রবীন্দ্রনাথ, পোশাকভাবনা ও নারীর চিত্রায়ণ

যশোধরা রায়চৌধুরী

দেহের সমাজতত্ত্ব

The body: a surface on which events are inscribed …Genealogy, as an analysis of where things come from is thus situated at the point of articulation of the body and history. Its task is to show a body totally imprinted with history, and history destroying the body.’ –Michel Foucaoult

পাশ্চাত্যে সোশিওলজি অফ দ্য বডি নামে যে বিষয়টির আমদানি ঘটেছে, তা কিন্তু মার্ক্স থেকেই গতি পায়, কেননা তিনিই প্রথম লক্ষ্য করেন, শরীরও কী ভাবে হয়ে উঠেছে প্রাতিষ্ঠানিক এক ক্ষেত্র, যার ওপরে নানা উৎপাদন প্রক্রিয়া মনোনিবেশ করেছে, তাকে বার বার বদলে দিতে চেয়েছে। (  the body is not only the indirect and unintended result of social relations but the target object of a systematic processing)। এরপর আসরে অবতীর্ণ হন ফুকো সাহেব, তিনি বললেন, ক্ষমতার ক্ষেত্র এই শরীরও, এবং ক্ষমতাই তাকে সাজায়, তাকে পেশ করে সমাজে, বলে দেয়, কীভাবে দেখা হবে একটি শরীরকে, কীভাবে তা আলাদা করে নেওয়া হবে অন্য শরীরের থেকে। এই সোশিওলজি অফ বডি বিষয়টি অতঃপর ঢুকে পড়ল বিদ্দ্বজ্জনদের গন্ডীতে, বইয়ের পর বই লেখা হল তা নিয়ে, আর , অতি সম্প্রতি, এই বিষয় জন্ম দিয়েছে আর এক নতুন বিষয়ের, যার নাম, সোশিওলজি অফ কনজিউমারিজম!

অথবা গ্ল্যামার শব্দটিই ধরা যাক। ধরা যাক না ক্যারল ডাইহাউজের “গ্ল্যামার : নারী, ইতিহাস, নারীবাদ” বইটির কথাই । এখানে গ্ল্যামারের সংজ্ঞা দিচ্ছেন ডাইহাউজ। যে গ্ল্যামার, ১৯০০ সালের আগে ব্যবহারই হত না, হলেই খুব ঝাপসা এক অর্থে। গ্ল্যামার প্রথম যুগে এক যাদুক্ষমতার মত, পরবর্তীতে ভাষার প্রতি পরতে গ্ল্যামার শব্দের ক্রমবিস্তারে তার অবস্থান বিলাস, ব্যসনে, প্রাচ্য-রেশমের সূক্ষ্ম-দুর্লভতার একজটিক ( exotic) -এ, নাটকীয় আড়ম্বর ঐশ্বররযে।  আরো পরে, ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত স্বপ্নকল্পনার উপাদান। হলিউড সিনেমার দাক্ষিণ্যে রোজকার থোড়বড়িখাড়া জীবন থেকে পালানোর উপাদান সেই গ্ল্যামার। যা প্রতিটি মার্কিন রমণীকে উজ্জীবিত করত, তার নিরেশ, নীরস দৈনন্দিন জীবনের নিরিখে আনন্দ দিত যে গ্ল্যামারের খোঁজ। জনপ্রিয় ফ্যাশন ও রুচির ক্ষেত্রে সিনেমার প্রত্যক্ষ প্রভাবের ব্যাপারটা মুভি থেকে টকির যুগ অব্দি স্পষ্ট হয়ে উঠল।  আর, সবচেয়ে বড় যে তফাত ঘটে গেল, তা হল, উচ্চবিত্তের আঙিনা থেকে সফিস্টিকেশন, রূপচর্চা আর পোশাকসচেতনতা নেমে এল মধ্যবিত্তের অন্দরে। অর্থাৎ সাজগোজ-গ্ল্যামার-পোশাক চর্চার মধ্যবিত্তায়নই সিনেমার সবচেয়ে বড় অবদান পাশ্চাত্যে, বিশেষত মার্কিন সমাজে।

আমাদের এই ক্ষুদ্র কথাবন্ধপ্রচেষ্টা আসলে রবীন্দ্রনাথের রচনাগুলির নিরিখে বাঙালির ফ্যাশন সমীক্ষা। যার অন্তরঙ্গ ও ওতোপ্রোত অংশ হল  ভারতীয় মেয়েদের চিত্রায়ণ । 

ফ্রান্সের ফ্যাশন জগতের গুরু ঈভস স্যাঁ লোরঁ কিন্তু বিখ্যাত লস্ট টাইমস বা হারিয়ে যাওয়া সময় উপন্যাসের লেখক মার্সেল প্রুস্তের লেখার দ্বারা অনুপ্রাণিত। প্রুস্ত তাঁর লেখায় পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলে এনেছিলেন সমসাময়িক প্যারিসের সালোঁ কালচার বা বসবার ঘরের সংস্কৃতিকে। পুঁজিবাদী ও বুর্জোয়া সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ফ্যাশন কালচার। এবং সাহিত্য যা জীবনের সহিত বিচরণ করে, তা কিন্তু ছবি, গান, চলচ্চিত্র, এবং সমসাময়িক ফ্যাশন থেকে উপাদান সংগ্রহ করবেই। যে লেখক যত সময় সচেতন, যত বস্তুনিষ্ঠ, তাঁর লেখা চরিত্র চিত্রণের সময়ে পরিধেয়কে গুরুত্বই শুধু দেবে না, ফ্যাশন সম্পর্কিত যাবতীয় ভাবনাচিন্তা ও যুগের হাওয়াকে লিপিবদ্ধ করবে, যেভাবে সমসাময়িক রাজনীতি লিপিবদ্ধ হবে, অথবা সমাজবীক্ষণ! আরেক ফরাসি কবি তথা যুগন্ধর শার্ল ব্যোদলেয়ার উপার্জন করতেন ছবি ও ফ্যাশনের সমালোচনা লিখে। তাঁর “ইন প্রেইজ অফ কসমেটিক্স” নামে একটি লেখাই আছে, যেখানে তিনি বলেছিলেন, শরীর বিনা ফ্যাশন নেই। পরিধানের পরেই একমাত্র কোন পোশাককে বিচার করা সম্ভব। তার বাইরে তা মৃত চামড়ার মত প্রাণহীন, সৌন্দর্য হীন। 

