ণ ভুলে, সিঁড়ির রেলিং ধরে অন্যদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে ওঠার চেষ্টা করে যেতে লাগলেন। বর বউ যেখানে বসেছে সেই  ঘরটিতে প্রবেশ করামাত্র গুপ্তসাহেবের   সহকর্মীরা তাঁকে দেখে হৈ হৈ করে উঠলেন। মিসেস নীলিমা গুপ্ত একবার ব্রুচটা ঠিক করে নিলেন, হাতদুটি জড়ো করে রাখলেন, একজন  অফিসারের স্ত্রী ও দুই সন্তানের মায়ের ঠিক যেমনটি থাকা উচিত তেমনই সভ্যভদ্র হয়ে রইলেন। 

হলঘরটি সত্যিই খুব সুন্দর। অনেক ছোট টেবিল ঘরের  মধ্য ছড়িয়ে রাখা। প্রতি টেবিলে ফুল, রেশমের ফিতে ও ঝালর। চেয়ার দিয়ে ঘেরা, চেয়ারের পিঠেও ঝালর।  এক দিকের প্লাটফর্মে বর বউ সিংহাসনে বসবে। একটা বিশাল ঝাড়লন্ঠন ছাতের থেকে ঝুলছে আর তার উষ্ণ উজ্জ্বল আলো প্রতিফলিত হচ্ছে কাগজের ফুল আর মালা দিয়ে সাজানো দেওয়ালে দেওয়ালে।   সবচেয়ে ভাল পোশাকে সাজগোজ করা অতিথিদের  লালচে মুখে সেই আলো পড়ে আরো উজ্জ্বল ও উষ্ণ  লাগছিল।

 এবার সিংহাসনে  বর বউ বসেছে। কনেটি গয়না আর লাল বেনারসি, লাল ওড়না সোনালি জরির তলায় সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে গেছে। জরির কাজের আড়ম্বরে ঢেকে গেছে রেশমের শাড়ি ব্লাউজ। তাকে দেখে মনে হচ্ছে একটা আইসিং করা কেক,  কেটে কেটে ছোট টুকরো করে পাশে বসা বরটিকে খাওয়ানোর জন্য একেবারে তৈরি। বর পরে আছে  সাদা কাপড়ের বন্ধগলা স্যুট, তার মাপের চেয়ে বেশ খানিকটা বড়ো। আজকাল এই ফ্যাশন উঠেছে, মাড়োয়ারিদের মত মাথায় পাগড়ি, সেটাও লাল সোনালি।  তাদের চারপাশে  সম্ভ্রান্ত সুশীলতার প্রতীক হয়ে বসে আছেন তাদের বাবা মায়েরা, আত্মীয়েরা। কনের ডানদিকে একটা টুলের ওপর উঁচুতে চড়ে বসেছে একটি ছোট্ট মেয়ে। তার  জরি বসানো সিল্কের গাউনটি কুঁচকেমুচকে আছে। এক কানের ওপর ফুলে গাঁঁথা একটা মুকুট ঝুলছে। সবাই একে একে যাচ্ছে, ওদের কাছে, বেদির ওপরে।  হাসছে, কথা বলছে,  বর বউকে গিয়ে উপহার দিচ্ছে , ছবি তোলাচ্ছে । বাইরের বৃষ্টিভেজার কাদার বোঁটকা একটা গন্ধ আর তার সঙ্গে এখানে এত আলোতে ভিড়ে মিশে থাকা ঘামের গন্ধ – সব মিলিয়ে মিশ্র একটা বদগন্ধে, হঠাৎ দম বন্ধ হয়ে এল নীলিমার।  

