krittibas smaroke songkolito, 2003

আমি তো নব্বইয়ের, কৃত্তিবাসের কে?
যশোধরা রায়চৌধুরী

সত্যি কথাটা হল, শুনতে যতই বেখাপ্পা লাগুক, ‘ইহাই রূঢ় বাস্তব, ইহাই জীবনের ট্র্যাজেডি। উনিশশো নব্বইয়ের কবিদের সঙ্গে “কৃত্তিবাসের” আদৌ কোন সম্বন্ধ থাকার কথা ছিল না। কৃত্তিবাস-এর যখন জন্ম, নব্বইয়ের অধিকাংশ কেন, প্রায় কোনো কবিরই তখন জন্ম হয়নি। নব্বইয়ের কবিরা যখন জন্মেছেন, কৃত্তিবাসের তখন শৈশব পেরিয়ে কৌশোর। আমার কাছে কৃত্তিবাসের কবিদের স্ট্যাটাস পুরোদস্তুর খুল্লতাতগোত্রীয়, একথা বললেও একবিন্দু মিথ্যে বলা হয়না।
আসলে পুরনো কৃত্তিবাসের নবজন্ম না হলে উনিশশ নব্বইয়ের কবিদের কাছে এর কোনও বিশেষ অর্থই থাকত না। ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা, নস্ট্যালজিয়া –প্রিয় বাঙালির আর এক রোম্যান্টিক স্মৃতিমাত্র রয়ে যেত কৃত্তিবাস। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামক স্বপ্নের পুরুষের হাত ধরে, মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করা চার পাঁচ অনাদি পুরুষ বা চিরন্তন অ্যাংরি ইয়াং ম্যান শক্তি-শরৎ-তারাপদ-সমরেন্দ্র-দীপকদের হাত ধরে।
একথা অস্বীকার করে লাভ নেই যে “কৃত্তিবাসে”র এই নতুন জন্মের ফলে নব্বইয়ের কবিরা বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছেন। উপকারটা কখনো –সখনো বেশ বস্তুতান্ত্রিকই হয়েছে। আবার উল্টোদিকে, নব্বইয়ের কবিদের তেজি কাঁধে ভর রেখে এই যে কৃত্তিবাসের আবার সক্রিয় হয়ে ওঠা, হৈ হৈ করে চলা – এতে আমাদের লেখালেখির জন্য প্রশস্ত এক জায়গাই শুধু তৈরি হল না, একদয়া যাঁদের দিকে তাকাতে ঘাড় টনটন করে উঠত এমন সব বাঘা বাঘা স্টলওয়ার্ট কবির সঙ্গে কাঁধ ঘষাঘষির স্বপ্ন ইচ্ছাপূরণেরও সুযোগ ঘটেছে।
তবে এরও বহু আগে, আমার প্রজন্মের ছেলেমেয়দের কালেকটিভ আনকনশাসের ভেতরে, অন্ধ অবচেতনের ভেতরে, কৃত্তিবাসের আনাগোনা। সেই কবি কবিতা সিং হের ‘শ্রবণী’, মঙ্গলবার সন্ধ্যার রেডিওতে, সেই এফ এম বিহীন রেডিওতে। কবিতাপাঠ, গল্পপাঠ। সেই রেডিওর কল্যাণেই শোনা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অসম্ভব কন্ঠ, তার উদাত্ত পাঠ, সেইসব টানটোন, সুর, যা থীক আপামার বাঙালি কবি কবিতা পড়তে শিখলেন যেন। শুরুটা বোধ হয় ওখান থেকেই, তখনো যাঁদের চোখে দেখিনি তাঁদের গলা শুনেছি… এই গোছের একটা শিহরণ। অনেকগুলো গমগমে গলা, অনেকগুলো গমগমে নাম।
তারপর ছাপার অক্ষর। কাকার বাড়িতে ( কবি মানস রায়চৌধুরী ( ১৯৩৫-১৯৯৬) , একদা যিনি কৃত্তিবাসের গোষ্ঠীর সঙ্গে ছিলেন যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ) ইতস্তত ছড়ানো থাকত নানা কবিতার পত্রপত্রিকা। তার মধ্যে ‘কৃত্তিবাস’ও থাকত। সেই ঐতিহাসিক, বড় সাইজের কৃত্তিবাস। নিউজপ্রিন্টে ছাপা। বুভুক্ষুর মতো ছাপার অক্ষরের খোঁজে পড়তাম, না বুঝলেও পড়তাম, বুঝতে পারতাম যে সামান্য কতিপয় শব্দ, মাথার ভিতরে গেঁথে যেত তারা , ঢুকে যেত ওই অন্ধ অবচেতনেই বোধ হয়। সে সব শব্দ বাংলাভাষায় না রচিত হলে, হয়ও আমারও কোনওদিন কবিতা লেখা হত না।