অন্তত এভাবে দেখার একটা শুরুয়াত বলা যেতে পারে এ লেখাকে। কিছু কিছু পর্যবেক্ষণও বলা যেতে পারে। প্রবন্ধ বা নিবন্ধের গুরুত্ব আমি একে দিতে নারাজ, পন্ডিতেরা সেসব কাজ করবেন।  রবীন্দ্রবীক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ এই দেখা। নারীকে দেখার চোখটি তাঁর সূক্ষ্ম এবং অন্তর্ভেদী, একইসঙ্গে অব্জেক্টিভ এবং তত্ত্বগতভাবে নির্যাসিত। কোথাও কোন ভাসা ভাসা ছায়া ছায়া আদল নেই। প্রতি নারীচরিত্র স্পষ্ট ও সু-নির্মিত। 

আমার বীক্ষণের প্রিয় বিষয় তো নানা মাধ্যমে নারীর  বদলে যাওয়া চেহারাছবি, এই নিয়েই যদি কথা বলতে বসি, আর কথাটাকে আটকে রাখি রবীন্দ্র বিশ্লেষণের ভেতরে? সেখান থেকেই কি নির্মিত হয়ে ওঠেনা, বাঙালি ও ভারতীয় নারীর এক ছবিও?

আমাদের সব হওয়া, সব বদলই কোথাও একটা গিয়ে একসুতোয় গাঁথা হয়ে উঠছে ক্রমাগত। নারীবাদ, পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে সমঝোতা ঃ এ একটা দেখার দিক। বিষয় হিসেবেই  কিন্তু নারীকে দেখতে অভ্যস্ত আমরা।  জনপ্রিয় সাহিত্য শিল্পের কাছে সেটাই প্রশ্নচিহ্নহীন ধরে নেওয়া। উপভোক্তা নারী পুরুষ যে-ই হোন, তাঁকে আমোদ দেবে, বিনোদন দেবে নারীর এই বিষয়-মূর্তিই। এটাই পুরুষ শাসিত সমাজের সহজ ছক।  নারী পুরুষের মিউজ, তার প্রেরণা, তার আকাংক্ষার বিষয় , সম্ভোগের বস্তু, হাসিল করার পণ্য ।

ফ্যাশন ব্যাপারটাকেও আমরা দেখতে পারি মেল গেজ-ফিমেল গেজ-এর দ্বৈততার নিরিখে। যে নতুন নিরীক্ষা তুলে ধরেছিলেন সিনেমা চর্চার ক্ষেত্রে লরা মালভে, তাঁর ‘ভিজুয়াল অ্যান্ড আদার প্লেজারস ‘ প্রবন্ধে, ১৯৭৩ সালে।  যা থেকে উঠে এসেছিল নতুন এক তত্ত্ব ।  লাকাঁ ও ফ্রয়েডের ধারা থেকেই জন্ম নিয়েছিল জনপ্রিয় ছায়াছবির নারীবাদী বিশ্লেষণের নতুন ধারণাটি, ‘ মেল গেজ ‘ বা ব পুং দৃষ্টির তত্ব । সে তত্ত্বও বলছে একই কথা । মূলস্রোত ছায়াছবি , হলিউডের বিখ্যাত ছবিগুলিই ধরা যাক, নারীকে দেখায় বিষয় হিসেবে। দুভাবে বিষয় করা হয় নারীকে। হয় ভয়ারিস্টিক বিষয়। সে পুরুষচোখে নারী লালসাময় বেশ্যা । নতুবা ফেতিশিস্টিক বিষয় । সে পুরুষচোখে , পুরুষচাহনিতে নারী দেবী, ম্যাডোনা, মা।

জ্ঞানদানন্দিনী ও শাড়ি পরার ধরণ পাল্টানো ঠাকুরবাড়ি 

জ্ঞানদানন্দিনী রবীন্দ্রসহোদর সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী। এই নারী বিবাহকালে কলকাতায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে নিজেকে তিনি আবিষ্কার করলেন কঠোর পর্দার মাঝে। ১৮৬২ সালে সত্যেন্দ্রনাথ যখন তার প্রবেশনারি ট্রেনিং এর জন্য ইংল্যান্ডে যান তখন জ্ঞানদানন্দিনীকেও সাথে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু পিতা দেবেন্দ্রনাথ সেটি মানলেন না। পরে জ্ঞানদানন্দিনীর সেজোদেবর হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার লেখাপড়ার দায়িত্ব নিলেন। তিনি বিখ্যাত ব্রাহ্ম শিক্ষাবিদ আয়াধ্যনাথ পাকড়ারাশি কাছেও শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৮৬৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন প্রথম ভারতীয় সিভিল সার্ভিস সদস্য হিসেবে ইংল্যান্ড থেকে ফিরলেন তখন জ্ঞানদানন্দিনী তার স্বামীর সাথে বোম্বেতে গিয়ে বসবাস শুরু করলেন।