নীলিমা পুতুলের মত নিজের স্বামীকে অনুসরণ করলেন, বর বউ ইত্যাদিকে নমস্কারাদি সম্ভাষণ ইত্যাদি  জানিয়ে বেদি থেকে নামলেন। উপহারটা সব কলিগ মিলে কেনা হয়েছে , সেটা যে নিয়ে আসবে সে এখনো আসেনি।   গুপ্ত সাহেবের মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তিনি নিশ্চিত জানেন,  তিনি আজ চুটিয়ে মজা  করবেনই। তিনি যেন ক্রমশ ফুর্তিতে ফুলে উঠছেন, টগবগ করে ফুটছেন, পুরনো  চেনা চেনা লোকেদের দেখতে পেয়ে। ঐদিকে চল, এক সহকর্মী তাঁর বাহু ধরে টানল। ছাতের এক কোণায় ড্রিংক্স সার্ভ হচ্ছে লুকিয়ে। সেদিকে গিয়ে দু ঢোঁক মেরে আসবেন। 

নীলিমা এখন কী করবেন একা একা, বুঝে পাচ্ছেন না। হঠাৎ তাঁর শাড়ি ধরে টানল কে যেন। তাকিয়ে দেখলেন, মিসেস রায় তাঁকে ডাকছে। একটা খালি চেয়ার টেনে তাকে পাশে বসতে বলল। একটা গোল টেবিলের চারপাশে কটা চেয়ার পাতা। 

কোল্ড ড্রিংকস খাবে ত? মাটন শাম্মিকাবাব টা হেব্বি করেছে কিন্তু। খেয়েছ? 

মিসেস রায়ের বেশ চারদিকে চোখ ঘুরছে।  অ্যাই, তোমার না,  ব্লাউজের পেছন দিকে নিচের জামা বেরিয়ে আছে ,  তুমি যখন ঘরে ঢুকলে আমরা দেখে না হেসে পারলাম না, আর এই শাড়িটা কী গো? বমকাই? আমারো একটা আছে । এ মা ,  শাড়ির তলা থেকেও তোমার পেটিকোট বেরিয়ে আছে। ম্যাচিং পেটিকোট করাওনি?

এ বাবা, কী যা তা  ব্যাপার। নীলিমা আড়ষ্ট হয়ে হাত দিয়ে টেনে ব্লাউজ নামাতে গেলেন তারপর আঁচল দিয়ে গোটা পিঠ ঢেকে দিলেন।  ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়তে পড়তে ঠোঁট কামড়ে বললেন, এত তাড়াহুড়ো হল না বেরুবার সময়ে! 

যাক গে যা হবার হয়ে গেছে –  রায়গিন্নি বলল, নিজের মোটা মোটা হাত টেবিলটার  ওপর ছড়িয়ে দিয়ে , নিজের মকরমুখী বালা, আর ছ জোড়া সোনার চুড়ির দিকে গভীর সন্তুষ্টির সঙ্গে তাকিয়ে । তবে কিনা, একটু সাবধান হতে হয় ,বিয়েবাড়ির সাজ বলে কথা। 

আর এইরকম জাঁকজমক যে বিয়েতে সেখানে ত বটেই। চেঁচিয়ে বলল মিসেস ব্যানার্জি। দুটো কোল্ড ড্রিংক নিয়ে এসে টেবিলে রাখল। এই নীলিমা তুমি কী খাবে গো? আরে, দেখেছ, ফিল্ম স্টার এসেছে? ঐ ঐ যে সিরিয়ালে অ্যাক্টিং করেগো!  নীলিমার উল্টো দিকে বসল মেয়েটি। 

কান্ড দেখেছ,  ঋদ্ধিমার বাড়ির লোকের সেন্স নেই কোন। ঋদ্ধিমার ওই বাচ্চাটাকে ট্যাঁকে করে এনেছে। ওর নিজের  আগের পক্ষের বাচ্চা! ভাব, বিয়েটা করছে শুধু দ্বিতীয় বিয়ে তাই না, আবার বরটা ওর থেকে পাক্কা পাঁচ বছরের ছোট। 

তিন মহিলা বসে বসে কনের দিকে প্যাঁট প্যাঁট করে দেখতে লাগলেন। কনে একেবারে শান্তভাবে বসা। ঠোঁটে একটা শূন্য ফ্যাকাশে হাসি। শুধু ওর চোখ দুটি এদিক ওদিক অস্বস্তিভরা দৃষ্টি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। 

কেমন ট্যাল্ট্যালে চোখ দেখ  বাচ্চাটার! ফিসফিস করে বললেন মিসেস রায়। স্ন্যাক্স খাচ্ছে মুখে সস লেগে যাচ্ছে। বাচ্চাটা কি অ্যাবনর্মাল নাকি, গো? গলা নামালেন মিসেস রায়।  বাড়িতে রেখে এল না কেন ওটাকে?