এর পর শুরু হল কবিতার বই পড়া, আমাদের নিজেদের। আমি আর দিদি। দিদি বড় বলে ওই শুরু করে। ল্যাজে ল্যাজে আমি। কবিতার বই আবিষ্কারও ছিল তার মধ্যে। বাড়িতেই , পুরনো বইয়ের তাক থীক, আমার স্বর্গত বাআব্র সং গ্রহের বইগুলি দিয়ে, পড়া শুরু হল।
তন্ন তন্ন করে পড়া হল গুপ্ত ধনের মতো। পারিবারিক রত্নকোষের মত, বাবার কেনা জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা, সিগনেট প্রেসের, হলুদের ওপর শ্যাওলা সবুজ ফার্নের ছবি ওয়ালা। তারপরেই যে আবিষ্কারটা ঘটল সেটা কৃত্তিবাসের সঙ্গে কিছুটা যুক্ত। দুটো বই। একটার নাম “প্রেমের কবিতা” । সুকুমার ঘোষ ও রাণা বসু সম্পাদিত । পাতায় পাতায় চারু খানের ছবি। বইটার আকৃতি সাড়ে চার বাই সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি। ওপরে বাহারি আর্ট পেপারের জ্যাকেট। খুদে, চমৎকার গেট আপের, উপহারযোগ্য এক বই। এই বইয়ে প্রেমের কবিতাগুলি খুব যে আধুইক ছিল তা বলা যায়না। কবিদের রেঞ্জ-এর শুরু রবীন্দ্রনাথে, শেষ অরবিন্দ গুহতে। ১৯৬২ তে প্রকাশিত এই বইয়ের ভিতরে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘প্রেম’ কবিতাটি পড়ে শিহরিত হই। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘প্রিয়তমাসু’ এবং ‘প্রধান আঁধারে’ পড়ে মুখস্ত করে ফেলি। একটা কালো ডায়েরিতে তখন প্রিয় কবিতাপংক্তি টুকে টুকে রাখতাম। সেখানে টুকে রাখি। ফাউন্টেন পেনের প্রুশিয়ান নীল বা রয়্যাল ব্লু কালিতে।
এই সব কবিতা পড়েই জীবনে প্রথম বুঝতে পারি প্রেমের কবিতা বস্তুটি কী। যেকোনো বাঙালি ছেলেমেয়ের মতই, প্রেমে পড়ার বহু আগেই, প্রেম কী তার এক অস্বচ্ছ ধারণা করে নিই এই কবিতাগুলি থেকে। অবশ্য মনে আছে সমর সেন-এর কবিতাটি জঘন্য লেগেছিল। ভীষণ তির্যক। ‘মেয়েটি বল্ল নতুন বন্ধুকে/ যা কিছু রটায় রটাক নিন্দুকে/ক্লান্ত মাথা রাখুন আমার উরুতে’ কবিতাটির অসামান্যতা বোঝার বয়স তখনো আমার হয়নি। বড্ড কড়া তখন এ আমার পক্ষে।
এই মিষ্টি বইটির সঙ্গে সঙ্গে আর একটি অপূর্ব বই পড়ি তখন। ওই বইয়ের যেখানে শেষ, এই বইয়ের সেখানে শুরু। প্রকাশ সাল কোথাও পাইনি। সম্পাদক শান্তি লাহিড়, দাম চার টাকা। ‘বাংলা কবিতা’ নাম, প্রকাশনার নাম ‘সাহিত্য’ । প্রোডাকশন দুর্দান্ত। জন্মসাল ধরে ধরে কবিদের সাজানো ছিল। কেবল পঞ্চাশের দশকের কবিরাই ছিলেন এই বইতে। জ্যাকেটে বলা হয়েছিল – “বাংলা কবিতার পঞ্চম দশক পুরধিকারের পুনরর্জনের পুনরুজ্জীবনের মাহেন্দ্র মুহূর্ত, প্রাচুর্যে প্রবলতায় সামর্থ্যে ও প্রত্যয়ে স্পন্দমান। আলোকের অভ্রশীর্ষ থকে অন্ধকারের পাতালগর্ভ পর্যন্ত তার দুই করতলের প্রসার, অহংকার ও আত্মহনন তার দুই গন্ডে আচিত্রিত। …যে সব কবিরা অনেকে মিলে সং হত কিংবা যাঁরা প্রত্যেকে আলাদা বিচ্যুত দ্বীপের মতো আত্মবলীন তাঁদের সবাইকে এই সংকলনে এই সর্বপ্রথম একত্রিত করা হল।“