বোম্বেতে গিয়ে জ্ঞানদানন্দিনী ইউরোপীয়দের সামাজিক বলয়ের মধ্যে পড়ে গেলেন এবং ইংরেজি আদব-কায়দা রপ্ত করতে লাগলেন। সামাজিক অবস্থানের এই পরিবর্তনের কারণে তার জন্য সঠিক ভাবে কাপড় পড়ার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ বাঙ্গালি কায়দায় শাড়ি পরার তখনকার প্রচলিত রীতি যা ছিল তা অনেকটাই আড়ম্বরপূর্ণ ছিল। স্বামীর সাথে গুজরাটে এক সফরে গিয়ে পারসি নারীরা যে শৌখিন কায়দায় শাড়ি পরেন,সেভাবে নিজের মত করে শাড়ি পরার কায়দা শুরু করলেন ।  এক্ষেত্রে তিনি নিজস্ব একটি স্টাইল চালু করলেন। তিনিই  প্রথম বাম দিকে আঁচল / পাল্লু দিয়ে শাড়ি পড়ার ধরনটি চালু করেন। সেটা ছিল পারসি স্টাইলের বিপরীত। ডান হাত দিয়ে যেন নির্বিঘ্নে কাজ করা যায় সেই চিন্তা থেকেই বাম কাঁধে আঁচল ফেলার বিষয়টি তিনি শুরু করেন। তিনি এমনকি ‘বামাবোধিনি প্রত্রিকা’ নামে একটি ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপনও করেছেন তার মত করে শাড়ি পরার প্রশিক্ষণ দিতে। কলকাতায় তার অনুগত প্রথম দিককার ছাত্রীদের মধ্যে একজন বিহারী লাল গুপ্তা আইসিএস এর স্ত্রী সৌদামিনী গুপ্তা। কলকাতার ব্রাহ্ম নারীদের মধ্যে তা দ্রুত জনপ্রিয়তা পেতে থাকলো “ব্রাহ্মিকা শাড়ি” নামে। পরে এটি পরার ধরনে পরিবর্তিত হয়ে “বোম্বাই দস্তুর” এবং শেষে নাম হয় ঠাকুরবাডির শাড়ি। ১৮৬৬ সালে ভাইসরয় লর্ড লরেন্সের দেয়া ভোজসভায় স্বামীর সাথে যোগ দিয়ে কলকাতায় জ্ঞানদানন্দিনী উচ্চবর্ণের পরিবারের রীতিনীতি ভাঙলেন।বাঙালি সমাজে আরো  দুটি জিনিসের প্রবর্তন করেন তিনি। একটি, সান্ধ্যভ্রমণ ও অন্যটি পরিবারে জন্মদিন পালন।

পাথুরিয়াঘাটার প্রসন্নকুমার ঠাকুরের সঙ্গে এই বিষয়ে দ্বিমত ও ঠাকুরবাড়ির ভেতরে একটা আপাত বিপ্লব, এই ঘটনার জন্য জ্ঞানদানন্দিনীকে আমরা মনে রাখব। বাঙালি মেয়ের শাড়ি পরার রীতিনীতি পাল্টে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের এই বৌদিদি। যাঁর আশ্রয়ে বালক ও কিশোর রবীন্দ্রনাথের মন ও মনন পর্যাপ্তপরিমাণে পুষ্ট হয়েছিল। সুতরাঙ লেখক রবীন্দ্রনাথ যে মেয়েদের পোশাক পরার রীতিনীতি সম্পর্কে সম্যক অবহিত হবেন এতে সন্দেহ নেই।  চিত্রা দেব লিখেছিলেন, তাঁর ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল বইতে ঃ

‘বাইরে বেরোবার জন্য জ্ঞানদানন্দিনী বাঙালি মেয়েদের দিলেন একটি রুচিশোভন সাজ। অবশ্য দেশি ধাঁচে শাড়ি পরা যে খারাপ তা নয়, তবে তাতে সৌষ্ঠব ছিল না। বোম্বাইয়ে গিয়ে তিনি প্রথমেই জবরজং ওরিয়েন্টাল ড্রেস বর্জন করে পাড়শি মেয়েদের শাড়ি পরার মিষ্টি ছিমছাম ধরনটি গ্রহণ করেন। নিজের পছন্দমতো একটু অদল-বদল করে জ্ঞানদানন্দিনী এই পদ্ধতিকেই রাখলেন।

… বোম্বাই থেকে আনা বলে ঠাকুরবাড়িতে এই শাড়ি পরার ঢঙের নাম ছিল ‘বোম্বাই দপ্তর’। কিন্তু বাংলাদেশে তার নাম হলো ‘ঠাকুরবাড়ির শাড়ি’। জ্ঞানদানন্দিনী বোম্বাই থেকে ফিরে এ ধরনের শাড়ি পরা শেখানোর জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। অনেক সম্ভ্রান্ত ব্রাক্ষ্মিকা এসেছিলেন শাড়ি পরা শিখতে; সবার আগে এসেছিলেন বিহারী গুপ্তের স্ত্রী সৌদামিনী। অবশ্য তখনও তার বিয়ে হয়নি। শাড়ির সঙ্গে জ্ঞানদানন্দিনী শায়া-সেমিজ-ব্লাউজ-জ্যাকেট পরারও প্রচলন করেন।

…‘বোম্বাই দপ্তর’র যেসব অসুবিধে ছিল সেগুলো দূর করবার চেষ্টা করেন কুচবিহারের মহারানী কেশব-কন্যা সুনীতি দেবী। তিনি শাড়ির ঝোলানো অংশটি কুঁচিয়ে ব্রোচ দিয়ে আটকাবার ব্যবস্থা করেন। তার সঙ্গে তিনি মাথায় পরতেন স্প্যানিশ ম্যানটিলা জাতীয় একটি ছোট্ট ত্রিকোণ চাদর। তার বোন ময়ূরভঞ্জের মহারানী সুচারু দেবী দিল্লীর দরবারে প্রায় আধুনিক শাড়ি পরার ঢংটি নিয়ে আসেন। এটিই নাকি তার শ্বশুরবাড়ির শাড়ি পরার সাবেক ঢং। বাস্তবিকই উত্তর ভারতের মেয়েরা, হিন্দুস্থানী মেয়েরা এখনও যেভাবে সামনে আঁচল এনে সুন্দর করে শাড়ি পরে, তাতে ওই ধরনটিকেই বেশি প্রাচীন মনে হয়। বাঙালি মেয়েরা অধিক স্বাচ্ছন্দ্যগুণে এটিকেই গ্রহণ করলেন, তবে জ্ঞানদানন্দিনীর আঁচল বদলাবার কথাটি তারা ভোলেননি, তাই এখন আঁচল বাঁ দিকেই রইলো। কিছুদিন মেমেদের হবল্ স্কার্টের অনুকরণে হবল্‌ করে শাড়ি পরাও শুরু হয়; তবে অত আঁটসাঁট ভাব সকলের ভালো লাগেনি। শাড়ির সঙ্গে সঙ্গে উঠল নানান ফ্যাশনের লেস দেয়া জ্যাকেট ব্লাউজ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘বিলিতি দরজির দোকান থেকে যত ছাঁটাকাঁটা নানা রঙের রেশমের ফালি’র সঙ্গে নেটের টুকরো আর খেলো লেস মিলিয়ে মেয়েদের জামা বানানো হতো।’[ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব, পৃষ্ঠা নং ১৯-২০]।