নীলিমা ঘুরে তাকালেন কনের মায়ের দিকে। মহিলা নিজের ডিভোর্স করে দ্বিতীয়বার বিয়ে করা মেয়ের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়েই আছেন। একটা বুড়ো বাঁদরের মত বাদামি কপাল।  ভুরু কুঁচকে দেখেই চলেছেন আর খুব গাম্ভীর্যের সঙ্গে মাথা নাড়ছেন মাঝে মাঝে । কফির কাপ তোলার সময়ে তাঁর হাত কাঁপছে। একবার  বুনোদের মত করে থুতু ফেললেন মেঝেতে, কাবাবের মধ্যে টুথপিক গেঁথে খেয়ে তারপর সেই টুথপিক দিয়ে দাঁত খুঁটলেন। ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছলেন কিন্তু যেন চটচটে একটা অস্বস্তির পর্দা লেগে রইল মুখে। 

ঈষৎ মত্ত হয়ে ফিরে এসেছেন কনের বাবা। কোণে গিয়ে টেনে এসেছেন আর কি  খানিক। প্রাক্তন আমলা, সরকারের ঘর থেকে অনেক উপরি এনেছেন। নইলে কেউ মেয়ের দ্বিতীয় বিয়েতে এত খরচ করেনা। 

গিন্নির কোমরে খোঁচা দিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, আরে,  আনন্দ কর বুড়ি! এবার আর বিয়ে ভাঙবে না ঋদ্ধিমার। জামাইকে ঘরজামাই করছি। 

 তারপর পাশে থাকা নিজের শালা আর আর কটা পুরুষ অতিথির দিকে চেয়ে উনি চোখ টিপলেন, অতিথিরা অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল। 

আমি আনন্দই করছি ত!  প্রৌঢ়া  বিড়বিড় করে বল্লেন। মুঠি দিয়ে হাঁটুতে ঠেকা দিতে লাগলেন, সানাইতে যে সোহিনী বাজছে, যেন তারই তালে তালে।   কনের মা হিসেবে খুব গর্বিত, প্রমাণ করতেই হবে তাঁকে। 

মিসেস রায়  বললেন, উনি আসলে ভুলতেই পারছেন না ,  ঋদ্ধিমা কতটা  বেলাগাম হুল্লোড়ের জীবন কাটিয়েছে।  এই ঘরজামাই বরটাকে ত ওর বাবা এনে ওর ঘাড়ে চাপিয়েছে। মেয়েটা মোটেই আবার বিয়ে করতে চায়নি। বাবা শেষে শাসিয়েছে যে সম্পত্তির ভাগ দেবে না বিয়ে না করলে।  

আগের বরের সঙ্গে কী হয়েছিল, গো? নীলিমা ইন্টারেস্ট দেখানোর চেষ্টা করলেন। আগের বিয়েটা ভেঙে গেল কেন?

মহিলারা কাঁধ ঝাঁকালেন । 

আরে প্রেম করে বিয়ে ত, বুঝতেই পার। শরীরের টান। কদিনের সেই প্রেম ভোঁভাঁ। হাপিস হয়ে গেছে। একটা মেয়ের ত উচিত স্বামীকে সেবা যত্ন দিয়ে বেঁধে রাখা। তা না, যদি সারাক্ষণ শোয়াশুয়ির ওপর রাখে কদিন আর ভাল্লাগবে বল? 