এই বইটিতে ১৯২৮ এর জাতক অরবিন্দ গুহ থেকে শুরু করে ১৯৪০-এর জাতিকা কেতকী কুশারী অব্দি ছিলেন। এই অসামান্য সংকলনটি, আমার ১৯৭০ দশকে যাপিত সদ্য কৈশোরের কবিতার পাঠ অভিজ্ঞতার এক প্রধান, গুরুত্বপূর্ণ ও প্রগাঢ় ইনপুট। এই বইতেই প্রথম পড়ি ‘হঠাৎ নীরার জন্য’ , যা বাঙালি প্রেমিকদের বাইবেল। পড়ি শঙ্খ ঘোষের ‘এখন আরো অপরিচয় এখন আরো ভালো/ যা কিছু যায় দুপুরে যায় উড়ে’। পড়েছি তন্ময় দত্ত-র ‘শিল্পী’ : কাঁধেতে ফুলের ছাতা শিল্পী চলে একা পথ দিয়ে’, পড়েছি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘চতুরঙ্গে’ “ খুব বেশিদিন বাঁচব না আমি বাঁচতে চাই না”। এর থেকে বেশি কপি করার মত, অনুকরণের মধ্যে দিয়ে সর্বাত্মক পূজনের যোগ্য, আর কীই বা ছিল, একজন হাংলা বাংলা , ইস্কুলে ইতিহাসে আর অংকে মুহুর্মুহু ঢ্যাঁড়া খাওয়া ক্লাস সেভেন –এইটের মেয়ের পক্ষে?
এর পরের ইনপুট নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর “উলঙ্গ রাজা” বা শান্তনু দাশের ‘কাফের’-এর সঙ্গে কেনা, আমার দিদির বইমেলা থেকে সংগৃহীত তারাপদ রায়ের ‘নীল দিগন্তে এখন ম্যাজিক’। যাতে একটা কবিতা ছিল “ কৃত্তিবাস ১৮ বছর, কৃত্তিবাস রায় ৬ বছর”। ‘তুমি আমার উনিশশো আটান্ন, আমার থার্ড ক্লাস ডিগ্রি,/ আমার পাজামার উপরে ফুল প্যান্ট, আমার পাগলামি/ চৈত্রমাসের রাত-দুপুরে আমার ভরা যৌবন…’ এখানে পেয়েছিলাম আরো এক কৃত্তিবাসের ইশারা। কৃত্তিবাস রায়। যে আরো চার বছর বাদে, প্রেসিডেন্সিতে আমার সহপাঠী হবে।
আমাদের ছোটবেলার উনিশশো ষাট-সত্তর, কলেজ গমনের উনিশশো আশির দশক জুড়ে, রাজনৈতিক টালমাটাল, প্রযুক্তির অমোঘ নীরব গুঁড়ি মেরে প্রবেশ, এই সবের ফাঁক – ফোঁকর দিয়েই, ক্রমাগত চুইয়ে এসেছে কবিতার জগৎ। আর সেই জগতে কৃত্তিবাসী কবিরা, মূলত পঞ্চাশের কবিরাই , ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম বইমেলা যাওয়ার স্মৃতিগুলো , ক্লাস এইট নাইনের আমার সেই চোখদুটো যে সব ছবি মনক্যামেরায় ধরে নিয়েছিল, সেগুলো এখনো তাজা। সেই সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সমরেশ বসু শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে ভিড়ের মধ্যে থেকে কৌতূহলী আমি দেখেছি, ময়দানের মেলায় ঢোল বাজিয়ে নাচানাচি করতে, দেখেছি অটোগ্রাফ দিতে, দেখেছি স্টলের সামনে চেয়ার পেতে বসে আড্ডা দিতে। শুরুর দিকের বইমেলার মাঠের গন্দ আর নতুন বইয়ের গন্ধ, তারই সঙ্গে মিশে ছিলেন কবিতার হিরোরা, আইকনরা। তৃষ্ণার্ত স্পঞ্জের মত শুষে নিয়েছি তাঁদের লিখিত বাক্য বন্ধ, তাঁদের তৈরি ইমেজ, তাঁদের আত্মউন্মোচনের ভঙ্গি।