আবার মল্লারিকা সিংহ রায় বলেছেন, 

‘পোশাকের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা পড়াশোনা করেন, তাঁরা বলেন যে ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কোম্পানির সাহেব কর্মচারীরা ‘শাড়ি’ নামের পোশাকটি ভারতীয় নারীদের বৈশিষ্ট্য বোঝাতে নির্বিচারে ব্যবহার করতে শুরু করেন অষ্টাদশ শতক থেকে। কোম্পানি আমলের ছবিতেও ক্রমশ সাধারণ পরিধেয় আর বিশেষ উপলক্ষের পোশাকের ব্যবধান ঘুচে যেতে থাকে। অনেক সময়ে জাতি, শ্রেণি, ধর্ম ইত্যাদির বৈশিষ্ট্য বোঝাতে পুরুষ-নারীর জুটির ছবি আঁকা হত নৃতাত্ত্বিক নমুনা হিসেবে। এই ছবিগুলি প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে ভারতীয়দের পোশাক দিয়ে কেমন করে চিনে নিতে হবে, তার নথি তৈরি করা শুরু হল। ভারতের মানুষ যেন একটিমাত্র কালখণ্ডের মধ্যে তার পোশাকের দ্বারা চিহ্নিত হয়ে গেল, যার আর লয়-ক্ষয় নেই। এরই মধ্যে নারীদেহের আব্রু রক্ষার ব্যাপারে খ্রিস্টান পাদরিরাও নিজেদের প্রভাব খাটাতে শুরু করলেন। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ভিক্টোরীয় মানসিকতার প্রবেশ শুরু হল।…বিশ শতকের শুরুতে স্বদেশি আন্দোলনে, এবং তার অব্যবহিত পরে মোহনদাস গান্ধীর রাজনৈতিক বয়ানে পোশাক হয়ে উঠল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অন্যতম ক্ষেত্র। যে নারীরা আন্দোলনে যোগ দিয়ে পথে বেরিয়ে এলেন, তাঁরাও ক্রমেই এক বিশেষ ভঙ্গিতে কাঁধে আঁচল দিয়ে শাড়ি পরে তাকে করে তুললেন জাতীয়তাবাদীর পোশাক। এই ভাবে শাড়ি পরা প্রথম শুরু করেছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, ১৮৭০-এর দশকে, পার্সি ধরনে শাড়ি পরায় সামান্য কিছু অদল-বদল করে।’

রবীন্দ্রসাহিত্যের পোশাকবিপ্লব

প্রাচীনা মেয়েদের ছবি আঁকতে দেশজ,  ঘরোয়া ভংগিতে শাড়ি পরার মেইনস্ট্রিম  ছবিই প্রথমত ফুটেছে রবি কলমে। 

ধলেশ্বরীনদীতীরে পিসিদের গ্রাম।/ তাঁর দেওরের মেয়ে,

অভাগার সাথে তার বিবাহের ছিল ঠিকঠাক।/ লগ্ন শুভ, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেল–/

সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে।

/মেয়েটা তো রক্ষে পেল/ আমি তথৈবচ/ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসাযাওয়া–/ পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর। ( বাঁশি কবিতা, পুনশ্চ)

অথবা, 

রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,

/ ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন।/  আগে ওকে বারবার দেখেছি/

 লালরঙের শাড়িতে/

দালিম ফুলের মতো রাঙা;/

আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,/ আঁচল তুলেছে মাথায়;;

 দোলনচাঁপার মতো চিকনগৌর মুখখানি ঘিরে।/  মনে হল, কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব/

ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে,/ যে দূরত্ব সর্ষেখেতের শেষ সীমানায়/ শালবনের নীলাঞ্জনে।/থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা / চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে( হঠাৎ দেখা, শ্যামলী)

রবীন্দ্রনাথ নিজে পোশাক পরিচ্ছদ সম্পর্কে স্পষ্ট ও ক্ষুরধার মতামত রেখেছেন। তা পুরুষ হোক বা নারীর।  সমাজ নামের প্রবন্ধাবলীতে তিনি কোট ও চাপকান প্রবন্ধে  কাজের পোশাক হিসেবে বাঙালি পুরুষদের ইংরেজি পোশাককে গ্রহণ করা সম্পর্কে খুব তির্যক ও ব্যঙ্গাত্মক ভংগিতে লেখেন, 

“ইংরেজি কাপড়ের একটা মস্ত অসুবিধা এই যে, তাহার ফ্যাশনের উৎস ইংলণ্ডে। সেখানে কী কারণবশত কিরূপ পরিবর্তন চলিতেছে আমরা তাহা জানি না, তাহার সহিত আমাদের কোনো প্রত্যক্ষ সংস্রবমাত্র নাই। আমাদিগকে চেষ্টা করিয়া খবর লইতে এবং সাবধানে অনুকরণ করিতে হয়। যাঁহারা নূতন বিলাত হইতে আসেন তাঁহারা সাবেক দলের কলার এবং প্যান্টলুনের ছাঁট দেখিয়া মনে মনে হাস্য করেন, এবং সাবেকদলেরা নব্যদলের সাজসজ্জার নব্যতা দেখিয়া তাঁহাদিগকে “ফ্যাশানেব্‌ল” বলিয়া হাস্য করিতে ত্রুটি করেন না।