হি হি করে হাসছিল দুই বান্ধবী, মিসেস ব্যানার্জি চোখের একটা ভঙ্গি করে বলল, উফফ দিদি তুমি পারও বটে। মেয়েটা সত্যি খুব কুত্তি, খালি আদাড়ে বাদাড়ে ছেলে ধরে বেড়াত কম বয়সে। 

মিসেস নীলিমা গুপ্ত নিজের কফির কাপের ভেতরে তাকালেন। ফুঁ দিয়ে ফেনাটার মধ্যে ছোট্ট একটা ফুটো করলেন। 

সেই, বিয়ে ত একটা পবিত্র বন্ধন।  

মিসেস ব্যানার্জি আরো বলতে লাগল। বরটাকে দেখছ না দিদি, অরুণাভ।  এই ছেলেটা একদম ল্যাদাড়ুশ। আমার কাকিমার পিসতুতো বোনের ভাশুরের ছেলে ত। আমরাই সম্বন্ধ দেখে দিলাম। ছেলের মা-বাবা নেই, একদম আইডিয়াল।  বলেছিল ছেলের নাকি মেয়েদের দিকে মনই নেই। ঐ আজকাল কী একটা উঠেছে না  , গে না কী যেন, ওইরকম হাবভাব।  কাজ ফাজ ও করেনা কোন । ছবিটবি আঁকে। ওকে এখানে গ্যারেজ করে দিল, ঘরজামাই করে দেবে, অঢেল টাকা আছে। মেয়ে উড়ে বেড়াবে আর জামাই ঘরে বসে আঁকবে। বলা যায়না, আবার, ছেলেটা হয়ত বিয়ে করে ঋদ্ধিমাকে সিধে করে দেবে পিটিয়ে। তখন সারাদিন পতিসেবা করে মরবে। বিয়ের পর মেয়েদের যে কত কী সইতে হয়!

নীলিমা গুপ্ত চোখ দিয়ে  নিজের স্বামীকে খুঁজলেন।  ঐ ত নিজের সহকর্মীদের সংগে বসে। উনি জানেন, স্বামীমহাশয় খুব বেশি মদ্যপান করে এসেছেন। হাত পা খুব নাড়ছেন বুনোমানুষের মত। কথা বলার সময়ে মুখ থেকে থুতু ছিটকে পড়ছে চারিদিকে। 

হ্যাঁ তা ত বটেই। সম্মতি দিলেন নীলিমা।  একেবারে সত্যি। মেয়েদের কত কি যে শিখে উঠতে হয়। 

এই দুই পৃথুলা মহিলার মাঝখানটিতে গোঁঁজ হয়ে বসে আছেন বলে, নীলিমার উঠতেই ইচ্ছে করছে না। স্বামী ইঙ্গিত করলেন এর ওপরের তলায় খেতে যাবেন কিনা।

সানাইতে তান ধরেছে…  বাচ্চারা, স্বামী সব ভুলে গেলেন নীলিমা। নিজেকে আবার এক তরুণী মনে হল যেন। তীব্র মধ্যম… কোমল রে… অনেক যুগ আগে গান শিখতেন নীলিমা… বিয়ের আগে। সানাইটা একটু দুঃখের, খুব মধুর লাগল তাঁর। খড়খড়ে হয়ে ওঠা হাতদুটি ভাঁজ হয়ে আবার খুলে গেল টেবিলের ওপরে। হঠাতই ভাল লাগছিল তাঁর আর সেজন্যেই, কারুর মুখের দিকে তাকাতে সাহস হল না তাঁর। মুখ জুড়ে রইল হাসির আদল,  ঠোঁটের চারপাশে সামান্য নার্ভাস কাঁপুনি । 

মিসেস রায় এবার উঠে দাঁড়ালেন। চলো খেয়ে আসি। পরে জায়গা পাব না আর। এখন ফাঁকা যাচ্ছে। 

খাবার জায়গায় গিয়ে মিসেস রায় আবার  চেঁচিয়ে উঠলেন। হে ভগবান! ঋদ্ধিমার বাচ্চাটাকে একটা চিকেনের লেগ দিয়েছে  প্লেটে, টাল সামলাতে না পেরে সেটা মাটিতে ফেলে দিল, আবার কুড়িয়ে তুলছে। ছি ছি ছি। 