এর বহু বহু পরে, ১৯৯৩-৯৪ তে আমার লেখা ছাপাছাপির শুরু। ভাগ্যক্রমে, এর পরপরই কৃত্তিবাসের দ্বিতীয় পর্বের সূচনা এবং তার সাথে আমার নিজের স্পেশা, স্মরণীয় যোগাযোগটার সূত্রপাত। ১৯৯৮ বইমেলার ঠিক আগে একদিন জয় গোস্বামী আমার বাড়িতে ফোন করে জানালেন, পুরনো কৃত্তিবাসী শ্রী ভাস্কর দত্ত বিদেশ থেকে এসে কৃত্তিবাস পুরস্কার আবার চালু করার জন্য উদ্যোগী হয়েছেন। তাঁরই প্রদত্ত অর্থে এই পুরস্কার চালু হবার প্রথম বছরে, পুরস্কার পাচ্ছে বিভাস রায়চৌধুরী ও যশোধরা রায়চৌধুরী। আগের দিনই মিটিং-এ এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। খবরটা শুনে অনেক ক্ষণ কথা বলতে বপারিনি। মাথার মধ্যে হতভম্ব ভাবটা ছিল অনেকটা সময় জুড়ে। শোইশবে, কৈশোরে, যখনই কবিতা লেখার অপচেষ্টা করেছি, দিনের পর দিন কাঁচা, আবেগতাড়িত, দগদগে, নড়বড়ে কবিতায় ভরিয়ে তুলেছি গোপনে ডায়েরির পর ডায়েরি, তখন কবিতা ছাপা হবার স্বপ্নটাই কী অলীক ছিল। আর কৃত্তিবাসী কবিরাও ছিলেন কত দূরের তারকা। তারাপদ রায়ের হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছিলাম, পেছনে চেয়ারে বসে সুনীলদা অনুমোদনের হাসি হেসেছিলেন। এর আগে হয়ত এক আধবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, কিন্তু এই মঞ্চটি যেন একটি বৃহৎ পারিবারিক সম্মেলন ছিল। আর আমিও গুটিসুটি মেরে ওঁদের সকলের প্রিয় “মানসের ভাইঝি, দিলীপদার মেয়ে” হয়ে গেছি তখন, তারাপদদা খুবই নস্টালজিক ছিলেন পুরস্কার হাতে তুলে দিতে পেরে। অল্প কিছুদিন আগেই চলে গেছেন মানসকাকু, চিকিৎসা বিভ্রাটে, অকালে। পাশে বসা দিব্যেন্দু পালি ফিসফিস করে বলেছিলেন, ক্যাশ আছে, সাবধানে নিয়ো। শরৎ মুখোপাধ্যায়, বিজয়াদি অথবা সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত এর কিছু আগে পরে আপন করে নিয়েছেন, এক অদ্ভুত স্নেহ আর সহজ স্বীকৃতি ছিল তাঁদের।
ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর বিখ্যাত কবিদের প্রতিফলিত বিভা, ঠিক কোন জিনিশটা আমাকে টেনেছে কৃত্তিবাসের প্রতি? সে সবের আগেও আসলে টেনেছে কৃত্তিবাসের গভীর উত্তরাধিকার। নবপর্যায়ের কৃত্তিবাস কবিতা লেখবার এক মুক্ত ক্ষেত্র থেকে গেছে। সেই অনবদমিত, স্বীকারোক্তিমূলক ‘নতুন কবিতা’ লেখার কৃত্তিবাস এখনো ততটাই তরুণ যেমনটা পঞ্চাশ বছর আগে। সেটা পৃথিবীর ইতিহাসে খুব একটা কম সময় নয়। এতগুলো বছরের এপারে এসেও ‘কৃত্তিবাসের’ নামের সঙ্গে যে গভীর স্নব ভ্যালু জড়িয়ে আছে, সেই মূলধনকে ভাঙিয়ে ভাঙিয়েই আমরা , উনিশশো নব্বইয়ের কবিরা খেয়ে চলেছি।
( ২০০৪ এর কৃত্তিবাস সুবর্ণজয়ন্তী সমাপ্তি স্মারকগ্রন্থে সম্বলিত, সামান্য সম্পাদিত)

Leave a comment