একে বিলাতি সাজ স্বভাবতই বাঙালিদেহে অসংগত, তাহার উপরে যদি তাহাতে ভদ্রোচিত পারিপাট্য না থাকে, তবে তাহাতে হাসিও আসে অবজ্ঞাও আনে। এ কথা সহজেই মুখে আসে যে, যদি পরিতে না জান এবং শক্তি না থাকে, তবে পরের কাপড়ে সাজিয়া বেড়াইবার দরকার কী ছিল।’

এই প্রবন্ধে তিনি চাপকান ও কোট পরিহিত বাঙালি পুরুষের পাশে শাড়ি পরিহিতা স্ত্রীদের বেমানান বলে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ,  পুরুষটির পাশ্চাত্য পোশাক ধারণ আর নারীর সাবেক পোশাকে থেকে যাওয়াকে তাঁর কাছে এক ধরণের গুরুচন্ডালী দোষে দোষাবহ বলেই মনে হয়েছিল।

তাই কি, তিনি অতি সযত্নে শেষের কবিতার অমিত রে চরিত্রটিকে নির্মাণ করেন? নিজের প্রোটাগনিস্ট হিসেবে?

“অমিতর নেশাই হল স্টাইলে। কেবল সাহিত্য-বাছাই কাজে নয়, বেশে ভূষায় ব্যবহারে। ওর চেহারাতেই একটা বিশেষ ছাঁদ আছে। পাঁচজনের মধ্যে ও যে-কোনো একজন মাত্র নয়, ও হল একেবারে পঞ্চম। অন্যকে বাদ দিয়ে চোখে পড়ে। দাড়িগোঁফ-কামানো চাঁচা মাজা চিকন শ্যামবর্ণ পরিপুষ্ট মুখ, স্ফূর্তিভরা ভাবটা, চোখ চঞ্চল, হাসি চঞ্চল, নড়াচড়া চলাফেরা চঞ্চল, কথার জবাব দিতে একটুও দেরি হয় না; মনটা এমন এক রকমের চকমকি যে, ঠুন করে একটু ঠুকলেই স্ফুলিঙ্গ ছিটকে পড়ে। দেশী কাপড় প্রায়ই পরে, কেননা ওর দলের লোক সেটা পরে না। ধুতি সাদা থানের যত্নে কোঁচানো, কেননা ওর বয়সে এরকম ধুতি চলতি নয়। পাঞ্জাবি পরে, তার বাঁ কাঁধ থেকে বোতাম ডান দিকের কোমর অবধি, আস্তিনের সামনের দিকটা কনুই পর্যন্ত দু-ভাগ করা; কোমরে ধুতিটাকে ঘিরে একটা জরি-দেওয়া চওড়া খয়েরি রঙের ফিতে, তারই বাঁ দিকে ঝুলছে বৃন্দাবনী ছিটের এক ছোটো থলি, তার মধ্যে ওর ট্যাঁকঘড়ি; পায়ে সাদা চামড়ার উপর লাল চামড়ার কাজ-করা কটকি জুতো। বাইরে যখন যায় একটা পাট-করা পাড়ওয়ালা মাদ্রাজি চাদর বাঁ কাঁধ থেকে হাঁটু অবধি ঝুলতে থাকে; বন্ধুমহলে যখন নিমন্ত্রণ থাকে মাথায় চড়ায় এক মুসলমানি লক্ষ্মৌ টুপি, সাদার উপর সাদা কাজ-করা। একে ঠিক সাজ বলব না, এ হচ্ছে ওর এক রকমের উচ্চ হাসি। ওর বিলিতি সাজের মর্ম আমি বুঝি নে, যারা বোঝে তারা বলে– কিছু আলুথালু গোছের বটে, কিন্তু ইংরেজিতে যাকে বলে ডিস্‌টিঙ্গুইশ্‌ড্‌। নিজেকে অপরূপ করবার শখ ওর নেই, কিন্তু ফ্যাশানকে বিদ্রূপ করবার কৌতুক ওর অপর্যাপ্ত। কোনোমতে বয়স মিলিয়ে যারা কুষ্ঠির প্রমাণে যুবক তাদের দর্শন মেলে পথে ঘাটে; অমিতর দুর্লভ যুবকত্ব নির্জলা যৌবনের জোরেই, একেবারে বেহিসেবি, উড়নচণ্ডী, বান ডেকে ছুটে চলেছে বাইরের দিকে, সমস্ত নিয়ে চলেছে ভাসিয়ে, হাতে কিছুই রাখে না।“

রবি ঠাকুরের “শেষের কবিতা” বোধ হয় উপন্যাসে বাংলার ইঙ্গবঙ্গ সমাজের সাজপোশাকের ডিটেলিং-এর এক দিকদর্শন। এভাবে সূক্ষ্ম বর্ণনার ভেতর দিয়ে তুলে আনায় প্রমাণ পায়, সাজ ব্যাপারটা মেয়েদের একচেটিয়া ব্যাপার নয়, এর “ইউনিসেক্স” চরিত্রটা বেশ ফুটে ওঠে। তবে, অমিত চিরকালই একটি ব্যতিক্রম। তবে এর পরই মেয়েদের ফ্যাশনদুরস্ততার বর্ণনা এসে পড়বে, যা আমাদের এই লেখার পক্ষে এক অতি উপাদেয় উপাদান…

“এ দিকে ওর দুই বোন, যাদের ডাকনাম সিসি এবং লিসি, যেন নতুন বাজারে অত্যন্ত হালের আমদানি– ফ্যাশানের পসরায় আপাদমস্তক যত্নে মোড়ক-করা পয়লা নম্বরের প্যাকেট-বিশেষ। উঁচু খুরওয়ালা জুতো, লেসওয়ালা বুক-কাটা জ্যাকেটের ফাঁকে প্রবালে অ্যাম্বারে মেশানো মালা, শাড়িটা গায়ে তির্যগ্‌ভঙ্গিতে আঁট করে ল্যাপ্‌টানো। এরা খুট খুট করে দ্রুত লয়ে চলে; উচ্চৈঃস্বরে বলে; স্তরে স্তরে তোলে সূক্ষ্মাগ্র হাসি; মুখ ঈষৎ বেঁকিয়ে স্মিতহাস্যে উঁচু কটাক্ষে চায়, জানে কাকে বলে ভাবগর্ভ চাউনি; গোলাপি রেশমের পাখা ক্ষণে ক্ষণে গালের কাছে ফুর ফুর করে সঞ্চালন করে, এবং পুরুষবন্ধুর চৌকির হাতার উপরে বসে সেই পাখার আঘাতে তাদের কৃত্রিম স্পর্ধার প্রতি কৃত্রিম তর্জন প্রকাশ করে থাকে।“