খেয়ে নামলেন ওঁরা। এই চলো চলো , অফিসের ওরা ডাকছে।  এখন একটা ঘোষণা হবে। তোমার স্বামী বক্তৃতা দেবেন গো নীলিমা। 

নীলিমা সোজা হয়ে শক্ত হয়ে বসলেন। 

গুপ্তসাহেব একাই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। হাতে একটা রুপোর বড় ট্রফি ধরে আছেন। ওইটা অফিসের সবার পক্ষ থেকে চাঁদা তুলে কেনা হয়েছে। সেটাই হাউমাউ করে বলছেন। অনেক আদিরসাত্মক রসিকতার সঙ্গে পাঞ্চ করে। একবার “দ্বিতীয়বার ন্যাড়া বেলতলায় যাচ্ছে” -টাইপের কিছু বোকা রসিকতা করলেন।  সবাই ওঁর বক্তৃতা শুনে হাসছিল, শুধু নীলিমার হাসি পাচ্ছে না।  সবাই হো হো করে হেসে  চীৎকার  করছিল ওঁর মুখভঙ্গি দেখে । ট্রফিটাকে যেন একটা শিশুকে কোলে নিয়ে যাচ্ছেন এমন ভঙ্গিতে ওঁর বর কনের দিকে নিয়ে যাওয়াটা দেখেও। 

নীলিমার  একটুও মজা লাগল না। চারধারের প্রতিটি অট্টহাস্যময় মুখের দিকে  তিনি তাকাতে লাগলেন, আর হঠাৎ সব মুখগুলোকেই তাঁর অচেনা মনে হল।  বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করল। ইচ্ছে হল আর কোনদিন বাড়ি থেকে বেরুবেন না। তাঁর মনে হল এই সব লোক আসলে তাঁকে নিয়েই হাসছে। এই ঘরে যত লোক , তার চেয়েও বেশি লোক হাসছে তাঁর দিকে চেয়ে। সবাই হাসছে, কারণ তারা আসলে ওর চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী।  

* * *

নীরবে হেঁটে বাড়ি ফিরল তারা। মিস্টার গুপ্ত লম্বা পা ফেলে সামনে সামনে। মিসেস গুপ্ত পেছনে পেছনে হুমড়ি খেতে খেতে।  বিয়েবাড়ি থেকে বাড়ি অব্দি রাস্তাটা বিষণ্ণ, কাদামাখা , কালচে, সামনে পড়ে আছে । 

 মুখ থেকে খালি শালের ঘোমটাটা খুলে খুলে যাচ্ছে ঠান্ডা দমকা হাওয়ায়, দূরে কোথায় যেন বৃষ্টি হচ্ছে খুব, একটু পরেই এখানেও এসে পড়বে দামাল মেঘের দল। হঠাৎ নীলিমার  মনে পড়ল, ফুলশয্যার রাত। এখন তাদের দুটো  বাচ্চা, টাকাকড়িও আছে… আচ্ছা নিজের জন্য একটা আলাদা ঘর, একটা আলাদা ড্রেসিং টেবিল কি করা যেত না? 

নাহ, এসবের মানে কী ? বিড়বিড়  করলেন মিসেস। কী লাভ এসবে? বাড়ি পৌঁছে নীলিমা প্রথমেই স্বামীর জন্য গেলাস, বোতল, বরফ, ড্রিংক্স-এর  ব্যবস্থা করতে লেগে গেলেন, চিনেবাদাম বার করলেন। রাতে শোবার আগে হাতের সব কাজগুলো সেরে ফেলতে হবে। তবু, কাজের ফাঁকেও,  এই হাস্যকর প্রশ্নটা তার আগে অব্দি নাছোড় হয়ে রইল তার সংগে। আচ্ছা আমার যদি একটা আলাদা ঘর থাকত। 