এর পরই পাঠক হিসেবে আমাদের তৃষিত অপেক্ষা হবে লাবণ্যের আবির্ভাবের জন্য। সেটা এইরকম…

“একটি মেয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। সদ্য-মৃত্যু-আশঙ্কার কালো পটখানা তার পিছনে, তারই উপরে সে যেন ফুটে উঠল একটি বিদ্যুৎরেখায় আঁকা সুস্পষ্ট ছবি– চারি দিকের সমস্ত হতে স্বতন্ত্র। মন্দরপর্বতের নাড়া-খাওয়া ফেনিয়ে-ওঠা সমুদ্র থেকে এইমাত্র উঠে এলেন লক্ষ্মী, সমস্ত আন্দোলনের উপরে– মহাসাগরের বুক তখনো ফুলে ফুলে কেঁপে উঠছে। দুর্লভ অবসরে অমিত তাকে দেখলে। ড্রয়িংরুমে এ মেয়ে অন্য পাঁচজনের মাঝখানে পরিপূর্ণ আত্মস্বরূপে দেখা দিত না। পৃথিবীতে হয়তো দেখবার যোগ্য লোক পাওয়া যায়, তাকে দেখবার যোগ্য জায়গাটি পাওয়া যায় না। …মেয়েটির পরনে সরু-পাড়-দেওয়া সাদা আলোয়ানের শাড়ি, সেই আলোয়ানেরই জ্যাকেট, পায়ে সাদা চামড়ার দিশি ছাঁদের জুতো। তনু দীর্ঘ দেহটি, বর্ণ চিকন শ্যাম, টানা চোখ ঘন পক্ষ্মচ্ছায়ায় নিবিড় স্নিগ্ধ, প্রশস্ত ললাট অবারিত করে পিছু হটিয়ে চুল আঁট করে বাঁধা, চিবুক ঘিরে সুকুমার মুখের ডৌলটি একটি অনতিপক্ক ফলের মতো রমণীয়। জ্যাকেটের হাত কব্‌জি পর্যন্ত, দু-হাতে দুটি সরু প্লেন বালা। ব্রোচের-বন্ধনহীন কাঁধের কাপড় মাথায় উঠেছে, কটকি কাজ-করা রুপোর কাঁটা দিয়ে খোঁপার সঙ্গে বদ্ধ।“

এই যে সাজ, যা বিংশ শতকের প্রথমার্ধ পররযন্ত উচ্চবিত্ত ইংরিজি শিক্ষিত মেয়েদের, তিররযকভাবে যাকে বলা চলে ব্রাহ্ম সাজ, সেই ফ্যাশনদুরস্ততার  পরিশীলিত বয়ান, যতটাই ইংরেজ শাসনের সঙ্গে সিংক্রনিক, ততটাই বসবার ঘর, বাইরের ঘর, বৈঠকখানার কালচারে চোবানো। একেই বোধ হয় বলে স্যালঁ (salon) কালচার!

যে মেয়েরা হিন্দু অন্তঃপুরে, সেই একই সময়ে , তাঁদের সাজও হয়ত বা উঠে এসেছে শরৎসাহিত্যে অথবা তরুণতর উপন্যাসসাহিত্যের বিবরণে। কিন্তু এত স্পষ্ট ও সচেতনভাবে এসেছে কি? তবে একথা বলাই যায় যে বঙ্গ বধূদের ঘরোয়া সাজের ভেতরে সেলাই করা ব্লাউজ ( সে যুগের ভাষায় যা জ্যাকেট) সেভাবে কিন্তু ছিল না বললেই চলে। শেমিজ হয়ত বা এসে উঠেছে ।  ফ্রিল দেওয়া হাতার যে কদর্য ক্যারিকেচারটি আমাদের আজকের সময়ে বাঙালি অন্তঃপুরিকামাত্রের অঙ্গে যে কোন নাটক বা সিরিয়ালে দেখি, অন্তত ততটা অনান্দনিক ছিল না সেই খালি গায়ে জড়ানো দিশিমতে পরা শাড়ি বা থানের বিশুদ্ধতা।

হিন্দু অন্তঃপুরের ভেতরে রাবীন্দ্রিক বিবরণের ঐ জ্যাকেট – সিল্ক শাড়ির সাজ যে কতটা বেমানান ও আরোপিত ছিল, স্বয়ং রবি ঠাকুরই তা স্পষ্ট করেননি?  ‘ঘরে বাইরে’তে, যখন এই ফ্যাশন গায়ের জোরে আমদানি হয় নিখিলেশের দ্বারা, বিমলের ওপরে? যে হালফ্যাশয়ানের প্রতি অগাধ সন্দেহ নিখিলেশের প্রাচীনপন্থী বিধবা বউদির। …বিমলের কন্ঠস্বরে তা অনেকটা এইরকম…”এখনকার কালের বিবিয়ানার নির্লজ্জতা! আমার স্বামী আমাকে হাল-ফেশানের সাজে-সজ্জায় সাজিয়েছেন– সেই সমস্ত রঙবেরঙের জ্যাকেট-শাড়ি-শেমিজ-পেটিকোটের আয়োজন দেখে তাঁরা জ্বলতে থাকতেন। রূপ নেই, রূপের ঠাট! দেহটাকে যে একেবারে দোকান করে সাজিয়ে তুললে গো…” সেই বিমলকেই যখন সন্দীপবাবুর সামনে যাবার জন্য সাজতে দেখা যায় তখন তা এইরকমঃ সেদিন সকালে মাথা ঘষে আমার সুদীর্ঘ এলোচুল একটি লাল রেশমের ফিতে দিয়ে নিপুণ করে জড়িয়েছিলুম। দুপুরবেলায় খাবার নিমন্ত্রণ, তাই ভিজে চুল তখন খোঁপা করে বাঁধবার সময় ছিল ন। গায়ে ছিল জরির পাড়ের একটি সাদা মাদ্রাজী শাড়ি, আর জরির একটুখানি পাড়-দেওয়া হাত-কাটা জ্যাকেট।    আমি ঠিক করেছিলুম এ খুব সংযত সাজ, এর চেয়ে সাদাসিধা আর-কিছু হতে পারে না। এমন সময় আমার মেজো জা এসে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। তার পরে ঠোঁটদুটো খুব টিপে একটু হাসলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, দিদি, তুমি হাসলে যে? তিনি বললেন, তোর সাজ দেখছি।“

পঞ্চাশ ষাটের দশকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বহু লেখায় মেয়েদের সাজপোষাকের বর্ননা পাই। রবি ঠাকুরের মত পুংক্ষাণূপুংক্ষ না হলেও, তাতে স্পষ্ট লেখা থাকে একটা দ্বৈততার কথা, সিসি লিসি বনাম লাবণ্যে যে লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে। একদিকে আছে অতি চর্চিত, মহার্ঘ, অতি সচেতন সাজগোজের উগ্রতা ( পড়ুন = চরিত্রের উগ্রতা), যা নায়িকা নয়, প্রতিনায়িকা অথবা সরাসরি ভ্যাম্পের রোলে ঠেলে দেয় নারীচরিত্রগুলোকে, অন্য দিকে অসচেতন, ঢলোঢলো কাঁচা সৌন্দর্য, যা আত্মার বিশুদ্ধতাকে দেহসৌষ্ঠব ফুঁড়ে নায়কের চোখের সামনে হাজির করছে। নায়িকারা সর্বদাই কিছুটা সাজগোজে অন্যমনস্ক হবেন, এ যেন তারপর থেকে দাঁড়িয়ে গেল বাংলা আইডিওলজির সঙ্গে সমান্তরালে, সাহিত্য শিল্পেও।

দেখা যাক, সুনীলের প্রতিদ্বন্দ্বী-তে কীভাবে এসেছে এই সংজ্ঞায়ন।

“মেয়েদুটির নাম মালবিকা আর কেয়া। মালবিকা তার পায়ের জুতো, শাড়ির রং, আংটির পাথর, হাতব্যাগ, টিপ সব মিলিয়ে পরেছে। চুল বাঁধার ধরন দেখলেই বোঝা যায়, সে এক-একদিন এক-এক রকমভাবে চুল বাঁধে। নিজের রূপ সম্পর্কে মেয়েটি সজাগ। মুখে সেই হালকা অহংকারের ছায়া পড়েছে। কেয়া মেয়েটি খানিকটা এলোমেলো স্বভাবের, পোশাকের পারিপাট্য নেই, কিন্তু মুখখানি তার ভারী সুন্দর – বড় বড় চোখদুটিতে সরল সৌন্দর্য। “

এই বর্ণনা থেকে লেখকের বা তার নির্মিত নায়কের পক্ষপাত স্পষ্ট, বাংলায় এই পক্ষপাত কিন্তু চলবে, একেবারে কালবেলা-র মাধবীলতা পর্যন্ত।  বলা ভাল সমরেশ মজুমদারে এসে বাঙালি মেয়ের এই ইমেজ কালমিনেশনে পৌঁছবে। “মাধবীলতাকে সে চেনে না… শুধু এটুকুই মনে হয়েছে মেয়েটি নরম এবং বোকা নয়। …মাধবীলতার নিজস্ব চিন্তাভাবনা আছে, এবং সেটাকে গুছিয়ে স্পষ্ট ভাষায় বলার ক্ষমতা রাখে। এরক সতেজ ডাঁটো আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে কোনও মেয়েকে অনিমেষ দেখেনি। কলকাতায় এসে নীলার সঙ্গে আলাপ হয়েছি। নীলা অবশ্যই খুব ডেসপারেট মেয়ে, কোনও রকম ভিজে ব্যাপার ওর নেই। কিন্তু নীলা কখনওই আকর্ষণ করে না, বুকের মধ্যে এমন করে কাঁপন আনে না। যে কোনও পুরুষবন্ধুর মতো নীলার সঙ্গে সময় কাটানো যায় …নীলার মানসিকতা বদ্ধ, মাধবীলতার মতো এমন দ্যুতি ছড়ায় না। “

রাবীন্দ্রিক লাবণ্যর থেকে আলাদা হয়েও আসলে কোথাও এক থেকে গেছে মাধবীলতা। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নারীচরিত্র, বহু কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ের মত আমারও কমবয়সের ফ্যান্টাসির উপাদান সে। সবচেয়ে বড় কথা , সে মেয়ে মেয়ে, সে নারী, অথচ নারীর যে অবয়বটি আরোপিত সেই তথাকথিত “ফ্যাশন”-সর্বস্ব নয়, আবার নীলার মত “পুরুষালি”-ও হলে তাকে চলবে না।

এখানেও বহাল রয়েছে পুরুষের দৃষ্টিকোণ, অবশ্যই। নির্মাণ যে করছেন একজনে পুরুষই!