 রাতে গুরুপাক খেয়েছেন স্বামী, কিন্তু এখন আবার বোতল খুলে বসা চাইই চাই। 

মিস্টার গুপ্ত গেলাসটা নিয়ে তারিয়ে তারিয়ে চুমুক মারলেন। 

অম্বল হয়নি ত তোমার? নীলিমা জিজ্ঞাসা করলেন  টেবিলের ওপর বাহুদুটি ভর দিয়ে, বালিশের মত বুকদুটি টেবিলের সঙ্গে ঠেকিয়ে রেখে। 

না না অম্বল কী আর হবে। মাংসটা ভাল করেছিল বেশ। বিরিয়ানিটাও হেব্বি।  টাকা খরচা করেছেন মিস্টার সেন। বল? 

হুঁ।  বললেন গৃহিণী। 

কেন ভাল্লাগেনি নাকি তোমার?  

না না ঠিকই আছে। নীলিমা বললেন। কেমন যেন ভয়ে ভয়ে। 

নাহ , টাকার গন্ধ খুব। তাছাড়া এমন কিছু একটা খাওয়াটা ছিল না , বল?  চিংড়ি ছিল না মেনুতে। গলদা চিংড়ি না থাকলে আবার বিয়ের খরচ কী দ্যাখানো!

পা দুটো ছড়িয়ে দিয়ে  আরামকেদারায় বসে স্বামী বললেন। 

ন্‌ -না, স্ত্রী স্বামীর ছেড়ে   ফেলে দেওয়া জামাকাপড়গুলোকে কুড়িয়ে , গুছিয়ে তুলতে তুলতে বললেন । 

গুপ্তসাহেব  হাই তুললেন,আড়মোড়া ভাঙলেন , তারপর হাসতে হাসতে স্ত্রীর দিকে মুখ তুললেন।

মনে আছে তোমার?আমাদের ফুলশয্যা?

সে অনেক দিন আগের কথা ত। আমার মনে টনে নেই। 

তবে মনে ত ওঁর ছিলই। 

তুমি আমাকে সে রাতে রামধাক্কা  মেরেছিলে !!  আমিও তোমাকে শিগগিরই উচিত  শিক্ষা দিয়েছিলাম। প্রথম রাতেই বেড়াল মেরেছিলাম হা হা হা। 

আবার এখন কথা কইতে বসো না। অতিরিক্ত গিলেছ ত। শুতে এস। 

গুপ্ত চেয়ারের ওপর শরীর একদম এলিয়ে ,  আমোদ পেয়ে  খুঁক খুঁক হাসলেন। 

ঐ দিন রাত্রে তুমি মোটেই আমাকে এটা বল নি। ওরে কপাল, তোমাকে পোষ মানাতে আমার যা ঝঞ্ঝাটঝামেলা  করতে হয়েছিল সেদিন!  …

ছোটখাট মোটাসোটা নীলিমা  পাশের ঘরে চলে গেলেন। ছেলেমেয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছে। একেবারে ছোটটার বিছানার গদিটা ধরে দেখলেন, ভিজিয়েছে কিনা। তারপর নিজের ব্লাউজের হুক খুলতে শুরু করলেন। 

সবই এক।  নীলিমা  বিড়বিড়োলেন। সারা পৃথিবীতে, সব বিয়েই ত একই রকম। বড্ড বোকা বোকা এই সব ব্যাপার। 

তারপর কোথা দিয়ে জানি, বিয়েবাড়ি যাওয়ার স্মৃতিটাও মুছে গেল । বিছানায় শুয়ে পড়লেন উনি।   হাতখানা মুখের ওপর আড়াল করে রাখলেন ,  যেন বাচ্চা মেয়ে, বড় একটা রাক্ষস এখুনি এসে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ভয়েতে মুখ আড়াল করে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

গুপ্ত সাহেব বাড়িতে রাখা বোতল থেকে আরো খানিকটা টেনে, টলতে টলতে তখনই ত শোবার  ঘরে ঢুকলেন কিনা!