রবীন্দ্রউত্তরাধিকারী ঋতুপর্ণ ঘোষ

এর বহু পরে, ২০০০ সালের আশেপাশে আমরা পেয়েছি ঋতুপর্ণ ঘোষ নামের এক বিজ্ঞাপন নির্মাতা ও চিত্র পরিচালককে, বাংলা ও বাঙালির উত্তর গোলোকায়ন নন্দন তত্ত্বের ক্ষেত্রে যাঁর ভাবনাগুলি অপ্রতিরোধ্য। ঋতুপর্ণের বিশেষ প্রবণতা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এবং অন্য প্রবণতা, পোশাক পরিচ্ছদের ডিজাইনিং, নানা ধরণের ফেব্রিকের বাছাই বিষয়ে বিশেষ অনুধ্যান ও আগ্রহ। নিজের পোশাক সচেতনতার “অ্যান্ড্রোজেনাস” চরিত্র সম্পর্কে তিনি ছিলেন মুক্তকন্ঠ যেমন, তেমনই এই রাবীন্দ্রিক পোশাকসচেতনতার একটি দিক তাঁর লেখা থেকে , আলোচনা থেকে বার বার উঠে এসেছে। 

একদা একটি টিভি চ্যানেলে ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ নামে একটি টক্ শো সম্প্রচারিত হত। সেই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ব‍্যক্তিরা অতিথি হয়ে সেখানে আসতেন। অপর্ণা সেন, সুধীর চক্রবর্তী, জয় গোস্বামী, কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য, চন্দ্রিল ভট্টাচার্য ও আরো অনেকের মতো একটি এপিসোডে অতিথি হয়ে এলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।

এই ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসাহিত‍্য-নির্ভর-ছবি সম্পর্কে ঋতুপর্ণ ঘোষের অবজারভেশানগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো সাজালে মোটামুটি এরকম দাঁড়ায়— ক. চলচ্চিত্রকারদের কাছে রবীন্দ্রনাথ আখ‍্যানে আটকে আছেন। তাঁর মতে, রবীন্দ্রনাথের গল্প-আশ্রিত ছবি যেগুলো আমরা দেখি সেগুলির মধ্যে কোনোটাই তাঁর খুব রাবীন্দ্রিক লাগে না। ‘চারুলতা’ ছবিটা তাঁর খুব প্রিয় কিন্তু ছবিটাকে তিনি রাবীন্দ্রিক বলে মনে করেন না। ‘নষ্টনীড়’ আর ‘চারুলতা’ আলাদা ভাবে তাঁর খুব ভালো লাগে কিন্তু ‘চারুলতা’কে রবীন্দ্রগল্পের চিত্রায়ণ হিসেবে ততটা ভালো লাগে না। ‘তিনকন‍্যা’ দেখে তাঁর মনে হয় ‘পোস্টমাস্টার’ খুব সহজেই বিভূতিভূষণের ছোটোগল্প হতে পারে, ‘মনিহারা’ ত্রৈলোক‍্যনাথের একটা গল্প আর ‘সমাপ্তি’ প্রভাতকুমারের। নিজের বানানো ‘নৌকাডুবি’ যে-কোনো সময় শরৎচন্দ্রের গল্প হতে পারে! খ. তিনি রবীন্দ্রনাথকে সিনেমায় খুঁজে পান কুরোসাওয়ারর ‘র‍্যান’ দেখে। অন্ধ তোসুরুমারু একাকী হেঁটে যাচ্ছে ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্গের ল‍্যান্ডস্কেপের উপরে দিয়ে, ঠিক খাদের ধারে এসে তার হাত থেকে পড়ে যায় একটি থানকা। আমরা, দর্শকরা, দেখি থানকায় আমিদা বুদ্ধের ছবি আঁকা যেটি তার দিদি সু তাকে দিয়ে অপেক্ষায় থাকতে বলেছিল। দর্শক একটু আগেই জেনে গেছে তার দিদি সু আর ফিরবে না। ক‍্যামেরা দূর থেকে দেখতে থাকে, ছবি শেষ হয়। এই দৃশ্যকল্পনাটাই তাঁর মনে হয় রাবীন্দ্রিক। গ. পিটার ব্রুকের ‘মহাভারত’-এ যখন গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যাচ্ছে প্রথম সাক্ষাতের জন্য তখন ‘ধীরে বন্ধু ধীরে ধীরে’ গানের ব‍্যবহারটাই তাঁর কাছে রাবীন্দ্রিক মনে হয়। এই গান হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ‘ফাল্গুনি’ নাটকে অন্ধ বাউলের গান। এই বাউল জন্মান্ধ ছিল না। সে যখন অন্ধ হলো তখন ‘অন্ধকারের বুকের মধ্যে আলো’ দেখতে পেতো, অন্ধকারকে তার আর ভয় লাগতো না। সে গান গাইতে গাইতে যায় আর বলে ‘আমার গান আমাকে ছাড়িয়ে যায়— সে এগিয়ে চলে, আমি পিছনে চলি’। ঘ. তিনি মনে করেন তাঁদের মতো যাঁরা রিয়েলিস্টিক সিনেমা বানান তাঁদের পক্ষে রবীন্দ্রনাথের সাবলাইমটা টাচ্ করা মুশকিল।

ঋতুপর্ণ ঘোষ রবীন্দ্র জন্ম সার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তৈরি করেন এক ডকুড্রামা। সেই চলচ্চিত্রটির গোটাটা জুড়ে, এবং তাঁর রবীন্দ্র আখ্যান নির্ভর চোখের বালি জুড়েও, তিনি রবীন্দ্র যুগের পোশাক পরিচ্ছদের যে চিত্রায়ণ করেছিলেন তা ছিল অনবদ্যভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ ডিটেলে সাজানো। খদ্দরের, রেশমের, হাতে বোনা / তাঁতের কাপড়ের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে অতি মাত্রায় সচেতন ঋতুপর্ণ আমাদের দেখিয়েছিলেন, রাবীন্দ্রিক সাবলাইম শুধু তত্ত্বের বিষয় নয়। তার নন্দনতত্ত্বের মধ্যে পোশাক কোন হেলাফেলার বিষয় নয়। বরং গভীর জানা, শোনা, অনুধ্যানের বিষয়। 

তথ্যসূত্র :

ইন্দ্রনীল মণ্ডল, আমার রবীন্দ্রনাথ: ‘ঘরে বাইরে’ প্রসঙ্গে ঋতুপর্ণ ঘোষ, গুরুচন্ডালী

উইকিপিডিয়া

মল্লারিকা সিং হ রায়, দেহের সীমানা ঠিক করবে কে, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১১ এপ্রিল ২০২২, 

চিত্রা দেব, ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল

পাপড়ি রহমান,  রাইজিং বি ডি পত্রিকা

Madison Mainwaring, Fashion Regained, Paris Review